![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘কমফোর্ট জোন (Comfort Zone)’ কি? কেন আমাদের বারবার বলা হয়, “যদি জীবনে উন্নতি চাও, পরিবর্তন চাও তাহলে ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের হও!” অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষও ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের হয়ে জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আজকের সময়ে বিশেষ করে যারা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার আছেন তাদের সবার মুখেই কখনো না কখনো এই ‘কমফোর্ট জোন’ ছাড়ার উপদেশ শুনে থাকবেন।
আমি ভাবলাম যেহেতু দীর্ঘসময় ধরে কারো না কারো মুখে শুনছি ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরহওয়ার কথা সেহেতু আমি এই ‘কমফোর্ট জোন’ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। কারণ ‘কমফোর্ট জোন’ নামক অঞ্চল কে চিনতেই না পারলে ঐ অঞ্চল ছাড়বো কীভাবে? তাই নয় কি?
‘কমফোর্ট জোন (Comfort Zone)’ শব্দের ভালো বাংলা অর্থ হতে পারে, ‘আরামদায়ক জায়গা’, ‘সুবিধাজনক অঞ্চল’, ‘স্বস্তির ঠিকানা’ ইত্যাদি। কিন্তু সবসময় যে ‘কমফোর্ট জোন’ ছাড়বার নসিহত দেওয়া হয় সেটার ইউনিভার্সাল কোন সংজ্ঞা নাই। দেশভেদে, মানুষভেদে, সংস্কৃতি ভেদে কমফোর্ট জোন আলাদা-আলাদা হয়ে থেকে। মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও বিবর্তন বুঝতে হবে শুধুমাত্র এই একটি শব্দের জটিলতা বুঝতে।
ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি অতি সামাজিক হওয়াকে খুঁজে পেতে পারেন তার প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে এক্সট্রোভার্ট ব্যক্তি সারাদিন বাড়িতে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিতে গিয়ে খুঁজে পেতে পারেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কালেটিভিস্ট সংস্কৃতি যেমন জাপানের মানুষজন সবাই মিলে মিশে শান্তিতে থাকাকে অর্জন মনে করেন, পুরষ্কৃত করেন। ইনডিভিজুয়ালিস্টিক সংস্কৃতি যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজন ঝুঁকি গ্রহণ এবং নতুনত্বে আগ্রহ বেশি রাখেন। দেশ ও মানুষ ভেদে কমফোর্টের যে পার্থক্য তা আশা করিউপরোক্ত দুটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা।
নিউরোলজিকাল প্যাটার্নেও বিষয়টি বুঝতে হবে। কেউ কেউ গ্রামে বা শান্ত পরিবেশে ভালো কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে কেউ কেউ শহুরে ব্যস্ততা ও প্রতিযোগীতাপূর্ণ পরিবেশে ভালো কাজ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট জায়গার কোন শব্দ, বিষয়, ব্যক্তি, স্মৃতি, ঘ্রাণ ইত্যাদি একত্র হয়ে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রোডাক্টিভ হবার জন্য ট্রিগার করতে পারে। আবার ঐ একই জিনিস অন্য কাউকে ‘আন-প্রোডাক্টিভ (Unproductive)’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সাধারণত, কোলাহলপূর্ণ জায়গায় একজন ভালো লেখক থাকতে চাইবেন না। অন্যদিকে, শিল্পায়ন ও শান্ত পরিবেশ একই সাথে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
