![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইসলামের ইতিহাসে ‘খিলাফত (Caliphate)’ একটি শক্তিশালী প্রতীক—ন্যায় ও ঐক্যের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবতা কঠোর: ক্ষমতার নির্মম লড়াই, শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের রক্তাক্ত শিকড় এবং অকল্যাণের কালো ইতিহাসে ভরা।
৬৩২ সালে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ‘খলিফা’—নবীর উত্তরসূরি—হিসেবে মুসলিম উম্মাহকে শাসনের জন্য এটি গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, জ্ঞানের স্বর্ণযুগ এনেছে, কিন্তু লাখো প্রাণের মূল্যে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ধর্মের চেয়ে নেতৃত্ব ও আর্থ-রাজনৈতিক আধিপত্যের সংঘর্ষ। আধুনিক যুগে আইএসআইএস-এর মতো গোষ্ঠী এই নামকে ধ্বংসের প্রতীকে রূপান্তরিত করেছে।
কালানুক্রমিক ইতিহাস
১. ৬৩২-৬৬১: রাশিদুন খিলাফত—নেতৃত্বের প্রথম রক্তাক্ত ফাটল
৬৩২ সালে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু। সাকিফা সভায় আবু বকর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন। সুন্নিরা এটিকে ঐকমত্য মনে করে; শিয়ারা আলী (রা.)-কে নেতা চায়, গাদির খুমে নবীর বক্তব্য তাদের যুক্তি। রিদ্দা যুদ্ধে (৬৩২-৬৩৩) হাজার হাজার বিদ্রোহী নিহত হয়—ঐক্যের জন্য রক্তের মূল্য।
৬৩৪ সালে উমর (রা.) ক্ষমতায়। ইয়ারমুক (৬৩৬) ও কাদিসিয়া (৬৩৬-৬৩৭) যুদ্ধে লাখো মানুষ মারা যায়; সিরিয়া, পারস্য, মিশর দখল হয়। তিনি প্রশাসন গড়েন, কিন্তু ৬৪৪ সালে হত্যা অস্থিরতা নিয়ে আসে। ৬৪৪ সালে উসমান (রা.) পবিত্র আল-কোরআন সংকলন করেন। কিন্তু দুর্নীতি ও পক্ষপাতের অভিযোগে ৬৫৬ সালে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শিয়ারা এটিকে সুন্নি শাসনের ব্যর্থতা মনে করে।
৬৫৬ সালে আলী (রা.) ক্ষমতায়। জামাল (৬৫৬) ও সিফফিন (৬৫৭) যুদ্ধে ৭০,০০০ মুসলিম নিহত। মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে এই সংঘর্ষ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের রক্তাক্ত শুরু। ৬৬১ সালে আলী (রা.)-এর হত্যা। সুন্নিরা এ যুগকে গৌরবের মনে করে; শিয়ারা ন্যায় হারানোর ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখে।
২. ৬৬১-৭৫০: উমাইয়া খিলাফত—বংশগত নির্মমতা ও কারবালার ক্ষত
৬৬১ সালে মুয়াবিয়া (রা.) উমাইয়া খিলাফত গড়েন। নির্বাচন ভেঙে বংশগত শাসন চালু করে তারা স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া জয় করেন। শিয়ারা এটিকে আলী (রা.)-এর বংশের অধিকার কেড়ে নেওয়া মনে করে।
৩. কারবালার ঘটনা (৬৮০)
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ ক্ষমতায়। হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের শাসনকে অবৈধ মনে করে কুফায় যান। ৬৮০ সালের ১০ মুহাররম, করবালায় তাঁর ৭২ সঙ্গী (পরিবারসহ) ৪,০০০ সৈন্যের মুখোমুখি হন। তিন দিন পানি বন্ধ করে তাদের দুর্বল করা হয়। হুসাইন (রা.)-কে তীর-তলোয়ারে হত্যা, তাঁর শিরোচ্ছেদ করে দামেস্কে প্রদর্শন করা হয়। তাঁর শিশুপুত্র আলী আসগর গলায় তীর খেয়ে মারা যায়। নারী-শিশুদের বন্দী করে নির্যাতন করা হয়।
সুন্নিরা এটিকে রাজনৈতিক প্রয়োজন মনে করে; শিয়ারা এটিকে নেতৃত্বের অধিকার ছিনতাই ও নৃশংসতার চিহ্ন হিসেবে দেখে। এটি শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে চিরস্থায়ী করে।
৭৫০ সালে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের ধ্বংস করে; হাজার হাজার মানুষ মারা যায়।
৪. ৭৫০-১২৫৮: আব্বাসীয় খিলাফত—জ্ঞানের উত্থান, রক্তাক্ত পতন
