নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলার প্রিয় সাত আত্মজীবনী

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৫০

আত্মজীবনীতে তিনি প্রকৃত কি সেটা লেখা হয় না, তিনি কি হতে চেয়েছিলেন সেটাই লেখা হয়। খুব কম আত্মজীবনীই একেবারে খোলামেলাভাবে লেখা হয়। যেমন নির্মলেন্দু গুণের ‘আমার কণ্ঠস্বর’ এবং তসলিমা নাসরিনের সাত খণ্ড (সাতকাণ্ডও বলতে পারেন) আত্মজীবনী। তসলিমা নাসরিন আত্মজীবনী লিখে বন্ধুদেরও বিরাগভাজন হন। বাংলার লেখককূল তাঁর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর বলা সত্যটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। হিটলারের মাই ক্যাম্প, জ্যোতি বসুর ‘রাজনৈতিক আত্মজীবনী’ ড. আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’সহ অনেক আত্মজীবনীই পড়েছি। প্রিয় ৭টি আত্মজীবনী/আত্মকথা উল্লেখ করলাম-
(তসলিমার আত্মজীবনী নিষিদ্ধ বলে তা নিয়ে লিখলাম না)

১। জীবনের রেলগাড়ি
জসীম উদ্দীন মণ্ডলের আত্মজীবনীর নাম জীবনের রেলগাড়ি৷ সম্ভবত প্রথম জীবনে রেল শ্রমিক ছিলেন বলেই এমন নামকরণ৷ জন্ম শেখ মুজিবের জন্মসালে ১৯২০, মানে তাঁর ৯৭ বছরের দীর্ঘ জীবন ছিল৷ মৃত্যুর সময় তাঁর কোন ঘর ছিল না, জমি ছিল না৷ দরিদ্র জীবনে যা ছিল তাও দিয়েছেন পার্টির জন্য৷ একজন আদর্শ কমিউনিস্ট নেতার সংগ্রামী জীবন৷ একজন ত্রিকাল দর্শী, বৃটিশ ভারতে ২৭ বছর, পাকিস্তানের ২৪ বছর আর স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৬ বছর৷ জন্মের পর থেকে আমৃত্যু গেছে সংগ্রামে৷ ভেবেছেন কিন্তু কোন পরিবর্তনেই জীবন বদলায়নি৷ জেল খেটেছেন তিন আমলেই৷ তাই শেষে হিসেব মিলাতে গিয়ে দেখেছেন, পাওয়ার পাল্লাটা শূন্য! আজই পড়ে শেষ করে মনে হল এমন মহৎ জীবন শূন্য হতে পারে না৷ কত আত্মজীবনী পড়েছি, এর চেয়ে মহৎ জীবন কার ছিল? বুকের গহীন থেকে বেরিয়ে আসে শ্রদ্ধা।