‘কমফোর্ট জোন’ একটি ধারণা মাত্রা। কমফোর্ট জন নামক নির্দিষ্ট কোন ফিজিক্যাল অবস্থান নাই। আবার এই ধারণার নেই কোন বাউন্ডারি। সৈনিকদের মধ্যে যুদ্ধে শক্রুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে জীবন যেমন নিতে পারেন তেমনি দিতেও পারেন। কারণ তাকে সেজন্যই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নৈতিকভাবে তিনি প্রয়োজনে দেশের জন্য জীবন দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু যখন তাকে সাধারণ বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালাতে বলা হয় তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন। তারমানে আবার এই নয় যে তিনি গুলি চালাতে পারেন না।
এখানে নৈতিকভাবে তিনি সবসময়ই দেশের নাগরিকদের পক্ষে থাকেন ফলে তাদের মৃত্যু তার কামনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর একটি সুন্দর উদাহরণ হলো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব।
‘কমফোর্ট জোন’ শব্দটি একধরণের তীব্র চাপ সৃষ্টি করে মানুষদের মধ্যে। বারবার এই শব্দ ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তুমি তোমার দারিদ্রতা থেকে বের হতে চাইছো না, তুমি তোমার সাথে ঘটে চলা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছো না। সর্বোপরি, জীবনে আরো উন্নতি... আরো উন্নতি... করতে তুমি যথেষ্ট চেষ্টা করছো না।
দারিদ্রতা, বৈষম্য বা আর্থিক কাঠামো এসব লিমিট এজেন্সি নানান কারণে আমাদের জীবনে এসে থাকে, নাকি শুধুমাত্র ‘কমফোর্ট জোন’ এ থাকার কারণে! বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়। অথবা লড়াই বা চেষ্টা করে গেলেই পরিবর্তন শতভাগ সম্ভব তারও নিশ্চয়তা নাই।
বর্তমানের ‘কমফোর্ট জোন’ শব্দটি অস্ত্র হিসেবে আমাদের উপর ব্যবহার করা হয়। যেখানে স্বাস্থ্যকর উন্নতি (Growth) ঘটতে পারে না। উল্টো একধরণের পারফরম্যান্স সাফারিং (যেমন: Toxic Productivity) আরো বাড়িয়ে দেয়। ‘কমফোর্ট জোন’ এর ওপারে ভয় আছে, অনিশ্চয়তা আছে। আর এই ভয় ও অনিশ্চয়তা কারণে এমন এমন সব চাকুরী করতে হতে পারে যা থেকে পরিত্রাণ প্রায় অসম্ভব।
কারণ সবকিছুর আগে টিকে থাকাটা জরুরী হয়ে পড়তে পারে। এমনকি ডেড-এন্ড একটি চাকুরী করে যাওয়া লাগতে পারে ভালো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। কারণ জীবনে ভালো পরিবর্তন দরকার।
এখানে বিবর্তনবাদ কীভাবে কাজ করে? আমাদের পূর্বপূরষরা সাধারণত দুটো কাজ করতেন,
১. শিকারে যেতেন। শিকারে গিয়ে শিকারী ধরে আনতেন অথবা নিজেই শিকারের হাতে পরতেন। মানে হলো, জীবনের ঝুঁকি নিতেন।
২. সুরক্ষিত জায়গায় নিজের পরিবার নিয়ে অবস্থান করতেন (যেমন: গুহায় থাকতেন)। যখন পরিবারের খাবার বা কোন কিছুর প্রয়োজন পড়তো তখন ফের শিকারে বের হতেন। মানে হলো, সুরক্ষিত জায়গায় থাকা।
কিন্তু আধুনিক সভ্যতা জীবনের ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দিছে। আগে যেমন আমাদের “Do or Die” অবস্থায় টিকে থাকতে হত এখন আমাদের “Comfort and Discomfort” অবস্থায় বেঁচে থাকা যায় এবং জীবনে অনেক উন্নতিও করা যায়। সহজ উদাহরণ হিসেবে স্মার্টফোনের ব্যাটারি ধরে নিন, একটা সময় ওটার চার্জের প্রয়োজন হয় আর বাকিটা সময় সচল থাকে, আপনাদের দেয়া কমান্ড অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু দিনশেষে ওর চার্জ গ্রহণ অপরিহার্য।
