![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
১।
পাভেল সাহেব ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওসি সাহেবের চোখের পাতা স্থির। ওসি মইনুদ্দিন খুবই চিন্তিত ও বিচলিত। জাঁদরেল ওসি হিসেবে পরিচিত মইনুদ্দিন সাহেব। পাভেল সাহেব, ওসি সাহেবের মাথার উপরে তাকিয়ে দেখে, বোর্ডে তার নাম লেখা - মাইনুদ্দিন, মইনুদ্দিন নয়। এই একটি বাড়তি আকারের জন্যই মনে হয়, পাভেল সাহেব যতটুকু ভেবেছিলেন, তারচেয়েও জটিল মানুষ তিনি। পাভেল সাহেব এসেছেন থানায় জিডি করতে। ওসি সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে পরিচিত। এরপরেও সাধারন ঘটনাটি যখন পাভেল সাহেব দুবার বলার পরেও বুঝতে না পেরে তৃতীয়বার বুঝলেন, তখন নিজের অজান্তেই তার হাত চলে গিয়েছিল লাঠির কাছে। শেষ মুহুর্তে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করেন। কারণ মনে হয়, পাভেল সাহেব শুরুতেই তার পরিচয় দিয়েছিলেন -
- তিনি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন প্রায় সতের বছর আগে। শিক্ষিত মানুষের একটা দাম আছে সবার কাছে।
ওসি সাহেব পাভেল সাহেবকে তখনও বসতে বলেননি। বসতে বলার আগে তিনি যেভাবে পাভেল সাহেবকে একবার পা থেকে মাথা ও মাথা থেকে পা অব্দি দেখলেন, সেভাবে -
- মানুষ কোরবানির হাটে গরুও দেখে না।
- আরবের লোকেরা যখন অসভ্য ছিল, তখন বাংলার গ্রাম গঞ্জে মানুষ এভাবে বিয়ের কনেও দেখত না।
পাভেল সাহেবের খুব ছোটবেলার একটা শখ ছিল - বাসা থেকে একবার পালাবেন। তার বন্ধুরা মোটামুটি সবাই একবার করে পালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ক্লাস ফোরে পাভেল সাহেবের পালানোর সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন ছিল। পালানোর সঙ্গী সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির বাসার টিনের চালে সকাল এগারোটার দিকে একটি ঢিল মারবার কথা ছিল। সারাটি দিন ঢিলের অপেক্ষায় কান পেতে রইলেন পাভেল সাহেব। ঢিলও পড়ল না, পালানোও হল না। অথচ বন্ধুটি পরে আরেক বন্ধুর সাথে ঠিকই পালিয়ে সেই বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, কিন্তু পাভেল সাহেবকে বলেনি। এই কারণে পাভেল সাহেব অসম্ভব রাগ হয়ে একটানা প্রায় দেড় দিন বন্ধুটির সাথে কথা বলেননি। এরপরে কয়েকবারই আজ কাল করে পাভেল সাহেবের আর পালানো হয়নি। পাভেল সাহেবের বয়স এখন চল্লিশ। আর দেরী করলে হবে না। তাই, শেষে একদিন সাহস করেই ফেললেন।
পাভেল সাহেবের এক বন্ধু ও তার বড় বোন বিদেশে থাকে। বাসাটি বড় বোনের। তিনি পাভেল সাহেবকে এক সেট চাবি দিয়ে গেছেন, যদি ঢাকার বাইরে যেয়ে থাকতে মন চায়, থাকতে পারে। তাছাড়া তিন তলা বাসার অভিভাবকও বলা যায় পাভেল সাহেবকে। দোতালার এক ইউনিট তালাবদ্ধ থাকে। ওনারা বাইরে থেকে বছরে একবার এসে দুই সপ্তাহ থাকেন। এই বাসাটিকেই পাভেল বেছে নিয়েছেলে পালিয়ে গুনে গুনে পাঁচদিন থাকতে।
২।
পাভেল সাহেব বড্ড ঝামেলায় পড়েছেন, বুঝতে পারেন। ভয়ও হচ্ছে এই মানুষটিকে। মাইনুদ্দিন সাহেব আর সময় পেলেন না? পাভেল সাহেবের বাসা ছেড়ে পাঁচদিনের জন্য পালানোর সময়টিতেই কি তার নিউমার্কেট থানার ওসি হয়ে থাকতে হয়?
