নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ সরল সোজা সাদা ভাষায় জীবনের কথা লিখতে পছন্দ করি। কাদা মাটিতে বেড়ে ওঠা একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ। মনের কথাগুলি বরাবরই মুখে এসে বের হতে চায় না, কলমে আসতে চায়।

বিজু চৌধুরী

আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।

বিজু চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিষ ফোঁড়া

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:১৬

১।
সদ্য ফোম লাগিয়ে আনা কাঠের রোলিং চেয়ারটিতে বসেও তমিজ উদ্দিনের আনন্দ হয় না। কেমন জানি মনে খচখচ করে। অথচ, তার অনেকদিনের স্বপ্ন -
- এই চেয়ারটিতে বসে রঙ্গীন টিভিতে হিন্দি গানের সাথে নাচ দেখবে।
কিন্তু, এই বশির সেটি হতে দিল না ।
চেয়ারটি তাকে দিয়েছিল পুরোন ঢাকার বার্নিশের দোকানদার মজিবর। কে জানি দোকানে পুরোন ফার্নিচার বার্নিশ করতে দিয়ে, ধীরে ধীরে এই চেয়ারটি বাদে সব মাল নিয়ে যায় টাকা না দিয়ে। এরপরে দুবছর আর আসে না। মজিবর বুঝতে পারে কাষ্টমার বাটপার। কারণ, চেয়ারটি থাকাতে মজিবর কোন সন্দেহ করেনি। পরে বার্নিশের বিল হিসেব করে দেখে যে, সেটির দামের একাংশও নয় এই চেয়ারটির দাম। সেই থেকে মজিবরের দোকানের সামনের এক পাশে সেটি অবহেলায় রক্ষিত ছিল। তমিজ তখন মজিবরের দোকানের সামনে, ঐ চেয়ারটির পাশে এক কোনায় বসে ভিক্ষে করত। ভিক্ষে করতে করতে প্রায়শই উঠে বসতে গিয়ে চেয়ারটির হাতল ধরে উঠে বসত। এ ছাড়াও প্রায়শই হাতলে হাত রেখে ভাবত -
- এটাতে শুইলে না জানি কি আরাম লাগে!
একদিন চেয়ারের হাতলে হাত দেবার পরে মজিবর বলে -
- কি তমিজ মিঞা, বইতে মন চায়?
মজিবর তমিজের মনের কথা বুঝতে পেরেছে বুঝে, তমিজ লজ্জা পেয়ে মাথাটা নীচু করে বলে -
- স্বপ্নের মাঝেও তো চিন্তা করতে পারি না মজিবর ভাই।
- তাইলে বও। আরে বও। লজ্জা পাও ক্যা?
তমিজ একটু বাঁকা হয়ে বসে। মজিবর বলে -
- কি অস্বস্তি লাগে? ভাল করে বও।
তমিজ এক মুহুর্ত বসেই উঠে আসে। বসে হেলান দিলেই কেমন জানি রাজা রাজা রাজা মনে হয়। তমিজ চেয়ার থেকে উঠে গেলেও তার এইরকম একটি চেয়ারের নেশা জাগে পাশের গলিতে একদিন ভিক্ষে করতে গেলে। সেখানে একটি টেলিভিশনের দোকানে সে ভিসিআরে চলতে থাকা হিন্দি গান শুনে -
- মাম্মু মিঞা, পমপম ।
নায়িকাটা বড়ই সৌন্দর্য্য। বিশ বছরের তমিজের দেহে কিছুটা কামনা জাগ্রত হয়। সেদিনই প্রথম মনে হয় -
- আহা! যদি ঐ রকম চেয়ারে বইসা নায়িকার নাচ দেখতে পারতাম!
