নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ সরল সোজা সাদা ভাষায় জীবনের কথা লিখতে পছন্দ করি। কাদা মাটিতে বেড়ে ওঠা একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ। মনের কথাগুলি বরাবরই মুখে এসে বের হতে চায় না, কলমে আসতে চায়।

বিজু চৌধুরী

আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।

বিজু চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আছির মাষ্টার

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:৪৩


১।
আছির উদ্দিন মাষ্টার, রাজধানী ঢাকা শহর যাবার উদ্দেশ্য বাসা থেকে শ্রাবণের ১৪ তারিখ দুপুরের পরে বের হলেন। ফিরবেন পাঁচ দিন পরে শ্রাবনের ১৯ তারিখে। কিন্তু, ফিরে এলেন পরের দিনই ১৫ তারিখে সন্ধ্যার পরে। তাকে জেলা শহরে লঞ্চে উঠতে দেখেছে পাড়ার রহমত ব্যাপারী রাতে। সেই হিসেবে সকালে লঞ্চে ঢাকা পৌঁছায় আবার রওনা করলে, দুপুরের পরে বরিশাল শহরে আসার কথা। সেখান থেকে পটুয়াখালী পৌঁছতে তিন ঘণ্টা। এরপরে সহজ রাস্তয় বাসায় আসলেও আরও দুইটা নদী পার না হয়ে আসার উপায় নাই। রাত নয়টার আগে কোনভাবেই বাসায় আসার কথা নয়। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আছির মাষ্টার বাসায় হাজির। রহমত ব্যপারি কি তাইলে ভুল দেখছে?
ফরিদা আছির মাষ্টারকে দেখে কিছুটা ভয় পায়। আছির মাষ্টার কোন কথা বলেনি এখন পর্যন্ত ফরিদার সাথে। ফরিদার বিষয়টি খুবই ভয়ের মনে হচ্ছে। এদিকে সাবুর কোন খবর নাই। সাবুর ডান হাত মতিনও ফিরে নাই, তাই সাবুর খবর পাবারও কোন উপায় নেই। ফরিদা সাহস করে আছির মাষ্টারকে জিজ্ঞেস করে -
- কি গো সাবুর বাপ, ফিইরা আইলেন যে?
আজ আছির মাষ্টারের চোখ দুটোয় রাগের পরিবর্তে যেন আগুন দেখা যায়। ফরিদা ভুলটা বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ বলে -
- পারুলের বাপের কি শরীরটা খারাপ?
আছির মাষ্টারের তিন মেয়ে দুই ছেলে। বড় মেয়ে পারুল। তিন মেয়ের পরে সাবু ও বাবু দুই ছেলে। বড় ছেলের নামে বাপরে ডাকার চলন থাকলেও, আছির মাষ্টার বড় মেয়ে পারুলের নামেই ডাকতে বলে ফরিদাকে। ফরিদা যতবারই এই ভুলটা করে, আছির মাষ্টারের চোখ ততবারই শাষন করে ফরিদাকে। ফরিদাকে পরিস্থিতি সামলাতে তাই সাথে সাথেই পারুলের বাপ ডাকতে হয়।

আছির মাষ্টার এই এলাকার মানুষ না হলেও অত্র অঞ্চলের মানুষ। তার বাড়ী বরগুনায়। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের ছেলে আছির মাষ্টার। ডিগ্রী পাশ করে পটুয়াখালী জেলার এই সমুদ্র ঘেষা গ্রামে আসে, এখানকার স্কুলে মাষ্টারি করতে। এসেই আছির উদ্দিনের নাম রাতারাতি এলাকায় হয়ে যায় আছির মাষ্টার। তখন তার বয়স মাত্র বাইশ। তবে চেহারা উচু লম্বা হওয়ায় মনে হয় পঁচিশের উপরে। আসার এক বছরের মধ্যেই অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই মানুষটি। তার এই জনপ্রিয়তা যে শুধু ছাত্রদের মধ্যে তা নয়, এলাকার লোকজনের মধ্যেও। ভাল শিক্ষক, কথা বার্তা ভাল, সৎ ও নির্ভীক। সেই সাথে ভাল বক্তাও তিনি। সমস্ত গুনাবলীগুলো যেন রাজনীতি করার জন্যই তৈরী হয়েছিল তার মধ্যে।

