![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক
রিকশাটা হাসপাতালের গেট দিয়ে না ঢুকে সরাসরি কলেজ গেট দিয়ে ঢুকল। গেট থেকে রাস্তাটা সোজাসুজি সামনে চলে গেছে, দু'পাশেই মেহগনি গাছ। রাস্তার বাম পাশে পরমানু গবেষণা কেন্দ্রের পিছনে বড় বড় কচুগাছ গুলো আজ ও আছে। কয়েকটাতে হলুদ ফুল এসেছে। হাতের বাম পাশের পোস্ট মর্টেম বিল্ডিংটা এখন চালু আছে। কালা দিলিপ সেখানে বসে সিগারেট টানছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সিগারেট টানায় মনযোগ দিল। হয়ত একটু পর স্যার আসলে পোস্ট মর্টেম শুরু করবে। একটু সামনেই নতুন আড়াইশ বেড নামে সবাই যে হাসপাতালটা চিনে অর্থাৎ গাইনি আর সার্জারি ইউনিট, সে বিল্ডিংটাতে শেওলা জমে গেছে। বিল্ডিং এর নিচে ফুলগাছগুলো আজ ও আছে। আগের চেয়ে অনেকটা বড় হয়েছে, ছোট ছোট সাদা ফুল ফুটে আছে সেগুলোতে। হাতের ডান পাশে যে খালি মাঠ ছিল সেখানে বিশাল এক অডিটোরিয়াম হয়েছে।
এই খালি মাঠে কত যে বসে থাকতাম আর একাডেমিক ভবনের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম কবে এখানে ক্লাস করতে পারব।আমার সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল, আর পুরন হল না। দীর্ঘ ছয় বছর পর আজকে নিজের ক্যাম্পাসে ঢুকলাম।একাডেমিক ভবনের সামনে এসে রিকশা থামল। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লাম। নেমেই লম্বা একটা নিশ্বাস নিলাম। বামে তাকিয়ে দেখলাম সেই দুতলার লেডিস হোস্টেলটা আগের মতই আছে। এখন সেখানে কারা থাকে জানি না।আমাদের ব্যাচের যারা প্রেম করত তারা সন্ধ্যায় এসে এখানে আড্ডা দিত।লেকচার খাতা নেওয়ার জন্য এখানে কত দাড়িয়ে থেকেছি।আর আমার ভালবন্ধু এবং কাছের মানুষটাকে দেখতে আসতাম।একাডেমিক ভবনের ডান পাশে বয়েজ হোস্টেল। বারন্দায় কয়েকটা লুঙি দেখা যাচ্ছে। তার পিছনেই ইন্টার্ন হোস্টেল। সেটাতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে একাডেমিক ভবনে ঢুকে পড়লাম। প্রথমেই এনাটমি ডিপার্টমেন্ট। ডিসেকশান রুমের সামনে ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে হেটে আমি সামনে লেকচারার'স রুমে চলে গেলাম।যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দেখলাম সেই ক্যাডাভারটা আজ ও আছে, টেবিলের উপড় শোয়ানো। আজকে সব কিছুই আছে, শুধু আমার পরিচিত মানুষ গুলো নেই। নেই সেই ১১২টি পরিচিত মুখ।জীবন সংগ্রামে সবাই ব্যস্ত কেউবা ব্যস্ত স্বামী সংসার নিয়ে। আর আমি আজকে এনাটমি লেকচারার হিসেবে জয়েন দিতে এসেছি নিজের মেডিকেল কলেজে। এত গুলো অপরিচিত মুখের মাঝে একটা মুখই পরিচিত পেলাম,আর সে হচ্ছেন আমাদের দীনেশ দাদা। দাদা এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল।
-আপনি তাহলে আজকে জয়েন দিবেন
-জ্বি দাদা
- ভালই হইছে, পুলাপাইনরে কিছু শিখাইতে পারবেন।
-দোয়া করবেন দাদা।
দাদা আমাকে নিয়ে লেকচারার'স রুমে ঢুকলেন।
-দাদা, এখন ও নাস্তা করি নাই, নাস্তা নিয়ে আসেন। একসাথে খাব।
আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দিলাম।
- দাদা। আসার সময় দেখলাম ক্যাম্পাসে অনেক গাড়ি,অনেক লোক।
