নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনেক অসাধারণের ভিড়ে আমি এক সাধারণ।

মনিরুজ্জামান স্বপন

যুক্তি বিশ্বাস করিনা আমি, তবুও যুক্তি খোঁজে ফিরি।

মনিরুজ্জামান স্বপন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জোসনা লোভী

১৯ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪১

গতকালের বাসী পত্রিকাটা বারবার ওল্টা পাল্টা করে দেখতেছিল আশফাক। যে কেউ তাকে এই অবস্থায় দেখলে ভাববে যে, সে কোন বিশেষ খবর খোঁজছে। আসলে তা-নয়। তার অভ্যাসটাই এরকম। আজকাল পত্রিকার কোন খবরই সে পড়ে না। শুধু পাতা ওল্টায়। পড়ে কি হবে? পত্রিকায় আজকাল মিথ্যা খবরই বেশি গরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয়। ভুয়া আর মিথ্যা খবরগুলো উপড়ের পৃষ্ঠায় রং বেরঙের ছাপ মেরে প্রকাশ করা হয়। এতে পত্রিকার বেঁচাবিক্রি ভাল হয়। খবরের শিরোনামগুলোকেও হতে হয় চটকদার, আনকমন। “ঢাকা ভাসছে জলের উপর’’ অথবা “অবিবাহিত চিত্র নায়ক সালেহ খানের এক পুত্রের সন্ধান’’ এই ধরনের শিরোনাম দেয়া হয় আজকাল। হঠাৎ একটা খবরে আশফাকের চোখ দুটো ফেবিকলের মতো পত্রিকার প্রথম পাতায় আটকে গেল। প্রথম পাতার একটা শিরোনাম- “শ্লীলতাহানির পর গলা টিপে হত্যা।’’ জৈনক শিক্ষিকার ষোড়শী মেয়েকে কে বা কারা গতকাল রাতে শ্লীলতাহানি করে গলা টিপে হত্যার পর লাশ ডোবার জলে ফেলে দিয়েছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছেন, ইত্যাদি। এরকম খবর আজকাল মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় আসে, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজকের খবরটি এই এলাকারই, মেয়েটিও আশফাকের পরিচিত। ব্যপারটা আশফাকের কেমন জানি লাগছে। গতকাল রাত আটটার দিকে মেয়েটার সাথে একবার কথা হয়েছিল আশফাকের। আশ্চর্য! এক রাতে এত্ত কিছু ঘটে গেল। মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভরে থুতু আসছে তার। সাথে কেমন জানি ভমি ভমি লাগছে। মন খারাপ হলে এমন লাগে তার। মাথাটা যেন ভন ভন করে ঘোরছে। আশফাক থুতু ফেলার জন্য ওঠতেই চারজন খাকি পোশাক পড়া ভদ্রলোক রুমে ঢুকলো। প্রত্যেকের পকেটের কাছেই নেমপ্লেট আছে আর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। নেমপ্লেটে নাম লিখা আছে। একজনের নাম আ: বাতেন। আ: বাতেন সাহেবের দারোয়ান টাইপের বিশাল গোফ আছে। বাকী তিনজনের কারো গোফ নেই। তাদের ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে ওনারা সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করতে এসেছেন। অথবা কোন দাগী ক্রিমিনাল ধরতে এসেছেন। তাদের হাতের চারটি অস্ত্রই আশফাকের দিকে তাক করা। আশফাক কিছুই বুঝতে পারছে না। আ: বাতেন তার হাতের ছোট অস্ত্রটির ইশরায় আশফাককে ওঠতে বললেন। আশফাক দুই হাত উপরে তুলে ওঠে দাড়াল।
-আমাদের সাথে ভালই ভালই থানায় চল জানুয়ারের বাচ্চা। রাগে দাতে দাত কাটতে কাটতে বলল আ: বাতেন সাহেব।
- নিয়ে যেতে এসেছেন যখন অবশ্যই যাব। কারন জানতে পারি কি?
-রাতভর মজা নিছ মনে নাই? থানায় চল, চিপা দিয়া মজা বাইর করুমনে।
- বুঝিয়ে বলুন।
- বুঝাচ্ছি তোমায়! মেশিনে আখের রস বাইর করতে দেখছ? না দেখে থাকলেও সমস্যা নাই। আমরাই দেখাইমু, আগে চল থানায়।
- কি আশ্চর্য! আমার কি অপরাধ আমি জানতেও পারব না?