২। হুমায়ুন আজাদের ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
বইটি হুমায়ুন আজাদের পৈতৃক বাড়ি রাঢ়ীখাল এবং তাঁর জন্মস্থান নানাবাড়ি ভাগ্যকুল ইউনিয়নের বিভিন্ন স্মৃতি নিয়ে লেখা। এমনিতেই তাঁর লেখার মূল উপজীব্য তার শৈশব। তাঁর সৃষ্টিশীলতা জুড়ে রয়েছে তাঁর শৈশব। ছবির মতো শৈশব ভেসে উঠতো তাঁর সাহিত্যে। তিনি আত্মস্মৃতি লিখে যান নি কিন্তু তিনি ‘ফুলে গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটিতে উঠে এসেছে তাঁর বাল্যকাল। তাঁর নিকটজনদের হাসি, আনন্দ, সুখ, দুঃখের কথা। সেই বাল্যবিভোরতা দেখেছি সর্বত্র। বইটির বিভিন্ন লেখায় রয়েছে অসংখ্য উপমা। তিনি চাঁদ নিয়ে লিখেছেন, রাতের চাঁদ ছিল প্রিয় সাদা বেলুনের মতো কিংবা পানু আপার ঠোঁটের হাসির মতো। মাছরাঙা নিয়ে লিখেছেন, পুকুরের আকাশে ধ্রুব তারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তরোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃদপিন্ডে। পিঠে নিয়ে লিখেছেন, পিঠে তৈরি হচ্ছে: মায়ের আঙুলের ছোঁয়ায় কেমন রূপসী আর মিষ্টি হয়ে উঠেছে চালের আটা। সন্ধ্যের পরে মাটির চুলোয় জ্বলছে আম কাঠের লাল আগুন। যেনো লাখ লাখ গোলাপ লাল হয়ে ফুটেছে চুলোর ভিতর। কচুরিফুলকে বলেছেন, পুকুরের ঝাড়বাতি। লাউডগা নিয়ে লিখেছেন, সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। আজো লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে- ঘাসের উপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদ-র পিয়াসী স্বপ্ন। সরপুঁটিকে বলেছেন, পানির নিচের আলো। মাংসের কবিতা হল সরপুঁটি। ভাগ্যকুলের বিখ্যাত জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটিকে বলেছেন বিলের ধারে প্যারিশ শহর। এই বাড়িতে স্থাপিত হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। এ বাড়ি বা জাদুঘর নিয়ে যখনই কোন লেখা হয়, এসে যায় তাঁর লেখা উপমা ‘বিলের ধারের প্যারিশ শহর’। রাঢ়ীখাল তাঁকে জীবনভর ডাক পেরেছে। তিনি ডাক ছেড়েছেন রাড়িকাল রাড়িকাল বলে, তুমি ক্যান হুমইর দ্যাও না।
বইটি যদিও একটি অসাধারণ ও আকর্ষণীয় কিশোর সাহিত্য তবে এতে প্রকৃতির বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। শুধুমাত্র বিভূতিভূষণের সাথে তুলনীয়।

৩। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি
জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিশেবে স্বীকৃত। তিনি ব্যক্তিগত ডাইরী লিখেছেন উত্তাল সময়ে। শুরু করেছেন ১ মার্চ থেকে এবং শেষ হয়ে বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাঁর তরুণ পুত্র শফি ইমাম রুমীকে কেন্দ্র করেই নিজের দেখা, শোনা কথাগুলো লিখেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি গঠন করে তার আহবায়ক হন এবং গণ আদালতের চেয়ারম্যান হিশেবে গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে রায় দেন। তিনি সৃজনশীল লেখক হিশেবে সুপরিচিত ছিলেন না। কিন্তু একাত্তরের দিনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে এতো চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, এটিই হয়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। কারো সাথে কথা বলে বা শুনে হুবহু সেই কথপোকথন তুলে ধরেছেন উপন্যাসের মতো। আমি তখন ফরিদপুর জেলা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি। মধুখালীতে জামাত-শিবিরের সাথে সংঘাত হয়। মামলায় আমাদের সংগঠনের ও প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দকে খুবই হয়রাণী করছিল। মধুখালী স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন জাহানারা ইমাম। বিশাল সমাবেশের পর পুলিশ হয়রাণী বন্ধ করতে বাধ্য হয়। দেশ তাকে চিনে শহীদ জননী হিশেবে। তাঁর সন্তান রুমী ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। তার সাথে আমাদের বিক্রমপুরের দুজন বিখ্যাত গেরিলা আবুল কালাম আজাদ ও আঃ হালিম চৌধুরী জুয়েলও একই সাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন। শহীদ আজাদের মাকে নিয়ে আনিসুল হক লিখেছেন আলোচিত ‘মা’ উপন্যাসটি। শহীদ জুয়েলের নামে স্বাধীনতা দিবসে আয়োজন করা হয় মোস্তাক-জুয়েল টুর্ণামেন্ট। জাহানারা ইমাম শহীদ জননী খেতাব কবে পান জানি না। সম্ভবত একাত্তরের দিনগুলো লেখার কারণেই শহীদ রুমীর মা হিশেবে শহীদ জননী খেতাব পান।

