নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ সরল সোজা সাদা ভাষায় জীবনের কথা লিখতে পছন্দ করি। কাদা মাটিতে বেড়ে ওঠা একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ। মনের কথাগুলি বরাবরই মুখে এসে বের হতে চায় না, কলমে আসতে চায়।

বিজু চৌধুরী

আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।

বিজু চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালবাসা

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:১৩

১।
মেয়েটি বেশ জড়তা নিয়ে দাড়িয়ে আছে শফিকের গুলশান অফিসের সামনে। মেয়েটির পড়নের সালোয়ার কামিজ বলে দেয়, আর্থিক অবস্থা বেশ নাজুক। ওড়নাটির এক প্রান্ত সেলাই করা। সালোয়ার কামিজটিও বেশ কম দামের বোঝা যায়। পায়ের চপ্পলটি সেলাই করা। মুখে কোন প্রসাধনী নেই। তবে চেহারায় বেশ তেজ আছে, ভাল করে দেখলে বোঝা যায়। সিকিউরিটি গার্ড তাকে লবিতে যেতে দেয়নি। যদিও লবিতে রাখা সোফায় অনেকেই অপেক্ষা করছে। সেখানে বসতে অনুমতি লাগে না। অনুমতি লাগে লিফটে উঠে অফিসে যেতে। তার বেশভুষার কারণেই সিকিউরিটি গার্ড তাকে জিজ্ঞেস করেছে, কাউকে সাধারনত করে না। শফিকের নাম বললেই যেতে দিত, কিন্তু মেয়েটি শফিকের নাম বলতে পারে না।
শফিক এ বিল্ডিংয়ের তিনটি অফিসের একটি অফিস, বায়িং হাউসের সিনিয়র ম্যানেজার। দুই লক্ষ টাকার মত বেতন ও গাড়ী পায় অফিস থেকে। মেয়েটি দেখে - শফিক গাড়ী থেকে নামল। ড্রাইভার শফিকের ব্যাগটি গাড়ী থেকে বের করে এনে দিল। শফিকের ডার্ক ব্লু কালারের স্যুটের সাথে লাল টাইটি বেশ মানিয়েছে। চোখে গ্লাস, ক্লিন শেভ, চকচকে কালো জুতা। মেয়েটি কিছুটা ঘাবড়িয়ে যায়। ইতস্তত করে দেখা করতে। কিছুটা পিছিয়ে গার্ডের পেছনে গিয়ে দাড়ায়। কিন্তু মনে আসে, তার দেখা করতেই হবে আজ। কোন উপায় নেই। আজই দেখা করতে হবে। গার্ড শফিককে আসতে দেখে উঠে দাড়িয়ে হাত কপালে ঠেকিয়ে সালাম ঠুকেছে। শফিক সালামের উত্তর দেবার আগেই মেয়েটি এগিয়ে এসে - শফিককে স্যার বলে মাথাটা নীচু করে ফেলে।
শফিক মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড কিছুটা হতচকিত হয়ে শফিকের দিয়ে তাকালে শফিক বুঝতে পারে, সিন ক্রিয়েট হতে পারে। তাই, শফিক মেয়েটিকে সাথে আসতে বলে। মেয়েটির বয়স পঁচিশের মত। শফিকের বয়স বত্রিশ চলছে। মেয়েটি শফিকের পিছু হাঁটছে। লিফটের সামনে দারোয়ান ডান হাতে শফিককে সালাম দেবার সাথে বাম হাত তুলে মেয়েটিকে আটকাতে চাইলে, শফিক সালামের উত্তর না দিয়ে বলে -
- আমার গেষ্ট।
লিফটে শফিকের একজন ফিমেল কলিগ আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে শফিকের দিকে তাকায়। শফিক বুঝতে পারে। অন্য অফিসের বাকী কয়েকজন শফিককে চিনে এবং সালাম দিয়ে একবার আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি মাথা নীচু করে আছে। শফিক সব বুঝতে পেরেও কিছু বলছে না। শফিকের আর আধা ঘন্টা পরেই ফরেন বায়ারের সাথে মিটিং। আধা মিনিট দেরী করা যাবে না। শফিক রিসিপশনে নিয়ে মেয়েটিকে গেষ্ট রেজিষ্ট্রারে এন্ট্রি করতে বলে।
মেয়েটি নীলুফার ইয়াসমিন লিখে। এরপরে বাকী তথ্য লিখতে থাকলেও, শফিকের চোখ নামটার দিকে আটকে থাকে। শফিক তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলিয়ে নেয়।
মেয়েটি রিসেপশনের পাশে, গেষ্ট ওয়েটিং রুমে বসে আছে। তার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে খেতে। রুমে আরও তিন চারজন পুরুষ মানুষ বসে আছে পরিপাটি পোশাকে। দামি মোবাইল হাতে। শফিক নাস্তা পাঠিয়েছে। নাস্তাগুলো মেয়েটির পছন্দের। শফিক যে সেটি বুঝেই পাঠিয়েছে, সেটি বুঝতে পেরে মেয়েটির চোখে জল আসলেও আড়াল করে। তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এতগুলো মানুষের সামনে খেতে লজ্জা লাগলেও মেয়েটি খেতে শুরু করে। শফিক ঘন্টা খানেক পরে এসে মেয়েটিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