মানুষও ঠিক তেমনি, একটা সময় বিশ্রামের জন্য এবং একটা সময় কাজের জন্য। সবসময় কাজ বা সবসময় বিশ্রাম দুটোই সমস্যার কারণ।
স্মার্টফোন তাও চার্জে থাকা অবস্থাতেও কাজ করতে পারে। কিন্তু মানুষ সবসময় খুঁজে বেড়ায় ‘হোমিওস্ট্যাসিস (Homeostasis)’। মানে হলো, ভালো কার্যকারিতার জন্য ভালো মানের বিশ্রাম খুবই জরুরী। যে শিকারী বিশ্রাম ছাড়া শিকার করতেই থাকে সে একসময় ক্লান্ত ও অবিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যে শিকারী কখনো শিকারেই যায় না সে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে।
আবার মানুষের উন্নতির বিষয়টি লিনিয়ার নয়। সরলরেখার মত নয়। আমাদেরকে শুধু চেষ্টা করলেই চলে না বরং নিউরোপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity) এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের চ্যালেঞ্জ কে ক্যালকুলেট করে একটি শক্তিশালী রাস্তা বানায়। কখন? যখন আমরা ভালো মানের বিশ্রাম নিয়ে থাকি তখন। অ্যান্ডার্স এরিকসনের মতে, ফোকাসড্ প্রাকটিস বেশি জরুরী। তারপর আবার বিশ্রাম নিতে হবেই। এই সমস্ত করতে গিয়ে ডিস-কমফোর্ট জনে যেতে তো হয় তবে সেটা মেন্টাল স্টেটে ঘটে থাকে। ফিজিক্যাল অবস্থান নির্দিষ্ট নয়।
এখানে ইস্ট-ওয়েস্ট দর্শনের মধ্যেও ব্যাপক ঝামেলা আছে। বৌদ্ধধর্ম ও তাওবাদ বলছে এফোর্টলেস অ্যাকশন, অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন পুঁজিবাদ বলছে, নিরলস প্রচেষ্টা। এছাড়াও আপনি হিন্দু ধর্ম নেন, ইসলাম ধর্ম নেন, সূফীবাদ নেন, সব জায়গায় চেষ্টা করবার কথা তো আছে কিন্তু সেটা বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে বস্তু ও ভোগের প্রতি সংযমের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে।
এমন তো নয়, আমাদের বারবার যে ‘কমফোর্ট জোন’ এর কথা বলা হয় সেটা মূলত ওয়েস্টার্ন পুঁজিবাদী সমাজের ধারার প্রতি অতি আগ্রহের প্রকাশ!
আমাদের এমন একটি ‘কমফোর্ট জোন’ এর কথা বলা হচ্ছে, যেটা আমাদের সরাসরি চাপ প্রয়োগ করছে টক্সিক ওয়ার্কপ্লেসে গিয়ে নিয়মিত ধাক্কা খাওয়াকে, ঝামেলা পোহানো কে। যে ধাক্কা বা ঝামেলা পোহাতে গিয়ে আমাদের গ্রোথের সাথে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে পারে। ১৯০৮ সালে ‘Yerkes-Dodson Law’ নামক একটি সাইকোলোজিক্যাল মডেল প্রকাশ পায়। এখানে বলা হয়, “Too little = complacency; Too much = paralysis”।
তাহলে ‘কমফোর্ট জোন’ বলতে মূলত কি বুঝায়? একটি জুতার উদাহরণ দিই?
আমাদের জীবন হলো এক জোড়া জুতার মতো। কখনও কখনও আমাদের স্নিকার্স/কেডস পরতে হয় ঘুরে দেখার জন্য, কখনও কখনও চটি/চপ্পল/সান্ডেলও পরতে হবে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। দুটোই দরকার, দুটোই প্রয়োজন।
রেস্ট করুন আবার এক্সপ্লোরও করুন!
২| ২৩ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১২:০০
দৈত্যুষ বলেছেন: ভালো লাগলো
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে মে, ২০২৫ সকাল ৯:০৯
রাজীব নুর বলেছেন: পড়তে ভালো লাগে। পড়লাম।