এর মাস ছয়েক পরে, তমিজের স্বপ্ন পুরণের অংকটির শুরু। পুরোন ঢাকা থেকে গুলিস্তান পেরিয়ে যে আরো এত বড় দুনিয়া ঢাকা শহরে আছে, তমিজ উদ্দিন আগে তা জানত না। তার পিঠের ফোড়ার ব্যাথাটা কমার পরে তমিজ বেশী আয়ের জন্য যখন এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করে, সেদিন সে প্রথম বুঝতে পারে যে -
- যে ঢাকা শহর সে এতদিন দেখেছে, সেটি প্যান্টের পাছার পকেটও না।
তমিজ বুঝে যায় তাকে এলাকা পরিবর্তন করতে হবে। এক জায়গায় বসে থাকলে যে সে শুধু কম ভিক্ষেই যে পাবে তা নয়, ভিক্ষের জন্য একটি পোক্ত জায়গা দরকার, সেটিও সে পাবে না কখনই। আজ মজিবর ভাই তাকে তুলে দিলে, সে কোথায় যাবে? পোক্ত জায়গায় ফকিরের সর্দার থাকে, সে সর্দারই ব্যবস্থা করে দিবে। ইতোমধ্যে তমিজ মগবাজার মালিবাগের ফকির সর্দার সুরুজ মিঞার সাথে দেখা করে। তমিজের ইতোমধ্যে কথা বলার ধরনটা যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সেটি ভেবে তমিজ অবাক হয়। তমিজের ফোঁড়াটার ব্যাথা নাই বললেই চলে। ফোঁড়া থেকে দূষিত রক্ত বের হওয়া আগেই বন্ধ হয়েছে। এরপরে ফোড়াটা ধীরে ধীরে শক্ত হতে শুরু করেছে। ব্যাথা না থাকলেও তমিজের কথায় সেই ফোড়ার ব্যাথাটি ফুটে ওঠে। এটি তমিজ না চাইলেও এমনিতেই হয়।
তমিজ সিদ্ধান্ত নেয়, সে মগবাজারে চলে যাবে। সব কথা পাকা করে যেদিন তমিজ মজিবরের কাছে বিদায় নিয়ে পুরোন ঢাকা থেকে মগবাজারের মোড়ে আসবে, সেদিন মজিবর তাকে বলে -
- তমিজ মিঞা, তোমারে আমি আর কি দিব বিদায়বেলা? এই চেয়ারটা নিয়া যাও। এটাতে বইসা তুমি ফকিরের রাজা হও, এই দোয়া করি।
তমিজ মজিবরকে কতবার যে ধন্যবাদ জানায়?, তার হিসেব নাই। কিন্তু মনে মনে তার একটি রাগ চাপে। তমিজ ফকির হলেও, কেউ তাকে ফকির বললে তার প্রচন্ড রাগ হয়। তমিজ সহ্য করতে পারে না। বহুবারই নিজের মনকে সে সান্তনা দিয়েছে এই বলে যে -
- আমি তো ফকিরই, তাইলে রাগ হওনের কি দরকার?
কিন্তু তারপরেও সে রাগ সম্বরন করতে না পেরে মনে মনে বলে -
- মজিবর ভাই, দেইখো, এই তমিজ একদিন তোমার চাইতে বেশী টাকার মালিক হবে। সেদিন তোমারে আমি তোমার কথাটা ফিরায় দিব।
তমিজ এরপরে যখন একদিন মজিবরের সাথে দেখা করতে আসে, তখন অর্থে তমিজ মজিবরের চেয়েও ধনী। কিন্তু, মনে কেমন জানি একটা খচখচে অনুভুতি হয়। তমিজ সেই আগের মতই চুপসিয়ে থাকে। মজিবরও তাকে আগের মতই হেয়ালী ভরা কণ্ঠে বলে -
- কি তমিজ মিঞা, ভিক্ষা কেমন চলছে?