২।
শফিক ব্যস্ততার মধ্যেও ব্যাংকে এসেছে বেশ কিছু টাকা তার বোনের একাউন্টে ট্রান্সফার করতে। এই মাসে একে শফিকের অফিসের চাপ, তার উপরে দেশের বাড়ী যেতে হয়েছে প্রতি সপ্তাহে। কিছু জমি বিক্রি করে একমাত্র বোনকে দিতে হচ্ছে, সম্পত্তির ভাগের অংশ। যদিও শিলা সেটি বলতে কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিল, তার সাংসারিক সমস্যা। এই মেয়েটি তাদের পরিবারে সম্পূর্ণ অশান্তি এনে দিয়ে নিজেও শান্তিতে নেই। পড়াশুনায় ভাল ছিল। শফিকরা কেউ বুঝতে পারেনি। যেদিন বাসা থেকে পালিয়ে গেল সোহেলের সাথে, সেদিনই অকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়। শফিকের বন্ধু পাভেলের বন্ধু ছিল সোহেল। সেই হিসেবে শফিকের সাথে পরিচয়। দুই তিনদিন বাসায় এসেছিল। এরপরে এক বছরের মাথায় এতদুর গড়াবে বিষয়টি, শফিক বা বাসার কেউ ভাবতে পারেনি।
এর তিন মাসের মাথায়, যেদিন বাবা শুনলেন, তার মেয়েটি কষ্টে আছে, সেদিনই প্রথমবার স্ট্রোক করল। এরপরে ধীরে ধীরে শিলার সাংসারিক অশান্তি যে বেড়েই চলছিল, সেটি বাবাকে না বললেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় দফার স্ট্রোক আর বাবা সামলাতে পারলেন না, মারা গেলেন। শিলাকে বাসার সাথে সংযোগ স্থাপনে যে আত্নীয় স্বজনরা চেষ্টা করছিল, বাবা মারা যাবার পরে সেটি থেমে যায়। মা প্রথম দিকে রাজী থাকলেও, পরে বেঁকে বসেন। মা বলতেন -
- তোর বাবা যে কারণে মারা গেল, সেই মেয়েকে আমি এই বাসায় ফিরিয়ে আনি কি করে?
মা নিজেও কষ্ট পেয়ে দু বছর পরে হটাৎই বড় কোন অসুখ ছাড়া মারা গেলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে তাদের বোনটি ছিল বাসার প্রান। সেই মেয়ে বাসার প্রানটি নিয়েই বের হয়ে গেল। এরপরে শফিক আর কোন খবর রাখেনি। তারমধ্যে চাকরির ব্যস্ততা। রুবিনার মারফত মাঝে মাঝে শফিক খবর পেত। পরের দিকে রুবিনাও শফিককে বলতে চাইত না। বলার কি আছে? সমস্যা তো দিনকে দিন বাড়ছে। সোহেল ছেলেটি নাকি মোটামুটি ভাল। কিন্তু রোজগার নেই। তাদের পারিবারিক অবস্থাও সেরকম ভাল না। তাই পদে পদে খোটা খেতে খেতে শিলা বিপর্যস্ত। শেষের দিকে নাকি তার শ্বাশুড়ি একদিন গায়ে হাত তুলেছে। রুবিনা শফিককে বলেছে - গায়ে হাত তোলার হুমকি দিয়েছে। এতেই শফিক যে বাথরুমে ঢুকে কেদেছে, সেটি রুবিনা বোঝে। মেয়েটার জন্যও মায়া লাগে। এরমধ্যে সোহেল নাকি শিলার গয়না নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বাসা থেকে, তিন বছরের একটি মেয়ে আর বউ রেখে।
শফিক শিলার একাউন্টে বড় একটি পরিমানের টাকা জমা করে। মধ্যবিত্ত পরিবারে তাদের টাকার পরিমানও খুব বেশী নয়। তারপরেও একেবারে কমও নয়। শিলা যদি টাকাটা কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ভাল হয়। দায়িত্বটা পালন করতে পেরে শফিকেরও ভাল লাগে।

