![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাত এগারোটা চৌত্রিশ। আকাশ যেন তার সবটুকু কষ্ট আজ রাতেই ঝরিয়ে দিচ্ছে। এ শুধু বৃষ্টি নয়, যেন মহাকালের শিরা কেটে নামছে অশ্রু, রক্ত আর জমাট বাঁধা শোক। নিকষ কালো টয়োটা প্রিমিও তীব্র গতিতে মহাসড়কের ভেজা বুক চিরে চলেছে। হেডলাইটের আলোয় বৃষ্টির কণাগুলো ক্ষণিকের জন্য হীরের মতো ঝলসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন অন্তিম যাত্রার পথে ছড়িয়ে পড়া হাজারো ভাঙা নক্ষত্রের শেষ দ্যুতি।
গাড়ির ভেতর চারজন—নিশা, রুদ্র, অয়ন ও তানভীর। মৃতবৎ নীরবতা গ্রাস করেছে তাদের। কেবল উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের একটানা ছন্দ আর চাপা শ্বাসের শব্দ। হঠাৎ, চারটি ফোনের স্ক্রিন একসাথে জ্বলে উঠলো। একটিই বার্তা, হিমশীতল ছুরির মতো হৃৎপিণ্ডে বিঁধে গেল: “আমাদের শেষ দেখা হোক সেই সেতুতে, যেখানে সব শুরু হয়েছিল।” প্রেরকের কোনো নাম নেই, কেবল একটি অচেনা নম্বর।
নিশার হাত স্টিয়ারিং হুইলে কাঁপছে। অ্যালকোহলের তীব্র গন্ধ আর ঘুমহীন রাতের কালিমা তার চোখেমুখে স্পষ্ট। পেছনের সিটে রুদ্র জানালার কাচে কপাল ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে, তার মুখে গভীর দুশ্চিন্তার ছায়া। অয়নের আঙুল পকেটে রাখা একটি পুরনো ছবির ওপর ঘুরছে। আর তানভীর ভেজা হাতে লাইটার জ্বালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে, তার ঠোঁটের কোণে এক তিক্ত হাসি।
“কে পাঠিয়েছে এটা?” অয়নের কণ্ঠে ভয়ের কাঁপুনি। “জানি না,” নিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কিন্তু আমরা যাচ্ছি।” “কেন?” রুদ্রর কণ্ঠস্বর ভারী শোনাল। “এই অভিশপ্ত জায়গাটা... এটাই কি আমাদের অসমাপ্ত গল্পের শেষ?” নিশার ঠোঁটে ভাঙা কাচের মতো আলো চিকচিক করে উঠল। “শেষ? আমরা তো কবেই শেষ হয়ে গেছি, রুদ্র। আমরা শুধু… বেঁচে থাকার অভিনয় করছি।”
কথোপকথন থেমে গেল। হঠাৎ লেন পরিবর্তন করতে গিয়ে দূর থেকে ভেসে এল এক দৈত্যাকার ট্রাকের তীব্র হর্ন। হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। নিশার আতঙ্কিত চিৎকার, “না!”—শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং ঘোরানোর এক ব্যর্থ চেষ্টা। তারপর ধাতব বস্তুর মচড়ে যাওয়ার আর্তনাদ, কাচ ভাঙার তীক্ষ্ণ শব্দ আর চারটি গলার মিলিত এক অন্তিম হাহাকার। সব শান্ত। কেবল বৃষ্টির শব্দ, যেন পৃথিবী তার বুক থেকে এই চারটি নাম চিরতরে মুছে ফেলেছে।
যখন চোখ খুলল, তারা নিজেদের আবিষ্কার করল এক অদ্ভুত, গোলাকার কক্ষে। স্থান বা কালের কোনো অস্তিত্ব নেই। মেঝেটা আয়নার মতো স্বচ্ছ, কিন্তু তাতে তাদের জীবন্ত প্রতিবিম্বের বদলে দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনার ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা তাদের রক্তাক্ত, নিষ্প্রাণ দেহ।
কক্ষের দেওয়াল জুড়ে হাজার হাজার স্ক্রিনে জ্বলছে তাদের জীবনের গভীরতম ক্ষতগুলো—একটি শূন্য দোলনা, নির্মমতার প্রতীক একটি বেল্ট, ফাঁসির দড়ির পাশে এক নিষ্পাপ শিশুর মুখ, হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া এক প্রিয় মুখ।
এক যান্ত্রিক, শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এল: “আমি মনিটর। তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরাল ডেটা থেকে সৃষ্ট এক হাইব্রিড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আমি তোমাদের বিচারক। এখানে তোমাদের পরীক্ষা হবে। উত্তীর্ণ হলে পাবে পুনর্জন্মের সুযোগ। ব্যর্থ হলে—চিরস্থায়ী নির্বাসন।”