২।
আছির মাস্টার তার ঘরে বসে পরীক্ষার রেজাল্ট তুলছে। ভয়ানক মাথা ঠান্ডা রাখার কাজ। এতগুলো ছাত্র ছাত্রীর মার্কস, একটু ওলট পালট হয়ে গেলে ঝামেলা। আর মনোযোগের মাঝে কাজ থেকে উঠে গেলে, মনোযোগ রাগ করে চলে যায়, আর ফিরে আসতে চায় না, পরীক্ষিত। পিওন দুলাল এসে বলে -
- স্যার, একজন দেখা করতে আসছে।
- পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে বল।
দুলাল আবার এসে বলে -
- স্যার দশ মিনিট হয়ে গেছে।
আছির মাস্টারের এই ব্যাচেলর রুমে এই মুহুর্তে একজন নতুন বাড়তি মানুষ আছে, ইলিয়াস সাহেব। ধর্মের শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। ফরিদপুরের মানুষ। আছির মাস্টারের চেয়ে বছর পঁচেকের বড়। বাসা ঠিক করে সামনের মাসে বউ বাচ্চা নিয়ে আসবেন। মানুষটা ভাল। তবে, সমস্যা একটাই। আছির মাষ্টারের মনে হয়, ধর্মের শিক্ষকদের পায়জামা পরিধান বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। সে তার চাচাকে দেখেছে ছোটবেলায় আর এখন এই ইলিয়াস সাহেবকে। আর যাই পড়ুক, লুঙ্গি হুজুরদের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিৎ। আছির মাষ্টার আড়চোখে দেখে। আজ অবস্থা ভাল, ভাল বললে কম বলা হয়। হাঁটুর নীচে, আলহামদুলিল্লাহ। আছির মাষ্টার দুলালকে বলেন -
- ভেতরে নিয়ে আস।
- স্যার, তিনজন।
- তুমি বললা একজন দেখা করতে আসছে।
- একজন কথা বলবে। দুইজন সাথে আইছে।
- একজনের লগে দুইজন। খোলাসা করে কও তো। চেয়ারম্যান সাহেব নাকি?
- কাছাকাছি স্যার।
- দুলাল, আমি ব্যস্ত। মস্করা না করে বল কে?
- চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মাইয়া।
- কি বললা? ফরিদা? আমার কাছে? কেন?
আছির মাষ্টার এতগুলো প্রশ্নের উত্তর আশা না করে, এক মুহুর্ত চিন্তা করে, লুঙ্গির উপরে পাঞ্জাবি জড়ায়। যাবার আগ মুহুর্তে কি মনে করে, দ্রুত পায়জামা পড়ে বাইরে যায়। ফরিদা আছির মাষ্টারকে দেখে, হাত কপালে ঠেকিয়ে বড় করে সালাম দেয় -
- স্যার, আসসালামুঅলাইকুম।
সাথের দুজনকে ফরিদার রেকর্ড মনে হয়। ফরিদার সালাম দেয়া শেষ হওয়া মাত্রই একজন বোরখা পড়া মহিলা ও একজন ভৃত্য হাত তুলে একই কায়দায় লম্বা করে টেনে বলে -
- স্যার, আসসালামুঅলাইকুম।
আছির মাস্টার সালামের উত্তর দিয়ে বলে -
- ফরিদা, তোমরা আসছ জানলে আমি বসিয়ে রাখতাম না। দুলাল কিছু বলেনি।
- স্যার যে কি বলেন? গুরুজন বলে, শিক্ষক হল..
এই বলে চুপ করা মাত্রই বোরখা পড়া মহিলা সাথে সাথেই বলে -
- বাবা মায়ের পরের স্থান।
- আচ্ছা। আচ্ছা, তা কি খবর ফরিদা?
- স্যার, উনি আমার নানী। আসছিলাম স্যার আপনাকে একটা কথা বলতে..
নানী কথা শেষ করেন -
- যদি অনুমতি দেন।
আছির মাষ্টারের ব্যপারটা অদ্ভুত মনে হলেও মজা লাগে। তিনি অনুমতি দিলে ফরিদা বলে -
- স্যার, আমি অংকে খুব দূর্বল। গতবার ৩৪ পাইছি। কানের পাশ দিয়া গুলি গেছে..
নানী শেষ করেন-
- তয় কানের দুলে লাগছে। প্রাইভেট না পড়লে সামনের বার কানের লতিতে, তারপরের বার বুকে লাগবে।
ফরিদা নানিকে বলে -
- না নানি, কানের পড়ে মাথায় লাগবে।
- যেইখানেই লাগুক,মরন তো হইবই।
আছির উদ্দিন মাস্টার এবার সত্যই হেসে দেন। তারপরেই গম্ভীর হয়ে বলেন -
- নানী, আমি শিক্ষকতা শুরু করছি এই নিয়ত কইরা যে, প্রাইভেট পড়াব না। তবে, আমি ক্লাসে ফরিদার দিকে খেয়াল রাখব। আপনারা আমাকে ক্ষমা করেন।
- ক্ষমা কি আর এক পক্ষ করলে হবে। দুই পক্ষকেই ক্ষমা চাইতে হবে।
এবার ফরিদা নানির কথা শেষ করে -
- স্যার, আমাগোও মাফ কইরা দিয়েন।
এবার তিনজনই একসাথে বলে -
- স্যার, আসসালামুঅলাইকুম।
ফরিদারা চলে যাবার পরে আছির মাষ্টার মনে মনে হাসে। চেয়ারম্যানের তিন মেয়ে। ফরিদা ক্লাস নাইনে, পরের দুই বোন সেভেনে ও সিক্সে। কোন ভাই নেই। পরের দুই বোন চটপটে হলেও ফরিদাই একমাত্র অন্যরকম, সহজ সরল।