৩।
শফিক নাহারকে ফোন করেছে। নাহার তার বাবার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার। শফিকের বায়িং হাউজ তাদের ক্লায়েন্ট। তাই শফিক ও শফিকের অফিসের লোকজনের সাথে বেশ খাতির রাখতে হয়। খুবই প্রফেশনাল মেয়ে, একেবারেই বাপকা বেটি। তবে, মেয়েটি এমনিতে বড্ড ফাজিল গোছের। আড়ালে সে শফিককে বলে -
- দুলাভাইরে শালি হইয়া ত্যালাইতে হয়, এরচেয়ে কষ্টের কি আছে?
শফিক হাসে। নাহার শফিকের স্ত্রী রুবিনার খুবই ক্লোজ বান্ধবী। শফিক এই চাকরিতে জয়েন করবার আগে থেকেই স্ত্রীর সূত্রে নাহারকে চিনে। নাহার বলে -
- দুলহা স্যার বলেন।
- থ্যাংক ইউ নাহার। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, কোনভাবেই যেন কেউ না বুঝে যে মেয়েটি আমার রেফারেন্সে তোমাদের গার্মেন্টসে ঢুকেছে। আমি ওকে পরিস্কার বলে দিয়েছি, তোমার প্রয়োজনে যদি ক্লিনারের চাকরি করতে হয় এবং করো, তাহলে খুশী মনেই করবে। তোমার নিজ যোগ্যতায় তোমাকে উঠতে হবে। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। শুধু তোমার নারীত্বে যদি আঘাত আসে, তাহলে প্রতিবাদ করবে এবং নাহার ম্যাডামকে তুমি জানাবে। নাহার, কেউ যেন কোনভাবেই না জানে ও আমার পরিচিত।
- শফিক ভাই, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। আমার মনে হচ্ছে ও ভাল করবে।
- থ্যাংক ইউ নাহার।
পরে কথায় কথায় নাহার একদিন বলছিল -
- শফিক ভাই, নীলুফার মেয়েটি খুবই ভাল করছে। মেয়েটির প্রচন্ড এনার্জি, ব্যাক্তিত্ব এবং আপনি কেন? মেয়েটিকে যে আমি চিনতে পারি, সেটিও বুঝতে দেয়নি। একটি ছোট প্রমোশনের হয়েছে।
শফিক উত্তরে কি বলবে? বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে। নাহার বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বিজনেসে চলে যায় খুব সুন্দরভাবে।
শফিকের একবার মনে হয়েছিল, মেয়েটি বুঝি তাকে পুরোন পরিচয়ে জ্বালাতন শুরু করবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত করেনি, এতে শফিকের একদিকে যেমন কিছুটা স্বস্তিবোধ হয়, অন্যদিকে মনটাও খারাপ হয়।

