![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আরব বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সে অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও মর্মান্তিক ঘটনা। একশ বছর আগেও অধিকাংশ আরব অঞ্চল ওসমানী খিলাফতের অংশ ছিল। ওসমানী খিলাফত ছিল একটি বিশাল বহুজাতিক রাষ্ট্র। এর রাজধানী ছিল ইস্তানবুল। বর্তমানে আরব বিশ্বের মানচিত্র খুবই জটিল একটি গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। গত শতাব্দীর ২য় দশকের (১৯১১-১৯২০) শুরুর দিকের কিছু জটিল ঘটনার কারণে ওসমানী সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সব রাষ্ট্র ও জাতি। নতুন সৃষ্টি হওয়া এসব রাষ্ট্রের সীমানা মধ্যপ্রাচ্যের মাঝ দিয়ে যায় এবং মুসলিমদের একে অন্যের থেকে আলাদা করে ফেলে। এই ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও, অন্যান্য সকল পশ্চিমা দেশের চাইতে বৃটেনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী ছিল। সেসময়ে বৃটেন ৩ পক্ষের সাথে ৩ টি আলাদা চুক্তি সই করে। এই চুক্তিগুলোর মধ্যেই আবার পরস্পর বিরোধী অঙ্গীকার ছিল। চুক্তিগুলোর ফলে মুসলিম বিশ্বের একটি বিশাল অংশ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা
১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শত্রু-মিত্র নির্ধারণের জটিল প্রক্রিয়া, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, ঔপনিবেশিক বাসনা ও সরকারগুলোর উচ্চপর্যায়ে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে এই প্রয়লংকারী যুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সন পর্যন্ত হওয়া এই যুদ্ধে প্রায় ১.২ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং অক্ষশক্তিতে ছিল জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি।
প্রথমদিকে ওসমানী খিলাফত নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কেননা তারা যুদ্ধরত জাতিগুলোর মত ততোটা শক্তিশালী ছিল না এবং নানা অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সমস্যায় আক্রান্ত ছিল। ১৯০৮ সালে শেষ শক্তিধর খলীফা আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় কে “তিন পাশা”(তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী) উৎখাত করে এবং সামরিক শাসন জারি করে। এরপর থেকে খলীফা পদটি শুধুমাত্র প্রতীকী পদ ছিল। এই “তিন পাশা” ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী “তরুণ তুর্কী” গ্রুপের সদস্য। অন্যদিকে, ওসমানীরা ইউরোপের নানা শক্তির কাছে বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝায় জর্জরিত ছিল যা তারা পরিশোধে অক্ষম ছিল। ওসমানীরা প্রথমে মিত্রশক্তিতে যোগদানে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে ১৯১৪ সালের অক্টোবরে অক্ষশক্তিতে যোগ দেয়।
ফলশ্রুতিতে, বৃটেন তৎক্ষণাৎ উসমানী খিলাফতকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীলনকশা করতে শুরু করে। বৃটেন ১৮৮৮ সাল থেকে মিশর এবং ১৮৫৭ সাল থেকেই ভারতকে দখল করে নিয়েছিল। উসমানী খিলাফতের অবস্থান ছিল ব্রিটেনের এই দুই উপনিবেশ এর ঠিক মাঝখানে। ফলে বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে উসমানী খিলাফতকে উচ্ছেদ করতে বৃটেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
আরব বিদ্রোহ
ব্রিটেনের অন্যতম বড় পরিকল্পনা ছিল ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব জনগণকে উস্কে দেয়া। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তারা আরব উপদ্বীপের পশ্চিমের এলাকা হেজাযের একজন ব্যক্তিকে সাথে সাথে পেয়েও যায়। মক্কার গভর্নর শরীফ হুসেইন বিন আলী ওসমানী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শর্তে বৃটেনের সাথে চুক্তি করে। শরীফ হুসেইন নিজের মুসলিম ভাইদের সাথে যুদ্ধ করার এই ব্রিটিশ পরিকল্পনায় কেন অংশ নিয়েছিলেন তার নিশ্চিত কারণ জানা যায় নি। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: তিন পাশা কর্তৃক তুর্কী জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়নের চেষ্টায় তার অসন্তোষ, উসমানী সরকারের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মনোবাসনা।