- তোমারে মেশিনে দিয়া রস বের করা হবে, তোমার অনেক রস হইছে এই জন্য। কথা বন্ধ করে থানায় চল জানুয়ারের বাচ্চা।
আশফাক বুঝতে পারল অবস্থা ভাল না। এদের সাথে কথা বললে এখানেই চিপা খেতে হবে। তাই চুপ করে ওদের নির্দেশ মতো পুলিশের জিপে ওঠল।
আশফাক এখন বসে আছে সদ্য জন্মানো পাগলা থানার একটি কক্ষে। তার নাক বরাবর সামনেই বসে আছেন যিনি তার নাম সারোয়ার হোসেন। ইনি এ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ভারমুক্ত হবেন বলে লোকের মুখে শোনা যাচ্ছে। ওনার কাজে প্রশাসন যারপর নাই সন্তুষ্ট। এলাকার চোর-বদমায়েশ সব গর্তে ঢুকে গেছে। ওনিও নিজে যেচে গর্ত থেকে ওদেরকে টেনে বের করতে চান না। তবে বাইরে আসলে তিনি তাদেরকে ধরে এনে না-কি বিশেষ জায়গা দিয়ে গরম ডিম দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আশফাক ওনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। লোকের কথার সাথে ওনার চেহারার কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। নিতান্তই ভাল মানুষ টাইপের চেহারা। চোখে মুখে কবি কবি ভাব আছে। পুলিশ না হয়ে ওনার সাহিত্যিক হওয়া উচিত ছিল। এই লোক কারো গায়ে হাত তোলতে পারে আশফাকের তা বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই। সারোয়ার সাহেবের পেছনে একজন দাঁড়িয়ে যত্নের সাথে তার মাথার চুলে বিলি কাটছে। আর তিনি মায়া ভরা অথচ বিদ্রোহী কন্ঠে শামসুর রাহমানের লেখা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা আবৃত্তি করছেন। ওনার দুই পাশে আরো দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে কবিতা শোনছেন। আশফাককে যিনি পাকড়াও করে এনেছিল তিনিও পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছেন। ওনি সম্ভবত এ থানার সেকেন্ড অফিসার। তিনি কবিতা শোনছেন বলে মনে হচ্ছে না। মাঝে মধেই তিনি কপাল কুচকাচ্ছেন। বাম হাতের দুটো আঙ্গুল নাকের ছোট্ট ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি নাকের চুল হ্যাচকা টান দিয়ে ছিড়ে আনছেন। তারপর ওগুলোর দিকে কিছুক্ষন মহব্বতের সাথে তাকিয়ে থেকে বিরক্তির সাথে ছোড়ে ফেলে দিচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে এ কাজে ওনি বেশ মজা পাচ্ছেন। সারোয়ার সাহেব এবার কবিতা ছেড়ে গান ধরলেন। জেনে শুনে বিষ করেছি পান আমি ....। একজন পুলিশ অফিসার যে এত সুন্দর করে গান গাইতে পারে আশফাকের তা জানা ছিল না। আশফাক মনে মনে আ: বাতেন সাহেবকে একটা ধন্যবাদ দিল। আজকে তিনি তাকে এখানে ধরে নিয়ে না এলে সে এরকম একটা অবিশ্বাস্য পরিবেশ কখনোই দেখতে পেতনা। হঠাৎই গান থেমে গেল। সারোয়ার সাহেবের কন্ঠটা যেন আচমকাই কর্কষ হয়ে সপ্তমে পৌছে গেল।
-আব্দুল্লাহ.., ডিম গরম হইছে?
