নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দের জন্য লেখা

MMohin

মহিউদ্দিন

MMohin › বিস্তারিত পোস্টঃ

অসমাপ্ত ডায়েরি

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:১৭


মাত্র ডিউটি শেষ করে রুমে ফিরেছি।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম তিনটা বেজে গেছে । কাঁধের ব্যাগটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন ঘুমে চলে এল বুজতে ও পারলাম না। হঠাৎ মোবাইলের রিংটনে ঘুম ভাঙল। মোবাইলটা বিরক্তিকর ভাবে চোখের সামনে আনতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। সিভিল সার্জন স্যার ফোন দিয়েছেন। কথা শেষ করলাম। ফেনী সদর হাসপাতালের জুনিয়র মেডিকেল অফিসার আমি। সব কাজ জুনিয়রদের উপরে চাপানো সবার একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। এখন একটা ইমার্জেন্সি পোস্টমর্টেম করতে হবে। কি আর করা, ফ্রেশ হয়ে মর্গের দিকে গেলাম।

মর্গের সামনে এসে দেখি দু'জন পুলিশ দাড়িয়ে আছে বাহিরে। আমি এগিয়ে যেতে আমাকে সালাম দিল। ডোম কালো দিলীপ ভিতরেই আছে। আমি ঢুকতেই পুলিশের চালানের কাগজ আমার হাতে বাড়িয়ে দিল দিলীপ। ২৭ বছরের একটা মেয়ে। নামটা খুব পরিচিত মনে হল, বিবাহিত। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে কিন্তু মেয়ের বাবা দাবি করেছে সে আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। বুঝতে আর বাকি রইল না কিছুই। খুব সূক্ষভাবে করতে হবে পোস্টমর্টেম। আমি দিলীপকে বললাম মৃতদেহের উপর থেকে সাদা কাপড় সরাতে। মুখের উপরের কাপড় সরাতেই মূহর্তের মধ্যে আমার হাত পা অবশ হয়ে পড়ল।নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। হ্রদপিন্ড মনে হয় তার কাজ বন্ধ করে দিবে। সারা শরীরে শীতল একটা ঘামের স্রোত বয়ে গেল।আমি পুরো একটা স্ট্যাচুর মত দাড়িয়ে রইলাম। যে রমনী প্রথম দেখায় আমার বুকে ছুরি চালিয়েছিল, তার নীরব নিথর দেহ আজ আমার সামনে পড়ে আছে। আমার নির্দেশে একটু পরে তার বুকে ছুরি চালাবে দিলীপ।মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেক কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে সে। অথচ ক্যাম্পাসে কয়েকশত মুখের মধ্যে এই মুখটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম। দেখার সাথে সাথে বুকের ধুক ধুক শুরু হয়ে যেত। তার সেই হাসি মাখা মুখখানি নেই, কালো মেঘ জমে আছে। ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখে শাড়ি পড়ে মাথায় ফুল দিয়ে সেজেছিল। আমাকে পেয়ে দৌড়ে এসে বলল তার একটা ছবি তুলে দিতে। আমি ক্যামেরা নিয়ে তার মাথার ফুলটাকে ফোকাস করলাম।সূর্যের আলোতে চকচকে সোনালী চুলের মধ্যে শিউলী ফুল, মনে হচ্ছে রুপকথার কোন এক রাজকন্যা আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। ক্যামেরার বাটনে ক্লিক করতে যাব এমন সময় বাতাস এসে চুলকে এলোমেলো করে দিয়ে গেল। বাতাস যেন তার সৌন্দর্যকে আর ও বাড়িয়ে দিয়ে গেল। সে ছবিটা আজ ও আমার কাছে আছে। এখন তার চুলগুলো এলোমেলো আছে কিন্তু সেই সৌন্দর্য নেই।