-আজকে থেকে ফাস্ট ইয়ারের ভর্তি শুরু।
-আচ্ছা।
দাদা নাস্তা আনতে চলে গেলেন। আমার মেডিকেলে ভর্তির স্মৃতি গুলো একটু একটু উঁকি দেওয়া শুরু করল। এখন ও মনে আছে, জাহিদ ভাই ফোন দিয়ে সকাল আটটায় আসতে বলেছিল। আগের দিন এসে এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিলাম। রাতে ঠিকমত ঘুম হচ্ছিল না। কখন ভর্তি হব, কখন সেই লালিত স্বপ্নের এপ্রোন গায়ে দিব। সকাল সাড়ে সাতটায় চলে আসলাম কলেজে।দোতলায় টিচার্স লাউঞ্জে যেয়ে বসতে বলল আমাদেরকে। অনেকে ইতোমধ্যে চলে এসেছে। চারদিকে অপরিচিত মুখ। আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। সবার মুখে অজানা একটা আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কত দেশ জয় করে এখানে এসেছে মাথায় রাজমুকুট পড়ার জন্য।
-এই যে আপনার নাস্তা, আমি প্লেট এনে দিতেছি,ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি দেব?
-দিলে ভালই হয় দাদা।আপনি সহ বসেন, একসাথে খাই।
-শুনেন, স্যার বলছে নাস্তা শেষ করে টিচারস লাউঞ্জে যাইতে।সেখানে ভর্তি চলছে। সেমিনারের জন্য সার্জারির স্যারদের আসতে দেরি হবে।পুলাপাইন এর মেডিকেল চেকআপ করতে হবে আপনাকে।
এনাটমির বিভাগীয় প্রধান স্যার জানতেন আমি সদ্য সার্জারিতে এফসিপিএস পাশ করে এসেছি। হয়ত এ জন্য আমাকে পাঠাচ্ছেন।
দুই
নাস্তা শেষ করে দুতলায় চলে আসলাম। অনেক ভীড়। অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট এর স্যাররা বসে আছেন। এক দুই জন ছাড়া বাকি সব স্যারই আমার পরিচিত। অনেকটা অস্বস্তি লাগছিল স্যারদের সাথে বসতে কিন্তু তাও বসে পড়লাম। মেডিকেল চেকআপ একটু পর শুরু হবে।
আমার মেডিকেল চেকআপের সময় কি ভয়ে না ছিলাম। আমি চুপ করে বসে ছিলাম।
হঠাৎ একজন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল
-হ্যালো, আমি আকাশ।
আমি হাত বাড়িয়ে তার সাথে পরিচিত হলাম। মেডিকেল জীবনে আকাশই আমার প্রথম বন্ধু। আমার দু'জন আগের সিরিয়াল তার। বেশ মায়াবী চেহার। মাথার মাঝখানে সিঁথি কাটা ছিল। কোর্ট টাই পড়ে এসেছিল।
-এই আকাশ, ব্যাগ থেকে বের করে নাস্তাটা খেয়ে নে বাবা।
-তুমি থাকো তোমার নাস্তা নিয়ে। আগে ভর্তি হই, তারপর খাব।
মাঝ বয়সী একজন মহিলা এসে আকশের পাশের খালি চেয়ারটায় বসতে বসতে কথাটা বল।
আকাশ তখন তার মায়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল।আমরা দু'জন একসাথে মেডিকেল চেকআপে গেলাম। মোটামুটি ততক্ষণে অনেক ভাল একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের।সব টেস্ট শেষ। আকাশের শুধু পস্রাব টেস্ট বাকি ছিল। অনেক কষ্ট করে এক ফোটা পস্রাব ও আনতে পারল না সে।
আন্টি খেপে আগুন।
-তোমাকে বলেছিলাম, বেশি করে নাস্তা করতে আর পানি খাইতে। শুনোনি আমার কথা। এখন সব ছেলেদের পিছনে পড়ে যাবে।
আমার আজ ও মনে আছে আন্টি জোড় করে দেড় লিটার পানি আকাশকে খাওয়াইছিলেন তখন।
-আম্মু, তুমি এত পানি খাওয়াইলা। আমি তো মরেই যাব।
-না বাবা, পানি শরীরের জন্য ভাল। আর পানির অপর নাম জীবন।
-স্যার, আমাদের মেডিকেল টেস্ট কখন শুরু হবে?
