![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
১॥
রাকিব সাহেবের পরিবারের মন খুবই খারাপ। তাদের ছেলে সিফাতের দুই বন্ধু মারা গেছে। সাত আটজন বন্ধু মিলে কুয়াকাটা, বরিশাল ঐ অঞ্চলে ঘুরতে গিয়েছিল। নৌকায় করে বন্ধুদের মধ্যে পাঁচজন একটি চর দেখতে গিয়েছিল। চরের কাছাকাছি নৌকাটিকে একটি ট্রলার ধাক্কা দিলে, নৌকাটি উল্টিয়ে একটি ঘূর্ণনের মধ্যে পড়ে ডুবে যায়। আশপাশ থেকে লোকজন এসে উদ্ধার করে বেশীর ভাগ মানুষকে। সিফাত সহ আরও দুই একজন স্থানীয় মানুষ দ্রুত সাতার কেটে ওঠে চরে। সিফাত সবার আগেই উঠে, হি ইজ আ স্পোর্টস ম্যান। তবে, ওর দুই বন্ধু সহ মোট পাঁচজন মারা গেছে। বাকী দুজন বন্ধুকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে।
রাকিব সাহেব এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেকে ফিরে পেয়ে ছেলের মা ও ছেলে দুজনই সেই ঘটনার ভয়াবহতায় অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তার মধ্যে দুজন বন্ধু মারা গেছে। বিকেলে রাকিব সাহেব বাসার সামনের বাগানে একা হাটাহাটি করেন। স্ত্রী সহ সিফাতকে সিলেটে ছোট শ্যালিকার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুই বন্ধুর শোক আর এত বড় একটি দুর্ঘটনা ভুলতেই পারছিল না, তাই। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রাকিব সাহেব স্মৃতিতে ফিরে যান তার প্রথম চাকুরী জীবনে -
চরের নাম হালের চর। নামকরণের কারণ আছে। চর জাগলে, ঐ মৌসুমে লোকজন সব হালচাষ করত।শয়ে শয়ে গরু নিয়ে পুরো চরেই চলছে হালচাষ। ভরা বর্ষায় তিনভাগের দুইভাগ পানিতে তলিয়ে যাবার পরেও এক তৃতীয়াংশ জায়গা, বিশাল এক রাজ্য মনে হত রাকিবের কাছে। সেই একভাগ রক্ষা পায় গত তিন বছর থেকে। এখানে যে বেড়ীবাঁধ করা হয়েছে, সেটিই ঐ একভাগকে পানি থেকে রক্ষা করত। বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে গাড়ি চলত। গাড়ী থামত অবশ্য আধা কিলো আগেই, স্ট্যান্ডে। এদিকে নদী, তাই এদিকে সামান্য কয়েকটি বাড়িতে প্রজেক্টে চাকরি করা লোকজনই থাকত। রাকিব সেই বেড়ীবাঁধের শেষেই বানানো একটি বাসায় থাকত। টিনের চালের ঘর একটি, থাকার জন্য। খড়ের তৈরি একটি রান্নাঘর। সামনে বেশ বড় উঠোন। উঠোনের শেষে একটি টিউবওয়েল। নদীর দিকে উঠোনের শেষে, বাঁশের তৈরি বেড়ার বড় একটি অংশ কেটে দরজা মত বানিয়ে নিয়েছিল রাকিব। রাকিবের অসম্ভব পছন্দের জায়গা ছিল, উঠোনের শেষে বাঁশের বেড়াটি খুলে চেয়ার নিয়ে বসত। বিশাল নদীটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একপর্যায়ে নদীটিকে মনে হত বিশাল আকাশ। বহুদিনের ইচ্ছে, সাহিত্য চর্চাও কিছুটা শুরু করতে পেরেছিল রাকিব।
২।