তমিজ কিছুই বলতে পারে না। কারণ, সে তখনও সেই ফকিরই। সেই খচখচে অনুভুতিটা আজও তার মনে বাসা বেঁধেছে - বশিরের কথায়। ফকির পরিচয়টা বারবার তার অর্থকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসে। তমিজ রাগে দাঁতে দাঁত চাপে প্রতিবার। শুধু এটুকুর মধ্যেই তার ক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রশমন - উভয়টিই থাকে।

২।
বশিরের পান বিড়ির দোকান, শাহজাদপুর রাস্তার মোড়ে। লোকেশনটা ভাল। তার দোকানের সামনেই তমিজ বসে থেকে ভিক্ষা করে। তমিজের কাঁধের রং মাখা দগদগে বিষ ফোড়াটা যতবারই বশির দেখে, ততবারই তার তমিজের উপরে ঘৃনা জন্মায়। কিন্তু, তাকে তুলে দিতে পারে না। ফকিরদেরও সর্দার আছে। সেই সর্দারের ক্ষমতাও অনেক। তবে, তুলে দেবার ক্ষমতা থাকলেও যে বশির সেটি পারত না, সেটি সে ভাল করেই জানে। কারণ, বশিরের মনটা বড্ড নরম। তবে, বশিরের আজ প্রচন্ড রাগ হবার কথা থাকলেও, সেরকম রাগতে পারে না। তমিজ আগেও একবার তার ছেলে সবুজকে গরীবের পোলা বলেছিল, বশির সেদিন কিছু বলে নাই। তমিজের উপরে শুধু করুণা হয়েছিল। কিন্তু, এই বেত্তমিজ তমিজ মিঞা আজ তার ছেলেকে ছোটলোকের পোলা বলেছে। বশির মাথা গরম না করে, যে জিনিসটি সে সহজে পারে না, মানুষকে কটু কথা বলতে, সেটিই আজ সে করেছে। বশির আজ তমিজ মিঞাকে পরিস্কার ভাবে বুঝিয়ে বলেছে -
- শোন তমিজ মিঞা, তুমি একটা বাটপার। তোমার ফোঁড়ায় নাই কোন ব্যাথা, তুমি আমার চোখের সামনেই প্রত্যেকচা দিন টমেটোর রসের সাথে লাল রং মাখায় এখানে বস। লজ্জা করে না তোমার? বাটপারির পয়সার কোন মূল্য নাই। আরেকটা কথা বলি। তুমি মনে হয় বয়সে আমার দুই এক বছরের বড় হবা। আমার কথা বাদ দ্যাও পিচ্চি পোলাপানও তোমাকে তমিজ মিঞা বলে। কেউ কোনদিন ভাই বলে ডাকছে? মুদি দোকানদার তাজুল ভাই না হইলেও বয়সে আমার পাঁচ বছরের বড় হবে, আমারে ভাই ডাকে। তুমি একে ফকির, তার উপরে বাটপার। তুমি কোন সাহসে আমার পোলারে ছোটলোক কও? আইজ তোমারে শেষবারের মত কইলাম কিন্তু। এরপরে সবুজের কোন খারাপ কথা কইলে কিন্তু তোমার বিচার হবে। মনে থাকে যেন।
তমিজের সাথে আর বেশী না রেগে বশির ভাবে -
- তার ছেলে সবুজকে ছোটলোক আসলে কি? সেটি বুঝান জরুরী দরকার। সবুজকে বোঝান দরকার, মানুষ কখন ছোট লোক হয়?
বশির সবুজের কাঁধে হাত রেখে বলে -
- বাজান, মানুষের কথায় মন খারাপ করার কোন মানে নাই, বুঝলা? মানুষ টাকা পয়সায় গরীব হয় না, গরীব হয় মনে আর অসৎ চলার পথে। তুমি ভাল করে লেখাপড়া শিখলেই আমরা বড়লোক হব বাজান।
ঠিক এই মুহুর্তেই বশিরের বউ ফাতেমা বলে -
- এত লেচকার না দিয়া, তাড়াতাড়ি খাইয়া পোলারে প্রাইভেট স্যারের বাসায় দিয়া দোকানে যান।
বশির হাসে। এই মেয়েটা না থাকলে তার জীবন অচল হয়ে যাইত। এক হাতে সব সামলায় ফাতেমা। ঘর ভাড়া দিতে লাগে তিন হাজার। খাওয়া দাওয়া সব মিলে নিদেনপক্ষে আরও পাঁচ হাজার টাকা। অসুখ বিসুখ আর বিভিন্ন বিপদ তো আছেই। ফাতেমার হাতের রান্না খুব ভাল। গুলশানের এক বাড়ীতে শুধু দুপুরে রান্না করে দিয়েই ফাতেমা পায় পাঁচ হাজার টাকা।
বশিরের প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগত, ফাতেমার এই কাজ করাতে। তমিজ তো আছেই। তমিজ বশিরকে বলছিল -
- কি বশির মিঞা? বউরে বুয়া বানায় দিলা?