আছির চেয়ারম্যান এলাকায় আসার এক বছর পরে প্রথম নির্বাচন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে ফরিদার বাবা রইস উদ্দিন চেয়ারম্যানের সাথে হারেস মেম্বারের। হারেস মেম্বার একসময় ফরিদার বাবারই ডান হাত ছিল, এখন প্রতিদ্বন্দ্বী। হারেছ মেম্বারের বড় শক্তি তারা দশ ভাই বোন ও তাদের শ্বশুর বাড়ীর সমস্ত আত্নীয় স্বজন। পরিবারেই প্রায় তিন হাজার ভোটের মধ্যে শ পাঁচেক। আর রইসউদ্দিনের শক্তি হল, তার বাসার দিকেই নদীর ঘাট ও ভোটার বেশী।
সেবার সত্যই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। আছির মাষ্টার ২৮০ ভোটে জিতেন। ১৫ বছরের চেয়ারম্যান জীবনে তিনি কখনও ৫০০ ভোটের কম ব্যবধানে জেতেননি।

৩।
আছির মাষ্টারের এলাকায় আসার এক বছর তিন মাস হল। তার মা এখানে আসেন নাই। আছির মাষ্টার আসলে বলতে পারেন নাই। কারণ, তিনি তখনও ব্যাচেলরদের মেসে থাকেন। দুই রুমের একটা বাসা নেয়া দরকার, আছির মাষ্টার ভাবেন। এখানে ব্যাচেলরদের বাসা পাওয়াটা সমস্যার কিছুটা হলেও, তার জন্য সমস্যা হবে না। বাসার ব্যবস্থা করে সামনের রমজানে মাকে নিয়ে আসবে, আছির মাস্টারের এমনই ইচ্ছা। বাবা গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। বাবার মৃত্যুর পরে মা কেমন জানি একটু অভিমানী হয়ে গেছেন। বাসায় চাচা চাচী সহ আরও লোকজন আছে। সবাই মাকে অনেক সম্মান করে।
পৌষ মাসের মাঝামাঝি, শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে আছির মাস্টার খবর পান -
- তার মা এলাকায় এসেছেন এবং উঠেছেন চেয়ারম্যান রইস উদ্দিনের বাড়ীতে। আছির মাস্টার অবাক হন। হটাৎ মা এলেন। চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ওঠাটা অবাকের কিছু না। এলাকায় কেউ নতুন আসলে ও একান্তই বিপদে পড়লে চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ওঠার রেওয়াজ আছে। আছির মাস্টারকে তার মা সেখানে ডেকে পাঠিয়েছেন। আছির মাস্টার হন্তদন্ত হয়ে ছোটেন। চেয়ারম্যান বাড়ীতে আছির মাষ্টারের এই প্রথম আগমন। বৈঠক ঘরে মা বসে আছেন। আছির ঢুকেই মাকে সালাম করেন। ঘরে আরো এক দুইজন মহিলা থাকলেও আছির মাষ্টার ঢোকার আগেই তারা বের হয়ে গেছে। আছির মাষ্টার বলে -
- মা, কেমন আছেন? হটাৎ কইরা আইলেন খবর না দিয়া।
- আছির, আমি চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মেয়ের সাথে তোর বিয়ার কথা পাকা করছি।
আছির মাষ্টার কিছুটা হতভম্ব হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মা বলেন -
- আমি তোরে কইছি আছির, আমি বাইচা থাকতে নার্গিসের সাথে তোর বিয়া হবে না। আইজ দুপুরের আগেই নার্গিসের বিয়া হইছে। আমি চাই না, এরপরে তুই একলা থাক।
আছির মাষ্টার সব কিছু মিলিয়ে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে শুধু বের হয় -
- মা।
- আছির, তুই আমার ছেলে হইলে, আইজ বাদ মাগরিব ফরিদারে বিয়া করবি।
সে রাতেই ৫০১ টাকা দেনমোহরানা ধার্য করে, আছির মাষ্টারের সাথে ফরিদার বিয়ে হয়ে গেল। বাসর হল ফরিদাদের বাসায়। ফরিদার বয়স তখন পনের বছর ও আছির মাস্টারের তেইশ।
বিয়ের পরে আছির মাষ্টারের কোন আপত্তি না থাকলেও, ফরিদা ও আছির মাষ্টারের শ্বশুর রইস উদ্দিন চেয়ারম্যান আর রাজী হলেন না ফরিদার স্কুল যাবার ব্যপারে। একই স্কুলে ছাত্রীর স্বামী ও শিক্ষক, এতে আছির মাষ্টারের মান সম্মানের হানি ঘটতে পারে। আছির মাষ্টার শ্বশুর বাড়ীর পাশেই একটি ঘর তুলে থাকা শুরু করেন। পরবর্তীত্ দুটি ঘর হলেও ফরিদাকে তার বাচ্চা প্রসবের জন্য বাপের বাসাতেই থাকতে হয় ও স্বাভাবিকভাবে আছির মাষ্টারকেও।

