নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ সরল সোজা সাদা ভাষায় জীবনের কথা লিখতে পছন্দ করি। কাদা মাটিতে বেড়ে ওঠা একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ। মনের কথাগুলি বরাবরই মুখে এসে বের হতে চায় না, কলমে আসতে চায়।

বিজু চৌধুরী

আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।

বিজু চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

হরিজন সম্প্রদায়

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৪৮

য়েক পোয়া ছাতুয়া মে আধা পোয়া গুড়
বিন্দিয়াকে রুপে হায় হো গ্যায়া চুড়।
আরে টারা রা রা রা..
কোন হিন্দি বা উর্দু ছবির ডায়ালগ নয়। খুব ছোটবেলায় শোনা বাংলা একটি সিনেমায় হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের মদ্যপ অবস্থায় ডায়ালগ। আমরা জ্ঞান হবার পরে মজা করে বলতাম, কিছু না বুঝেই।
হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে না সাধারণত। কেন করবে? গোত্রের বাইরে যে বিয়ে হয় না। বিয়ে হয় না, না বলে বলা উচিৎ কেউ করে না। বেশী শিক্ষিত হলে তো ঝামেলা। গোত্রে যদি শিক্ষিত পাত্র পাত্রী না পাওয়া যায়? তখন? সংসার জীবনে শিক্ষায় অসম পাত্র পাত্রী তৈরী করে লাভ কি? এমনিতেই গোত্র হিসেবেও তারা যে খুব বড় তাও নয়।
ক্লাসে আমাদের এক বছর বড় ছিল হরিজন সম্প্রদায়ের মতিলাল। পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিল। মেট্রিক পাশ করে আর পড়াশুনা করেনি। তবে সে সার্ভেয়ার হিসেবে খুবই নামকরা। আমি তাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলাম জমি মাপার ব্যাপারে। হাতের আঁকা থেকে শুরু করে লেখা, যোগ বিয়োগের স্টাইল, পুরো রিপোর্টটি সার্বিকভাবে ছিল অসাধারন।
আমার ছোট বোনের সাথে রীতা কুমারি নামে হরিজন সম্প্রদায়ের এক মেয়ে পড়ত। ঐ স্কুলের অংকের সিনিয়র শিক্ষকের অভিমত - রীতা কুমারীর মত ইলেক্টিভ ম্যাথে মাথা আর কারো সে দেখেনি তার শিক্ষক জীবনে। মেট্রিকে দুই অংকেই লেটার মার্কস পেয়ে বিয়ে করে এখন নাটোর অথবা নওগাঁর সরকারী হাসপাতালের সুইপার।

দেশের বাড়ী কুড়িগ্রামে হরিজন সম্প্রদায়ের বাস, শহরের পুরাতন গওহর পার্ক মাঠে অবস্থিত মজিদা কলেজের পিছনে খাস জমিতে, রেল লাইনের সমান্তরালে, যেন আরেকটি গোত্রের সমান্তরাল জীবন। যে জীবন, আমাদের মত সাধু ভদ্রলোকদের সাথে সবসময়েই সমান্তরালে প্রবাহিত, কখনও মিলিবার নয়।
একদিন প্রাইভেট কলেজ - মজিদা কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে পিওন একটি ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এলো। ভিজিটিং কার্ড দেখেই প্রিন্সিপ্যাল স্যার দাড়িয়ে গেলেন। একে আরেকজন প্রিন্সিপ্যাল এসেছেন, সেও চট্টগ্রাম থেকে। তার উপর প্রাইভেট কলেজ হলেও কথা ছিল, সরকারী কলেজ। তাও যেনতেন কলেজ নয়, খোদ চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। এখানে শেষ হলেও মানা যেত, নামের আগে যে "ডঃ" লেখা। এলাকার হাতেগোনা দুই একজন মানুষ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হলেও তারা কেউই এলাকায় থাকেন না। তাদের খুব কম মানুষই দেখেছে। এইরকম একজন ডক্টরেটকে পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছুটা উত্তেজিত।
উনি এসে বসলেন, কুশল বিনিময় শেষে প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বললেন যে জগলাল কোথায় থাকে? প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে একাধিকবার তার নাম বলে নিশ্চিত করতে হল যে, উনি আসলেই হরিজন সম্প্রদায়ের প্রধান জগলালের কাছে এসেছেন। জগলালের কাছে খবর গেল। জগলাল জানতেন যে, উনি যে কোন দিন আসতে পারেন। খানিক্ষন পরে আলমিরাতে তুলে রাখা প্যান্ট শার্ট পরে জগলাল এলো।