- স্যার, শুরু করেন।
দিলীপের কথায় আমি সম্মিত ফিরে পেলাম। দুনিয়ার সব থেকে কঠিন কাজটা আজকে করব সেটা কল্পনা ও করিনি। কিন্তু দায়িত্বের কাছে আমি পরাজিত। ওর আত্মা যেন শান্তি পায় সে জন্য আমাকে ভালভাবে ওর মৃত্যুর কারন বের করতে হবে। চোখ ফেটে নদীর ফোয়ারা বইতে চেষ্টা করছে কিন্তু অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি।বুকের মধ্যে অনেক দিনের পুরনো স্মৃতি হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। এভাবে আমার জেরিনকে ৩ বছর পর দেখতে পাব সেটা আদৌ কল্পনা করিনি।

পুলিশের ফাইলে লেখা আছে ৫ ঘন্টা আগে বিষ খেয়েছে। আমি দিলীপকে রাইগর মর্টিস দেখতে বললাম। রাইগর মর্টিস দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি, জেরিন ১২ ঘন্টার আগে মরেছে অথচ রিপোর্টে আছে ৫ ঘন্টা। আমি তখন দিলীপকে বাকি আলামত গুলো দেখতে বললাম। গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত কাটা হল। ছোট্ট হ্রদপিন্ডটার দিকে তাকিয়ে শুধু মনে হত লাগল এই ছোট্ট জায়গায় আমার জন্য এত ভালবাসা ছিল। এই তো সেই ফুসফুস, যেটার গরম বাতাস আমার কাঁধে না লাগলে শান্তি পেতাম না। আর তাকাতে পারলাম না। মর্গের জানালার লোহার শিক ধরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাতাসের প্রতি অনু অক্সিজেন আমার কাছে বিষের মত মনে হচ্ছে। দিলীপের ডাকে আবার ফিরে গেলাম। পাকস্থালীতে বিষের কোন আলামত নেই। পেটের মধ্যে কয়েকটা রক্তের চাকা, জরায়ুটা ফেটে গেছে। আমার আর বুজতে বাকি নেই। প্রয়োজনীয় অঙ গুলো কৌটায় রেখে দিতে বললাম। দিলীপকে বললাম তার আর কাজ করতে হবে না। আমি সিলাই গুলো দিব। না জানি জানোয়ার স্বামী কত কষ্ট দিয়ে শ্বাসরোধ করে আমার জেরিনকে হত্যা করেছে। মরছে না দেখে পেটে লাত্থি মেরেছে।আর মরার পরে তার মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে বলেছে আত্মহত্যা করেছে।আমি আস্তে আস্তে কাটা জায়গা গুলো সেলাই করতে লাগলাম। হাতে গ্লোবস পড়িনি। জেরিনের প্রতি ফোটা রক্তে ওর অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করছি। খুব মনে পড়ে, প্রথম যেদিন ওর হাতে রক্তের গ্রুপিং এর জন্য ফুটা করি, সামান্য রক্ত দেখে বলেছিল " তুমি কি আমার সব রক্ত বের করে ফেলবে।"অথচ আজ ওর রক্তে আমার হাত রঞ্জিত। শেষ বারের মত ওর পাকস্থালী ভাল মত দেখে সেলাই করতে লাগলাম। আমি আস্তে আস্তে রোবট হয়ে যাচ্ছি, সব গুলো অনুভুতি হারিয়ে ফেলেছি। শেষবারের জন্য ওর হ্রদপিন্ডটা ধরে আমার প্রতি ভালবাসা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। সেলাই প্রায় শেষের দিকে, গলাটা বাকি আছে। আমি কত যত্ন করে বকুল ফুলের মালা গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলাম, আর এখন সেখানে আলতো করে সেলাই করে দিচ্ছি চিরদিনের জন্য, বাহির থেকে দেখে কেউ যেন বুজতে না পারে ওর পুরো শরীরটাই কাটা। কেন জানি ওর মায়াবী চোখটা দেখতে ইচ্ছা করল খুব। দুই হাত দিয়ে আলতো করে খুললাম। ঘোলা চোখ, আমাকে যেন কি বলতে চাচ্ছে। কি বলবে সেটা আমি বুঝে ফেলেছি। খুব গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, " জেরিন, তুমি আত্মহত্যা করনি, ওরা তোমাকে হত্যা করেছে। আমি সব আলামত পেয়েছি। আমি সব কাগজে লিখে রেখেছি। তোমার পক্ষ হয়ে আমি আদালতে সাক্ষী দেব।ক্যাম্পাসে কোন বিপদের মূর্হতে আমাকে যেমন পাশে চাইতে, আজ ও আমি তোমার পাশে আছি। তুমি শান্তিতে চিরনিদ্রায় থাক। হয়ত খুব শীঘ্রই দেখা হবে তোমার সাথে।" দিলীপ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমার তখন ও হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়নি। যেহেতু বাহিরে পুলিশ আছে, আমাকে সেভাবে থাকতে হবে। সব কাজ শেষ করে পুলিশকে বুঝিয়ে দিলাম সব। চালানের এক কপি আমার কাছে রেখে দিলাম। আমি জানতাম জেরিনের বাড়ি ফেনী সদরে কিন্তু বাসার ঠিকানা জানতাম না। পুলিশের চালান থেকে দেখে নিলাম। এখন আমার উদ্দেশ্য ওর বাসায় যাওয়া। কারন একমাত্র আমি জানি ওকে খুন করা হয়েছে। আর বাকিরা জানে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করা কোন লোককে ভালমত কবর দেওয়া হয় না, জানাজা দেওয়া হয় না । কিন্তু জেরিন নির্দোষ।ওর শেষ বিদায়টা যেন ভালমত করতে পারি সে জন্য আমাকে ওর পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে।