বিয়ের প্রথম চার বছরেই ফরিদার একে একে তিন কন্যা সন্তান হয়। এই চার বছরে চেয়ারম্যান রইস উদ্দিনের বাকী দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে ঢাকায় চলে যায় তারা। আছির মাষ্টার ও ফরিদার সব ছোট মেয়ের ছয় মাস। মেজ মাইয়ার দুইবছর আর বড় মাইয়া পারুলের বয়স তিন বছর।
চেয়ারম্যানের বাড়ীতে এখন চেয়ারম্যান আর আছির মাষ্টারই পুরুষ মানুষ। আছির মাষ্টার তখন এলাকায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তার শ্বশুর রইস উদ্দিন চেয়ারম্যানের সাগরেদ হারেস মেম্বারই রইস উদ্দিনের প্রতিপক্ষ।
নদী এলাকার মানুষ অসম্ভব সাহসী। তবে সাহসের হিসেবে, আছির মাষ্টারের আশে পাশে ঘেষবার মত মানুষ এই গ্রামে নেই। এই গ্রামের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রইস উদ্দিন মাস্টারই ঘোর বর্ষায় উত্তাল পায়রা নদী সাতরে পার হয়ে সাথে সাথেই আবার ফিরেও এসেছিলেন। এরপরে আরও কয়েকজন পার হলেও অদ্যাবধি কেউ এপার ওপার দুবার পর পর পার হতে পারেনি।

৪।
চেয়ারম্যান রইসউদ্দিন সেইসময়ই একদিন বিকেলে বৈঠক ঘরে, জামাই আছির মাষ্টারকে ডেকে বলেন -
- বাবা আছির, বুঝলা বাবা, চেয়ারম্যান হইল নেশা, পারিবারিক সম্পত্তির মতই অনেকটা। এইটা কোন বাসায় ঢুকলে, বাসার কুকুর বিড়ালও নাকি এইটারে ধইরা রাখতে জীবন পর্যন্ত দিয়া দেয়। আমার কথা কি বুঝতে পারছ বাবা।
- জ্বী আব্বা, বুঝতে পারছি।
- আমার খুব শখ, বাবা তোমাকে চেয়ারম্যান দেইখা যাইতে চাই।
- কিন্তু আব্বা, আমার তো শরীরে রাজনীতির রক্ত নাই। তাছাড়া মাষ্টারি করতেই আমার ভাল লাগে।
- বাবা, চেয়ারম্যান হবার জন্য তোমার শইলের এক ফোঁটা রক্তের সমান রক্ত নাই এই গ্রামে কারও।
আছির মাষ্টার রাজী হয় না। রইস উদ্দিন ৪৫ বছর বয়সে আবার চেয়ারম্যান হন। তবে, ১৫ বছরের চেয়ারম্যান জীবনে এইবারই রইস উদ্দিন মাত্র ১৮৫ ভোটে জিতেন তারই হাতে তৈরী মেম্বার হারেসের বিপক্ষে। লোকে বলে -
- চেয়ারম্যান এইবারই হারত। শুধু আছির মাষ্টার চেয়ারম্যান বাড়ীর জামাই হওয়াতেই জিতেছে।
রইস উদ্দিন যে পরেরবার ভোটে জিততে পারবে না, তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়।

আছির মাষ্টার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দুটো ভাগ করে যারা ভাল, তারা কি করে আরও ভাল করবে সেই ব্যপারে কাজ করে। আর যারা খারাপ, তাদের গোড়া শক্ত করার কাজ করা শুরু করলেন স্কুলে। বিনা বেতনে অতিরিক্ত ক্লাস। পরিশ্রমী আছির মাষ্টার টুকটাক ব্যবসা ও দেশের বাড়ীর সম্পত্তির সঠিক ব্যবহারে আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে আসেন। রইস উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাসার পাশেই তার নিজস্ব বাসাটিতে দুইটি থাকার ঘর, একটি বৈঠক ঘর, রান্নাঘর ও গোয়াল ঘর তুলেন। বড় মেয়ে পারুলের বয়স এখন সাত। পরের দুজন ছয় ও সাড়ে চার। সময় হয়ে আসে পুনরায় চেয়ারম্যান নির্বাচনের।