এক ছাত্রের ডাকে ধ্যান ভাঙল আমার।
-এইতো এখনই, বস তোমরা।
ভর্তির কাজ শেষ করে আর এনাটমি ডিপার্টমেন্ট এ গেলাম না। সরাসরি ডক্টরস ডরমেটরিতে চলে গেলাম। দীনেশ দাদা আমার জন্য একটা রুম গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। জানালার পাশেই খাট দেওয়া। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। এক খন্ড কালো মেঘ সূর্যটাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কয়েকটা সাদা বক উড়ে বেড়াছে মেঘের খন্ডটার সামনে।
আকাশের মায়ের সাথে আমার মাসে পাঁচ থেকে ছয়বার কথা হয়। কিন্তু আজ প্রায় দুমাস হয়ে গেল কথা হয় না। আমার ও নানা ব্যস্ততার কারনে মনে থাকে না কিংবা যখন মনে পড়ে তখন রাত অনেক হয়ে যায়,ঘুমের অসুবিধা হবে দেখে আর ফোন দিতাম না। আমার জন্য প্রায় কুরিয়ারে করে খাবার দিতেন। প্রথম দিকে অনেক নিষেধ করতাম। কিন্তু বলতেন, "আকাশ যেমন আমার ছেলে তুমি ও তেমন আমার ছেলে। " আমি নিষেধ করলে হয়ত উনি কষ্ট পাবেন তাই আর নিষেধ করতাম না। বছরে অন্তত দুই তিনবার আকাশের বাসায় যেতাম। প্রতি ঈদে আকাশ যেরকম পাঞ্জাবি পছন্দ করত সেরকম পাঞ্জাবি কিনে পার্সেল করে দিতেন।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে আন্টিকে কল দিলাম।
সব সময় উনি নিজেই রিসিভ করতেন। কিন্তু আজকে অন্য একজন ধরল।
-আসসালামু আলাইকুম আন্টি
-ভাইয়া আমি আরিফ।
-কেমন আছ আরিফ?
-ভাল না ভাইয়া
-কেন? কি হয়েছে? আন্টি কোথায়?
- ভাইয়া, আম্মু আজকে ১২ দিন হাসপাতালে ভর্তি। হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়েছিল। সারাদিন একা বসে বসে চিন্তা করত। খাওয়া ধাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। আপনি আসেন না একটু ভাইয়া। আপনাকে দেখলে আম্মু আর ও ভাল হয়ে উঠবে।
-এখন কি অবস্থা?
-একটু ভাল আছে।কথা বলতে পারে।
আগামীকাল শুক্রবার,তাই আর চিন্তা না করেই বলে দিলাম আমি কাল আসব।
কথা বলেই ফোনটা রেখে দিলাম। আরিফ হচ্ছে আকাশের ছোট ভাই।এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।ভর্তির সময় এসেছিল।কয়েকটা চকলেট, চিপস আর জুস কিনে দিয়েছিলাম।
তিন
ইবনে সিনা হাসপাতালে আন্টি ভর্তি আছেন। আরিফের কাছে ফোন দিয়ে রুম নাম্বার জেনে নিলাম। আমি রুমে ঢুকতেই আন্টি আমার দিকে তাকালেন। অভিমানে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। উনি বসাই ছিলেন।আমি ও উনার পাশে গিয়ে বসলাম।
-আন্টি, আপনি রাগ করছেন জানি, কিন্তু আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারবেন না, এটাও জানি
-তুমি চলে যাও, এসেছ কেন?