৪। অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী একদিন জেলগেটে বসে তাকে বললেন, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’। তিনি কয়েকটি খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি শুরু করলেন এবং আমরা পেয়ে গেলাম এক মহাগুরুত্বপূর্ণ আত্মজীবনী। তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন। বইটির ভূমিকা লেখেন শেখ হাসিনা, যখন তিনি কারাবন্দি। যতটুকু জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশ করেন। ফলে শেখ মুজিবের একটি প্রকৃত জীবন আমরা পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। বইটিতে সংযোজন করা হয়েছে জাতিরজনকের সম্পূর্ণ জীবনই। তাঁর পরিবার, শৈশব, কৈশোর, ছাত্র রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন, জেলজীবন উঠে এসেছে অবিকৃতভাবেই। একই সাথে আমরা পেয়ে যাই তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন আরো বিষয়গুলো জানার একটি ভাল ঐতিহাসিক দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমরা জানি বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনী লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে। অনেকদিন ডিটেকশন নিলেও সেটা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। বাজারে বঙ্গবন্ধুর অনেক আত্মজীবনী রয়েছে, রয়েছে তাঁর লেখা কারাগারের রোজনামচা বইটিও। কিন্তু অসমাপ্ত আত্মজীবনীই বঙ্গবন্ধুর জীবনের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি, আকরগ্রন্থ।

৫। প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি
বদর বদর বলে মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।
এক নারী হুমায়ূন আহমেদকে তার উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র। হুমায়ূন আহমেদ তাকে ধরলেন, বদর বদর বলে কোন মাঝিকে আপনি নৌকা ছাড়তে দেখেছেন। তিনি উপন্যাস শুনলেন না। মহিলাও তার জন্য আনা খাবার ফেরত নিয়ে গেল।
এই বাক্যটি আমি পড়েছি প্রতিভা বসুর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘জীবনের জলছবি’ তে। মহিলা জীবনের জলছবি থেকে ওই লাইনটি মেরে দিয়েছিলেন। প্রতিভা বসু মাঝিদের মুখে শুনেই লিখেছিলেন। সদরঘাট থেকে তখন নৌকায় বিক্রমপুরের হাসাড়া আসতে হতো। প্রতিভা বসু আমাদের বিক্রমপুরের হাসাড়া গ্রামের মেয়ে। তাঁর নাম ছিল রানু সোম। বসু হলেন বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করার পর। তিনি কাজী নজরুলের প্রিয় ছাত্রী ছিলেন। তিনিই তার নাম বদলে রাখেন প্রতিভা বসু। প্রতিভা বসু নিজেও ঔপন্যাসিক ছিলেন। নজরুলের গান গেয়েও বিখ্যাত হন। তাঁর বাড়ি খুঁজতে বেড়িয়েছিলাম অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, লেখক সুমন্ত রায় ও আমি। অনেকগুলো সোম বাড়ি। কিন্তু অনেক ঘুড়েও রানু সোমের বাবা আশুতোষ সোমের বাড়ি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হই। স্যার পরবর্তীতে আরেকটি অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত করেছেন রানু সোমের জন্ম ভিটা।
জীবনের জলছবিতে প্রতিভা বসু লিখেছেন, সেই ছাদটা আমাদের গ্রামের বাড়ি হাঁসাড়া গ্রামের ছাদ। হাঁসাড়া গ্রাম ঢাকা (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলার) জেলার বিক্রমপুর পরগনার একটি গ্রাম। আমার জন্মস্থান সেখানে। জন্মেছিলাম ফাল্গুন মাসে, সেদিন দোলপূর্ণিমা ছিলো, বৃহস্পতিবার ছিল, সবাই বলতো আমি নাকি খুব লক্ষ্মী।...
জলের গ্রাম। এ বাড়ি ও বাড়ি সব খাল দিয়ে ঘেরা। নৌকা ছাড়া কোথাও যাবার উপায় নেই..। তখনকার দিনের ফ্যাশনমতো আমাদেরও চকমিলানো বাড়ি। মাঝখানকার বাঁধানো উঠোনটা এতো বড়ো যে একসঙ্গে চারটে বিয়ে হতে পারে। যেখানে বর-কনে বসে তার চারদিকে চারটে কলাগাছ রোপন করার নিয়ম। সুতরাং সেই বাঁধানো উঠোনে ষোলোটা গর্ত ছিলো। একবার একসঙ্গে যখন দুটো বিয়ে হচ্ছিলো, দৈবাৎ কনে বদল হয়ে গেল.. কাকার কাছে বসিয়ে দেয়া হলো তার নিজের বোনকে। কাকা চিনতেই পারেননি বোনকে। কিন্তু বোন চিনতে পেরে কেঁদে ফেলে বলে উঠেছে, ‘সোনাদা, আমি টুনি..
প্রতিভা বসু অর্থাৎ রানু সোম অনেক কথা লিখেছেন হাঁসাড়া গ্রামকে নিয়ে। তাঁর বাড়ি থেকে উঁকি দিলে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বাড়ি। প্রতিভা বসুর সেই বাড়ি এখন অর্পিত সম্পত্তি। কিছুকাল আগে বলা হতো শত্রু সম্পত্তি। হাঁসাড়া ইউনিয়ন পরিষদের পূর্বদিকেই যে সোম বাড়ি অর্থাৎ রানু সোমের পিতা আশুতোষ সোমের বাড়ি সেখানেই জন্মেছিলেন প্রতিভা বসু। এই হাসাড়া গ্রামেই বিখ্যাত গায়িকা শ্রেয়া ঘোষালের পৈতৃক বাড়ি।