ওসি সাহেব নিজেকে সামলিয়ে নিলেন দ্রুত। এরপরে বেশ কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন -
- পালাবেন কেন?
- আমার বহুদিনের শখ।
- ন্যাংটা হয়ে রাস্তায় হাঁটা, কোটিপতির ছেলে ভিক্ষে করা, পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ফুটপাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা কে কতক্ষণ থাকতে পারে? দেখেছি। এইরকম পাগলামো তো শুনি নাই।
- আসলে ছোটবেলার একটা শখ।
- ছোট বেলার শখ, যান পুরন করুন গিয়ে। চাইলে কাপড় না পড়েই যেতে পারেন। আমার কাছে এসেছেন কেন?
- থানায় জানিয়ে যাওয়া কি উচিৎ নয়?
- আপনি বেড়োতে যাচ্ছেন। এত বড় মানুষ পালাবেন কিভাবে? জিডিই বা করবেন কেন?
- জিডি না করলে, বাসা থেকে জিডি করতে আসলে তো আপনারা জঙ্গী ভাবতে পারেন।
- এই বয়সে মানুষ জঙ্গী হয় নাকি?
- ভাই, কিছুই বলা যায় না। সত্তুর বছর বয়সে যেয়ে মানুষ বিয়ে করার জন্য পাগল হয়। সত্তুর বছর বয়সে বিয়ে পাগলা মানুষের মাথার ভেতরের ফারেনহাইট আঠার বছরের ছেলের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশী, আর জঙ্গীদের চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশী থাকে। বাই দ্যা বাই, ফারেনহাইট থেকে সেলসিয়াসে যেতে চাইলে সূত্র হচ্ছে -
C/5 = (F-32)/9
ওসির চোখ পিটপিট করছে। একটা চটকানি দিতে ইচ্ছে করছে। সেটি দিতে না পেরে, মেজাজ অসম্ভব গরম। এদিকে দর্শনার্থী জমে গেছে আরো অনেকে। এই পাগলকে বিদেয় করতে হবে। তাই বললেন -
- আপনি এপ্লিকেশন লিখে এনেছেন?
- জ্বী, এই নিন।
সাধু ভাষায় লেখা পালোনোর বিশদ কারণ যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে স্বস্তি পাবার কথা থাকলেও, ওসি সাহেবের অস্বস্তি হচ্ছে পাগল ভেবে।
- আপনি যদি না ফিরে আসেন?
- দেখুন, আমার বাচ্চা কাচ্চা আছে। আমার পুরোন মোবাইলটা বন্ধ রাখব। আজই এই নতুন নাম্বারটি নিয়েছি। বায়োমেট্রিক করা আছে। চাইলে আমি আপনাকে প্রতিদিন ফোন দিব, আমার নতুন নাম্বার থেকে।
ওসির এই কথাটি মনে হল মনে ধরেছে। জিজ্ঞেস করলেন -
- আর কোন ডকুমেন্ট আছে।
- জ্বী। এই যে আমার ন্যাশনাল আইডির কপি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি, পাসপোর্টের কপি, টিআইএন নাম্বারের কপি, বাসার ইলেকট্রিসিটি ও ফোন বিলের কপি, অফিস থেকে ছুটি নেবার কপি, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট সব আছে। সাথে মূল কপি আছে, মিলিয়ে নিতে পারেন।
- বাসায় চিন্তা করবে না?
- আমার পুরোন মোবাইলটা খুলে প্রতিদিন একটা মেসেজ পাঠাব - আই এম ফাইন, ডোন্ট ওরি। এরপরে ফোন বন্ধ।
- আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানকার ঠিকানা দিন।
- সেটি এপ্লিকেশনের সাথে সংযুক্ত আছে। ঠিকানার সাথে গুগল ম্যাপে লোকেশনও দেয়া আছে।
বাধ্য হয়ে ওসি সাহেব জিডি নিলেন, কিন্তু কপালের ভাঁজ কোনভাবেই সমান হল না।
৩।
পাভেল সাহেব ওসি সাহেবকে ফোন করেছেন -
- আসসালামুঅলায়কুম ওসি সাহেব।
- অলায়কুম আসসালাম। কে বলছেন?
