![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যুক্তি বিশ্বাস করিনা আমি, তবুও যুক্তি খোঁজে ফিরি।
-তুমি কাল সকালেই বাড়ি ছেড়ে চইল্লা যাবা।
-জ্বি, যাব। আরেকবার ভাবলে হতো না?
-ভাববার কিছু নেই, যেতে বলেছি যাবা।
-জ্বি যাব, তবে আপনার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে।
- না, আমার চোখ কথা বলতে পারে না। যাও সামনে থাইক্কা।
-জ্বি, তাই হবে।
ফারজানা ভাবতেই পারছেনা কেন তাকে এই শাস্তি পেতে হবে। অবশ্য সে ভাবতেও চায় না। তিনি যেতে বলেছেন সে যাবে, এটাই শেষ কথা। এখানে ভাববার কিছু নেই। তবুও জানতে ইচ্চে করছিল কেন তিনি তাকে এ শাস্তি দিতে চাচ্ছেন। নিজের ভাবনাকে মাটিচাপা দিয়ে ফারজানা রওনকের জন্য কফি বানাতে পাশের রুমে গেল। রওনক খাওয়া শেষে হাত ধুওয়ার জন্য ওঠে বেসিনে গেল। তিন মিনিটের মাথায় ফারজানা কফির মগ হাতে নিয়ে পুনরায় রুমে ঢুকল। রওনক রাতের খাবার খাওয়ার পর বিশাল সাইজের মগ দিয়ে এক মগ কফি খায়। কখনো তার ব্যতিক্রম হয় না। আজও হবে না। রওনক ফারজানার হাত থেকে কফির মগ নিয়ে তাতে চুমুক দিল। আশ্চর্য! আজকের কফিটা যেন অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে স্বর্গীয় স্বাদ ঢেলে দেয়া হয়েছে কফির মগে। এরকম কফি এক মগ খাওয়া উচিত নয়। দ্বিতীয়বার ফারজানাকে কষ্ট দিতেও ইচ্ছে হলো না তার। সে ইজি চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল। ফারজানা তার পিছনে দাঁড়িয়ে আলতো করে মাথার চুল টেনে দিচ্ছিল। ফারজানার এই কাজগুলো রওনক মারাত্মক রকমের উপভোগ করে। তারপরও মেয়েটার দাড়িয়ে থাকা তার সহ্য হয় না। কোথায় যেন কষ্ট হয় ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলে। কফি শেষ করে মগটা ফারজানার হাতে দিয়ে বলল-
-যাও শুয়ে পরগে, অনেক রাত হলো।
-আজকে আপনার সাথে শুই?
-না, তোমার রুমে যাও।
ফারজানা বাক্যব্যয় না করে কফির মগ হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই রওনকের অন্তরাত্মা লজ্জাবতি পাতার মতো চুপসে গেল। এই ব্যপারটা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কেন? সে কি আরেকবার এ রুমে থাকতে চাইতে পারতো নাহ? আরেকবার জোড় দিয়ে কি বলতে পারতো না যে, সে এ রুমেই ঘুমাতে চায়! “আমি এ রুমেই আপনার সাথে শুব” একথাটি কি বলা যেত নাহ? এত্ত আনুগত্য কে চায় তার কাছে? যত্তসব! খিটখিটে মেজাজ নিয়ে রওনক পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ফারজানা রওনকের কাছ থেকে নিজের রুমে এসে ড্রেসিন টেবিলের সামনে বসল। আরশির ভিতরে ভেসে ওঠা নিজের প্রতিচ্ছবিটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি কি তাঁকে আরো বেশি করে ভালবাসতে পারো নাহ? তুমিতো বুঝেছিলে- সে তোমাকে তার কাছেই থাকতে বলেছিল- তবে চলে এলে কেন?” প্রতিচ্ছবি জবাব দিল- “আমি তাঁর অনুগত, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তাকে ভালবাসতেও পারি নাহ”। কারো হাসির শব্দ কানে আসতেই ফারজানার ভাবনা তরঙ্গ থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তাকে একা একা কথা বলতে দেখে কাজের মেয়েটা খিল খিল করে হাসছে। সে কাজের মেয়েকে ডেকে কাছে বসিয়ে বলল-
-আমি কিছুদিন বাড়ীতে থাকব না, দেখিস সাহেবের কোন সমস্যা না হয় যেন। তোকে আমি সবই শিখিয়েছি। সকালে নাস্তা না করিয়ে অফিসে যেতে দিবিনে। পোশাক চেঞ্জ করে পড়তে ওনি ভুলে যান। না বলে দিলে একসেট পোশাক পরেই দিনের পর দিন অফিসে যাবেন। তুই মনে করে প্রতিদিন পোশাক পাল্টে যেতে বলে দিস। রাতে অফিস থেকে ফিরে এসেই ওনি গরম পানি দিয়ে গোসল করেন। গরম পানির ব্যবস্থা করে দিস, বুঝেছিস?