৬। জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপারের ছেলেবেলা
মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরের বিখ্যাত গ্রাম অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বজ্রযোগিনী গ্রামে কাটানো ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়টার কথা বর্ণনা করেছেন বইটিতে। এটাই তাঁর জন্মস্থান। তাঁর দেখা এবং অন্তদৃষ্টির প্রখরতা উপলব্ধি করা যায় বইটি পড়ে। পিতা-মাতার কথা, নিজের জন্ম, হাতেখড়ি, স্কুল, সমাজের কথা, ধর্মভেদ, যুদ্ধ, মন্বন্তর, মতাদর্শ, রাজনীতি ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লিখেছেন বিস্তারিত। ওই সময়ের বিক্রমপুর নিয়ে লিখেছিলেন শক্তিকান্ত চট্টপাধ্যায় ‘পদ্মা থেকে গঙ্গা’। কিন্তু জয়ন্তানুজের দেখার অন্তদৃষ্টি অতুলনীয়।
ওই সময়ের বিক্রমপুরের সামগ্রিক চিত্রটাই তিনি তুলে ধরেছেন। আমরা বলতে পারি ওটাই বিক্রমপুর। ওই সময়ের হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, প্রগতিশীল-সাম্প্রদায়িক সকল দিকই আমরা পেয়ে যাই। ওই সময়ের সম্পূর্ণ সমাজচিত্র। হিন্দু বাড়িতে পারিবারিক বিগ্রহ- নারায়নশীলা, পাথরের বা পেতলের লক্ষ্মী, মনসা, শীতলা, শনি পূজা-পরিচর্যার কথা থেকে জানতে পারি মন্দিরভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম খুব তাৎপর্য ছিল না। সারা বজ্রযোগিনীর একমাত্র কালিমন্দিরে খুব কম মানুষই যেতো। ধনীদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো সেখানে ধর্ম পালনের চেয়ে উৎসবের মেজাজই বেশি ছিল। হিন্দু মুসলমান পরস্পরের উৎসবে যোগ না দিলেও সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। হিন্দুরা মুসলমানদের নিচু চোখে দেখতো কিন্তু নিম্নশ্রেণির হিন্দু বা মুসলিমরা উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের সম্ভ্রমের চোখেই দেখতো। গুরুপ্রথা ছিল। এখন মুসলমানদের পীর আর হিন্দুদের গুরুরা অনেক প্রতিপত্তিশালী তেমনটা নয়। গুরুরা দাবী করতো, গুরু থুইয়া কৃষ্ণ ভজে, সাত জন্ম নরকে পচে। ওই সময়ে ব্রাহ্মণদের মধ্যেও বিভাজন ছিল- কুলীন, ভঙ্গ কুলীণ আর শ্রোত্রীয় কুলীন ব্রাহ্মণ। রাজা বল্লাল সেন তক্ষশীলা থেকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় ও চক্রবর্তী ব্রাহ্মণদের আনেন, এরা সকলেই কুলীন। ওই সময় ৫জন পরিচারক কায়স্তও এনেছিলেন- ঘোষ, বসু, গুহ, মিত্র ও দত্ত। দত্তরা কৌলিণ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন- দত্তরা কারো ভৃত্য নয়, সংগে এসেছিল মাত্র। তাই প্রথম চার পদবীর কায়স্তরাই কুলীন। কতরকম কথা যে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অতীশ দীপঙ্করের ভিটার উপর বুড়ো শিব ছিল। ওখানে মায়ের সাথে গিয়েছিলেন। শিব দেখে তিনি হেসেছিলেন। কারণটা বলেননি। ওই সময়ে ব্রাহ্মণদের চোখে সব নিচু জাতি ছিল দুভাগে বিভক্ত- জলচল আর অজলচণ। জলচল মানে যাতের সাথে জল খাওয়া চলে যেমন কায়স্ত, ধোবা, কুম্ভকর, কর্মকার, নাপিত আর অজলচল মানে যাদের সাথে জল খাওয়া চলে না যেমন- নমশূদ্র, ডোম, ভূইমালি, মুচি, মেথর। জলচলদের ঘরে মুচি-চিড়া খাওয়া যেতে পারতো কিন্তু রান্না করা খাবার খাওয়া যেত না। ওই সময়ে হিন্দু বাড়িতে মাংশ খাওয়ার প্রচলন ছিল না। জয়ন্তানুজের শিক্ষক পিতা একবার মুসলমানের বাড়ি থেকে মুরগী খেয়ে আসলে তার মা বলে, লোকে শুনলে কী বলবে? তার পিতা অগ্রাহ্য করে বললেন, মানুষ কই? আমি যা করবো সেটাই হবে অন্য মানুষের অনুকরণীয় আদর্শ; অমানুষদের কথা শুনে চলব তার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সেই পিতার বিরুদ্ধেও তাঁর মা, বোন এবং নিজেদের উপর অন্যায় আচরণের বহু কথাও তুলে ধরেছেন। পিতার অসত্য কথন ও চারিত্রিক দুর্বলতার কথাও বলেছেন।তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করার অভিযোগও তুলেছেন।