- আমি পাভেল রহমান। পালিয়ে আসার জন্য জিডি করেছিলাম।
- রোমেল, তোর তো সাহস কম নয়, চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিস, আবার ফোন করেছিস? একবার ধরি, সারা জীবনে যত ডিম মুখে খেয়েছিস, তারচেয়ে বেশী ডিম উল্টো রাস্তায় যখন খাওয়াব, তখন বুঝবি।
- ওসি সাহেব, আমি ইঞ্জিনিয়ার পাভেল। গতকাল বিকেলে..
- আপনি সত্যি পালিয়েছেন? ফাজলামো না করলে হয় না? এমনিতেই সারাদিন চোর বাটপারের পেছনে দৌড়াতে হয়, তার উপরে আপনাদের যন্ত্রনা।
এই বলে ওসি সাহেব সেদিন ফোন রেখে দিয়েছেন। পরের দিন ফোন করবার জিজ্ঞেস করলেন -
- আপনি সত্যই পালিয়েছেন?
- জ্বী, আপনাদের দোয়ায়।
- আমি এইসব পাগলামো কাজে দোয়া করতে যাব কি করতে?
- সরি।
- কেন প্রতিদিন ফোন করছেন?
- আপনারে প্রতিদিন ফোন করে আপডেট দিতে হবে না?
- আচ্ছা রাখি, ফোন করে জানাবেন।
এই বলে ওসি সাহেব সেদিন ফোন কেটে দিলেন। তৃতীয় দিন মনে হয়, ওসি সাহেবের মুড ভাল ছিল। পাভেল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন -
- আচ্ছা, পালিয়েছেন, ভাল কথা। সাথে বন্ধু বান্ধবী কতজন?
- না, না, আমি একা।
- বলেন কি? রান্না করে কে?
- আমি। আমি খুব ভাল রান্না করতে পারি, সুনাম আছে পরিবারে। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না।
- রাখেন আপনার চিন্তা। আপনার তো পরিবার, আমার রান্নার প্রশংসা পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই আছে।
- তাইলে তো একদিন খেতে হয়।
- তা থানায় খেতে চান? নাকি লকারের ভেতর?
- সেটি তো আপনার ব্যপার। কেউ দাওয়াত দিলে কি জিজ্ঞেস করা যায় যে, ভাই মেঝেতে বসে খাওয়াবেন? নাকি ডাইনিং টেবিলে?
- কথা তো ভালই শিখেছেন।
- পুলিশ হয়ে রান্না করতে পারেন, শুনে আমার ভালই লাগছে।
- পুলিশকে আপনারা কি ভাবেন? আমরা মানুষ নই?
- সরি, তা বলতে চাচ্ছিলাম না আসলে।
-আপনি ওয়াইফকে জানিয়েছেন?
- জ্বী। প্রতিদিন একটা করে এসএমএস করি। আপনাকে ফরোয়ার্ড করব?
- কি উল্টাপাল্টা বলছেন? আপনার ওয়াইফকে পাঠানো মেসেজ আমি দেখতে যাব কেন?
- সরি সরি।
- এত সরি বলতে হয় কেন? রাখি।
৪।
চতুর্থদিন পাভেল সাহেব ব্যাপক ভয় পেলেন ওসি সাহেবের সাথে কথা বলে। ওসি সাহেব বললেন -
- পাভেল সাহেব, কেমন লাগছে? কি করেন সারাদিন?
- আনন্দেই কাঁটছে ভাই। সারাদিন মুভি দেখি, রান্না বান্না করি। জীবনের একটি অপূর্ণ হওয়া আশা পুরণের চেয়েও ভাল লাগছে এই জায়গাটি - খুব সুন্দর। মজার ব্যপার হল - দোতালার বারান্দায় দাড়িয়েই মাছ ধরা যায়।
- আপনি তো আগামীকালই ফিরছেন, তাই না?
- না ভাই। অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছিলাম।। ভেবেছিলাম পাঁচদিন পালিয়ে আর দুদিন বাসায় কাটাব। পরে চিন্তা করে দেখলাম, ছুটি এক্সটেন্ড না করে, বাসার দুদিনকে পালানোতে এড করি। তাই আগামী রোববার ফিরব।
- সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ?