- জ্বি, বুঝবার পারছি আম্মা। তয় আপনে যাইবেন কনে?
-সে তোর না জানলেও চলবে। তোকে যা যা বললাম- মনে থাকে যেন। এবার যা শুয়ে পড়গে।
জ্বি আম্মা বলে, পদ্ম চলে গেল নিজের রুমের দিকে। পদ্ম এ বাড়ীর কাজের মেয়ে। সে অত্যান্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সব সময়। রওনক আর ফারজানকে সে পিতা-মাতার মতোই মনে করে। দুজনের কান্ড কারখানা দেখে সে মাঝে মধ্যেই একা একা হাসে। কিছুক্ষন আগেও হেসেছিল ফারজানাকে একা একা কথা বলতে দেখে।
সকালে কাজের পদ্মর ডাকে রওনকের ঘুম ভাঙল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে সে তাকিয়ে দেখলো- পদ্ম টুথব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তার মেজাজটা হঠাৎই বিগড়ে গেল। আশ্চর্য! পদ্মর হাত দিয়ে আজকাল আমার সেবা করানো হচ্ছে! রাগটাকে প্রকাশ না করে শান্ত কন্ঠে বলল- তোর মা কি করছেন রে, তুই এলি যে?
- মাকে তো কাল আপনিই চলে যেতে বললেন। মা ভোরেই চলে গেছেন।
রওনকের মনে হলো- তার কানে কেউ যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই তার গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল। নিজেকে শান্ত করে পদ্মর হাত থেকে পেস্ট আর টুথব্রাশ নিয়ে বলল- ঠিক আছে তুই যা, নাস্তা রেডি করগে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিতে যেতেই একটা কাগজ চোখে পড়ল। কাগজটি যথাস্থানে রেখে দিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়াল রওনক।
চার বছর হলো রওনক আর ফারজানার বিয়ে হয়েছে। ফারজানা মনে করে তাদের দুজনের মধ্যে চমৎকার একটা ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে এতদিনে। অন্যদিকে রওনক মনে করে স্ত্রী হিসাবে ফারজানার তার কাছ থেকে আরো অনেক বেশি ভালবাসা পাওয়া উচিত। যতটা ভালবাসা ফারজানাকে তার দেয়া উচিত ততটা সে দিতে পারছেনা। অফিসের নানা ঝামেলার জন্য সে তাকে ঠিকমত সময় দিতে পারছে না, ইত্যাদি। ফারজানা দুই বছর আগে একবার বাচ্চার মা হবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু রওনক রাজি হয়নি। এত তাড়াতাড়ি তাদের দুজনের মধ্যে অন্য কেউ এসে মাঝখানে শুবার জায়গা নেবে- এটা রওনক মানতে চায়না। আজব সব ভাবনা তার। ফারজানাও দ্বিতীয়বার কিছু বলেনি। এভাবেই চলছে জীবন।
রওনক মাঝে মধ্যেই ওর সাথে ঝগড়া করে। সামান্য করনেই রাগ করে সে। রাগ করে দুজন দুই বিছানায় সারা রাত গড়াগড়ি খায়। একজনের চোখেও সেদিন ঘুম আসে না। ইলেক্ট্রিক আলোর নিচে, দুজন দুই রুমে সারা রাত পায়চারী করে প্রভাত ডেকে আনে। ঐ রাতগুলোও ভীষণ লম্বা হয়। কাটতে চায়না সহজে। গেল বছর শীতের সময় এক রাতের বেলায়। ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া নিয়ে ঝগড়া করল রওনক। ফারজানাকে বাপের বাড়ী চলে যেতে বলল সে। ফারজানাও চলে গেল সকালেই। পঞ্চম দিন রাতে ফারজানা খবর পেল- রওনক ডিম ভাজতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে। পরদিন কাক ডাকা ভোরে ফারজানা চলে এসেছিল।
আজ আবার রওনক তাকে চলে যেতে বলেছে। তেমন কোন কারন নেই। রাতে রওনক তাকে কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ পড়তে বলেছিল। ঘরে কম করে হলেও পাঁচ শতাধিক কালো ছোট্ট টিপ থাকার কথা। রওনক তাকে মাঝে মধ্যেই কালো ছোট্ট টিপ কিনে দেয়। অথচ সে অনেক খোঁজে কালো ছোট্ট একটি টিপও পায়নি। কাজের সময় কোন জিনিসই ঠিকঠাক জায়গায় পাওয়া যায় না। টিপ খোঁজে না পাওয়ার অপরাধে রওনক তাকে নির্বাসন দন্ড দিয়েছে। সেও বিনা শর্তে, বিনা দ্বিধায় দন্ড মাথায় নিয়ে চলে গেছে। যাবার বেলায় কাজের মেয়েটাকে খুব করে বলে দিয়ে গেছে- সাহেবের যেন অযত্ন না হয়। এই হলো তাদের দুজনার জীবন। এই তাদের ভালবাসা।