৭৫০ সালে আব্বাসীয়রা বাগদাদ থেকে শাসন শুরু। ‘হাউস অব উইজডম’ বিশ্ব সভ্যতাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু শিয়ারা তাদের প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তারা আলী (রা.)-এর বংশের পরিবর্তে আব্বাস বংশকে ক্ষমতায় বসায়। শিয়া ফাতিমীয়রা (৯০৯-১১৭১) উত্তর আফ্রিকায় পৃথক খিলাফত গড়ে। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলরা বাগদাদ ধ্বংস করে; ২,০০০,০০০ মানুষ নিহত, টাইগ্রিস রক্তে লাল হয়। খিলাফত মিশরে নামমাত্র চলে।
৫. ১৫১৭-১৯২৪: অটোমান খিলাফত—শক্তির চূড়া, করুণ পতন
১৫১৭ সালে অটোমানরা খিলাফত গ্রহণ করে। তাদের সুন্নি পরিচয় শিয়া সাফাভিদের (ইরান) সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। চালদিরান যুদ্ধে (১৫১৪) হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯২৪ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক খিলাফত বিলুপ্ত করেন। এটি মুসলিম বিশ্বে শূন্যতা তৈরি করে, জাতীয়তাবাদ ও বিভক্তির জন্ম দেয়।
৬. ৬৯১-২০১৯: খিলাফতের নামে অকল্যাণকারীদের কালো ইতিহাস
(ক) হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (৬৯১-৭১৪): উমাইয়া গভর্নর। মক্কায় হামলা করে কাবা ক্ষতিগ্রস্ত করে; হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে। বক্তব্য: “বিদ্রোহ দমন শাসনের জন্য।” তাঁর নৃশংসতা মুসলিমদের মনে ভয় জাগায়।
(খ) ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া (৬৮০): কারবালায় হুসাইন (রা.)-কে হত্যা। অবস্থান: “বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করা শাসনের অধিকার।” এটি শিয়াদের মনে চিরস্থায়ী ক্ষোভ বপন করে।
(গ) আল-কায়েদা (১৯৮৮-বর্তমান): ওসামা বিন লাদেন ৯/১১ হামলায় ৩,০০০ মানুষ হত্যা করে। বক্তব্য: “পশ্চিমা শক্তি ধ্বংস করে খিলাফত ফিরবে।” তাদের সন্ত্রাস বিশ্বে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
(ঘ) আইএসআইএস (২০১৪-২০১৯): আবু বকর আল-বাগদাদি খিলাফত ঘোষণা করে ৩৩,০০০ মানুষ হত্যা করে। বক্তব্য: “শিয়া ও কাফেরদের নিশ্চিহ্ন করে খিলাফত গড়ব।” তাদের শিরোচ্ছেদ ও গণহত্যা মুসলিমদের মনে ঘৃণা ও ভয় জাগায়।
(ঙ) হিজব-উত-তাহরির (১৯৫৩-বর্তমান): অহিংসভাবে খিলাফত চায়। বক্তব্য: “খিলাফতই মুসলিমদের মুক্তি।” তাদের প্রচারণা উত্তেজনা তৈরি করে।
এরা সবাই ধর্মের নামে ক্ষমতার লোভে ধ্বংস ডেকে এনেছে।
খিলাফতের বৈশিষ্ট্য সমূহ কি কি?
খিলাফত ছিল শরিয়ার শাসন, সামরিক জয় ও সমাজকল্যাণের সমন্বয়। কিন্তু আদর্শ (ন্যায়, ঐক্য) বাস্তবে রক্তপাত ও দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে।
যুদ্ধের রক্তাক্ত তালিকা
(ক) রিদ্দা (৬৩২-৬৩৩): হাজার হাজার মৃত
(খ) ইয়ারমুক (৬৩৬): ৪০,০০০ মৃত
(গ) কাদিসিয়া (৬৩৬-৬৩৭): হাজার হাজার মৃত
(ঘ) নিহাওয়ান্দ (৬৪২): ৩০,০০০ মৃত
(ঙ) প্রথম ফিতনা (৬৫৬-৬৬১): ৮০,০০০ মৃত
(চ) কারবালা (৬৮০): ৭২ শহীদ
(ছ) চালদিরান (১৫১৪): হাজার হাজার মৃত
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব: ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব নেতৃত্বের সংঘর্ষে শুরু। সুন্নিরা সাকিফাকে ন্যায্য মনে করে; শিয়ারা গাদির খুমকে আলী (রা.)-এর অধিকারের প্রমাণ বলে। কারবালায় সুন্নিরা শাসনের স্থিতিশীলতার যুক্তি দেয়; শিয়ারা এটিকে নিপীড়ন মনে করে। উভয়ই রক্তপাতে জড়িয়েছে—সুন্নি উমাইয়ারা শিয়াদের দমন করেছে, শিয়া সাফাভিরা সুন্নিদের বিরুদ্ধে লড়েছে। এটি অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইকেও তীব্র করেছে—যেমন, তেল সম্পদ নিয়ে সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব।
সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব
(ক) ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮): ১০ লাখ মৃত। তেল ও ক্ষমতার লড়াই।
(খ) ইরাক গৃহযুদ্ধ (২০০৬-২০০৮): হাজার হাজার মৃত।
(গ) সিরিয়া (২০১১-বর্তমান): ৫ লাখ মৃত। শিয়া ইরান বনাম সুন্নি সৌদি।
(ঘ) ইয়েমেন (২০১৪-বর্তমান): ৪ লাখ মৃত। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বর্তমান জনসংখ্যা
• বিশ্ব: সুন্নি ৮৭-৯০%, শিয়া ১০-১৩%
• ইরান: ৯০-৯৫% শিয়া
• ইরাক: ৬০-৬৫% শিয়া
• সৌদি: ৮৫-৯০% সুন্নি
• ইয়েমেন: ৫৫-৬০% সুন্নি
খিলাফতের পতনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
১৯২৪ সালে অটোমান খিলাফতের পতন মুসলিম বিশ্বে শূন্যতা তৈরি করে। জাতীয়তাবাদ ও বিভক্তি জন্ম নেয়। সুন্নি দেশগুলো (যেমন, সৌদি) ও শিয়া দেশগুলো (যেমন, ইরান) পৃথক ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে, যা আজকের দ্বন্দ্বের মূল।
শিয়া-সুন্নি উভয়ের খিলাফত নিয়ে ভয়
সুন্নিরা ভয় করে যে খিলাফত শিয়া আধিপত্যে রূপ নেবে (ইরানের মতো); শিয়ারা ভয় পায় এটি সুন্নি শাসনের পুনরাবৃত্তি হবে (উমাইয়ার মতো)। ঐতিহাসিক রক্তপাত ও অকল্যাণকারীদের নৃশংসতা এই ভয়কে জিইয়ে রেখেছে।
খিলাফত ফিরে আসার মানসিক দ্বন্দ্ব
সুন্নিরা খিলাফতকে গৌরবের প্রতীক মনে করে; শিয়ারা নিপীড়নের ছায়া দেখে। হাজ্জাজ, ইয়াজিদ, আইএসআইএস-এর কলঙ্কিত ইতিহাস প্রশ্ন তুলেছে—এটি কি শান্তি আনবে, নাকি রক্তের নদী বইবে? জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এটিকে আরো অবাস্তব করে তুলেছে।
খিলাফত ন্যায় ও ঐক্যের আদর্শ ছিল, কিন্তু বাস্তবে এটি ক্ষমতার নির্মম খেলা। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ধর্মের চেয়ে আর্থ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে গড়ে উঠেছে। অকল্যাণকারীরা এর নাম কলঙ্কিত করেছে। এই ইতিহাস লাখো প্রাণের রক্তে লেখা—একটি কঠোর সত্য যা আজকের বিশ্বকে বোঝায়।
সূত্র
১. Kennedy, Hugh. The Prophet and the Age of the Caliphates. Routledge, 2015
২. Lapidus, Ira M. A History of Islamic Societies. Cambridge University Press, 2014
৩. Hitti, Philip K. History of the Arabs. Palgrave Macmillan, 2002
৪. “Battle of Karbala.” Al-Islam.org, http://www.al-islam.org
৫. “ISIS and the Caliphate.” BBC News, http://www.bbc.com, 2014
৬. Pew Research Center. Mapping the Global Muslim Population, 2009
৭. Nasr, Vali. The Shia Revival. W.W. Norton, 2007
২| ১৩ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৩:৩০
কামাল১৮ বলেছেন: ঐতিহাসিক ঘটনাবলির কোন নিরপেক্ষ প্রমান নাই।যা আছে সবই মুসলমানদের লেখা।
৩| ১৩ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪১
নতুন বলেছেন: ধর্ম মানুষকে নিয়ন্ত্রনের আরেকটা টুলস মাত্র।
রাস্ট নায়ক/সমাজপতিরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে মানুষকে একটা ছাতার নিচে বেধে রাখতে।
৪ খলিফার মাঝে ৩ জনকেই হত্যা করেছে ততকালীন মানুষেরা। যুদ্ধ, ক্ষমতার লড়াই, দন্দের মাঝে এগিয়েছে ইতিহাস।
সাধারন মানুষ শুধুই ধর্মের আফিমকে বুদ হয়ে থাকে। রাজনিতিকরা ফয়দা লুটে।
ফিলিস্তিনে হামাসের আক্রমন আর বর্তমানের হত্যার মিশন কতদিন হয়ে গেলো? কিন্তু বাংলাদেশে এখন কেন এত বড় মিছিল?
আর যেইসব নেতারা এখন বেশি জজবা দেখাচ্ছে তারা সত্যিকারের কতটুকু সাহাজ্য করছে ফিলিস্তিনিদের?
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:৫১
এইচ এন নার্গিস বলেছেন: ভালো লিখেছেন