-ইয়েস স্যার...., ডিম রেডি স্যার...। সারোয়ার সাহেব যত দ্রুত প্রশ্ন করলেন, আব্দুল্লাহ তত দ্রুত উত্তর দিলেন।
চোখের পলকে সারোয়ার সাহেবের চোখ মুখ অন্য রকম হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মাথার দুই পাশে শিরাগুলো সামান্য ফুলে ওঠলো। কপালে সামান্য ঘাম দেখতে পেল আশফক। ওনি বিষ দৃষ্টিতে আশফাকের দিকে তাকাল। সারোয়ার সাহেবের দৃষ্টি যেন আশফাকের ভেতরটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় আশফাকের বুক ফেঁটে যাবার উপক্রম হচ্ছে যেন।
-আপনারা কয়জন ছিলেন? কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই আশফাকের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সারোয়ার সাহেব। ওনার দৃষ্টি প্রখর আর অত্যান্ত সূচালো। চোখের ভিতর দিয়ে তিনি যেন আশফাকের মগজে ঢুকে যাবার চেষ্টা করছেন। স্তব্ধ আশফাক বুঝতে পারছে না কি জবাব দিবে। এ প্রশ্নের উত্তর যে তার জানা নেই।
-বিশ্বাস করুন এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তবে গত রাত আটটার দিকে একবার মেয়েটার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সাধারণ কুশল বিনিময় হয়েছিল মাত্র।
-পাঠান সাহেব....। সারোয়ার সাহেবের কন্ঠে এবার যেন বজ্রপাতের শব্দ পেল আশফাক।
-ইয়েস স্যার.....। ততোধিক উচ্চস্বরে সাড়া দিল প্রায় সাড়ে ছ ফিট লম্বা একজন কনস্টেবল। তার নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে নকিব উদ্দিন পাঠান।
-ওনাকে নিয়ে যাও, গরম ডিম দিবার আয়োজন কর। শোন, একটা ডিমে কাজ হবে না বোধ হয়। তিনটা ডিমের ব্যবস্থা করবা।
-ইয়েস স্যার....। তাই করছি স্যার....।
সারোয়ার সাহেব এবার আ: বাতেন এর দিকে দৃষ্টি দিলেন। আ: বাতেন সাহেব তখনো নাকের চুল ছিঁড়তেছিলেন।
-আ: বাতেন সাহেব...।
-ইয়েস স্যার....। বাতেন সাহেব এবার বিদ্যুৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালেন।
- আমার বিশ্বাস এ ঘটনার সাথে অন্তত ৭/৮ জন জড়িত আছে।
- ইয়েস স্যার....., আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার...।
- হওরের পোলারা কোন গর্তে ঢুকছে দেখুন। সাড়াশি অভিযান চালিয়ে একটা একটা করে খুঁজে গর্ত থেকে টেনে বের করার ব্যবস্থা করুন। আর শুনুন, আমি কোন অজুহাত শোনতে অভ্যস্ত নই, কথাটা মনে রাখবেন।
-জ্বি স্যার...। আমি দুই দিনের মধ্যে সবকটাকে বের করব স্যার।
-এত সময় আমার কাছে নেই। আগামী কালের মধ্যে আমি সবকটা অমানুষের বাচ্চাকে আমার সামনে দেখতে চাই। ও হ্যা, থানায় পৌছানোর আগেই জিপের মধ্যে ওদেরকে কিছু গরম নাস্তার করিয়ে তবেই আনবেন। ওদের চেহারা মোবারকে আমি যেন আদর আপ্পায়নের আলামত দেখতে পাই।
-ইয়েস স্যার...., তাই হবে স্যার...।
- ওনাকে কি রাস্তায় আদর দিয়েছিলেন? আশফাকের দিকে তাকিয়ে বললেন সারোয়ার সাহেব।
- নো স্যার..., আপনার নিষেধ ছিল স্যার..।
- আচ্ছা এখন যান, তিনটা ডিম রেডি করুন। এমপি সাহেবের সাথে একটু কথা বলেই আমি আসছি।
সারোয়ার সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই ওনার মোবাইলটা গান গেয়ে ওঠলো- ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া.....।
-হ্যালো....। আসসালামু আলাইকুম স্যার।
- সারোয়ার সাহেব কেমন আছেন? ওপাশ থেকে মাননীয় এমপি মহোদয় মিষ্টি কন্ঠে কথা বলছেন।
- জ্বি, আলহামদুল্লিাহ, ভাল আছি স্যার।
- নতুন কেসটার কতদূর কি হলো?
- জ্বি স্যার, একজনকে ধরা হয়েছে। বাকীরাও ধরা পরে যাবে স্যার।
- দেখবেন কোন নিরপরাধী যেন কষ্ট না পায়।
- জ্বি স্যার, অবশ্যই স্যার।
- আমার দলের কোন ছেলে ছোকড়া এসবের সাথে জড়িত আছে কি-না খবর নিয়ে দেখুন।
- জ্বি স্যার, থাকলে কি করবো স্যার...?
