নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আমার ছায়া। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি, হাতের মধ্যে আকাশ; তবু ছুঁতে পারিনা।

মোহাম্মদ বাসার

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। ফিচার এডিটর- বাংলাপোস্ট, যুক্তরাজ্য।

মোহাম্মদ বাসার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:০২

জীবনের গল্প

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা

'দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন'- কথাটা মস্তবড়ো বোকার হদ্দ থেকে বিজ্ঞজনেরা সবাই বলেন। কিন্ত এর প্রায়োগিক ব্যাপারটি আমরা কতজনই যত্নসহকারে আমাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাই বলুনতো!!

যদিও এই প্রবাদের ভাবার্থ ও শব্দগত অর্থে মিল রয়েছে যথেষ্ট। কিন্ত আমার আজকের এই নাতিদীর্ঘ আলোচনায় এর শব্দগত অর্থই বিশেষ প্রাধান্য পাবে।

আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বাপচাচারা মিলে আমরা ছিলাম প্রায় ২৫/৩০ জনের ফ্যামিলি। কৃষি ভিত্তিক পরিবার হওয়ায় মৌসুমের দিনগুলোতে আমাদের বাড়িতে ফসলের গাদাগাদিতে ঢোকাই যেত না। আখের মৌসুমে বারান্দায় বসে বসে আখ চিবুতাম। দুইটা আখের কল দিয়ে আখ মাড়াই হত ৩/৪ মাস ব্যাপি। সে এক উৎসবের মত ব্যাপার। ঘন বর্ষায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেলে বারান্দায় বসে বসে কিংবা কখনো নৌকায় চড়ে আখ খাওয়ার পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতা হত কে কত বেশী আখ খেতে পারে। আমার তখন ধারণা ছিল আখ হয়তবা সাদা ফকফকা ও শক্তপোক্ত দাঁত গঠনে বিশেষ উপকারী। অবশ্য যেভাবে গজমক্কল, মিছিমালা, ডানকিনি ও বোম্বাই আখ চিবিয়ে চিবিয়ে খেতাম তাতে সে ধারণা অনেকটা বধ্যমূলই ছিল। বিপত্তি দেখা দেয় তখন যখন আমরা উপলবদ্ধির করলাম দাঁতে পোকা ধরতো। মূলকথা কার্বোহাইড্রেট ও সুগার জমে থাকার কারণে দাঁতে যে ক্ষয় রোগ দেখা দিত তাকেই আমরা দাঁতের পোকা ধরা বলতাম।

আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে মনোহর বাজারের কাছে ছিল গৌরাঙ্গ বাবুদের বাড়ি। আমাদের অত্র এলাকার সবাই সেই বাড়িতে যেতেন দাঁতের পোকা ফেলার জন্য। আমিও বেশ কয়েকবার ফুলা মাড়ি নিয়ে ব্যাথাসহ গিয়েছি সেই বাড়িতে পোকা ফেলতে। অদ্ভুত জাদুকরী ক্ষমতায় সাদা মলম দিয়ে ঘষে আর সবুজ পাতা দাঁতের আশেপাশে বুলিয়ে মুখ থেকে বের করে আনত জ্যান্ত জ্যান্ত পোকা। দেখে অবাক হতাম, বিস্মিত হতাম আবার ভয়ও পেতাম। ফকিরের কেরামতিতে তার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস দুটোই বেড়ে যেত। আমি বড় আপা, মাকে, আমাদের বাড়িতে গরীব আত্মীয়স্বজন যারা ছিলেন তাদের জিজ্ঞেস করতাম এই পোকা কিভাবে দাঁতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে! এখন বেশ বুঝতে পারি ওরা পঁচা কলাগাছ, পঁচা ফলমুল কখনোবা টয়লেটে থেকে এসব পোকা সংগ্রহ করতো( নাউজুবিল্লাহ, ইয়াক! ইয়াক!)।