৪।
শফিকের ছেলে শাওনের বয়স চার হয়েছে। ছেলেটি সকাল থেকেই উত্তেজিত। সে আজ প্রথম শুনেছে যে তার একটি ফুপি আছে এবং ফুপির একটি মেয়ে বেবি আছে শাপলা, তার চেয়ে এক বছরের বড়। সে আজকে সন্ধ্যায় ঐ বাসায় যাবে।
আজ প্রায় সাড়ে ছয় বছর পরে শফিক যাচ্ছে শিলার বাসায়। রুবিনা এত কিছু কিনেছে যে, শেষে শফিককে সামনে বসতে হয়েছে শাওনকে নিয়ে। সোহেল শিলার গয়নাগুলি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গিয়েছিল। শিলার সাথে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু শিলা কাউকেই সেটি বলেনি। বললেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হত শ্বশুর বাড়ীতে। সোহেল দুবছর পরে এক মাসের জন্য এসেছে। এবার গিয়ে দু বছর থেকে একেবারেই চলে আসবে। আসলে সোহেল ছেলেটি নাকি ভাল। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কোন ইনকাম ছাড়া বিয়ে করে ফেলাটা কেউই মেনে নেয়নি। শফিক অবাক হয়ে ভাবে, শিলা কি করে এতকিছু সহ্য করে ম্যানেজ করল? আসলে বিপদে পড়লে সবাই ঠিকই পারে।
শফিকের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে, কেমন জানি লাগছে। অথচ একটা সময় বাইরে থেকে এসেই এই শিলাকে চিল্লায় ডাকার কারণে সে এবং বাবা কতবার মায়ের বকুনি খেয়েছে, ইয়ত্তা নেই। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে শিলা এক সপ্তাহের জন্য গেল খালার বাসায়, খালাত বোন সমবয়সী। তৃতীয় দিন শফিক নিয়ে এল ভুলিয়ে। এসে শিলার কান্নার সাথে মায়ের বকুনি। এক পর্যায়ে মা বাবাকে বলছে -
- তুমি তোমার ছেলেকে বকছ না কেন? তোমার মেয়ের প্রতি এত দরদ, কোথায় গেল?
- আসলে, শফিককে আমি বলেছিলাম আনতে।
হটাৎ নিশ্চুপ সবাই। মেয়েটা এত বড় একটা ভুল করে ফেলল? শফিকের চোখে জল চলে এসেছে।
সোহেল দরজা খুলে। সবার আগে শাওন দৌড় দিয়ে যেয়ে শাপলার হাত ধরে। শাপলা বলে -
- জান, বাবা না আমার সমান পুতুল এনেছে। পুতুলটা শুধু আমার সাথেই কথা বলে। তবে বলেছে তোমার সাথেও কথা বলবে।
দুজন একটি ঘরে চলে যায়। শফিক শুনতে পারে, পুতুলটা শাওনের সাথে কথা বলছে। এজন্যই মনে হয় বলে নিষ্পাপ বাচ্চা।
সোহেল কিছুটা অপরাধবোধ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে মাথা নীচু করে। শফিকও পারে না কথা বলতে। বিব্রতকর অবস্থা। কিছু গুন সৃষ্টিকর্তা শুধু মেয়েদের মধ্যেই দিয়েছেন। রুবিনা আজ প্রথম সোহেলকে দেখল। কিন্তু এই অবস্থাটি কাটিয়ে উঠতে কি সুন্দর করেই সোহেলকে বলল -
- মাগো, সারাজীবন দেখে আসলাম বউরা লজ্জা পায়, এখন দেখছি জামাইরাও পায়। জামাইবাবু দাড়িয়ে গল্প করতে আমার ভাল লাগছে, কিন্তু আপনার মনে হয় সমস্যা হচ্ছে। এই বলে রুবিনা সরাসরি বেড রুমে তাদের নিয়ে গেল, যেন তারই বাসা। বেড রুমের কিছু জিনিসপত্র দেখে শফিক বুঝতে পারে, রুবিনার সাথে শিলার পরের দিকে ভালই যোগাযোগ ছিল। এজন্য রাগ নয়, রুবিনার প্রতি শফিকের শ্রদ্ধাবোধই জন্মায়।
বাবা মারা যাবার সময় শাপলার জন্মের সময় ঘনিয়ে এসেছিল, আসতে পারেনি বা কেউ না বলেছে কিনা? শফিক জানে না। কিন্তু, মা মারা যাবার পরে শিলাকে খবর দেযা হয়নি। কেন? কিভাবে হল? শফিক জানতে চেয়ে খামোখা কষ্ট বাড়ায়নি। কিন্তু, এই অপরাধবোধটা শফিকের রয়ে গেছে। এর মাঝে শিলা ঝড়ের বেগে এসে রুবিনাকে বলে যায় -
- ভাবি দশ মিনিট। আমি রান্না ঘরের কাজটা সেরেই আসছি।
- ভাল করে দেখ। তোমার চুলার চাবি পেছনে ঠিক থাকে না তো অনেক সময়।
রুবিনা এটি বলেই বুঝতে পারে যে, শফিক বুঝতে পেরেছে। শফিক রুবিনাকে উদ্ধার করতে রুবিনার কাঁধে হাত রেখে বলে -
- তুমি সামলাও, আমি বাচ্চাদের নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