-আন্টি আমি নতুন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
-সত্যিকার এর মা হলে ঠিকই খবর নিতে।
আমি আর কথা বলতে পারলাম না। আন্টি কথা বলেই চলছেন।হঠাৎ উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন।
-আজকে আমার আকাশ থাকলে এত দেরি করে আসত না। তুমি আছ বলেই আমি আকাশের কষ্টটা একটু ভুলে থাকতে পারি। গত দুই মাস হল আমাকে ফোন দাও নি। এখান দিয়ে যখন কোন জুনিয়র ডাক্তার হেটে যায়, আমার মনে হয় আমার আকাশ যাচ্ছে। আমার আকাশ হলে কি পারত দুমাস আমার সাথে কথা না বলে থাকতে।
আমি কোন কথার উত্তর দিতে পারছি না। গলাটা আস্তে আস্তে ভারি হয়ে আসছে। জানালার পর্দাগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আর তার মধ্যে আমি স্পষ্ট আকাশের স্মৃতি গুলো দেখতে পাচ্ছি।
ভর্তি শেষে আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। যাওয়ার সময় আন্টি আমার ফোন নাম্বার নিয়ে যায়। আকাশকে তখন ও ফোন কিনে দেয়নি। বাড়িতে যাওয়ার পর প্রায় আমাদের কথা হত। আমি এ তিনমাস বন্ধে কি করব, সকাল থেকে বিকেলে কি করি এসব কিছু শুনত।আমি ও ওর কথা শুনতাম।
একদিন সন্ধ্যায় আকাশ ফোন দিল। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদের সামনে দাড়িয়ে গল্প করছিলাম।রিসিভ করার সাথে সাথে বলা শুরু করল
-দোস্ত,আমি কাল গ্রামে যাচ্ছি। অনেক মজা করব, পুকুরে সাঁতার শিখব। আর ও কত প্লান যে তার, আমি শুধু শুনেই গেলাম।
-দোস্ত,যাই কর সাবধানে কর।
-আরে, তুই চিন্তা করিস না। মজার কথা কি জানিস আম্মু আমাকে বার বার নিষেধ করেছে যেন পুকুরে না নামি। এই বয়সে কেউ এই কথা মানে, তুই বল।
-তারপর ও তুই সাবধান থাকিস।
-তুই ও দেখি আম্মুর মত। আমাকে নিয়ে টেনশান করিস না। ব্যাগ গোছাব, এখন রাখি। আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
মাঝে তিন দিনের মত কথা হয়নি।আমি জানি সে গ্রামে আছে এজন্য হয়ত কথা বলার সময় পাচ্ছে না।
বিকালে এক বড় ভাই ফোন দিয়ে কংকাল কিনার কথা জানাল। আমি আর আকাশ এক সাথে কিনব। সেজন্য আন্টিকে ফোন দিলাম।ফোনটা রিসিভ করে আজকে যেভাবে কান্না করছে ঠিক সেভাবে কান্না শুরু করলেন। তিনি কিছুই বলতে পারলে না। আরেকজনকে দিয়ে দিলেন। তিনি যেটা বললেন আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না সেটা শুনার জন্য। গত দুইদিন আগে আকাশ দাদার বাড়িতে গিয়েছিল। সাঁতার শিখার জন্য পুকুরে একাই নেমেছিল কিন্তু পুকুর অনেক গভীর ছিল বলে আর উঠতে পারেনি, নিচে তলিয়ে গিয়েছিল।প্রায় ঘন্টাখানেক পর পুকুরের অন্য পাড় দিয়ে আকাশের নিথর নিস্তব্ধ দেহ ভেসে উঠেছিল।
যে পানি আমাদের জীবন বাঁচায়,সে পানি আজকে আকাশকে ও বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের মাঝে;শুধু স্মৃতি হিসেবে।
©somewhere in net ltd.