৭. নির্মলেন্দু গুণের আমার কণ্ঠস্বর
যত আত্মজীবনীই পড়েছে নির্মলেন্দু গুণের মতো এতোটা স্বচ্ছভাবে উদাম করে কেউ লিখেনি তা পড়েই বুঝা যায়। মানুষ তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কলঙ্কগুলো সুন্দরভাবে অপ্রকাশিত রাখে আর সম্ভাব্য সুন্দরগুলো যা তার জীবনে ঘটেনি তা লিখে মহৎ হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এ কথা খাটে নি আমার কণ্ঠস্বরে। এমন অভিনব কণ্ঠস্বর কোথাও দেখিনি। দ্বিধাহীন সত্য বলা। কবি হওয়ার জন্য তাঁর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। তাঁর জীবনের শঠতা, নিচুতা, অসম্পূর্ণতা আমরা দেখেছি- দেখে তাকে মানুষ ও মহৎ মনে হয়েছে। যে অকুণ্ঠিতভাবে সত্য বলতে পারে তার চেয়ে মহৎ আর কে হতে পারে। নিজের গঞ্জিকাসেবনসহ বিভিন্ন নেশায় আচ্ছন্ন হওয়ার কথা লিখেছেন, অন্নসংস্থানের জন্য হাত পেতেছেন, জুয়ার নেশায় সব উড়িয়েছেন কিন্তু সৎ ছিলেন কবিতা লেখার ক্ষেত্রে, আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে। নিজের বোনকে নার্স বানাতে চেয়েছিলেন যাতে নিজের অন্নসংস্থান হয় কিন্তু তার পিতা ধরে ফেলে দূরভিসন্ধি! আত্মার বন্ধু কবি আবুল হাসানের কথা বলেছেন। বন্ধুরা মিলে ছোট একটি প্রকাশনা করেছিলেন- যা বন্ধুদের কাছে দুটাকা করে বিক্রি করেছিলেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন সহপাঠী শেখ হাসিনার কাছেও গিয়েছিলেন এক কপি বিক্রি করতে। তিনি বলেছিলেন, তোদের দুই টাকা দেয়ার চেয়ে ভিক্ষুককে দুই টাকা দেয়া ভাল। বহুদিন পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি খামের মধ্যে ভরে সেই দুই টাকা নির্মলেন্দু গুণকে দিয়েছিলেন ঠিকই। আমি খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি-বান্দরবান ও কক্সবাজার ভ্রমণের সময় বইটি সাথে নিয়েছিলাম। বইটি আমার পাহাড় ভ্রমণের আনন্দকে হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১১