হটাৎ একদিন হারেস মেম্বার নিজ বাসায় ফেরার পথে খুন হন। গ্রামে উত্তেজনা দেখা যায়। রইস উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ী আক্রমন করতে চেয়ে পারে না। কিন্তু, চেয়ারম্যানের নামে কেস হয় ও পুলিশ এরেষ্ট করে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানকে। যতদূর জানা যায়, নৌ ঘাটের ইজারা নিয়ে বর্তমান পক্ষের লোকজনের সাথে ঝামেলা চলছিল। এতে চেয়ারম্যান জড়িত না থাকলেও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। লোকজন এও বলে -
- চেয়ারম্যান নাকি স্বেচ্ছায় জেলে গিয়েছে। এতে ভোটের আগে জীবনের উপর হামলার যে সম্ভাবনা ছিল, সেটি থেকে বাঁচবার জন্য। এছাড়া জেলে থেকে ভোট করলে নাকি ভোটে জেতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতে তার পোষ্টারের নিচে ছোট করে ফরিদা ও আছির মাষ্টারের ছবি জুড়ে দেয় চেয়ারম্যানের লোকজন। সেবার চেয়ারম্যান, জেলে থেকেই হাজারের উপরে ভোটে জিতেন। চেয়ারম্যানের বিপক্ষে দাড়ায় মৃত হারিস উদ্দিনের সব বড় ভাই। কিন্তু, তার জনপ্রিয়তা ঐ রকম ছিল না। তবে, লোকে বলে -
- ছোট্ট করে আছির মাস্টারের ছবি লাগানোতেই নাকি এই জেতা।

৫।
আরও পাঁচটি বছর কেটে গিয়ে চেয়ারম্যানের নির্বাচনের সময় এসে দাড়ায়। আছির মাষ্টারের এখন চৌত্রিশ বছর বয়স। বড় মেয়ে পারুলের বার ও পরের দুজনের এগারো ও সাড়ে নয়। পড়াশুনায় তিন মেয়েই বেশ ভাল। তিনজনই ক্লাসে ফার্স্ট।
আছির মাষ্টারকে এর মাঝেও রইস উদ্দিন অনুরোধ করেও রাজনীতিতে আনতে পারে না। বাধ্য হয়ে পুনরায় রইস উদ্দিন নির্বাচনে দাড়াতে মনস্থির করেন। এবার পাঁচ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে বাতাস বহে উল্টো দিকে। রইস উদ্দিনের মৃতদেহ মসজিদ আর বাসার মাঝামাঝি বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে পাওয়া যায় মাগরেবের নামাজের পরে। বাসার একশত গজের মধ্যে তাকে খুন খুন করতে পারে, এটি মনে হয় রইস চেয়ারম্যান নিজেও ভাবেন নাই। গ্রামে কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। অনেকে আছির মাস্টারকে অনুরোধ করেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। আছির মাস্টার রাজনৈতিক বিষয়ে মাথা ঘামাতে রাজী হয় না। তার মধ্যে পুলিশ তার শ্বশুর রইস উদ্দিনের মৃতদেহ থানায় নিয়ে গেছে। দাফনের আগে এইসব বিষয়ে আছির মাষ্টার জড়াতে চাইলেন না।

আছির মাস্টারের এই রাজনীতিতে না জড়ানোর ইচ্ছেটাই তাকে সেদিন রাজনীতিতে নিয়ে আসল। সংঘর্ষের এক পর্য্যায়ে মৃত হারেস মেম্বারের লোকজনের একটি অংশ, সেদিন নিহত রইস উদ্দিনের বাসায় সুযোগ বুঝে হামলা করে রাত নয়টার দিকে। জনা পঁচিশেক লোক বাসার সামনে লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হলে, বাসার পুরোন ভৃত্য রহমান তাদের বলে -
- চেয়ারম্যান সাহেবের মরদেহ এখনও বাসায় আনা গেল না। আপনারা কারে চান?
হারেস মেম্বারের ভাই বারেক শেখ মূলত এই আক্রমনের নায়ক। সে এসেছে চেয়ারম্যান হবার রাস্তাটা পাকাপোক্ত করতে। এই বাসা থেকে যাতে আর কেউ চেয়ারম্যান হইতে না পারে। বারেক শেখ রহমতকে বলে -
- আছির কই?
- মুখ সামলায় কথা বলেন। আছির মাস্টার বলেন।
মুহুর্তের মধ্যে মাথায় লাঠির বাড়িতে রহমান অজ্ঞান হয়ে যায়। বাসায় থাকা পাঁচ সাতজন যখন মারামারি করে পর্যদুস্ত প্রায়, তখন আছির মাস্টার একা লাঠি হাতে বাসার বাইরে আসেন। কেউই আছির মাস্টারকে এই চেহারায় আগে দেখেনি। লুঙ্গি মালকোচা মেরে খালি গায়ে শক্ত একটি লাঠি হাতে আছির মাস্টারকে সম্পূর্ণ পাকা লাঠিয়ালের মত মনে হয়।
আছির মাস্টার আজ লাঠি হাতে তুলে নিয়েছেন মূলত তার স্ত্রী ও চার মেয়ের জন্য। এরা বাসায় ঢুকে পড়লে এদের জীবন ও ইজ্জত হানির ভয় আছে। আছির মাস্টার হুংকার ছেড়ে বলে -
- তোরা কি চাইস?
আছির মাস্টারের শারীরিক উপস্থিতির সাথে লাঠি হাতে হুংকার মানসিক ভাবে কিছুটা হলেও দূর্বল করে ফেলে প্রতিপক্ষকে। সবাই ইতস্তত করতে থাকলে, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বারেক শেখ লাঠি হাতে এগিয়ে আসে। মুহুর্তের মধ্যেই তার মাথা ফাটিয়ে ফেলেন তেত্রিশ বছর বয়সের আছির মাস্টার। এরপরে সবাই দেখে আছির মাস্টারের সাহস ও শারীরিক শক্তি। প্রায় পনের মিনিটের লাঠালাঠিতে আছির মাষ্টার ও আহত বাসার চার পাঁচজন মিলে প্রায় র্পযদুস্ত করে ফেলে এই বিশ পচিশজনকে।