ফারজানা বাড়ী ছেড়েছে আজ সপ্তম দিন হলো। এর মধ্যে বাড়ীর চেহারা ছবিতে পরিবর্তণ না এলেও তার নিজের চেহারা সুরতে পরিবর্তণ এসেছে মেলা। কাঁচা পাকা দাড়িগুলো গালের মধ্যে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছে। চোখের নিচে কালী পড়তেও সময় লাগবে না আর। মাথার চুলগুলোও ভেড়ার গায়ের পশমের মতো হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। অরুচি ধরেছে খাবারেও। দুপুরে খেতে বসেই মনে মনে ভাবলো- অনেক হয়েছে শাস্তি পাওয়া। এবার ওকে ডেকে নেয়া দরকার। কোথায় যে গেছে, তাও সে জানে না। হঠাৎই বালিশের নিচে থাকা সেদিনের কাগজটার কথা মনে পড়লো তার। সেই কাগজে নিশ্চয় লিখা আছে। খাবার প্লেটে হাত ধুয়ে, নিজের রুমে এসে কাগজটি খোঁজে চোখের সামনে মেলে ধরলো। গুটি গুটি অক্ষরে ফারজানা লিখেছে, সম্বোধনহীন চিঠি-
কি বলে শুরু করা উচিত ছিল বুঝতে পারিনি। তাই সম্বোধন ছাড়াই শুরু করতে হলো। আমি জানি এ চিঠি আপনি সহজে খুলবেন না। যেদিন নিজের উপড় অসহ্য রকমের বিরক্ত হবেন- সেদিনই এ চিঠির কথা আপনার মনে পড়বে।
আপনি আমাকে সকালে চলে যেতে বলেছেন, ঠিক সময়টা বলেননি। সূযোর্দয়ের সাথে সাথেইতো সকাল হয় জানি। এজন্য সূযোর্দয়ের ক্রান্তি লগ্নেই আমাদের (আপনার) গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে পথ ধরলাম। অনেক ইচ্ছা ছিল আপনাকে নিয়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়ীতে থাকবো। তা আপনাকে বলা হয়ে ওঠেনি কখোনো। এবার যখন আপনার মৌখিক (আত্মিক নয়) অনুমতি পাওয়া গেল- তখন ভাবলাম একবার একলাই না হয় ঘুরে আসি। আমি জানি সেখানে আমার অমর্যাদা বা অবহেলা হবে না। তাই আপনার মঙ্গল কামনা করে নির্ভয়ে সেখানকার উদ্দেশ্যেই বাসা থেকে বের হলাম। আমার জন্য আশির্বাদ করবেন- যেন আপনাকে ছেড়ে থাকার কষ্টগুলো সহ্য করতে পারি।
আপনি যখন আমাকে চলে যেতে বললেন, আমি তখন আপনার চোখে অন্য কিছু দেখে ছিলাম। আপনার চোখ বলেছিল- তুমি যেও না যেন, তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। বুঝে ছিলাম আমি সে চোখের আকুতি কিন্তু কি করবো বলুন! আমি আপনার চোখের কথা শুনি মন দিয়ে, মুখেরটা শুনি কান দিয়ে। চোখের কথা উপলব্ধি করি মন থেকে। আর মুখের কথাগুলো পালন করার চেষ্টা করি শরীর দিয়ে। বিশ্বাস করুন- আমি যাচ্ছি শুধু আমার শরীটা নিয়ে, মনটা পড়ে থাকবে আপনার কাছেই।
আমি আপনাকে ভালবাসি। এজন্য আপনার ভাল, মন্দ- সব চাওয়ার গুরুত্ব আমার কাছে সমান। আমি আপনার দাসী নই, অনুগতা। আপনার মুখের প্রতিটি কথাই আমার জন্য অবশ্যই পালনীয় বলে আমি জানি। আমার জন্য কষ্ট হলেও তা মানতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে মনে কষ্ট থাকে এজন্য যে, কষ্ট আমি একা পাইনে, আপনি তার চেয়ে বেশিই পান। যাহোক, ভাল থাকবেন। আমার আপনার শাস্তি পাওয়া শেষ হলে- যে কাউকে দিয়ে খবর দিলেই আমি চলে আসবো। আমি অহর্নিশী আপনার ডাকের অপেক্ষায় থাকবো।
-ইতি আপনার অনুগতা, আপনার স্ত্রী ফারজানা।
চিঠি পড়া শেষ করে রওনক পদ্মকে ডাকলো। পদ্ম মাথা নিচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রওনক বুঝতে পারছে- এই মেয়েটাও ফারজানার অভাব মেনে নিতে পারছে না। সে বলল-
- তোর মায়ের ড্রেসিন টেবিলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আমার রুমে নিতে হবে। দুজন লোক ডেকে নিয়ে আয়। আর শোন..., আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, বিকেলে তুই তোর মাকে আনতে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে যাবি। অনেক হইছে। এবার ....। রওনক তার কথা শেষ করার আগেই পদ্ম রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে......
©somewhere in net ltd.