- ভালই লাগছে। আর চিন্তা করে দেখলাম, একটা পেয়ারার বীচি খেয়ে রোজা ভাঙ্গা যে কথা, এক থাল ভাত খেয়ে রোজা ভাঙ্গা একই কথা। তাই জীবনে একবারই পালিয়েছিই যখন, তখন সাতদিনই থাকি।
- আচ্ছা পাভেল সাহেব, আপনি কি বাসা থেকে বের হন না?
- না ভাই। ছোটবেলাতেই তো প্রথম লিষ্ট করেছিলাম। এখন তো নতুন ভার্সনে সব নিয়ে একবারেই ঢুকেছি। বের হওয়া তো দুরের কথা, মেইন দরজাই খুলিনি।
- আচ্ছা। আপনি বের হবেন না।
- কেন? কেন ভাই?
- দেখুন, নিয়ম অনুযায়ী আপনি যেখানে থাকেন, সে জায়গাটিতে আমাদের ফোর্স পাঠানোর নিয়ম খোঁজ নিতে।
পাভেল সাহেব ভয় পেয়ে বলছেন -
- কেন ভাই?
- জঙ্গী থাকতেও তো পারে। আর, আপনাকে জানিয়ে যাবার কথা নয়। যেহেতু আপনি শিক্ষিত মানুষ, তাই জানালাম। কাল শুক্রবার, ফোর্স যেতে পারে, না হলে হয়তো শনিবার যাবে।
পাভেল সাহেব খুবই ভয় পেলেন। কারণ, উর্দি পড়ে লোকজন আসলে ব্যপারটা খারাপ হবে। আবার এখনই বাসায় ফিরে গেলে সন্দেহ করতে পারে। আর এই ওসি যেরকম কঠিন টাইপের মানুষ!
পাভেল সাহেব পরের দিন খিচুড়ি ও ডিম ভাজা করেছেন। দুপুরে একটু বেশী করেই রান্না করেন, রাতের জন্যও। জুম্মার নামাজ পড়ে পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থাতেই ওসি সাহেব নিজেই চলে এলেন। এই ওসি সাহেব আসা মারাত্নক ভয়ের ব্যপার মনে হয়েছিল। কিন্তু, পাভেল সাহেব এটি ভেবেই সান্তনা পেলেন যে, সিভিল ড্রেসে এসেছেন। পাভেল সাহেব ঘরের সমস্ত আলমিরার চাবিগুলি ওসির হাতে দিতে দিতে বললেন -
- আপনি চেক করতে পারেন।
- আমি চেক করব কেন? আমি কোন চাবি কোথাকার? বুঝব কি করে? আপনি রাখেন, দরকার হলে আমি বলব।
- ও সরি! সরি।
- শুধু সরি। সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি। কিসের?
- ও খিচুড়ি রান্না করেছি। খাবেন?
- খাবার নিয়ম নেই। কিন্তু, আপনি তাহলে খাবেন কি?
- আমি তো বেশী করেই রান্না করেছি।
ওসি সাহেব পেট পুরে খেলেন। এরপরে বললেন -
- আপনার রান্না আসলেই সুন্দর। তবে, আমার সাথে ড্র করার সম্ভাবনা চল্লিশ ভাগ আর হারার সম্ভাবনা ষাট ভাগ। জেতার প্রশ্নই আসে না।
৫।
ঘর বাড়ী চেক না করে ওসি সাহেব আগে একটি সিগারেট ধরিয়ে পাভেল সাহেবের দিকে একটি সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন। পাভেল সাহেব কিছুটা লজ্জা পেলেও সিগারেটটি নিয়ে ধরালেন। ওসি সাহেব তার চেয়ে মনে হয় দুই তিন বছরের বড় হবেন, খুব বেশী হলে। তবে, লোকটার ভাব আছে।
ওসি মাইনুদ্দিন ধোঁয়া ছেড়ে ড্রইংরুমের বারান্দায় দাড়িয়ে বললেন -
- জায়গাটা তো সুন্দর। সামনের দোতলা বাড়ীটি কার?
- আমি ঠিক জানি না। তবে, যে দুই তিনজনকে দেখেছি, জঙ্গী মনে হয়নি।
- শিওর?