দুধদাঁত পড়ে যখন আসল দাঁত উঠা শুরু করলো তখন থেকে আর দাঁত ব্যাথা বা পোকায় ধরার ব্যপারটা তেমন আর অনুভব করিনি। কিন্ত পর্যাপ্ত সতর্কতার অভাবে দাঁতের মাড়িতে সমস্যা ঠিকই দেখা দিয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভাল মাড়ির এই দূর্বলতা আমাদের অনেকটা জেনিটিক্যাল। আমাদের বাবার দাঁতে তেমন কোন সমস্যা না থাকলেও মায়ের দাঁতের মাড়ির অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না, এখনো নেই। আমদের অধিকাংশ ভাইবোনেরই মাড়িতে সমস্যা ছিল কিংবা আছে। আমার পুত্র সমুদ্রেরও মাড়ি অতটা মজবুত নয়। কিন্ত যথেষ্ট পরিচির্যায় এই সমস্যা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকেই মাড়িগুলো ফুলে যেতে থাকে। এর প্রভাব আমার চোখেও পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ কয়েক মাস দেখেছি ময়লা জমে চোখও খুলতে পারছিলাম না। যাইহোক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর ঢাকা এসে যখন ছোটখাট সার্জারী করে দাঁতের স্কিলিং করালাম তার পর থেকে আর তেমন কোন সমস্যাই রইলোনা। এখনও সেই ডাক্তার ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে। লম্বা ছিপছিপে গড়নের সুদর্শন ডাক্তার ভদ্রলোক ছিল ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ডাক্তার। অসম্ভব বিনয়ী সেই ডাক্তার ভদ্রলোক লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়ে যখন আমার আপারেশান পর্ব শেষ করলেন তখন বললেন আর বেশ কিছুদিন দেরী করলে নাকি আমার অনেক দাঁতই একেবারেই নষ্ট হয়ে যেতে পারতো। যাইহোক দাঁত নষ্ট হয়ে যেতে পারে একেবারেই এরকম আরেকটি গল্প আমার বিলাত কেন্দ্রিক জীবিনেও আছে, সেটা একটু পরে বলছি।

দাঁতের পরিচর্যা কখনোই আমাদের জীবনে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নয়, অন্তত অনেকটা আগে যে ছিলনা তা বেশ হলফ করেই বলতে পারি। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ১৯৮৮ সালের পরে দ্বিতীয়বার যখন দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাই সেটা সম্ভবত ১৯৯১ কিংবা ১৯৯২ সাল হবে। ততদিনে আমার বাল্যবন্ধু রেজা রাজশাহী ম্যাডিক্যালের ডেন্টাল ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে। ওর পরামর্শে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের হেড জনাব আঃ জলিলের গ্রীনরোডের চেম্বারে যাই দাঁতের সমস্যা নিয়ে। মাড়ির সমস্যা যারা আক্রান্ত তাদের প্রতি ডাক্তারের পরামর্শ থাকে অন্তত ৬ মাস অন্তর অন্তর দাঁতের ডাক্তার দেখানো। তো জলিল সাহেবকে দেখানোর পরে তিনি আমার পরিচয় পেয়ে খুশী হলেন এরকম গদগদে ভাব দেখালেন। আমি শরীয়তপুরবাসী বলে তার নির্দিষ্ট ফি থেকে এক দেড়শো টাকা কমও রাখলেন। চিকিৎসা শেষে যখন বললাম স্যার কিছু কিছু দাঁতের গোড়ায় মনে হয় স্টোন রয়ে গেছে। তিনি বললেন হলে যেয়ে ব্রাশ করে কুলি করলেই চলে যাবে। আমি একবার ভেবেছিলাম বলি যে 'যদি কুলি করলেই স্টোন চলে যায় তাহিলে আপনার এখানে আসছি কেন?' যাইহোক রেজার রেফারেন্সে আসছি ও মেডিকেলের বিদেশী ডিগ্রীধারী স্বনামধন্য ডাক্তার এবং আমাদের শরীয়তপুরের লোক বলে তেমন কিছুই বলা হয়নি। এর পরেও আরেকবার তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডেন্টাল ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। তখন তার শিষ্য ছাত্ররা আমার মাড়িতে এমনভাবে স্কিলিং করেছিল যেন আমি স'মিলের কাঠের মত আমার মাড়িখানা করাতের নীচে ছেড়ে দিয়েছি, সেই থেকে অন্তত একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম যে জীবনে আর যাইহোক সস্তায় অন্তত সিঙ্গারা কেন রসগোল্লাও খাব না।