রাকিব ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সিভিতে এপিয়ার্ড লিখেই ঐ চাকরিতে জয়েন করেছিল। হলের সিনিয়র ভাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বাবা মা এতদূরে গিয়ে চাকরি, তার মধ্যে খাবার কষ্ট, সব মিলিয়ে বললেও - রাকিব চাকরিটা ছাড়তে চাচ্ছিল না। রেজাল্ট দেবার সময় রাকিবের এক মাস হয়ে গেছে চাকরির। রাকিবের জায়গাটা ভাল লাগত। নদী, গাছপালা মিলে বেশ ভালই। চাকরির পরে আর কোন কাজ না থাকায় বিসিএসের জন্য পড়াশুনা করার ভালো সময় পেত। ঢাকায় থাকলে হয়ত আড্ডা মেরে শেষে চাকরি করে যতটুকু সময় মিলত, ততটুকুও মিলত না।
সমস্যা ছিল একটিই, খাওয়ার ব্যাপারে। আসার পরে স্থানীয় একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা রান্না করে দিত। কম বয়সী মহিলা বা কাজের লোক রাখার অনেক সমস্যা। মা বারবার মানা করে দিয়েছিল। তবে, রাকিব নিজেও কারণটি ভালো বুঝত। মাস দেড়েক পরে বুড়ি অসুস্থ হলে, রাকিব কয়েকদিন নিজেই রান্না করে খায়। আশেপাশে চরের ভেতরে বিক্ষিপ্ত কিছু ছনের ঘর করে লোকজন থাকত, মূলত চাষাবাদের সময়টিতেই। তাদের মধ্যে অনেকেই রাকিবের বাসায় পানি নিতে আসত। কারণ, রাকিবের বাসার পরে আরও আধা কিলোমিটার দূরে গেলেই তবে ডিপ টিউবওয়েলের পানি পাওয়া যেত। রাকিব তাই কখনই না বলেনি, হাজার হলেও পানি বলে কথা। সন্ধ্যার আগে, রাকিব বাসার ফেরার আগেই সবাই পানি নিয়ে যেত। এখানকার মানুষ সন্ধ্যার পরেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, তেলের খরচ বাঁচাতে। উঠত আবার সূর্য ওঠার আগেই। রাকিবের কিছু দিন সময় লেগেছিল নিজেকে এডজাস্ট করতে। তারপরেও রাকিব রাত দশটার আগে ঘুমাত না। তবে এগারটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাবার একটি ভালো অভ্যাস তৈরি হয়েছিল।
বুড়ি জ্বরে পড়বার দুদিন পরে তার ছেলে এসে বলে –
- মায়ের বেতনটা যদি দিতেন, মায়ের চিকিৎসা করা দরকার। মায়ে আসলে রান্নাবান্না করতে পারব না।
রাকিব শুনে খুশীই হয়। কারণ, এই বুড়ির রান্না রাকিব খেতেই পারত না। নিজে থেকে না আসতে বলতেও পারছিল না। মাস পুরো না হলেও পুরো মাসের টাকা দিয়েও, আরও পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে রাকিব বলে –
- না, ঠিক আছে। আগে চিকিৎসা করান দরকার। আমি ঢাকা যাচ্ছি, ফিরে এসে একজন ঠিক করে নিব।
৩।
সেবার রাকিব ঢাকায় এসে দুটি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে যায়। ফেরার পরে রাকিব নিজেই রান্না করে খেত। শুধু রাতের খাওয়া। সকালের নাস্তা ও দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা অফিসেই ছিল। আর এখানে রাকিবের ছুটি ছিল তিন সপ্তাহ পরে চার দিন। দিন দশেক পরে হবে হয়ত। একদিন রান্না না করেই বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে রাকিব ঘুমিয়ে পরেছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখে রাত দশটা। উঠে বারান্দার টেবিলের উপরে দেখে রান্না করা