- যদি থাকে, আপনি যদি সঠিক প্রমাণ পান, তবে অন্যদের তুলনায় দশটা ডিম বেশি দিবেন।
- জ্বি স্যার..., শোনে ভাল লাগলো স্যার।
- আর শুনুন..., আমার ধারনা এই কাজে দলীয় কোন না কোন ছেলে অবশ্যই জড়িত আছে। বিরুধী দলের কোন পোলাপানের এত সাহস হবার কথা নয়।
- ইয়েস স্যার, আমি তদন্ত করে আপনাকে জানাবো স্যার।
- না, এ ব্যাপারে আমার সাথে আপনার আর কিছু বলার দরকা নেই, আমিও কোন কারনে এ বিষয়ে আপনাকে কিছু বলবো না। আপনার উপড় আমার বিশ্বাস আছে। আপনি আপনার মতো করে তদন্ত করুন। কারো কোন অনুরোধ শোনবেন না। আমি চাই এসব অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। ফোন রাখছি এখন।
- ইয়েস স্যার, তাই হবে স্যার।
সারোয়ার সাহেব ফোনটা পাঠান সাহেবের হাতে দিয়ে চেয়ারে বসলেন। ওনার মুখে তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন-
-আ: বাতেন সাহেব...।
- ইয়েস স্যার..।
- আজ রাতেই আপনি অভিযান চালাবেন। আমি আপনাকে বলে দিবো কোথায় কোথায় যাবেন। এই থানার সব কটা গর্তই আমার নখদর্পণে। তার আগে ইনফরমার টেরগা শাকিলকে একটা খবর দিবেন। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।
- ইয়েস স্যার.., টেরগাটাকে দুই তিন দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।
- তাহলে ওই হওরের পোলাডারেই আগে গর্ত থেকে টেনে বের করার ব্যবস্থা করুন।
- ইয়েস স্যার..., এই বদের বাচ্চাটাকে এখনই কি ডিম দেয়ার ব্যবস্থা করব স্যার? আশফাকের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললেন আ: বাতেন সাহেব।
- এক হালি ডিম রেডি করুন। রাত নয়টায় আমিই ওর যত্ন নেব। আপনারা ওকে কিছুই বলবেন না। এখন যান।
আশফাক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনছিল আর নিজের কপালে কি আছে তাই ভাবতেছিল। বিষয়টা সুবিধার মনে হচ্ছে না। ওসি সাহেবের কথার মধ্যে কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ ওর গায়ে হাত তুলেনি কিন্তু কতক্ষন এভাবে চলবে বলা যাচ্ছে না। আ: বাতেন সাহেবতো তাকে রোড ডলা দেওয়া জন্য হাতে তেল মেখে রেডি হয়েই আছেন। শুধু হুকুমের অপেক্ষা মাত্র। পাঠান সাহেবও মাঝে মধ্যে ঝাঁঝালো দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছেন যেন যে কোন সময় তাকে চিবিয়ে চিবিয়ে কাঁচাই খেয়ে ফেলবেন। সারোয়ার সাহেবকে ছাড়া বাকী সবাইকে এক একটা শকুন মনে হচ্ছে আশফাকের কাছে। নিজেকে মনে হচ্ছে ভাগাড়ে পরে থাকা মরা গরু। সবকটা শকুন যেন তাদের দল-নেতার অঙ্গুলি নির্দেশের অপেক্ষা করছে। নির্দেশ পেলেই তাকে ছিঁড়ে খোবলে খাবে।
রাত নয়টা বাজে। কিছুক্ষন আগেই আশফাককে রাতের খাবার দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট দুটি রুটি। জেলখানায় মনে হচ্ছে বড় রুটি বানানোর নিয়ম নেই। সাথে বিশ্রী রঙের দেখতে মসুরের ডাল। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে অবশ্য পাঠান সাহেব তাকে ভাত খেতে দিয়েছিলেন। সাথে ছিল পাঙ্গাস মাছের তরকারী। প্রচন্ড দুশ্চিন্তার কারনে আশফাক খেতে পারেনি। মুখ ভরে থুতু আসছিল শুধু। এখন ওগুলো আশফাক খুব মজা করেই খেয়েছে। তবে আরো দুটো রুটি হলে বেশ ভাল হতো।
আশফাকের খাওয়া শেষ হতে না হতেই পাঠান সাহেব সেলের তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। তার চোখ থেকে যেন ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে। সে আগুন যে কোন মূহুর্তে আশফাককে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবে।