হরিজন সম্প্রদায়ভুক্ত চট্টগ্রাম কলেজের ঐ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী প্রিন্সিপ্যাল স্যারের মেয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশুনা করত। স্যার সমস্ত কলেজ ও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে বলে রেখেছিলেন যে, কোথাও যদি কখনো হরিজন সম্প্রদায়ের কেউ পড়তে আসে তাকে যেন খবর দেয়া হয়। একদিন তিনি খবর পেলেন আরেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশুনা করছে। খবর পেয়েই উনি ছুটলেন। সেই ছেলের পরিচয় হচ্ছে - সে কুড়িগ্রামের হরিজন সম্প্রদায়ের প্রধান - জগলালের ছেলে।
ওনার বেশী সময় লাগেনি জগলালের ছেলে ও তার মেয়েকে এটি বোঝাতে যে, এই দেশ তোমাদের জন্য নয়। এখানে পদে পদে বর্ণ বৈষম্যের চেয়েও হাজার গুনে ভারী গোত্র বৈষম্যের শিকার হতে হবে। তোমরা বিয়ে করে আমেরিকা চলে যাও। আমি ব্যাবস্থা করছি।

বছর পাঁচেক আগে হবে হয়তোবা, আমি তখন কুড়িগ্রামে ও সেদিনই বিয়ে হচ্ছিল। জগলালের নাম তখন কুড়িগ্রামে সবার মুখে মুখে। জগলালের বিয়াই একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী নামকরা সরকারী কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। জগলাল সংখ্যালঘু নয়, অচ্ছুত বলে গণ্য একটি গোত্রের মানুষ হয়ে কুড়িগ্রামের মাথা উঁচু করে দিয়েছে। বেশ কয়েকদিন রাস্তা ঘাটে জগলালকে লোকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল - ঘটনা কি সত্যি নাকি? জগলালের সাথে সাধারণ মানুষজন প্রথম আগ্রহ নিয়ে কথা বলল ও অনেকে দাওয়াত করতে বলায় জগলাল দাওয়াত করল। দাওয়াতের সময় তাকে যে কথাটি বলতে হয়েছিল তা হচ্ছে - বাবু আসবেন। আপনাদের প্যান্ডেল বানানো থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া সবকিছুই আমি অমুকের দায়িত্বে দিয়ে দিয়েছি। আমার কোন লোকজন সেখানে যাবে না, আপনারা আসবেন। হায় সেলুকাস! বিচিত্র এ নিয়ম! এতটাই কি অস্পৃশ্য তারা? - খাবার প্যান্ডেল বানানোর সময় থেকে খাওয়া রান্না, পরিবেশন কোন কিছুতেই সামনে আসবে না। হায়রে - আমার একটা অচ্ছুত মানুষ দাও, যার রক্তে বর্জ্যের গন্ধ।

চাকরিগত সূত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভিভিআইপি বগি দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। যেগুলো বৃটিশ আমলে ব্যাবহৃত হত বৃটিশদের পরিবহনের কাজে। এখন সেই জৌলুশ আর নেই, রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে। কিন্তু বিলাসিতার পরিসর বা ব্যাপ্তি সহজেই অনুমেয় এখনো। দুটো কামড়া জোড়া দিয়ে তৈরী করা। ভিতরটা আপাদমস্তক লাল কার্পেট দিয়ে মোড়ানো। দুইটি বেডরুম এর সাথে এটাচড টয়লেট, যেখানে ইংলিশ কমোড, বেসিন ও টয়লেটটি টাইলস দিয়ে মোড়ান। কিচেন, চাকরদের থাকবার জন্য ঘর, সিকিউরিটি গার্ডদের থাকার ব্যাবস্থা রয়েছে। কিছু কথা বাংলায় লিখে বোঝাতে কষ্ট হয়। Last but not the least, কুকুর রাখবার জন্য একটি ছোট্ট ঘর ছিল। এই বৃটিশদের তৈরী করা একটি বিশেষ আইন আমি তখনই শুনেছিলাম, যদিওবা বিশ্বাস হয়নি প্রথমে।
হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশে জমি কিনতে পারে না। কিন্তু দেশের সমস্ত খাস জমি চাইলেই তারা ভোগদখল করতে পারে। শুধু একটা নামমাত্র অনুমতি নিতে হয়। লিজের দরকার হয় না।
হরিজন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই চাকরি আছে, যেহেতু প্রতিটি অফিসেই টয়লেট আছে।
হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রাইভেট কাজের রেট সন্মন্ধে কারো কোন ধারনা আছে কিনা জানি না। আমরা যখন ছোট, তখন মা প্রাইভেট স্কুলে সর্বসাকুল্যে ছয়শ টাকার মত বেতন পেত। ঐ সময় কুড়িগ্রামে ও দেশেও বটে, বেশীরভাগ জায়গাতেই স্যানিটারি টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। টিনের ড্রাম নিচে রেখে উপরে টয়লেট স্থাপন করা হত। আধা ঘণ্টায় একটি টিন পরিস্কার করে দিতে তারা ঐ সময়েই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা নিত।
হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের আরেকটি সুবিধা নাকি অসুবিধা বলব - মদ খেতে কোন লাইসেন্স লাগে না এবং ইচ্ছে মত খাও। তাদেরকে মদ দিতে বাধ্য যত ইচ্ছে তারা চাইবে। তারা মদ খাইবে আর গাইবে -
য়েক পোয়া ছাতুয়া মে আধা পোয়া গুড়
বিন্দিয়াকে রুপে হায় হো গ্যায়া চুড়।
আরে টারা রা রা রা..