যে কারণেই হোক না কেন, বৃটেনের সাহায্যের অঙ্গীকার পেয়ে শরীফ হুসেইন উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিলেন। অন্যদিকে বৃটেন বিদ্রোহীদেরকে টাকা ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়, কেননা টাকা ও অস্ত্র ছাড়া উসমানীদের সুসংঘটিত বাহিনীর সাথে পেড়ে ওঠা কষ্টকর ছিল। ব্রিটেন তাদের এ প্রতিশ্রুতিও দেয় যে, যুদ্ধের পর শরীফ হুসেইনকে ইরাক ও সিরিয়া সহ গোটা আরব উপদ্বীপ মিলিয়ে একটি বিশাল আরব রাজ্য শাসন করতে দেয়া হবে। দুইপখের মধ্যে এ আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি বিষয়ক চিঠিগুলো ইতিহাসে ম্যাকমেহন-শরীফ পত্রবিনিময় (McMahon-Hussein Correspondence) নামে পরিচিত, যেহেতু শরিফ হুসেইনের যোগাযোগ তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমেহন এর সাথে হচ্ছিল।
১৯১৬ এর জুনে, শরীফ হুসেইন তার সশস্ত্র আরব বেদুঈনদের নিয়ে ওসমানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বেড়িয়ে পড়েন। কয়েক মাসের মধ্যেই বৃটিশ সেনা ও নৌবাহিনীর সহায়তায় আরব বিদ্রোহীরা মক্কা ও জেদ্দা সহ হেজাজের বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ব্রিটেন সৈন্য, টাকা, অস্ত্র, পরামর্শদাতা (যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিখ্যাত লরেন্স অফ এ্যারাবিয়া), পতাকা দিয়ে বিদ্রোহীদের সহায়তা করে। মিশরে অবস্থানরত বৃটিশরা বিদ্রোহীদের একটি পতাকা বানিয়ে দেয় যা “আরব বিদ্রোহের পতাকা” নামে পরিচিত ছিল। এই পতাকা-ই পরবর্তীতে অন্যান্য আরব দেশ যেমন: জর্ডান, ফিলিস্তিন, সুদান, সিরিয়া, কুয়েতের পতাকা তৈরিতে মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৯১৭ এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আরব বিদ্রোহীরা ওসমানীদের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়। একদিকে বৃটেন বাগদাদ ও জেরুজালেম দখল করে ইরাক ও ফিলিস্তিনে তাদের অবস্থান জোরদার করে, অন্যদিকে আরব বিদ্রোহীরা আম্মান ও দামেস্ক দখল করে বৃটেনকে তাদের কাজে সাহায্য করতে থাকে। এখানে জেনে রাখা জরুরি যে, অধিকাংশ আরব জনগোষ্ঠীরই এই আরব বিদ্রোহে কোন সমর্থন ছিল না। এটি ছিল নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে কয়েক হাজার গোত্রীয় লোকদের ছোট একটি আন্দোলন। অধিকাংশ আরব জনগোষ্ঠী এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে এবং ওসমানী বা বিদ্রোহী কোন পক্ষকেই সমর্থন দেয় নি। শরীফ হুসেইনের আরব রাজ্য বানানোর বাসনা এতদিন ঠিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃটেনের অন্যান্য পক্ষের সাথে করা প্রতিশ্রুতিগুলো এবার বাঁধ সাধল।
সাইকস-পিকোট চুক্তি
আরব বিদ্রোহ শুরু হবার আগেই এবং শরীফ হুসেইন তার আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বৃটেন ও ফ্রান্সের অন্য পরিকল্পনা করা ছিল। ১৯১৫-১৬ এর শীতে, বৃটেনের স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রান্সিস জর্জেস পিকোট ওসমানী খিলাফত পরবর্তী আরব বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে গোপনে মিলিত হন।
sykes-picot-1916
সাইকস-পিকো চুক্তি অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে বৃটিশ ও ফ্রেঞ্চ নিয়ন্ত্রিত এলাকা
বৃটেন ও ফ্রান্স পুরো আরব বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করে, যা পরবর্তীতে সাইকস-পিকোট চুক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। বৃটেন বর্তমানের জর্ডান, ইরাক, কুয়েত “নামে পরিচিত” দেশগুলোর দখল নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। ফ্রান্স পায় বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ তুরস্ক। জায়োনবাদীদের ইচ্ছাকে এখানে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ফিলিস্তিনের দখল নেয়ার বিষয়টি পরবর্তীতে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃটেন ও ফ্রান্সের দখল করা অঞ্চলগুলোর কিছু কিছু জায়গায় আরবের সীমিত মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেয়ার কথা থাকলেও, ইউরোপীয় শাসন ব্যবস্থাই তাদের উপর কর্তৃত্বশীল থাকবে। চুক্তি অনুযায়ী, অন্যান্য এলাকায় বৃটেন ও ফ্রান্স সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব করার অধিকার পায়।