কক্ষের কেন্দ্রে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সম্বলিত একটি হলোগ্রাম ফুটে উঠল।
“এটা কী জায়গা? আমরা কি মরে গেছি?” নিশা চিৎকার করে উঠল। মনিটরের শীতল কণ্ঠ জবাব দিল, “মৃত্যু কেবল একটি দরজা। তুমি কোন দিকে আছ, তা নির্ভর করবে তোমার উত্তরের ওপর।” “তুমি কে আমাদের বিচার করার?” রুদ্রের কণ্ঠে ক্রোধ। “আমি তোমাদের বিস্মৃত স্মৃতি, তোমাদের চাপা ভয়,” হলোগ্রামটি ঝলসে উঠল। “আমি তোমাদেরই এক বিচ্ছিন্ন অংশ।”
মুহূর্তে কক্ষটি তাদের ফেলে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত হলো। কিন্তু এ এক অদ্ভুত ক্যাম্পাস—গাছের পাতাগুলো রক্তে ভেজা, মাটিতে তাদের পায়ের ছাপ কালো পোড়া দাগের মতো বসে যাচ্ছে। এখানেই একদিন তাদের স্বপ্নের শুরু হয়েছিল। নিশা, বিস্ময়কর প্রতিভাধর কোডার; রুদ্র, ন্যায়ের পাহারাদার হতে চাওয়া আইনের ছাত্র; অয়ন, মেয়ের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে চাওয়া বাবা; আর তানভীর, হাসিখুশি স্বভাবের আড়ালে অপরাধবোধে ভোগা এক সন্তান।
মনিটরের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “তোমরা এখানেই শুরু করেছিলে। এখন বলো, কী হারিয়েছ?” একে একে তারা তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করল। নিশা হারিয়েছে তার অনাগত সন্তান, যার জন্য সে নিজেকে দায়ী করে। রুদ্র হারিয়েছে তার বিশ্বাস, যখন সে প্রয়োজনের সময় নিশার পাশে দাঁড়াতে পারেনি। অয়ন হারিয়েছে তার পরিবার, তানভীরের কথায় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে। তানভীর হারিয়েছে তার মা-কে, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে।
ক্যাম্পাসের মাটি মৃদু কাঁপতে শুরু করল। মনিটর বলল, “তোমরা নিজেদের ক্ষতগুলো দেখেছ। এবার মুখোমুখি হও নিজেদের কঠিনতম সত্যের।”
তারা এবার এক কাঁচের গোলকধাঁধায় বন্দী। স্বচ্ছ দেওয়ালে তাদের নিজেদের ছায়া—তাদের অন্ধকার সত্তা—তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ছায়া তাদের ব্যর্থতা আর ভুলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনিটর তাদের হাতে একটি করে হাতুড়ি দিয়ে বলল ছায়াগুলোকে ধ্বংস করতে।
কিন্তু তারা পারল না। নিশা, রুদ্র, অয়ন, তানভীর—প্রত্যেকেই হাতুড়ি ফেলে দিল। তারা নিজেদের অন্ধকার অংশকে ধ্বংস করতে অস্বীকার করল, কারণ তারা বুঝতে পারছিল—ওরাও তাদেরই অংশ। এই অস্বীকৃতি ছিল নিজেদের ত্রুটিগুলোকে মেনে নেওয়ার প্রথম ধাপ।
গোলকধাঁধা মিলিয়ে যেতেই তারা এক বিশাল, ফাঁকা মঞ্চে এসে দাঁড়াল। মঞ্চের মাঝখানে একটি প্রকান্ড পাথর, যার গায়ে তাদের জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা আর অনুতাপ খোদাই করা। মনিটরের আদেশ এল: “এই পাথর—তোমাদের সম্মিলিত পাপ আর দুঃখের ভার—গড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাও।” তারা একসাথে চেষ্টা শুরু করল, কিন্তু প্রতিবারই পাথরটি পিছলে নিচে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এ যেন এক অন্তহীন, অর্থহীন প্রচেষ্টা।