তারপরের ঘটনা বেশ সহজ সরল শুধুমাত্র একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। এখানে দাঁতের স্কিলিংসহ অন্যান্য চিকিৎসা এমন নিখুঁত যে আপনার মনেই হবেনা আপনার মুখের মধ্যে লংকা কান্ড হচ্ছে। এইজন্য বাসায় এসেও আমি তন্নতন্ন করে খোঁজার চেষ্টা করি যে কোথাও কোন স্টোন রয়ে গেল কীনা! যাইহোক বিলেতের ব্যতিক্রমী ঘটনাটা বলি। সম্ভবত ২০০৭/৮ সালের দিকের ঘটনা। আমি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীতে ফায়ার এলার্ম ইন্সপেক্টরের কাজ করি। আমাদের এক ক্লায়েন্টের দাঁতের ক্লিনিক। বেশ অধুনিক, সাজানো গোছানো। একেতো আমাদের ক্লায়েন্ট তাদের বিল্ডিং অথরিটি তারপরে প্রতি সপ্তাহেই কমবেশী একবার দেখা হয়। তো দাঁত দেখানোর ফ্রি অফার চলছে। ওদের চাপাচাপিতেই আমি দাঁত দেখালাম। ডাক্তার সাহেব রাশিয়ান, আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন। তিনি আমাকে বললেন 'You are lucky Mr Basar, still you have some teeth.' আমি বললাম 'What should be done then?' তারপর তিনি যে ফিরিস্তিসহ লিস্ট ধরিয়ে দিলেন তা প্রায় ১৮০০ পাউন্ডের ধাক্কা। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি তোমাকে পরে জানাবো। তারপর সে বলল শোন এইগুলি খুব গুরুত্বপূর্ন, এখন না করালেই না, তোমার এপয়নমেন্টের ব্যবস্থা করি, ১২০০ পাউন্ডের মধ্যেই হয়ে যাবে। আমি বললাম তোমাকে পরে জানাব, তখন সে আবার বলল শোন তাহলে এইগুলি কর, তোমার ৬০০ পাউন্ড লাগবে। আমি বললাম Mate i am bit busy right now, I will let you know! একথা বলেই ওকে বিদায় দিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে আসলাম। যাইহোক এই তিক্ত স্মৃতির মধ্যেও ভাল স্মৃতি আছে। এইতো গত সপ্তাহ দু'য়েক আগে গেলাম ডিন্টিস্টের কাছে। চমৎকারভাবে দাঁতের চিকিৎসা হলো, মাত্র ৩০ পাউন্ডে পুরো স্কিলিং ও ক্লিনিং। ভাবা যায়! পৃথিবীর সবচেয়ে অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর বাংলাদেশেও আজকাল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সেবা খাতেও খরচের পরিমাণ পশ্চিমা দেশের চেয়ে বেশী।

দেশের সবকিছুতেই যে তিক্ততার স্মৃতিতে ভরপুর তা নয়। মনে পড়ে ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে যখন প্রথম বারের মত বিলেত মুখো হই তার ইমিডিয়েট আগে ফেব্রুয়ারীতে গিয়েছিলাম নাকের পলিপাস জাতীয় সমস্যা নিয়ে বন্ধু রেজার রাজশাহী ম্যাডিক্যাল কলেজে। যাওয়ার আরও কারণ ছিল রেজার কাছ থেকে দাঁতের চিকিৎসাটাও করিয়ে নেয়া। সেখানে ডাঃ সাইফুল ইসলাম যিনি ছিলেন নাক কান ও গলা বিভাগের হেড তার ব্যক্তিগত চেম্বারেই হয়েছিল জেনারেল এনেশস্থেশিয়া দিয়ে আমার আপারেশান। মজার ব্যাপার হলো অজ্ঞান অবস্থাতেই আমার অনেক ব্লিডিং হচ্ছিল তখন। অনেক বন্ধুরাই দেখতে এসছিল ক্লিনিকে। শুনেছি মাধবী আমাকে ক্লিনিকেও দেখতে এসছিল। যে হাত মাধবী রাজশাহীর মতিহারের বিস্তীর্ণ সবুজে হেঁটে হেঁটে দ্বিধা সংকোচে ধরতে পারেনি সে হাত ধরেছিল ঘুমের ঘোরে। এখনও কানে বাজে 'জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা মরণে কেন তারে দিতে গেল ফুল..'।

৬ই নভেম্বর ২০১৮
যুক্তরাজ্য




মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: দেশে ফিরে আসছেন না কেন?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.