সবকিছু। নিজের সাথেই কনফিউশন তৈরি হয়, আমি রান্না করেই ঘুমাইনি তো? মনে হয়, না। তাহলে যারা পানি নিতে আসে, তাদের মধ্যেই কি কেউ রান্না করে দিয়েছে দয়াপরবশ হয়ে? হতেও পারে। কারণ সবজি , পেয়াজ সহ মাছ, রাকিব কেটে ধুয়ে রেখেছিল। চালও ধুয়ে রেখেছিল। শুধু চুলায় বসিয়ে রান্না। তাই ভাবে, কেউ হয়ত রান্না করে দিয়েছে। এলাকার সামান্য লোকজন থাকে। বলা যায়, সবাই রাকিবকে খুব পছন্দ করে। কারণ, রাকিব খুব ভালো ছেলে ও মানুষের বিপদ আপদে সাহায্য করার হাত ছিল।
রাকিব খেতে বসে দেখে, বেশ সুস্বাদু হয়েছে রান্না। সে যে রাঁধেনি, এটি অন্তত নিশ্চিত। পরের দিন জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে অবশ্যই। পরের দিন রাকিব সন্ধ্যার পরপরই ফিরে দেখে একজন মহিলা রান্না করছে। রাকিবকে দেখে ঘোমটা টেনে দেয়। রাকিব বলে –
- আপনিই কি গতকাল রান্না করে গিয়েছিলেন।
- জ্বি বাবা। পানি নিতে আসতে একটু দেরি হয়েছিল। দেখলাম আপনে ঘুমাচ্ছেন, তাই ডাকি নাই। আমার হাতে সময় ছিল তো তাই।
- ও আচ্ছা। কিন্তু, আপনি এভাবে আলাপ সালাপ না করে শুরু করে দিলেন।
- সেটা নিয়ে সমস্যা হবে না। আপনি আগে ঐ বুড়িরে যা দিতেন, তাই দিয়েন। আমার সমস্যা নাই। হাতে সময় আছে।
- আচ্ছা, আপনার নাম?
- আমার নাম জোবেদা। তয় বাবা, আমি আপনারে রান্না কইরা দেই, বলার দরকার নাই। আমার বাসায় শুনলে রাগ করবে। স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার তো, তাই। আপনি দয়া করে কাউরে বইলেন না বাবা।
- আচ্ছা।
মহিলার কথার মধ্যে একটা মায়ের মত মমতা আছে। ঘোমটা টানায় মুখ সম্পূর্ণ দেখা যায় না। যতটুকু দেখে বোঝা যায় যে, মহিলা দেখতে খারাপ নন। কপালে একটা বড় রকমের কাটা দাগ স্পষ্ট। চল্লিশের মত বয়স হবে।
৪।
রাকিবের অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়াতে মাঝে মাঝেই ফিরতে রাত আটটা বেজে যেত। ফিরে রান্না করা খাবার পেত। মাঝে শুধু একদিন রাকিব জোবেদার মাকে দেখেছিল।
এর দিন সাতেক পরেই রাকিবের হটাত করেই ঢাকা আসবার সুযোগ হয়। প্রজেক্ট থেকে একটা গাড়ী রাত আটটার দিকে বরিশাল যাবে। সেটিতে করে গেলে, ভোরের লঞ্চ ধরে ঢাকা যাওয়া যাবে। রাকিব হাতের কাজ সেরে সাড়ে সাতটায় বাসায় আসে, দ্রুত ব্যাগ গোছাতে। দেখে খাবার টেবিলে রান্না করা খাবার। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে খেতে খেতে দেখে জোবেদা থালা বাসন ধুচ্ছে। খেয়েই ব্যাগ গুছিয়ে বের হবার আগ মুহূর্তে জোবেদা বলে –
- বাবা, একটা অনুরোধ করতাম। রাখবেন।
রাকিব বোঝে হয়ত আগাম বেতন চাইবে। যদিও দিন পনের হয়েছে মাত্র। তাই রাকিব বলে –
- আচ্ছা রাখব। বলেন।
- বাবা আমি এখানে কাজ করতে আসি, আমার এই জায়গাটায় আসতে মন চায়। আমার খুব কষ্ট বাজান।
এই বলে জোবেদা কাঁদতে শুরু করে। রাকিব অপ্রস্তুত হয়ে বলে –
- কিসের কষ্ট?