মিনিট দশেক যাওয়ার পর রিকশাওয়ালা বলল এসে গেছি। ভাড়া মিটিয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম। অনেক সুন্দর ডুপ্লেক্স একটা বাড়ি। ঠিক মাঝে মাঝে জেরিন যে বর্ণনা দিত হুবহু সে রকম। শুনশান নীরবতা। আমি আস্তে আস্তে ভিতরে গেলাম। হঠাৎ পিছনে থেকে ডাক শুনতে পেলাম,
- কে আপনি?
- জ্বি, আমি ডাক্তার রেজওয়ান।
এ কথা বলেই পিছনের দিকে ঘুরে দাড়ালাম।ষোল কি সতের বছরের একটি মেয়ে। বুঝলাম ও হচ্ছে জারিফা, জেরিনের ছোট বোন। জেরিন প্রায় জারিফার গল্প করত আমার সাথে।

মেয়েটি নির্ভাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।আমি তখন বললাম

- জারিফা, আমাকে খুলে বলবে সব কিছু? জেরিন কিভাবে মারা গিয়েছে?আমি তোমাকে কিভাবে চিনি সেটা পড়ে বলব।

জারিফা তখন আমাকে একটা রুমে নিয়ে বসাল। এটাই জেরিনের রুম। চারদিকে দেওয়ালে ওর ছবি টাঙানো। টেবিলে আমার দেওয়া প্রথম টেবিলঘড়িটা এখন ও টিকটিক করে চলছে।

- ভাইয়া, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।আপু প্রায় আপনার কথা বলত। আপুর স্বামীটা ভাল পড়েনি। প্রায় টর্চার করত। মাতাল থাকত। অনেক জ্বালা সহ্য করত আপু। ডাক্তারিটা পর্যন্ত করতে দেয়নি আপুকে। আজকে দুপুরে হঠাৎ খবর এল আপু সুইসাইড করেছে। আমি বিশ্বাস করি না ভাইয়া।হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল।

- জেরিন সুইসাইড করেনি।আমি নিজে তার পোস্টমর্টেম করে সরাসরি এখানে চলে এসেছি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের সব ফর্মালিটি শেষ করে কিছুক্ষনের মধ্যে এখানে ওকে নিয়ে আসবে। তোমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে চল আমাকে।