- আমি মোটামুটি শিওর। তবে, ওনাদের একটি কিশোরী মেয়ে আছে, তাকে একটু ঢঙ্গী মনে হয়েছে, জঙ্গী নয়।
- এত কথা বলছেন কেন? সন্দেহজনক।
- সরি, সরি। আপনি চেক করুন।
- সেটি আমার ব্যপার। আপনার ওয়াইফ আপনাকে কি কোন মেসেজ করেনি?
- করেছে, তবে খুব একটা টেনশন শো করেনি। আসলে, জীবনে যখন সব কিছু ভাল মনে হবে, তখন বুঝতে হবে - বড় খারাপ কিছু দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কি জানি, বাসায় গেলে এবার জীবনে প্রথমে গায়েই হাত তুলে কিনা? বুঝতে পারছি না।
- ওয়াইফরে ভয় পান নাকি?
- কি যে বলেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী না? আপনারা পুলিশ মানুষ, ভয় তো নিশ্চয়ই পান না।
- কেন? আমরা পুলিশরা কি মানুষ নই? স্ত্রীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনারা কেন বলেন? জানি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো আমাদের, আমরা বুঝি ভাল। জীবনে দুইবার মন্ত্রীর সাথে সামনা সামনি কথা বলেছি। বেশী রাত করে বাসায় ফিরলে, বউরে যে ভয় পাই, তার সিকি ভাগ ভয়ও লাগে নাই।
- বলেন কি ভাই?
- হ্যাঁ, কেন বুঝতেছেন না? আমরাও সাধারন মানুষ। গান শোনেন মনে হচ্ছে। কি সিডি আছে?
- আমি তো ইংলিশ গান শুনি। আপনার পছন্দের হিন্দি গান নাই।
- আমি কি বলেছি যে, হিন্দি গান আমার পছন্দ? পুলিশকে কি ভাবেন? তবে আমার ইংলিশ গান পছন্দ নয়। সত্য কথা বুঝি না।
এই বলে ওসি একটি সিগারেট ধরাতে গেলে পাভেল সাহেব বলেন -
- প্লিজ, আমার কাছে এবার নিন।
ওসি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে বেডরুম সংলগ্ন বারান্দায় গিয়ে চারদিক চেক করতে লাগলেন। পাভেল সাহেবের ভয় লাগছে।। কখন কি ধরে ফেলবেন? শেষে না বিপদেই পড়েন। হটাৎ শুনলেন, অদ্ভুত সুন্দর গলায় ওসি সাহেব গান গাইছেন -
- এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে।
বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে পাভেল সাহেবের এ গান শুনে মনে হল, এবার ইংলিশ গান শোনা বাদ দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা শুরু করতে হবে। গান শেষ হলে তিনি ওসি সাহেবকে বললেন -
- পুলিশ হয়ে আপনি এত সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গান?
- এত সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই, সেটি আশ্চর্য্যের হতে পারে। কিন্তু, পুলিশ হয়ে মানে? আপনি বারবার এমন সব কথা বলছেন যেন, পুলিশ মানুষ নয়, তাদের মন নেই।
- সরি, সরি।
- বারবার সরি শুনতেও ভাল লাগছে না।
এই বলে ওসি সাহেব আস্তে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। যাবার আগে ফিসফিস করে বললেন -
- বড় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ফোন করেছে।
৬।
কথা বলে এসে ওসি সাহেব এবার সরাসরি পাভেল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন -
- আচ্ছা, এই ফ্ল্যাটের চাবি কার কার কাছে আছে?
পাভেল সাহেব একটু ভয় পেয়ে বললেন -
- এক সেট ফুল আমার কাছে, আরেক সেট দেশের বাড়ীতে মালিকের মায়ের কাছে। আরেক সেটের - এই বেডরুমের চাবিটা ওনার বোনের কাছে, বাকী রুমের চাবি ও মেইন ডোরের চাবি নীচ তলার এক ভাবির কাছে, পরিচিতা। কেউই ঢোকে না। ঢুকলেও আমাকে জানিয়ে ঢুকে।
- তার মানে আপনি কন্ট্রোলার?
- জ্বী। কোন সমস্যা?
- আমি কি বলেছি সমস্যা? কে কে আসে?
- আমি এই প্রথম থাকতে এসেছি।
- আর কেউ কখনো আসে নাই?
