নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বর্তমান সময়ে 'হলুদ সাংবাদিকতা' কথাটার সাথে পরিচিতি নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এসব মানুষের মধ্যে যারা আবার একটু বিবেকের ধার ধারেন, তারা বরং এ বিষয়টা নিয়ে বেশ বিরক্ত-ই। এখন এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের তুলনায় হলুদ সাংবাদিকরাই যেন পরিমাণে বেশি। তো বর্তমান সময়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ানো এই হলুদ সাংবাদিকতার শুরুর এক কাহিনি আছে- এ কাহিনি উনবিংশ শতকের শেষাংশের ইতিহাস, দুটো প্রতিযোগী পত্রিকার ঠোকাঠুকির ইতিহাস।
১৮৮৯ সালে জোসেফ পুলিৎজারের (জ্বি, বর্তমানে এ ব্যক্তির নামেই 'পুলিৎজার পুরস্কার' প্রচলিত রয়েছে) অধিকৃত পত্রিকা ওয়ার্ল্ড ধারাবাহিকভাবে "Hogan's Alley" নামে একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাপাতে শুরু করে। এ ব্যঙ্গচিত্রের 'বিষয় ছিল শহরের জনাকীর্ণ অঞ্চলের বসতবাড়িগুলোর জীবনযাত্রা, আর এর মূল চরিত্র- আলখেল্লা পরিহিত একটি ফোকলা শিশু'। ১৮৯৩ সালে যখন সংবাদপত্র মুদ্রণে রঙের ব্যবহার শুরু হয়, তখন পরীক্ষামূলকভাবে ফোকলা শিশুটির আলখেল্লায় একটু হলুদ রঙের ছোপ লাগিয়ে দেয়া হলে সে Yellow Kid of Hogan's Alley বা 'হোগানের গলির হলুদ বাচ্চা' নামে ব্যাপক সাড়া ফেলে আর তার বদৌলতে ওয়ার্ল্ড পত্রিকার বিক্রি তুমুল হারে বেড়ে যায়।
এরপরে ১৮৯৫ সালে মার্কিন সংবাদপত্র জগতের অন্যতম প্রকাশক William Randolph Hearst নিউইয়র্কের আরেকটি সংবাদপত্র জর্নাল কিনে নিয়ে ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। তখন তিনি প্রতিযোগিতার প্রমাণস্বরূপ ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদকগোষ্ঠীর অনেককেই অধিক বেতনের বিনিময়ে নিজের পত্রিকায় নিযুক্ত করেন। এদের মধ্যে সেই Yellow Kid of Hogan's Alley-এর নির্মাতা Richard. F. Outcault-ও ছিলেন। তখন একই সাথে জর্নালে Outcault-এর আঁকা Yellow Kid ব্যঙ্গচিত্র ও ওয়ার্ল্ডে ভিন্ন এক চিত্রকরের আঁকা Yellow Kid ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হতে থাকে।
কিন্তু এ দুই পত্রিকার মধ্যকার প্রতিযোগিতা ক্রমশই ফোকলা শিশু থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য সংবাদের ক্ষেত্রেও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। কে কত বেশি অতিরঞ্জিত সংবাদ উপস্থাপন করে পাঠক আকৃষ্ট করতে পারে- এই যেন হয়ে ওঠে এদের মূল লক্ষ্য। এদের এমন বিকৃত প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণ করে সমসাময়িক প্রেস কাগজের সম্পাদক Ervin Wardman বিরক্ত হয়ে এ দুটি কাগজকেই 'Yellow Press' নামে নিন্দিত করেন। তাঁর নামকরণের প্রথম অংশটির উদ্ভব-ইতিহাস সেই হলুদ শিশুর ব্যঙ্গচিত্র কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাকে চিহ্নিত করলেও পরবর্তীতে এটি 'দায়িত্বজ্ঞানহীন সস্তা চটুল উত্তেজক খবর প্রচারের সমর্থক' হয়ে দাঁড়ায়।
আর সে থেকেই এ দ্বিতীয় অর্থ প্রকাশ করেই 'হলুদ সাংবাদিকতা' শব্দগুচ্ছ পৃথিবীব্যপী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এর উদ্ভবস্থল নিউইয়র্ক-ই হোক আর এটি সারা বিশ্বভ্রমরণ-ই করুক, হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তৃত ব্যবহার আমাদের সোনার বাংলাদেশর মতো করে আর কোথাও হয়েছে কিনা সন্দিহান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত 'খবরে'র খবর পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগ-ই হলুদ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য বেশ ভালোভাবেই পূর্ণ করে। চটকদার, বিচ্ছিন্ন শিরোনাম; ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠ ঘটনার- যার সঙ্গে পাঠকসাধারণের কোনো সম্পর্ক নেই-বীভৎস অনাবৃতকরণ; জনসাধারণের রুচিকে সুচিন্তিতভাবে অধঃপতিত করার উদ্দেশে অশ্লীল ভাষা ও অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার ব্যবহার হরহামেশাই দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ে।