৫।
শফিক বায়ারদের সাথে জরুরী মিটিংয়ে। রিসেপশন থেকে ফোন করে বলে -
- স্যার, নীলুফার ইয়াসমিন নামে একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছে।
শফিক অবাক হয়, কোন খবর না দিয়ে চলে আসল অফিসে? রিসেপশনিষ্টকে শফিক বলে -
- আমার ঘন্টা খানেক লাগবে। অপেক্ষা করতে হবে।
শফিকের মিটিং সোয়া ঘন্টা পরে শেষ হলে বায়ারদের নীচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে উপরে এসে গেষ্ট রুমে ঢুকতে গেলে রিসেপশনে থাকা মেয়েটি বলে -
- স্যার, উনি চলে গিয়েছেন। যাবার সময় প্যাকেটটি দিয়ে, এই চিরকুটটি লিখে রেখে গেছেন।
খোলা চিরকুটটি শফিক পড়ে -
- "স্যার, বেতন পেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ। - নীলুফার ইয়াসমিন নীলু।"
আজ কি ইচ্ছে করেই নীলু লিখল? প্রথমদিন তো লিখেনি। শফিক উদাস হয়ে ভাবে, সে একদিন নীলু ডাকায় তাকে বলেছিল -
- বাবা আমাকে ঐ নামে ডাকে। আমি চাইনা আর কেউ ডাকুক।
শফিক প্যাকেট খুলে দেখে তার সমস্ত পছন্দের খাবার। মেয়েটি শফিকের পছন্দের খাবার মনে রেখেছে।
তবে, মেয়েটির আত্নসম্মানবোধ আছে। সেই দিনের পরে আজই এল। পুরোন পরিচয়, পুরোন ভালবাসার দাবি নিয়ে আর যাই হোক, মেয়েটি শফিককে যে বিব্রত করতে চাইছে না, সেটি শফিক বোঝে।