- তমিজ ভাই, খাইটা খাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নাই।
- বশির মিঞা, তুমি খালি আমারে খোঁটা দেও কথায় কথায়।
- তমিজ ভাই, আমি সত্য কথা কই। ভিক্ষা করলে কোন ভাল কথাই তোমার ভাল লাগবে না। ছাইড়া দাও এই ভিক্ষাটা।
তমিজ রেগে গটগট করে হেঁটে চলে যায়। তমিজের মনে প্রচন্ড রাগ জন্মায় নিজের উপরে। তমিজের এই রাগটা খুব ঘন ঘন উঠে নিজের উপরে ইদানিং। এক সময় সেই রাগ তার দেহে জৈবিক তাড়নার সৃষ্টি করলে তমিজের মনে হয় -
- তার পাঁচ নম্বর বউ সুফিয়ার মতিগতি ভাল ঠেকতেছে না। সে শুনেছে, কোন এক রিক্সাওয়ালার সাথে নাকি তার প্রেম হইছে। সেই পোলারে নাকি সুফিয়া একদিন ঘরে আনছিল। আইনা দরজা বন্ধ করছে শালী। তমিজের রাগটা আবার নিজের উপরেই আসে। শালার সুফিয়া নিজে ফকিরের মাইয়া হইয়াও, ফকির জামাই তার পছন্দ না। তার পাঁচ বউয়ের কেউই তারে ভালবাসে নাই, শুধু ফকির হবার কারণে। তমিজ নিজেকে নিজেই বলে -
- তমিজ মিঞা, ছাইড়া দে না এই ভিক্ষা করাটা। বয়স আর কত? আটাশ বছর। শরীরে তো কোন সমস্যাই নাই। খাইটা খাইলেই পারিস।
তমিজের চুড়ান্ত রাগের সময় তার প্রথম বউ মালেকার মায়ের মুখটা মনে ভাসে সবসময়। সে এই মালেকার মাকেই একমাত্র কাগজ কলমে কাজী ডেকে কলমা পড়ে বিয়ে করছে। বাকীগুলা সব ফকিরের মাইয়া, ফকিরের হাতে দোয়া পইড়া তুইলা দিছে। মালেকার মায়ের কথা তমিজের যতবারই মনে আসে, ততবারই একইসাথে তার মনে ভালবাসা ও দেহে উত্তেজনা আসে।

৩।
তমিজ মগবাজারে আসার পরে পেট্রোল পাম্পের পাশে একটা স্থায়ী জায়গা পায় ভিক্ষা করার। স্থায়ী জায়গায় বসলেও বেশীরভাগ সময়ই তমিজ ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে। ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করলে ইনকাম বেশী। অর তমিজের কাঁধের ফোড়াটাই তো তার বড় অস্ত্র। ভিক্ষা চাইতে হয় না, রাস্তার মোড়ে এমনিতেই গাড়ীর ভেতর থেকে টাকা দিয়ে লোকে বলে অপারেশন করাও। তমিজ বলে -
- আর কিছু টাকা উঠলেই করামু সাহেব।
কিন্তু, তমিজের মনে তখন অপারেশনের কোন চিন্তাই নাই। সে ভিক্ষায় মজা পেয়ে গেছে। তমিজের ইনকাম একজন রিক্সাওয়ালার চেয়ে অনেক বেশী। তার ভিক্ষার অস্ত্র সে কি করে অপারেশন করবে? তবে, তমিজের ইচ্ছে আছে, টাকা পয়সা হলে সে ব্যবসা শুরু করবে। তখন ফোড়াটা অপারেশন করাবে।
এক শুক্রবার তমিজ পেট্রোল পাম্পের পাশে বসে থাকে। সুন্দরী একটা মেয়ে নামে বাস থেকে। তমিজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কি মায়ার চেহারা! আর শরীর স্বাস্থ্যও মাশাল্লা। তার সাথে একটা ছোট মেয়ে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই মেয়ের বিয়া হইছে। জামাইটার চেহারা ছবি অতটা ভাল না। তমিজের মনে হয় -
- আহারে! এইরকম মাইয়া যদি তার বউ হইত। তমিজের বয়স তখন মাত্র তেইশ চব্বিশ। এরপরে অরো একদিন সেই মেয়েটাকে দেখার পরে, পাশে বসা খোড়া সলিম তাকে বলে -
- তমিজ মিঞা! ড্যাবড্যাব কইরা কারে চাইয়া দেখ? তুমি জান, মাইয়াটা ক্যাডা?
- না সলিম ভাই, ক্যামনে জানমু? আমার তো অহনও এইহানে আহনের বছরই পুরে নাই।
- হেইডা হইল গিয়া আমগো ওস্তাদ সুরুজ সর্দারের মাইয়া। থাকে গাবতলীতে। জামাই ঐহানে একটা পেট্রোল পাম্পে কাম করে। হ্যায় জানে, সে ব্যবসায়ীর মাইয়া বিয়া করছে। ওস্তাদে তো আবার বাসার সামনে রড সিমেন্টের দোকানের একটা সাইনবোর্ড লাগাইছে, দ্যাহ নাই?