- মালিকের এক বন্ধু আর আমার দুই বন্ধু এসেছিল দুবার।
- নিজের বউ নিয়ে এসেছিল তো? এসব জায়গায় তো লোকজন বান্ধবী নিয়ে আসতে চায়।
- না, না, কি বলছেন? সবাই একাই এসেছিল।
- সবাই কি পালিয়ে আপনার মত?
পাভেল সাহেব কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলেন -
- জ্বী।
- তাহলে তো এটিকে পালাটেদের অভয়াশ্রম বলা যায়। কি বলেন? আপনি সবাইকে ভালভাবে চিনেন তো? নাকি, চাইলেই চাবি দিয়ে দেন?
- মোটামুটি ভালই চিনি? চাইলেই কি আর সবাইকে দিব?
- যদি ভয় দেখায়? ধরেন, আমি চাইলাম?
- ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এই বান্দা ভয় পায়না। আপনি চাইলে তো অবশ্যই দিব, যদিও চাইবেন না, জানি।
- আমাকে তো ভয় পেয়েই দিবেন? নাকি?
- ভয় পেয়ে কেন? আপনার একটা আইডেন্টিটি আছে না? হাজার হইলেও পুলিশ।
- আবার পুলিশ? তারপরে আবার বলছেন, হাজার হলেও। বাংলাদেশে লক্ষ পুলিশ আছে, চাইলেই সবাইকে চাবি দিবেন? সন্দেহজনক!
- সবাইকে দিব কেন? আপনি ভাল মানুষ।
ওসি সাহেব হেসে ফেলে বলেন -
- আপনি দুইদিনের পরিচয়ে ভাল মানুষ বানিয়ে দিলেন?
- আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না। আর এত সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত যে মানুষ গাইতে পারে, সে খারাপ হতে পারে না।
ওসি সাহেব আবার হেসে বলেন -
- পাভেল সাহেব, আমি আসি। আমাকে ও আপনার স্ত্রীকে ফোন করবেন। আপনি তো পরশু দিন অর্থাৎ রোববারে বাসায় ফিরবেন, তাই না?
- জ্বী।
- ফেরার পথে আগে থানায় দেখা করতে পারবেন?
- কেন পারব না? আপনি পুলিশ মানুষ।
- বারবার পুলিশ পুলিশ করছেন কেন? এতবার আপনাকে বলছি, আমরাও সাধারন মানুষ, বুঝতে পারছেন না কেন?
- সরি, এবার বুঝতে পেরেছি।
- কি বুঝতে পেরেছেন?
- অপনারাও মানুষ।
- কিছুই বুঝতে পারেন নি। আমি রোববারের পরে পাঁচদিনের ছুটিতে। ঠিক করেছি, আপনার মত দুদিন পালাব। আপনার কোন অপত্তি না থাকলে, দুদিনের জন্য চাবিটা দিতে পারবেন? এত সুখ কোথায় পাব?
পাভেল সাহেব কয়েক মুহুর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন -
- অবশ্যই পারব।
পাভেল সাহেব দেখেন, ওসি সাহেবের মুখটা আনন্দে চিকচিক করছে। তিনি বললেন -
- রোববার আপনি ফিরছেন, আমি ঢুকছি। ঠিক আছে?
এই বলে ওসি সাহেব গাইতে লাগলেন -
- "আমার হবে শুরু, তোমার হলে সারা।"
এটি বলেই বললেন -
- গানটা জীবনমুখী করে কথাগুলি বদলিয়ে গাইলাম।
ওসি সাহেবকে এগিয়ে দিতে পাভেল সাহেব আজ প্রথম বাসা থেকে নেমেছেন। ওসি সাহেব আকাশের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে বললেন -
- ঢাকায় থাকলে আকাশের এই বিশালতা কখনই বোঝা যায় না।
রওনা করবার আগে পাভেল সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দিয়ে, ওসি সাহেব এবার শিষ দিয়ে গানের সুর তুলে রওনা করলেন -
- এ আকাশকে সাক্ষী রেখে, এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে
তোমাকে বেসেছি ভালো, তুমি মোর নয়নের আলো।
পাভেল সাহেব দেখেন -
- "ভদ্র্যলোকের হাসিটা শিষ দেবার মতই বড্ড সুন্দর।"
©somewhere in net ltd.