পাশের দুইটা রুম পরেই ওর বাবা-মায়ের রুম। সেখানে দু'জন বসে কান্না করছেন। আমি ওনাদের সব খুলে বললাম। বাহিরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আমি পুলিশের কাছে যাইনি। জেরিনের বাবা জেরিনকে পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিল। নিজের হাতে ওর কবর খুঁড়েছি। জানাজা শেষ করে কবর দিতে দিতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে গেল। এতক্ষণ অনেকটা রোবটের মত কাজ করেছি, নিজেকে কিছু বুজতে দেই নি। জেরিনকে কবরে রেখে যখন চলে আসতেছি তখন আর চোখের বৃষ্টি বাধ মানে নি। ইচ্ছা করছে ওর কবরের উপর শুয়ে থাকতে।

রুমে ফিরে দেখি রাত তখন দেড়টা বেজে গেছে।

চোখের পাতায় ঘুম নেই। সব স্মৃতি মনে পড়ছে। প্রথম দেখায় জেরিনকে ভাল লেগেছিল। আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল।অনেক সাহস করে ভালবাসার কথা বলেছিলাম। প্রায় দুই বছর আমাদের প্রেম ছিল।আমি তখন ইন্টার্ন শেষের দিকে, আর জেরিন ফাইনাল প্রফ দিয়ে ছুটিতে বাড়ি গেছে। ইন্টার্ন শেষ করেই বাসায় জানাব ভাবছিলাম। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় জেরিন ফোন দিয়ে কান্না শুরু করল। আগামীকাল তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে তার বাবা। ছেলে অনেক বড় ব্যবসায়ী। আমি যেন আজকে রাতের মধ্যে ওকে নিয়ে আসি। আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, অনেক কষ্ট করে এত দুর এসেছি।বাবা মায়ের কত পরিশ্রমের ফসল আজকে আমার এ অবস্থানে আসা। কিন্তু আমার একটা হঠাৎ সিদ্ধান্তে সবাই কষ্ট পাবে সেটা চাই নি।পরের দিন থেকে আর জেরিনকে কোন দিন ফোনে পাইনি। আর কোনদিন কথা বলতে পারিনি। সামান্য যোগাযোগ ও করেনি সে। আমার উপরে অভিমান ছিল তার সেটা বুজেছিলাম। অনেকের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার কিন্তু সে করেনি।

নাহ! আর কোন স্মৃতি মনে আসছে না। মাথাটা অসহ্য ব্যাথা করছে। একটু পরে ফজরের আজান দিবে।

জেরিন আমি আসছি তোমার কাছে।

ডা. রেজওয়ান চৌধুরী
সময়: ভোর ৪ টা বেজে ১০ মিনিট
১১ ডিসেম্বর, ২০১০

ডায়েরির পাতাটা বন্ধ করে ডাক্তার দাদু চোখের পানি মুছে আমাদের দিকে তাকালেন।

- এখন তোরা কি প্রশ্ন করবি আমি জানি।আমি এবার মুখে বলছি সব।

দাদুর কথা শুনে আমরা চুপ হয়ে বসে রইলাম।

- ডাক্তার রেজওয়ান ছিল আমার মেডিকেল জীবনের সব থেকে ভাল বন্ধু। আমার আর ওর একসাথে পোস্টিং ছিল ফেনীতে। জেরিন মরার পরদিন থেকে প্রতিদিন জেরিনের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকত।কয়েকদিন পরে এমন অবস্থা হল যে আমরা ওকে কবরের পাশ থেকে আনতে পারতাম না। ও বিভিন্ন রকম পাগলামি শুরু করত। জেরিনের মৃত্যুর প্রায় দিন আটেক পরে রাতে রেজওয়ানকে না পেয়ে চারপাশে খুজি, না পেয়ে খুব ভোরে জেরিনের কবরের কাছে যাই এবং সেখানে আমরা ওর মৃত দেহটা খুজে পাই।

রেজওয়ানের মৃত দেহের এক পাশে এ ডাইরিটা ছিল, যেটা তোদের এতক্ষণ পড়ে শুনালাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.