ইতোমধ্যে আছির মাষ্টারকে আক্রমন করা হয়েছে, এই খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারের উপরে মানুষ উপচে পড়ে রইস উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ীতে। শেষে আছির মাস্টারই আক্রমনকারী সবার জীবন রক্ষা করেন। তা না হলে উত্তেজিত মানুষ সেদিন সবাইকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলত। হাজার মানুষ শ্লোগান দিতে শুরু করে আছির মাস্টারের নাম ধরে। ঐ একই দিনে রইস উদ্দিনের মৃত্যুর সাথে, আছির মাস্টারের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে।
আছির মাষ্টার সেবার ঐ এলাকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট ও ব্যবধানে জিতেন। তবে, লোকজন কেউ কখনই আছির চেয়ারম্যান বলে আছির মাষ্টারের নাম উচ্চারণ করেনি। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেও, আছির উদ্দিন নামের এই মানুষটি সারা জীবন -
- আছির মাষ্টার নামেই পরিচিত ছিলেন।

৬।
ফরিদা কি করবে? বুঝতে পারে না। আছির মাষ্টার গতকাল রওনা করে, কি করে? কেন? আজই চলে আসলেন বাসায়। এদিকে সাবুর কোন খবর নেই। সাবু ফরিদাকে বলেছিল -
- মা, মোরে চেয়ারম্যান হইতে দিতে বাজান মনে হয় চায় না। গতবার কইলাম মেম্বার ইলেকশন করি। বাজান দিল না।
- একটু ধৈর্য্য ধর বাবা।
- কেমনে ধৈর্য্য ধরি? এদিকে শুনলাম বাজান নাকি জমিজমা সব লিইখা দিয়া যাইতেছে। বাবুর নামে নাকি সব জমি লিইখা দিচ্ছে।
ফরিদা এই কথাতে একদম চুপ মেরে যায়।

আছির মাষ্টার চেয়ারম্যান হবার পরে যখন শিক্ষকতার মত রাজনীতিতেও বেশ ভাল দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন, ঠিক তখনই ঘটে একটি দূর্ঘটনা। রইস উদ্দিনের বিরুদ্ধে পুরোন একটি হত্যা মামলায় আছির মাষ্টারের নাম ঢুকিয়ে দেয়। কারণ, আছির মাষ্টারের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক সাফল্যে যে আগামী দিনগুলোতে হারেস মেম্বারের পরিবারের কেউ আর চেয়ারম্যান হতে পারবে না, সেটি তারা বুঝে গিয়েছিল। থানার পুলিশ তথন হারেস মেম্বারের আত্নীয় সম্পর্কীয় মানুষ। তার সাথে বুদ্ধি করে এ মামলা। আছির মাষ্টারকে এরেষ্ট করে দ্রুত জেলা শহরে চালান করে দেয় পুলিশ। আছির মাষ্টারের লোকজন উত্তেজিত হয়ে এক গ্রুপ থানায় আক্রমন করলে পরিস্থিতি খারাপ
হয়ে দাড়ায়। আছির মাষ্টারের কাছের লোকজন, সবার নামে মামলা হয়। তারা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয় কিছুদিনের জন্য। লোকজন বলাবলি করে -
- এবার আছির মাষ্টারের বিপদ আছে। সারা জীবন জেলে কাটাইতে হয় কিনা?
আছির মাষ্টার্র বড় মেয়ে পারুল তখন ক্লাস টেনে। পরের দুজন নাইন ও সেভেনে। ফরিদা বুঝতে পারবে না কি করবে? এরই মাঝে ফরিদা অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। সে আবার সন্তান সম্ভবা।
আছির মাষ্টার সেবার চৌদ্দ মাস জেল খেঁটে ফিরে। ধীরে ধিরে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে গ্রামের লোক আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন শুরু করার পরে আছির মাষ্টারের আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা আরেকবার প্রকাশ পায়। থানার ওসিকে সরিয়ে নেয়া হয়। হারেস মেম্বারের পরিবারের লোকজন যারা এটিতে জড়িত ছিল, তারা অনেকেই পরিবার নিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। যদিও আছির মাষ্টার কখনই আর তাদের আক্রমন করে নাই। বরঞ্চ সাহায্যই করেছে। আছির মাষ্টার যখন ফিরেন, তখন সাবুর বয়স দুই মাস।

