নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের আয়নায় বিটকয়েন: অনিশ্চয়তার গাণিতিক রূপ

০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:৪৯



আপনি নিশ্চয়ই ‘Chaos Theory (বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব)’-এর নাম শুনেছেন, এমনকি এর মূল ধারণা সম্পর্কে কিছুটা জানাও থাকতে পারে। তবে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করা জরুরী: বাটারফ্লাই ইফেক্ট (Butterfly Effect) এবং বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব একই জিনিস নয়। বাটারফ্লাই ইফেক্ট আসলে বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের একটি মৌলিক উদাহরণ বা প্রকাশমাত্র, যা এই তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই উদাহরণে দেখানো হয়, কীভাবে একটি ক্ষুদ্র ও স্বল্পপ্রভাবশালী ঘটনা (প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো) সময় ও স্থানের সাথে জটিলভাবে বিবর্ধিত হয়ে একটি বিশাল প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে (যেমন: যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড়)।

বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের মূল কথাই হলো—ডিটারমিনিস্টিক সিস্টেমে (যেখানে নিয়ম আছে) অপ্রত্যাশিত আচরণ। এটি গণিত ও বিজ্ঞানের একটি শাখা, যা প্রমাণ করে যে প্রাথমিক শর্তের প্রতি অতি সংবেদনশীলতা (Sensitive Dependence on Initial Conditions) এবং নন-লিনিয়ার ডাইনামিক্স-এর কারণে সরল নিয়মও জটিল ও অনিশ্চিত ফল তৈরি করতে পারে। বাটারফ্লাই ইফেক্ট এই তত্ত্বেরই একটি চমকপ্রদ দিক, যেখানে ক্ষুদ্র পরিবর্তনের প্রভাব অনুমান করা যায় না বলেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে (আবহাওয়া, অর্থনীতি, শেয়ার বাজার, জনসংখ্যার গতিবিধি, জীববিজ্ঞান) এর প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।

এই তত্ত্ব বোঝার জন্য ‘বিটকয়েন (Bitcoin)’ হতে পারে একটি আদর্শ উদাহরণ!

ধরুণ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তনে বিটকয়েনের মূল্য ব্যাপক বাড়তে পারে। কিন্তু ঐ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে বিটকয়েনের মূল্যে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। এতে পুনরায় বিটকয়েনের মূল্য আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারে বা কমে যেতে পারে অথবা আরো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতেও পারে।

এই পর্যন্ত সরকার পরিবর্তন ও সরকারের পদক্ষেপে আমি ধরে নিচ্ছি, বিটকয়েনের মূল্য বেড়ে গেল। কিন্তু যে মুহুর্তে বেড়ে গেল ঠিক ঐ মুহুর্ত থেকে বিটকয়েনের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে না। কখনো মূল্য বাড়বে তো কখনো মূল্য কমবে।

এরপর, আমি পুনরায় ধরে নিচ্ছি, বিটকয়েনের মূল্য কমে গেছে কিন্তু সময় সময় বাড়ছেও। হঠাৎ একজন বিলিয়নিয়ার অনেকগুলো বিটকয়েন ক্রয়ের ফলে বিটকয়েনের মূল্য একটু বৃদ্ধি পেয়ে ঐ সুনির্দিষ্ট জায়গা থেকে কমতে ও বাড়তে শুরু করতে পারে। আবার একটি স্থিতিশীলতা ধরে রাখতেও পারে। কারণ যখন মূল্য বাড়ছে তখন আরো বিলিয়নিয়ার বিটকয়েন ক্রয় করতে পারেন। এখানে একধরণের চরম রান্ডমনেস কাজ করবে। আপনি চাইলেও এই জগতে একটি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পাবেন না।

এখন যেহেতু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেহেতু অনেক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ তুলে নেবার ঘটনাও ঘটতে পারে। এবং তারা অন্য মার্কেটে চলে যেতে পারেন। এর ফলে বিটকয়েন নিজেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং নতুন একটি ব্যবস্থা বা অন্য কোন কয়েনের দিকে বাজার ঝুঁকতে পারে।