- বাবা আপনাগো তো পরিচিত লোকজন অনেক বড় আছে। চেয়ারম্যানের শালা সলিম আমার সোমত্ত মেয়েটার ইজ্জত নিয়া মাইরা, আপনার এই রুমের পাশের ঐ পেঁপে গাছটার নিচে দশ হাত মাটি খুইড়া পুইতা রাখছে। কেউ বিচার করবার নাই। আমি বিচার চাই বাবা।
এই বলে জোবেদা কাঁদতে শুরু করে। এই এলাকায় খুন খারাবি, ধর্ষণ এখন কমলেও প্রোজেক্ট শুরু হবার আগে নাকি অনেক বেশি ঘটত। তাই রাকিবের কাছে এটি আশ্চর্যের কিছু মনে হয় না। তাড়া থাকায় রাকিব বলে –
- ঠিক আছে আমি দেখব।
- বাজান, আপনার মায়ের কথা ভাইবা হইলেও এর বিচার কইরেন। আপনি আমারে বাবা কথা দিছেন।
রাকিবের তাড়াহুড়া, তাই রাকিব বেরিয়ে যাবার আগে শুধু বলে আচ্ছা।
৫।
ঢাকায় এসেই সেবার রাকিব ইন্টারভিউ দেয়া একটি চাকরিতে নির্বাচিত হয়। শুধু সামান্য জিনিস আনবার জন্য আবার অতদুরে ফিরে যাবার মানে হয়না। হটাতই জোবেদার সেই অনুরোধ মনে আসে। মনে আসে তার শেষ কথাটি –
- আপনি আমারে বাবা কথা দিছেন।
তখন বন্ধু মারুফের কথা মনে আসে। মারুফ রাকিবের কলেজ বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পাশ করেই বিসিএস দিয়ে ও তখন পটুয়াখালীর এএসপি। সপ্তাহ খানেক পরে মারুফ ঢাকায় এলে, মারুফকে জোবেদার কথা খুলে বলে। মারুফ যেহেতু পুলিশে আছে, তাই অনুরোধ করে বলে –
- যদি সম্ভব হয়, তাহলে তুই জোবেদার মেয়েটাকে হত্যার বিচারের ব্যাপারে সাহায্য করিস। পেঁপে গাছের দশ হাত নীচে মেয়েটাকে নাকি পুতে রেখেছে।
এর মাস দুয়েক পরে আরেকবার মারুফের সাথে দেখা হলে মারুফ তাকে আশ্বস্ত করে যে, মেয়েটির দেহের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। আসামীর বিচার চলছে। কেস হয়েছিল কিন্তু ডেড বডি না পাওয়া যাওয়াতে বিচারটা ঠিকমত হয়নি। মেয়েটি ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করত। ছুটিতে বাসায় ফেরার পরে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
রাকিব বেশ অস্বাস্থ্য হয় শুনে।
এরপরেই মারুফ বলে –
- দোস্ত, তুই বলেছিলি মেয়েটার মা তোকে অনুরোধ করে। কিন্তু মেয়েটির মাকে একই দিনে - বাঁধা দেয়াতে তারা হত্যা করে নদিতে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেয়। দুটি হত্যারই রহস্য উৎঘাটিত হয়। মেয়েটির মায়ের নাম ছিল জোবেদা।
রাকিবের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটি স্রোত নেমে যায়। বলে –
- মা? না খালা? কিছু একটা বলেছিল। মনে নেই দোস্ত। রাকিব প্রসঙ্গ পাল্টায়।
রাকিব সাহেব হটাতই কাঁদতে শুরু করেন। তার একমাত্র ছেলে। সাতার জানত না। কাঁদছিল আর বারবার বলছিল –
- “বাবা, একটি মহিলা আমাকে ঠেলে হালের চরের পাড়ে এনে দিয়ে, কোথায় যে চলে গেল বুঝলাম না। মহিলার কপালে বড় একটি কাটা দাগ ছিল বাবা।“
©somewhere in net ltd.