কয়েক বছর আগেও এই হলুদ সাংবাদিকতার বিচরণ অনলাইন ভূঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমগুলোতেই বেশি লক্ষ্য করা যেত। এ কারণে অনেক জনসাধারণ-ই অনলাইনে পাওয়া কোনো সংবাদ সহজে বিশ্বাস করতেন না; বরং নিশ্চয়তার জন্য দেশের কতিপয় দৈনিক সংবাদপত্র ও বিশ্বাসযোগ্য কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের উপরে নির্ভর করতেন। তবে বর্তমানে এ হলুদ সাংবাদিকতা এতটাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে কোন সংবাদটা যে হলুদ না, তা-ই বরং যাচাই করে নিতে হয়। সংবাদটা হলুদ না হলেও পাঠককে বিভ্রান্ত করে আকৃষ্ট করার জন্য শিরোনামটা অন্তত হলুদ হয়েই থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আর এর প্রধানতম কারণ হতে পারে বর্তমান সময়ে পত্রিকাগুলোর ক্লিক-বেইজড ব্যবসায়ীক প্রবণতা। পাঠক একটা উদ্ভট শিরোনাম দেখে লিঙ্কে ক্লিক করবে, এতে ওই নির্দিষ্ট পত্রিকার ওয়েবসাইটের ভিউ বৃদ্ধি পাবে এবং সে ভিউ থেকে আয় বৃদ্ধি হবে- এই এক ট্রেন্ডই যেন শেষ করে দিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার গৌরবান্বিত মহিমা।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টা হলো, এ ধরণের নিম্নমানের কৌশলের ব্যবহার আজ আর শুধু ভূঁইফোড় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আবদ্ধ নেই। এ দেশের ভরসাযোগ্য অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাও চোখ বুঁজে এ পথেই চলছে। ভিউ পাওয়ার জন্য এরা বিচ্ছিন্ন শিরোনামের ব্যবহার থেকে শুরু করে তথাকথিত টিকটকারদের সাক্ষাৎকার, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নিয়মিত খবরাখবর উপস্থাপন, ছোটপর্দা-বড়পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিষ্প্রয়োজনীয় তথ্যাদির হালনাগাদীকরণসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকটু কৌশল অবলম্বন করেই চলেছেন। আর এমন সংবাদের নিয়মিত উপস্থাপনে এটা স্পষ্ট যে, এই কাজের সাথে কোনো নির্দিষ্ট পত্র-পত্রিকার এক-দুইজন না, বরং ছোট থেকে বড় সব কর্মকর্তাই বেশ ভালোভাবে অবহিত এবং তারা সজ্ঞানেই এ কাজগুলো করে চলেছেন।
আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগে- এরা কি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না? এদের একটু অনুশোচনা হয় না নিজেদের দায়িত্বে এভাবে ফাঁকতাল দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়ার জন্য? আগে মানুষ পুলিশকে গালি দিত, এখন মানুষ সমান হারে সাংবাদিকদেরও গালি দেয়। অথচ আজন্মকাল এ পেশাকে একটি সম্মানীয় পেশা হিসেবে জেনেই বড় হয়েছি। কিন্তু সম্মান ধরে রাখতে না পারলে কে দেবে তাকে সম্মান?
তথ্যসূত্র- বুদ্ধিজীবীর নোটবই//সুধীর চক্রবর্তী
ছবি- ইন্টারনেট
১১ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৮
মৌরি হক দোলা বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
২| ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ৯:০১
খায়রুল আহসান বলেছেন: চমৎকার পোস্ট। বিশেষ করে পোস্টের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের গণমাধ্যমসমূহের বর্তমান অবস্থার একটা বিশ্বস্ত প্রতিফলন।
"আগে মানুষ পুলিশকে গালি দিত, এখন মানুষ সমান হারে সাংবাদিকদেরও গালি দেয়" - এটাও সত্য কথা। সাংবাদিকরা সকলে মিলে নিজেরাই নিজেদেরকে টেনে এতটা নীচে নামিয়েছেন। আগে কারা সাংবাদিকতায় যেত, এখন কারা আসে- এর উত্তর খুঁজলে মানপতনের কারণটাও জানা যাবে।
১১ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪৯
মৌরি হক দোলা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ জানবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:০১
মাজহার পিন্টু বলেছেন: ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে। বিশেষ করে হলুদ সাংবাুদকতরি ইতিহাস জেনে। ধন্যবাদ।