নেয়ামুল নাহিদ বলেছেন: আত্মজীবনীগুলো পড়ার ইচ্ছা রইলো।

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৭

মুজিব রহমান বলেছেন: ওপারের ছেলেবেলা এদেশে পাবেন না। সম্ভবত প্রিন্ট আউট। বাংলাদেশ থেকেই বইটির প্রকাশের ব্যবস্থা করা উচিৎ। আমি পড়েছি ফটোকপি করিয়ে।

২| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৩

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর একাত্তরের দিনগুলি পড়েছি। বাকিগুলি পেলে পড়ব আশা করি।

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৮

মুজিব রহমান বলেছেন: এদুটিই বহুল পঠিত।

৩| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৯

ঢাবিয়ান বলেছেন: একমাত্র জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলো পড়েছি। বইটা শুধু জাহানারা ইমামের আত্মজীবনি নয় , আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটা ইতিহাসও। সব প্রজন্মের পাঠকদের বইটা পড়া উচিৎ।

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৩৪

মুজিব রহমান বলেছেন: অবশ্যই।
মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি অসাধারণ দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন। অনেক ডায়ালগ তিনি তুলে দিয়েছেন তাতে তাঁর স্মৃতিশক্তির পরিচয় পাই এবং একই সাথে লেখার দক্ষতাও প্রকাশিত হয়।

৪| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৪

রাজীব নুর বলেছেন: সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর একাত্তরের দিনগুলি পড়েছি। বাকিগুলি পেলে পড়ব আশা করি।

আমারও একই অবস্থা।

৫| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:২৬

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: হাঁসাড়ার এতো কাহিনি।৭১ রে কয়েক দিন ছিলাম হাঁসাড়ায়।বিএনপির মুজিবর মোল্ল আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল।মারা গেছে।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৬

মুজিব রহমান বলেছেন: হাঁসাড়া খুবই বিখ্যাত গ্রাম। ওই গ্রামের অনেককেই ঘণিষ্ঠভাবে চিনি। বিভিন্ন কারণে বহুবারই গিয়েছি, থেকেছি।

৬| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:৪৩

খায়রুল আহসান বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন। মন্তব্যসহ বই এর সারাংশ পড়ে অনেক কিছু জানলাম, বইগুলো পড়ারও আগ্রহ জন্মালো। দুটো অবশ্য পড়া আছে।
পোস্টে ভাল লাগা + +।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৭

মুজিব রহমান বলেছেন: ভাল বইর কথা বলছি, অনেকের কাছে আমিও সন্ধান পাচ্ছি।

৭| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:১৮

নতুন নকিব বলেছেন:



সুন্দর পোস্ট। ধন্যবাদ। +

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৭

মুজিব রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও।

৮| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৩৮

সাগর শরীফ বলেছেন: ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:৪৩০

খায়রুল আহসান বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন। মন্তব্যসহ বই এর সারাংশ পড়ে অনেক কিছু জানলাম, বইগুলো পড়ারও আগ্রহ জন্মালো। দুটো অবশ্য পড়া আছে।
পোস্টে ভাল লাগা + +।
আমার অবশ্য একটা মাত্র পড়া হয়েছে।
ধন্যবাদ স্যার, সুন্দর উপস্থাপনের জন্য!

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:০৯

মুজিব রহমান বলেছেন: ভাল লাগে যখন শুনি কেউ বইগুলো পড়েছেন। ভাল কিছু বইর সন্ধানও অন্যরা দিচ্ছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.