যদিও এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে করণীয় বিষয়ক একটি গোপন চুক্তি ছিল, কিন্তু ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বলশেভিক সরকার একে সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়। ফলে দেখা যায় সাইকস-পিকোট চুক্তির সাথে শরীফ হুসেইনকে দেয়া ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতির মধ্যে স্পষ্টতই অনেক ঝামেলা আছে। এ ঘটনার পর বৃটেন ও আরব বিদ্রোহীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এটিই বৃটেনের করা সর্বশেষ পরস্পর বিরোধী চুক্তি ছিল না, নাটকের চিত্রনাট্যের এখনো কিছু অংশ বাকি ছিল।
বেলফোর ঘোষণা
আরেকটি সম্প্রদায়েরও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের দিকে দৃষ্টি ছিল এবং তারা হল জায়নবাদীরা। জায়োনিজম হল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যা ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতো। এ আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯ শতকে এবং এর লক্ষ্য ছিল ইউরোপের ইহুদিদের জন্য (যারা মূলত পোল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়ার বাসিন্দা) ইউরোপের বাইরে একটি আবাসভূমি খুঁজে বের করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জায়োনিস্টরা বৃটেন সরকারের কাছে যুদ্ধ পরবর্তীতে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের ব্যাপারে সাহায্য চায়। অন্যদিকে, বৃটিশ সরকারের ভিতরেও এমন অনেক কর্মকর্তা ছিলেন যারা এই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আরথার বেলফোর। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বরে, বেলফোর (ইহুদিবাদি) জায়োনিস্ট সম্প্রয়দায়ের নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এই চিঠিতে তিনি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সরকারী সমর্থন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
“মহামান্য (বৃটিশ রাজার) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বসতি স্থাপনের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্যে তার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, এমন কিছুই করা হবে না যাতে ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি (অন্যান্য ধর্মাবলম্বী) সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, অথবা অন্য কোনো দেশে বসবাসকারী ইহুদীদের উপভোগকৃত অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষতিসাধন হয়।”
তিনটি পরস্পরবিরোধী চুক্তি
ফলে দেখা গেল, বৃটেন ১৯১৭ সালের মধ্যেই তিন তিনটি ভিন্ন পক্ষের সাথে তিনটি আলাদা চুক্তি করলো এবং এই তিনটি ভিন্ন চুক্তিতে আরব বিশ্বের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তিনটি ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হল। বৃটেন আরবদেরকে আশ্বাস দিল, তারা শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে; অন্যদিকে ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নিবে। আবার বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী জায়োনবাদীরা ফিলিস্তিন পাওয়ার আশা করলো।
১৯১৮ সালে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং এর ফলে ওসমানী খিলাফতের পতন হয়। যদিও ওসমানীরা ১৯২২ পর্যন্ত নামে মাত্র টিকে ছিল এবং খলিফা পদটিও ১৯২৪ সাল পর্যন্ত নামমাত্র টিকে ছিল। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ওসমানীদের অধীনে থাকা সব অঞ্চল ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশে পরিণত হয়। যদিও যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য তিন পক্ষের পরস্পরবিরোধী বিতর্কের মধ্যে আটকা পড়ে যায়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অফ নেশন্স এর তত্ত্বাবধানে মধ্যপ্রাচ্য