এই আইনগুলি বৃটিশরা তৈরী করেছিল - টয়লেট মানুষ সারাজীবনই করবে। হরিজন সম্প্রদায় তাই সারাজীবনই লাগবে। তাই হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ, তোমরা আয় করবে দুই হাতে, মদ খেয়ে সেই পয়সা উড়াবে দুই হাতে, জমি কিনতে পারবে না, কিন্তু জমির তো দরকার নেই। বসত বাড়ী নেই, সমাজে মানুষের সাথে মিশবার সুযোগ নেই, মাছ মাংসের বাজারে তাদের প্রবেশ নিষেধ, চলতি পথে ভুলেও কারও শরীরে যেন শরীর না লাগে। আমরা ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম যখন, তাদের ডাকলেও খেলতে আসত না। বল কোন কারণে ওদের বাসার দিকে চলে গেলে, কখনই পা দিয়ে লাথি মেরে ফেরত পাঠাত না, হাত দিয়ে তুলে পাঠাত। এতটা অপমান? এতটা কষ্ট? এজন্যই তোমাদের মদের পরিমানের উপরেও কোন বিধি নিষেধ নেই। যত কষ্ট পাবে, ততই মাতাল হবে।
সেই টিনের টয়লেটের পরিবর্তে আজ সেনেটারি টয়লেট এসেছে, যুগান্তকারী পরিবর্তন। তবে, সেটি হরিজন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের প্রতি আমাদের চিন্তা ভাবনাকে পরিবর্তন করতে পারেনি।
১৭৫৭ - ১৯৪৭, প্রায় দুইশত বছরের বৃটিশ শাসনে আমরা হয়েছি সভ্য, ভদ্র, মানবতার শিরোমনি। বৃটেনের রাণী সবার সাথে হাত মেলান না, তাই আমরাও হরিজন সম্প্রদায়ের সাথে হাত মিলাই না।
বলো কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী
পার হয় তোমাকে ধরে, দূর্বল মানুষ যদি?

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৩৩

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: ধন্যবাদ, হরিজনদের করুন জীবনগাথা তুলে ধরেছেন এ লিখায় , ধরনীকে যারা করে বসবাস উপযোগী তাদের সাথে হাতে হাত
কাধে খাধ মিলিয়ে দিতে হবে জীবনের পথ পারি । তাদের মুল্যবান শ্রমের মর্যাদা দেয়ার জন্য সমাজের সকলকে আসতে হবে
এগিয়ে ।

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:১৮

বিজু চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কথাটিকেই সমর্থন করতে বলি - বৈষম্য সমাজে থাকবে, কিন্তু সেটি যেন মানবতার সীমার নীচের না নামে কথনই।

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:০৫

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: খুবই অবহেলিত ও সামাজিকভাবে নিপীড়িত হরিজন সমাজের কথা বলে গেলেন! সমাজের এই নিষ্ঠুরতার প্রতি ধিক্কার!

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:১৯

বিজু চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মানুষ হিসেবে মানুষকে গন্য করতেই হবে, এটি ন্যুনতম চাওয়া।

৩| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:০০

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: ধন্যবাদ সুন্দর প্রতি উত্তরের জন্য ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.