৬।
বাসা থেকে গজ চল্লিশেক সামনে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। যদিও কোক থেকে শুরু করে মাছ মাংস এমন কিছু বাদ নেই, রুবিনা কিনে নাই। হোক সাড়ে ছয় বছর। এটি তো অনেকটা মেয়ে ফিরানোর মতই অনুষ্ঠান। এরপরে শফিকের বাসায় শিলার যাওয়া আসাটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। শফিকের আজ হটাৎই মনে হয় শিলার দোষের তুলনায় বাবা মাকে শেষ দেখা না দেখতে পারাটা কি অনেক বড় শাস্তি নয়?
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে শাওন একটি আইসক্রিম নিতে চাইলে শফিক দুজনকেই দুটো কিনে দেয়। শাপলা একটি কন্টেইনারে রাখা চকলেট দেখিয়ে বলে -
- মামা, ওখান থেকে আমাকে তিনটে চকলেট কিনে দিবে? শাওন, আমি আর আম্মু। আম্মু চকলেট পছন্দ করে।
শফিকের হটাৎ মনে আসে, সে কি করে ভুলে গেল যে, শিলা চকলেট পাগল ছিল একসময়। শাপলার চোখ জোড়া ছানাবড়া হয়ে ওঠে যখন দেখে মামা পাশাপাশি রাখা দুটো কন্টেইনারই কিনে ফেলেছে। একটি কন্টেইনার মেয়েটি বুকে জড়িয়ে ধরে। রাস্তা পার হতে হবে। রাস্তায় গাড়ী ঘোড়াও একটু বেড়েছে। তাই, একটি চকলেটের কন্টেইনার এক হাতে নিয়ে, অপর হাতে শাওনকে ধরে ড্রাইভার সুন্দর রাস্তা পার হয়ে যায়। শাপলা দুই হাতে চকলেটের কন্টেইনারটি ধরে রেখেছে। শফিক শাপলাকে কোলে নিয়ে রাস্তা পার হয়। রাস্তার অপর পার্শ্বে পৌঁছান মাত্র একটি ফাজিল ট্রাক ড্রাইভার হাইড্রলিক হর্ণ চেপে ধরে চলে যায়। শাপলা ভয়ে শফিকের বুকে মুখ লুকায়।
শফিকের দাদা বাড়ীতে শফিক প্রথম বাইসাইকেল চালানো শিখে বার বছর বয়সে। দুপুরের পরে শফিক মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে সাইকেল বের করে চালানো শুরু করার আগেই শিলার কাছে ধরা পড়ে যায়। শিলা তাকে নিলে মাকে বলবে না বলায় বাধ্য হয়ে শফিক রাজী হয়। শিলাকে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে সাইকেল চালিয়ে কাঁচা রাস্তা থেকে সামনের মোড়ে পাকা রাস্তায় উঠবার আগ মুহুর্তেই বিকট হর্ণ বাজিয়ে একটি ট্রাক চলে গেলে, শফিক সাইকেল সহ পড়ে যায়, তবে আস্তে। শফিক মাটি থেক ওঠা মাত্রই শিলা দৌড় দিয়ে এসে শফিকের বুকে মুখ লুকায় ভয়ে।
শফিক শাপলাকে দেখে আজ সত্যই অনেকটা আঁতকে উঠেছিল। একদম সেই পাঁচ বছর বয়সের শিলার ফটোকপি। শফিক তার বার বছর বয়সে ফিরে যায় আর সেদিনের সেই শিলাই যেন তার বুকে ভয়ে মুখ গুজে রেখেছে। শফিক হাঁটতে পারে না। চোখে ঝাপসা দেখছে। চোখ মোছবার সাথে সাথে শাপলা বলে ওঠে -
- ওমা মামা! তুমি দেখি আমার চেয়েও ভীতু।

৭।
শফিক ফিরে এসে চা নাস্তা না করে একবারে ডিনারে বসতে চাইলেও চায়ের কাপটা সোহেলের অনুরোধে নিতে হল। শিলা ট্রেতে চায়ের কাপটা নিয়ে যাবার সময় রুবিনা হটাৎই কোন কারণ ছাড়াই বলে ওঠে -
- আচ্ছা, এতক্ষণ হল আমরা এসেছি। দুই ভাই বোনকে তো কথা বলতে দেখলাম না। শিলা ঘুরে ট্রে হাতে যেন বরফ হয়ে গেছে। মাথা নীচু করে আছে, যেন সমস্ত অপরাধ তার। শফিকেরও একই অবস্থা। কয়েকটি মুহুর্ত যেন কয়েক যুগ মনে হয়। শফিক কি মনে করে বলে ফেলে -
- কিরে পাগলি, অফিসে গিয়ে যেমন স্যার বলেছিলি, এখানেও স্যার বলবি নাকি?
ট্রাকের বিকট হর্ণের মতই যেন আওয়াজ হয়, শিলার হাত থেকে খালি কাপ সহ ট্রে মেঝেতে পরে।
-"শিলা শফিকের বুকে আজও কাঁপছে সেদিনের মতই... তবে... ভয়ে নয়, কষ্ট জয়ের আনন্দে...।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৮

রানা আমান বলেছেন: খুবই ভালো লেগেছে ।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১:১৬

বিজু চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভাল লেগেছে জেনে খুশী হলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.