-চলুন, আপনাকে ডলা দেওয়ার সময় হইছে। অনেক সুখ করে রুটি খাইছেন, এবার ডলা খাইবেন।
আশফাক কোন কথা না বলে জনাব পাঠান সাহেবকে অনুসড়ন করল। আশফাককে নিয়ে পাঠান সাহেব একটা অন্ধকার রুমে ঢুকল। কেউ না বলে দিলেও আশফাক বেশ বুঝতে পারছে যে, এটাকেই টর্চার সেল বলা হয়। বিদঘুটে অন্ধকার যেন ঢেলে দেওয়া হয়েছে রুমটাতে। নিজের শরীরটাও দেখা যাচ্ছে না। ক্রিমিনালদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশই বটে। রুমে ঢুকতে গিয়ে একটা চেয়ারের সাথে হোঁচট খেল আশফাক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচন্ড তীব্র আলোতে রুমটা ভরে ওঠলো। এত আলো এর আগে কখনোই দেখেনি আশফাক। অসহ্য আলোতে চোখ জ্বলতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এমন আলো সহ্য করা বেশ কঠিন। রুমের ঠিক মাঝ খানটাতে একটা চেয়ারে একটা ছেলে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে। তার বা হাতের চারটা আঙ্গুল থেকে রক্তের ফোটা পড়ছে। ছেলেটা যে প্রায় অজ্ঞান হয়ে আছে তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। মুখ থেকে থুতু বের হচ্ছে ছেলেটার। তার সামনেই অন্য একটা চেয়ারে বসে আছেন সারোয়ার সাহেব। তিনি দরদর করে ঘামছেন। রুমের এক কোণায় একটি টেবিলে একটি ভয়েস রেকর্ডার, দুটি মোবাইল ফোন, একটি রিভালবার, বেশ কয়টি বড় মাপের সুই পরে আছে। আশফাককে সেই ছেলেটার পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে তার হাত পা বেঁধে দেওয়া হলো চেয়ারে সাথে। পাশেই একটা প্লাস্টিকের বালতিতে বিদ্যুতের হিটে পানি ফুটছে। মাথার উপরেই সেই অসহ্য আলোর লাইটটি ক্লান্তিহীন আলো ছড়াচ্ছে। মাথার মগজ গলে যাবার উপক্রম হচ্ছে আশফাকের। সারোয়ার সাহেব হাতের ঘড়িটি খুলে পাঠান সাহেবের হাতে দিলেন। পাঠান সাহেবের এক হাতে ঘড়ি আর অন্য হাতে একটা বিশেষ সাইজের লাঠি। এটাকেই সম্ভবত রুল বলা হয়। ওসি সাহেব হাতের ইশারায় পাঠান সাহেবকে চলে যেতে বললেন। পাঠান সাহেব হাতের লাঠিটি রেখে চোখের পলকে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সারোয়ার সাহেব আশফাকের সামনে বসলেন।
-তাহলে আপনি কিছুই জানেন না?
-জ্বি-না, যেটুকু জানি আপনাকে বলেছি।
-মেয়েটার সাথে কী কী কথা হয়েছিল?
-স্বাভাবিক কথা। আমি কালই ঢাকা থেকে বাড়ীতে এসেছি।
-আমি যা জানি তা বলার দরকার নাই। যা জানি না তা জানতে চাচ্ছি। আপনি বুঝতে পারছেন?
-জ্বি, পারছি। কিন্তু এর বেশি কিছু আমি জানি না। তার সাথে সাধারণ কুশল বিনিময় হয়েছিল মাত্র। আমি ঢাকা থেকে যখন বাড়ীতে আসি তখন তার সাথে দেখা হলে এরকমই কথা হয় সব সবসময়।
সারোয়ার সাহেবের হাতে বিশেষ লাঠিটা বিশেষ ভঙ্গিতে খেলা করছিল। ডান হাতে লাঠি ধরে নিজের বাম হাতের তালুতে বার বার মৃধু আাঘাত করছিলেন তিনি। একবার লাঠির দিকে একবার আশফাকের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন। এ দৃষ্টি বড় ভয়ানক দৃষ্টি।
-স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
-বলুন। মারাত্মক ধরনের ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন সারোয়ার সাহেব।
-কাল কি পূর্ণিমা?
-পূর্ণিমা দিয়ে কি হবে?
- কাল যদি পূর্ণিমা হয় তাহলে আমাকে ঘন্টা তিনেকের জন্য ছাড়তে হবে। এই অন্ধকারে থেকে সময় তারিখ ভুলে গেছি।
- ছেড়ে দেব? তোমাকে?