হঠাৎ মনিটর বলল, “তোমরা একে অপরকে সাহায্য করে চূড়ায় পৌঁছাতে পারো। কিন্তু তার জন্য একজনকে বেছে নিতে হবে, যে স্বেচ্ছায় এই পাথরের নিচে চাপা পড়বে, অন্যদের পথ করে দেবে।” তৎক্ষণাৎ প্রত্যেকেই নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইল। নিশা মুক্তি চাইল, রুদ্র নিশাকে বাঁচাতে চাইল, তানভীর নিজের জীবনকে অর্থহীন ভেবে এগিয়ে এল। কিন্তু অয়ন চিৎকার করে বলল, “কেউ থাকবে না। যদি বাঁচি, একসাথে বাঁচব। যদি মরি, একসাথে মরব।”
এই প্রথম তারা নিঃস্বার্থভাবে একে অপরের দিকে তাকাল এবং কোনো কথা ছাড়াই পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে রাখল। আশ্চর্যজনকভাবে, পাথরটি স্থির হয়ে গেল। মনিটরের কণ্ঠে প্রথমবারের মতো যেন অনুভূতির আভাস পাওয়া গেল: “তোমরা একে অপরকে বাঁচিয়েছ। কিন্তু পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি।”
মঞ্চ মিলিয়ে গিয়ে তারা এক ধবধবে সাদা, অন্তহীন ক্যানভাসে এসে দাঁড়াল। সেখানে ফুটে উঠছে তাদের বিকল্প জীবনের ছবি—যেখানে তারা সুখী, সফল এবং শান্তিতে আছে।
মনিটর তার চূড়ান্ত নির্দেশ দিল: “তোমরা একে অপরের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারো। কিন্তু তার জন্য একজনকে চিরতরে বিলীন হতে হবে। বেছে নাও, কে হবে সেই একজন?”
গভীর নীরবতা নেমে এল। অবশেষে নিশা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা কেউ মরব না। যদি বাঁচতে হয়, একসাথে বাঁচব। যদি হারাতে হয়, একসাথেই হারাবো।” বাকিরাও তার সাথে যোগ দিল। তারা জীবনের কাছে হয়তো হেরে গেছে, কিন্তু একে অপরকে হারাতে রাজি নয়।
সাদা ক্যানভাসটি কালো হয়ে গেল। তারা আবার ফিরে এল দুর্ঘটনার সেই ভয়াল মুহূর্তে। গাড়ির ভেতর। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকের তীব্র আলো।
নিশা শেষবারের মতো ফিসফিস করে, “আমরা একা নই…” রুদ্র বলে, “আমরা একসাথে…” অয়ন উচ্চারণ করে, “আমরা বেঁচে আছি…” তানভীর প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলে, “আমরা দুঃখিত…”
তারপর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিল সবকিছু।
একটি হাসপাতালের ওয়েটিং রুম। টিভির পর্দায় সংবাদ পাঠিকার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর: “আজ রাতে জাতীয় মহাসড়কে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন তরুণ-তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।” টিভির স্ক্রিনে মুহূর্তের জন্য মনিটরের সেই হলোগ্রামটি—বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো আর রুনিক অক্ষরসহ—একবার ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। যেন এক অসীম চক্রের প্রতীক, এক ইনফিনিটি লুপ। তাদের বিচার, অনুশোচনা আর পরিণতির এই চক্র হয়তো অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকবে।
ছবি: Copilot Enterprise
২| ০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:২০
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: আমি দেখেছি আপনার সব লেখাই উন্নতমানে কিন্তু পাঠক নেই এই কারণ আমি বুঝিনা।
৩| ০৪ ঠা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১০:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: আমি দেখেছি আপনার সব লেখাই উন্নতমানে কিন্তু পাঠক নেই এই কারণ আমি বুঝিনা।
কারন হচ্ছে উনি অন্য কারো পোষ্ট পড়েন না। মন্তব্য করেন না।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:১৪
আধুনিক চিন্তাবিদ বলেছেন: ভালো লিখেছেন।