তাহলে কোন পক্ষ অবশেষে বিজয় লাভ করেছিল? প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই তাদের পূর্ণ চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পায় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে লীগ অব নেশনস (জাতিসংঘের আদি রূপ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। লীগ অব নেশন্সের অন্যতম এক দায়িত্ব ছিল, পশ্চিমাদের জয় করা ওসমানী অঞ্চলগুলোকে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া। লীগ অব নেশন্স সম্পূর্ণ আরব বিশ্বকে অনেক ভাগে বিভক্ত করে (যাকে ‘ম্যান্ডেট’ বলা হয়)। এসব ম্যান্ডেট বৃটেন ও ফ্রান্স এর হাতে তুলে দেয়া হয় এবং বলা হয় ব্রিটেন ও ফ্রান্সই শাসন করবে যতদিন না তাদের নিজেদের দায়িত্ব নেয়ার সামর্থ্য না হয়। এই লিগ অব নেশন-ই সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন সীমানা আরোপ করে দেয় যা আমরা বর্তমানে মানচিত্রে দেখতে পাই। এই সীমানাগুলো স্থানীয় জনগণের কোনপ্রকার মতামত ছাড়াই আরোপ করা হয়। জাতিগত, ভৌগলিক অথবা ধর্মীয় কোন পরিচয়ই বিবেচনায় আনা হয় নি, অর্থাৎ তা ছিল সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী একটি সিদ্ধান্ত। এটা জেনে রাখা জরুরি যে, আরব বিশ্বের এই রাজনৈতিক সীমানা কোনভাবেই বিভিন্ন জাতির উপস্থিতি নির্দেশ করে না। ইরাকি, সিরিয়, জর্ডানি ইত্যাদি পার্থক্যসমূহ সম্পূর্ণরূপে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদীদের তৈরী করে আরবদেরকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত করে ফেলার পদ্ধতি হিসেবে।
mandate
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অফ নেশন্স এর তত্ত্বাবধানে মধ্যপ্রাচ্য
ম্যান্ডেট সিস্টেমের মাধ্যমে বৃটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের উপর তার কাঙ্খিত দখল বুঝে পায়। অন্যদিকে শরীফ হুসেইনের ক্ষেত্রে, তার ছেলেরা বৃটিশদের ছায়াতলে থেকে শাসনকাজ পরিচালনার সুযোগ পায়। প্রিন্স ফয়সালকে সিরিয়া ও ইরাকের রাজা করা হয় এবং প্রিন্স আব্দুল্লাহকে করা হয় জর্ডানের রাজা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃটেন এবং ফ্রান্স-ই এইসব এলাকার প্রকৃত কর্তৃত্বে ছিল।
অন্যদিকে, বৃটেন সরকার জায়োনবাদীদেরকে কিছু শর্তসাপেক্ষে ফিলিস্তিনে বসতি গড়ার অনুমতি দেয়। বৃটেন সেখানে আগে থেকে বসবাসকারী আরবদের রাগান্বিত করতে চায় নি, তাই তারা ফিলিস্তিনে আসা ইহুদীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বেঁধে দেয়। এতে জায়োনবাদীরা ক্ষেপে ওঠে, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ইহুদীরা বৃটেনের শর্ত না মেনেই ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এসব ঘটনা আরবদের ক্ষোভও বাড়িয়ে দেয়, কেননা তাদের কাছে ফিলিস্তিন ছিল এমন একটি ভূমি যা ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহ আল-দ্বীন আল-আইয়্যুবির বিজয়ের পর থেকে তাদের নিজেদের ছিলো এবং এখন তা বসতি স্থাপনের ফলে জোরপূর্বক ইহুদীদের দখলে চলে যাচ্ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বৃটেন মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করেছিল তা আজও বিদ্যমান। পরস্পরবিরোধী চুক্তিগুলো এবং এর ফলে সৃষ্টি হওয়া আলাদা আলাদা দেশগুলো মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। জায়োনিজমের উত্থান ও মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যের অভাবে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জালিম সরকারের উপস্থিতি ও অর্থনৈতিক পতন দেখা দিয়েছে। যদিও এই বিভাজনটি গত ১০০ বছরের ছোট পরিক্রমার ভেতরে তৈরি করা হয়েছে, তবুও বৃটেন এর তৈরী করা এই বিভেদ মুসলিম বিশ্বে আজও শক্তিশালীভাবে বিরাজ করছে।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ How the British Divided Up the Arab World
Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ
Fromkin, David. A Peace to End All Peace: The Fall of the Ottoman Empire and the Creation of the Modern Middle East. New York: H. Holt, 2001.
Hourani, Albert Habib. A History Of The Arab Peoples. New York: Mjf Books, 1997. Print.
Ochsenwald, William, and Sydney Fisher. The Middle East: A History. 6th. New York: McGraw-Hill, 2003. Print.
©somewhere in net ltd.