- জ্বি ছাড়তে হবে, পূর্ণিমার রাতে আমার গায়ে জোসনা মাখার অভ্যাস হয়ে গেছে।
- দাড়াও তোমায় পূর্ণিমা খাওয়াচ্ছি এবার।
সারোয়ার সাহেব ওঠে দাড়ালেন। আশফাকের বুকের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। প্রচন্ড পানির পিপাসা লেগেছে। নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে যেন। হঠাৎই টেবিলে রাখা সারোয়ার সাহেবের ফোনটি বেজে ওঠল। তিনি ফোনটা হাতে নিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রুমের আলোটা নিভে গেল। রুমটা ভয়ংকর অন্ধকারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এত বেশি অন্ধকার হয়ত কবরেও থাকে না। আশফাকের মনে হচ্ছে সে এখন কবরে বসে আছে। এখনি ফেরেস্তা এসে তাকে সওয়াল করবে। পাশের চেয়ারের ছেলেটির জ্ঞান ফিরেছে হয়ত। গোঙানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অতি ক্ষীন স্বরে সে তীব্র ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তার কণ্ঠ থেকে বিচিত্র এক ধরনের আওয়াজ বের হচ্ছে।
আ: বাতেন সাহেব চেয়ারে বসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন। এসময় তার অপারেশনে থাকার কথা। ওসি সাহেব কোথায় যেন বেরিয়েছেন। এজন্য তিনি অপারেশনের জন্য বের হতে পারছেন না। একা একা নিরামিষ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। কিছু একটা করা দরকার। কি করবেন তাই ভাবছেন তিনি। হঠাৎই চোখ দুটি চকচক করে ওঠলো। তিনি গজারি কাঠের বিশেষ লাঠিটি হাতে নিয়ে টর্চার সেলে চলে এলেন।
আশফাক চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে। তাকে মশা যেমন পারছে কামড়াচ্ছে। তবুও সে নড়ছে না। নড়াচড়া করলেই হাত পায়ের গিট্টুগুলো আরো বেশি টাইট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন চামড়া কেটে যাচ্ছে। চামড়া কেটে রক্ত পড়ার চেয়ে মশারা রক্ত খাক সেই ভাল। রক্তগুলো অযথায় নষ্ট হবে না তবু্ও। আ: বাতেন সাহেব রুমে ঢুকেই ভয়েস রেকর্ডারটি হাতে নিলেন। তার এক হাতে ভয়েস রেকর্ডার অন্য হাতে লাঠি। তিনি বসলেন আশফাকের সামনের চেয়ারটাতে। হাতের লাঠিটা আশফাকের থুতনিতে ঠেকিয়ে বললেন-
-চান্দু মিয়া, এবার ভালই ভালই স্বীকারোক্তি দাও, আমি রেকর্ড করে রাখি।
- আমি চান্দু মিয়া নই স্যার...। ঠোট ওল্টে বেংচি কেটে বলল আশফাক।
- কি! আমার সাথে মশকরা হচ্ছে? দাড়াও দেখাচ্ছি।
- কিছু দেখান লাগবে না স্যার...। আমি জবানবন্ধি দিচ্ছি, আপনি রেকর্ডার চালান। (সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রেকর্ডারের বোতাম চাপলেন)
- হুম, এবার বল।
-আমি এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি যে, পাগলা থানার সেকেন্ড অফিসার জনাব আ: বাতেন এর পূর্ণ সহযোগীতায় আমরা কয়েকজন মিলিয়া মিলি নামের মেয়েটাকে.....। আশফাক তার কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই আ: বাতেন সাহেব প্রচন্ড শব্দে গর্জে ওঠলেন।
- কিহ্: কি বললি শুয়ার! আমি সহযোগীতা করেছি? দাড়া বের করছি তোর তেল। তোর অনেক তেল হইছে নাহ? তোর সব তেল আইজকা আমি বের করে নিব। সেই তেল দিয়া কই মাছ ভাজব। আমার সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে! এবার বুঝ...।
আ: বাতেন সাহেব রেগে গিয়ে আশফাককে এলোপাথারী আঘাত করতে লাগলো। আশফাকের মাথায় একটা আঘাত লেগে মাথা ফেটে গেল অনেকটা। সেদিকে খেয়াল নেই আ: বাতেন সাহেবের। তিনি শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে এলোপাথারী আঘাতের পর আঘাত করে চলছেন।

# চলবে -------

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.