সাবুর ছয় মাস বয়সের সময় - আছির মাস্টার তার বাসার সাথেই একটি ছোট ঘর করে জায়গা দেন নার্গিস নামে তার এক দুর সম্পর্কের বিধবা বোনকে। বোনের সাথে একটি দশ বছরের মেয়ে। তার মাস ছয়েক পরে মায়ের মৃত্যুর পরে, আছির মাস্টার চল্লিশার অনুষ্ঠান করেন গ্রামের বাড়ীতে। সেবারই ফিরে এসে আছির মাস্টার নার্গিসকে বিয়ে করেন। এক বছরের মাথায় নার্গিসের ঘরে বাবুর জন্ম হয়।
লোকে আগে আছির মাস্টারের ছেলে নাই জন্য বিয়ের কথা বললেও, সাবু হবার পরে আবার বিয়ে করাটা লোকজনের কাছে কিছুটা আশ্চর্যজনক মনে হয়। পরে জানা যায় -
আছির মাষ্টারের সাথে ছোটবেলায় নার্গিসের প্রেম ছিল। আছির মাষ্টারের মা বলেছিলেন -
- তিনি বেঁচে থাকতে আছির নার্গিসরে বিয়ে করলে যেন তার সেদিনই মরন হয়। তাই মায়ের মৃত্যুর পরেই এই বিয়ে। আর নার্গিস বিধবা হয়ে কোথাও যাবার জায়গা না থাকলে, আছির মাষ্টার তাকে থাকার জায়গা দেন।
বাবুর জন্মের সময় সাবুর বয়স দুই। পারুলের সতের, পরের দুটি মেয়ের ষোল ও সাড়ে চৌদ্দ। নার্গিসের মেয়ের এগার।
পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই আছির মেম্বারের তিনজন ও ছোট বউ নার্গিসের মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। চেয়ারম্যান বাড়ীতে থাকে আছির মাষ্টারের বড় বউ ফরিদা ও সাত বছর বয়সের সাবু। আছির মাষ্টারের নিজের বাড়ীতে থাকে ছোট বউ নার্গিস ও পাঁচ বছর বয়সের বাবু।

৭।
শুধু ফরিদা নয়, সবাই অবাক হয় দেখে, আছির মাষ্টার বড় বউ ফরিদার কাছেই থাকে বেশীরভাগ সময়। মাঝে মাঝে ছোট বউয়ের কাছে। সাধারনত, পুরুষ মানুষরা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে, ছোট বউয়ের কাছেই থাকে বেশী। আছির মাষ্টার আশ্চর্যজনক ভাবে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম শুধু বউয়ের ক্ষেত্রেই নয়, ছেলে দুজনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম।
আছির মাস্টারের বাবুর প্রতি টান সাবুর থেকে যে বেশী, সেটি ফরিদা যেমন বুঝতে পারে, তেমনি সাবুও এক পর্য্যায়ে বুঝতে পারে। সাবুর বয়স এখন বিশ, বাবুর আঠার। বড় হবার পরে আছির মাস্টারের সাথে সাবুর কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সাবুর মাতব্বর গোছের ভাবসাব শুধু আছির মাস্টারই নয়, এলাকার অনেকেই পছন্দ করে না। সাবু পেছনে পেছনে চেয়ারম্যান হতে কাজ চালায়। কিন্তু আছির মাস্টার সব জায়গাতে বাবুকেই এগিয়ে রাখেন। এ নিয়ে ফরিদা কয়েকবার সরাসরি জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পান নাই। সাবু দুই বছরের বড় হলেও বাবুকেই যেন সাবুর চেয়ে বড় লাগে তার শরীরের কারণে। বাবু শুধু শরীর নয়, চেহারা, কথাবার্তা ও আচার ব্যবহার পেয়েছে আছির মাস্টারের মত। পক্ষান্তরে, সাবুর কোন কিছুই তার বাপের মত নয়।

সাবু তাই, তার সাগরেদদের নিয়ে, আছির মাস্টারকে এবার শহরে সামনাসামনি কথা বলে চাপ সৃষ্টি করবে বলে পরিকল্পনা করে। ফরিদা এ কথা শুনে সাবুকে বলে -
- বাবা, এই কাজ করিস না। তোর বাপ চাপে পইরা মন পরিবর্তনের মানুষ না।
- তাইলে কি করুম মা? বাজানে যে আমারে চেয়ারম্যান না কইরা বাবুরে করব, এইটা তো তুমি জানই মা।
ফরিদা চুপ করে থাকে। সাবুর কথাবার্তা তার ভাল লাগে না।