- হ দেখছি তো। ঐটা কি জামাইরে দেয়ার জন্য নাকি?
- আরে, তমিজ মিঞা যে কি বুদ্ধি লইয়া চল না? ঐটা দেখায় তো ওস্তাদ জায়গামত ফকিরের সর্দার না কইয়া কয়, এই একতলা পাকা বাড়ীটা সে ব্যবসা কইরা বানাইছে। ফকির সর্দার জানলে কি কেউ তার মাইয়ারে বিয়া করত?
তমিজ একটু দমে যায় এই কথা শুনে। তার আবারও মনে আসে সে ফকির। মন খারাপ হয়। যতদিন যাচ্ছে, তমিজের খারাপ লাগাটা ততই বাড়তেছে।
তমিজের মনটা ভাল করতেই যেন পরপর দুটি ঘটনা ঘটে যায় -
- ওস্তাদ সুরুজ সর্দারের জামাই জানতে পারে যে, তার শ্বশুর ফকির সর্দার। এটা জানার পরে বউ আর মেয়েকে শ্বশুর বাড়ীতে ফেলে রেখে জামাই চিরতরে চলে গেছে। যাবার পরে লোক মারফত খবর পাঠাইছে। এই কথাও নাকি কইছে যে, তার খোঁজে গাবতলীত বউ আর শ্বশুর যেই যাউক, তাকেই কোপায় মারবে।
- ওস্তাদের বউ মারা গেছে, তমিজ এই জায়গায় আসার ঠিক আগে আগে। এখন খালি বাসায় স্বামী নাই, এমন সোমত্ত মেয়ের উপর পাড়ার ছেলেপেলের নজর লাগছে। এক পোলা নাকি বাসার সামনে, ওস্তাদের মেয়ের গায়ে সন্ধ্যেবালা হাত দিছে। এর এক সপ্তাহ পরে সুরুজ মিঞা তমিজকে ডেকে একদিন তার মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে, তমিজ কি করে না করবে? তার চোখে তখন ঐ মায়াকাড়া চেহারা আর দেহের ভেতরটা ফুসতে থাকে ঐ দেহের জন্য।
পরের শুক্রবারই কাজী ডেকে ওস্তাদের মেয়ে সালেকার সাথে তমিজ মিঞার বিয়ে হয়। ওস্তাদের নাতনির নাম মালেকা। মেয়ের নাম সালেকা হইলেও সবাই মালেকার মা বলে ওস্তাদের মাইয়ারে ডাকে। তমিজ বাসর ঘরে ঢুকে। তার বুক ঢিবঢিব করতে থাকে। সে দেখে সালেকা বিয়ের শাড়ী বদলিয়ে সালোয়ার কামিজ পরে আলমিরার ভেতরে কাপড় রাখছে। তিন বছর বয়সী মালেকা আজ পাশের ঘরে তার নানার কাছে ঘুমাচ্ছে।। তমিজ আশা করেছিল সালেকা বিয়ের শাড়ী পরে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে। তমিজের চোখে ভেসে আসে পুরোন ঢাকায় দেখা সেই বাংলা সিনেমার দৃশ্য। রাজ্জাক বাসর ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে শাবানার ঘোমটা সরিয়ে দেয়। শাবানা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। তমিজেরও মনে সেরকম আশা ছিল। তবে, সে আশা পূরণ না হওয়ার কষ্ট তমিজ ভোলে পেছন থেকে সালেকাকে দেখে। কিছু বলতে পারে না। ফকির হওয়াতেই মনে হয় তার মধ্যে থাকা সব সাহস উধাও হয়ে গেছে। তমিজ বিছানায় শুয়ে অন্যপাশে চলে যায়, সালেকার জন্য জায়গা রেখে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে কি বলবে সে সালেকাকে? খুটখুট আওয়াজে তমিজ বোঝে সালেকা কাজ করছে। মনে হয় - কখন এ আওয়াজ বন্ধ হবে?