যখন বাজার ধ্বংসের দিকে এগোয়, তখন কিছু বিনিয়োগকারী ছোট ছোট ওঠানামা (মাইক্রো-ফ্লাকচুয়েশন) থেকে লাভের চেষ্টা করেন। এই অবস্থাকে ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে মূল্যের চার্টে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বিভিন্ন সময়সীমায় (টাইমফ্রেমে) পুনরাবৃত্ত হয়। যেমন: ১ ঘন্টার চার্টে যে ‘সাপোর্ট-রেজিস্ট্যান্স’ দেখা যায়, সপ্তাহের চার্টেও একই প্যাটার্ন লক্ষ্য করা সম্ভব। যারা ফ্র্যাক্টালের এই স্ব-সদৃশতা (Self-Similarity) বোঝেন, তারা সম্ভাব্য মূল্যবিন্দু অনুমান করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটি দৈব বা জুয়ার মতো মনে হয়—কারণ ক্ষুদ্র সময়ের ওঠানামা দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব ফেলবে, তা অনিশ্চিত।

Chaos Theory-এর ভাষায়, এটি ডিটারমিনিস্টিক র‍্যান্ডমনেস—নিয়ম থাকা সত্ত্বেও ফলাফল অপ্রাকটিক্যাল! এখন এখান থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আরো বেশি অসম্ভব অবস্থার তৈরি করতে পারে। মানে হলো, কিছু বিলিয়নিয়ার বিটকয়েনের বাজার থেকে ছুটে গেলেও একাধিক মিলিয়নিয়ার আগ্রহ খুঁজে পেতে পারেন। এবং এই দীর্ঘমেয়াদী প্রেক্ষাপটে বিটকয়েনের মূল্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।

সর্বশেষ আমরা এমন একটি বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে পারি, যে বাস্তবতায় বিটকয়েনের মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধি আর পাবে না। একটি নির্দিষ্ট মূল্য সবসময় উপস্থিত থাকবে। কারণ কোনো ব্যবস্থা ব্যাপক বিশৃঙ্খলা মোটেই পছন্দ করে না। ঠিক আমাদের জীবনের মত। আমরা আমাদের জীবনে কেন কিছু ক্ষেত্রে হেরে যাচ্ছি এবং কিছু ক্ষেত্রে জিতে যাচ্ছি তার সবকিছু আমাদের হাতে নেই। আমরা শুধু আমাদের জীবনে পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সময় দিয়ে জীবনের সামনের সময়গুলোকে প্রভাবিত করতে পারি।

বিটকয়েনের বাজার বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের (Chaos Theory) বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে জীবন্ত করে তোলে। নিচের ফ্লো চার্টে দেখানো হলো কীভাবে এই তত্ত্বের ধাপগুলো বিটকয়েনের গতিবিধির সাথে মিলে যায়:

ফ্লো চার্ট:

১. Sensitive Dependence on Initial Conditions (প্রাথমিক শর্তের প্রতি সংবেদনশীলতা)
উদাহরণ: একটি ফেক নিউজ বা সেলিব্রিটি টুইট (যেমন: ইলন মাস্কের “Bitcoin is a good thing”) বিটকয়েনের মূল্য ২০% বাড়িয়ে দিতে পারে। চেইন রিঅ্যাকশন: এই পরিবর্তন ট্রেডারদের মধ্যে ফোমো (FOMO) তৈরি করে, বাজারকে অপ্রত্যাশিত দিকে ঠেলে দেয়।

২. Non-Linear Dynamics (অসরল গতিবিদ্যা)
উদাহরণ: সরকার বিটকয়েন নিষিদ্ধ করলে মূল্য কমার কথা, কিন্তু বাস্তবে কিছু বিনিয়োগকারী বিপদে বেশি কিনে মূল্য বাড়িয়ে দেন (Counter-Intuitive Response)।

৩. Apparent Randomness in Deterministic Systems (নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় আপাত দৈবতা)
উদাহরণ: টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের সব পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হয় যখন একটি ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট (যেমন: FTX এক্সচেঞ্জ ধস) ঘটে।

৪. Attractors and Self-Organization (আকর্ষক ও স্ব-সংগঠন)
উদাহরণ: বিটকয়েনের মূল্য বারবার $৩০,০০০-এ ফিরে আসে, কারণ ট্রেডাররা এই স্তরকে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট হিসেবে বিবেচনা করে।