৮।
আছির মাস্টার বারান্দায় বসে আছে নিশ্চুপ। প্রচন্ড বৃষ্টি। ফরিদা এক কাপ চা এনে আছির মাষ্টারের কাছে রাখতে রাখতে ফরিদা জিজ্ঞেস করে -
- পারুলের বাপ, আপনার শইলটা কি খারাপ? কাইল বাসা থাইক্যা রওনা কইরা ঢাকা শহর না গিয়া আইজ চইলা আইলেন?
আছির মাষ্টার চায়ে চুমুক না দিয়ে ও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফরিদাকে বলে -
- ফরিদা, সত্য কইরা বলতো, চেয়ারম্যান কার হওয়া উচিৎ? সাবুর? না বাবুর?
ফরিদা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। আছির মাস্টারই বলেন -
- ফরিদা, তুমি যদি আমারে বইলা একটা ছেলে দত্তক নিতা, তাইলেও আমি তারে চেয়ারম্যান করতাম। কিন্তু, তুমি সাবুরে জন্ম না দিয়া, কি করে আমারে তারা বাবা সাজাইলা? আমি কিন্তু রাগ কইরাই নার্গিসরে বিয়া করছি।
ফরিদা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে -
- লোকে বলাবলি করতেছিল, আপনি আর জেল থাইকা ছাড়া পাইবেন না। ফাসিও হইতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ চিন্তা কইরা।
- ফরিদা, চেয়ারম্যানি ক্ষমতা একবার পরিবার থেকে বাইরে গেলে আনা কঠিন। কিন্তু, ফেরার পরে আমারে তুমি বললেই পারতা! আমি এইটা মাইনা নিতে পারি নাই, তুমি আমারেও ধোকা দিলা?
- বিশ্বাস করেন পারুলের বাপ, আমি এতসব ভাবি নাই, আমি আপনারে বহুত ভালবাসি।
এই বলে ফরিদা আবার কান্নাকাটি শুরু করে। কান্না একটু কমলে আছির মাস্টার বলে -
- ফরিদা, তুমি বাবুরে তোমার সতীনের পোলা না ভাইবা, আছির মাস্টারের পোলা ভাবতে পার না? বাবু চেয়ারম্যান হউক, সেইটা চাও না? তুমি চাও না? ভাল মানুষ চেয়ারম্যান হউক, তোমার বাবা যেমন চাইছিলেন?
- আমার ভুল হইয়া গেছে গো পারুলের বাপ।
- আমি মইরা গেলে, তুমি পারবা না বাবুরে চেয়ারম্যান বানাইতে?
- পারব পারুলের বাপ, পারব। কথা দিলাম।
- ফরিদা, আমিও তোমারে অনেক ভালবাসি। এইজন্যই তো ছোট বউয়ের কাছে না যাইয়া তোমার কাছেই থাকি। তোমার কাছেই আসলাম। আমি সাবু বাবুরে সমান সম্পত্তিই লেইখা দিছি ফরিদা। আমি তোমার ইচ্ছেটাকে অসম্মান করি নাই। বড় বউ হিসেবে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা ও দাবি, দুইটাই বেশী।
ফরিদা এই কথা শুনে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করলে, আছির মাস্টার ফরিদার মাথায় হাতটি রেখে, বেরিয়ে যায় এই বৃষ্টির মধ্যে।

আছির মাষ্টার সত্যই ছোট বউয়ের কাছে যায়নি। ফরিদা অস্থির হয়ে সারাটা রাত কাঁদে আর বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করতে করতে ভোর হয়ে যায়, কিন্তু আছির মাষ্টার ফিরে না। ভোর বেলায় আছির মাস্টারের কাছের মানুষ ও বন্ধু রহমান চৌধুরী, ফরিদার কাছে খবর নিয়ে আসে -
- গতকাল মাঝরাতে আছির মাষ্টারের মরদেহ বরিশালের কাছে চরে পাওয়া গেছে। একদিন পূর্বে লঞ্চে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়ায়, মরদেহে পঁচন না ধরলেও আছির মাস্টারের চোখ দুটো, মাছ ঠুকরে খেয়ে ফেলেছে।
সাবুর অনুপস্থিতিতে বাবুই আছির মাষ্টারের দাফন সম্ন্ন করে আষাঢ়ের ১৬ তারিখ বাদ এশা। দাফনের পরে আরেকটি খবর আসে -
- বাসা ফেরবার পথে বাস দূর্ঘটনায় -
সাবু জানে বেঁচে গেলেও, কাচে কেঁটে তার দুটো চোখই সম্পূর্ণ বের হয়ে গেছে।

বিজু চৌধুরী

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৪৫

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: গ্রামীন পটভূমিতে দুর্দান্ত গল্প রচনা করেছেন বিজু ভাই!

পোষ্টে ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম!

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৩০

বিজু চৌধুরী বলেছেন: নতুন হওয়াতে উত্তরের পরিবর্তে কমেন্ট করেছিলাম। সেটিই করি করলাম।
বিজু চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ। এটি আমার প্রথম লেখা এবং আপনিই প্রথম কমেন্ট করলেন। খুব ভাল লাগল। লেখার ইচ্ছে আছে। আপনাদের ভাল লাগা সেটিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে, আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.