৫. Bifurcation (বাইফারকেশন)
উদাহরণ: বিটকয়েন হ্যালভিং (Halving) ইভেন্টের পর বাজার সম্পূর্ণ নতুন আচরণ শুরু করে—মাইনিং রিওয়ার্ড কমে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী মূল্য প্রভাবিত হয়।

৬. Fractal Geometry (স্ব-সদৃশ জ্যামিতি)
উদাহরণ: ১ দিনের মূল্য চার্ট এবং ১ মাসের চার্টে একই ধরনের ‘পাম্প অ্যান্ড ডাম্প’ প্যাটার্ন দেখা যায় (Self-Similarity)।

৭. Long-Term Unpredictability (দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তা)
উদাহরণ: ১০ বছর আগে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি যে বিটকয়েন ৬০,০০০ ডলার ছুঁতে পারবে, আবার ৬০,০০০ ডলার ছুঁতে পারবে, আবার ১৬,০০০ ডলারে নামবে।

৮. Transient Chaos (অস্থায়ী বিশৃঙ্খলা)
উদাহরণ: ২০২২ সালের ক্রিপ্টো শীতকালে (Crypto Winter) বাজার ৭০% ধসে গেলেও ২০২৩-এ নতুন অ্যাট্র্যাক্টরে ($৩০,০০০) স্থিতিশীল হয়।

জীবনকে আমরা নিয়মিত রুটিনের মাধ্যমে সংগঠিত করতে পারি, লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও সময় দিতে পারি। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (Chaos Theory) আমাদের শেখায়, প্রাথমিক শর্তের প্রতি সংবেদনশীলতা (Sensitive Dependence) এবং নন-লিনিয়ার ডাইনামিক্সের কারণে ফলাফল অনুমানযোগ্য নয়। যেমন: একই পরিশ্রমে দুজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন ফল পেতে পারেন—কেউ সাফল্য, কেউ ব্যর্থতা। এখানে ‘স্টোইক’ দর্শনের মতোই আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয়ে মনোযোগ দেওয়াই যুক্তিযুক্ত, কারণ বাইরের অগণিত ফ্যাক্টর (অর্থনীতি, সমাজ, দুর্ঘটনা) আমাদের প্রচেষ্টাকে অপ্রত্যাশিত দিকে ঠেলে দিতে পারে।

অভিজ্ঞ মানুষেরা এই অনিশ্চয়তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলেন—তারা আশা ও নিরাশার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখেন, ঠিক যেমন বিশৃঙ্খল সিস্টেমে অ্যাট্র্যাক্টরস কাজ করে (যেমন: আবহাওয়া মডেলের পুনরাবৃত্তিমূলক প্যাটার্ন)।

‘ফ্রি উইল’ বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আমাদের কর্মকে প্রভাবিত করলেও তা চূড়ান্ত ফল নির্ধারণ করে না। এটি বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের ইনিশিয়াল কন্ডিশন-এর মতো—আমাদের পছন্দ-অপছন্দ সিস্টেমের প্রাথমিক দিক ঠিক করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কী হবে তা জটিল ইন্টারঅ্যাকশনের উপর নির্ভরশীল।

এই অনিশ্চয়তাই জীবনের গতিপথকে ‘পাল্প ফিকশন (Pulp Fiction)’ সিনেমার মতো অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট করে তোলে, যেখানে কারণ-ফলাফলের সরল সমীকরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে, বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব প্রমাণ করে—নিয়ম থাকলেও নিয়তি অনিয়মিত।

তাই জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো বা না-পৌঁছানো যতটা আমাদের হাতে, তার চেয়ে বেশি হাজারো অদৃশ্য শক্তির খেলায়…

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মে, ২০২৫ রাত ১২:০৪

নীল মনি বলেছেন: আলাপটি পড়ব বলে বুকিং দিলাম।এখন পড়লে ঘুম চলে যাবে

২| ০৪ ঠা মে, ২০২৫ সকাল ১০:১৩

রাজীব নুর বলেছেন: অর্থ্যাত নিয়তি।
সব কিছু নিয়তির হাতে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.