এক পর্যায়ে আওয়াজ বন্ধ হয়। তমিজ চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। কত মিনিট ঘণ্টা জানে না, তবে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে বোঝে। এর মাঝে ঘরের লাইট বন্ধ হয়েছে। তমিজ চোখ খুলে দেখে সামান্য আলোয় যতটুকু দেখা যায়, তাতে দেখতে পায় - সালেকা মেঝেতে শুয়েছে। তমিজের বুকটা ফেটে যায়। তমিজ ভাবে - দ্বিতীয় বিয়া, এই কারণেই মন টানতেছে না। মনে পাথর চাপা দিয়ে তমিজ ঘুমিয়ে পরে মনে আশা নিয়ে।

৪।
রাস্তার পাশে দুটো দেয়ালের মাঝের একটি চিপার মধ্যে বশিরের সিগারেট আর পানের দোকান। সারাটা সময় বলা যায় দাড়ায় থাকতে হয়। বসলেও, এতটাই কম জায়গা যে, হাঁটু বাঁকা করে বসতে হয়। আজ বশিরের আনন্দের দিন। বশির আজ পান সিগারেট থেকে মুদি দোকানদার হতে যাচ্ছে। এর জন্য অবশ্য সপূর্ণ অবদান বউ ফাতেমার। দোকানটা খালি হওয়ার পরে এমনিতে কথায় কথায় ফাতেমারে বশির লেই কথাটা বলে। পরের দিনই ফাতেমা তাকে বলে দোকানটার বায়নার পঁচিশ হাজার টাকা দিতে। এই অভাবের সংসারে ফাতেমা কেমন করে জানি দশ হাজার টাকা জমায় ফেলছে। বাকী পনের হাঁজার টাকা গুলশানের সেই বাসার মালিকের বউ দিছে। মহিলা ফাতেমাকে খুব ভাল জানে। আনন্দে বশিরের চোখে পানি চলে আসে। বশির শুধু এতটুকুই বলতে পারে -
- ফাতেমা, তোমার মত বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।
তমিজ সকালে ঘণ্টা দুয়েক বসে থেকে উঠে রওনা করতে আশেপাশে। এক জায়গায় বসে থাকলে তো চলে না। ঠিক সেই মুহুর্তে বশির তমিজকে বলে -
- তমিজ মিঞা, আল্লাহতালার অশেষ রহমত, আইজ এডভান্সের টাকা দিয়া দিছি। সামনের শুক্রবারের পরের শুক্রবার আল্লাহ চায় তো দোকানটা চালু করব। দোয়া রাইখ তমিজ মিঞা। সেদিন বাদ জুম্মা মিলাদ দিব। তুমি অবশ্যই খেয়াল কইরা আইসো।
- আচ্ছা বশির ভাই। আল্লাহ তোমার ব্যবসায় বরকত দেউক।
এই বলে তমিজ রাস্তায় নেমে আসে। তমিজের হিংসে হয় না। কিন্তু, তমিজের আবারো মনে হয় - কেন সে এই ফোঁড়াটা অপারেশন করে ভাল কাজকর্ম শুরু করছে না? তমিজ থলে থেকে ভিক্ষার থালাটা বের করবার আগেই একজন তার সামনে এসে দাড়ায়। সে চিনতে পারে। দেশের বাড়ীর তিন বাড়ী পরের সোলেমান মিঞা, তমিজের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। তমিজ জিজ্ঞেস করে -
- কি সোলেমান, কই যাও?
- এই তো বশির ভাই, গার্মেন্টসে ঢুকছি, কামে যাই। আপনি ঢাকা শহরে আইয়া হারায় গেলেন। এত বড় বিপদের সময়ও দেশে গেলেন না?
তমিজ বুঝতে পারে, আজ কতদিন পরে সে কাউকে তুমি সম্মোধন করছে, কতদিন পরে কেউ তাকে ভাই বলেছে, আপনি করে কথা বলেছে। ভিক্ষে শুরু করার পরে মানুষকে সালাম দেয়া আর আপনি বলা এবং তার বিনিময়ে তুমি আর তুই শোনাটা যেন নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে। তবে, তমিজ বিপদের ব্যপারটা বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করে -
- সোলেমান, বিপদের কথা কি কইলা যেন?
সোলেমান কিছুটা অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে বলে -
- তমিজ ভাই, ছয় মাস আগে তোমার মা যে মারা গেছে, সেইটা কি এখনও জান না? মরার আগে তমিজ তমিজ করতেছিল।
তমিজ বাসায় এসে মেঝেতে শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তিন বছর হয়, সে যাবে যাবে করে বাড়ী যায় না। বাড়ীতে আর কিছু না থাক, একটা ঘর আর মা তো ছিল! তমিজের দেশে ফিরতে যতবারই মন চেয়েছিল, ততবারই এই ভিক্ষাবৃত্তিটাই তাকে বাঁধা দিয়েছে। তমিজের দেশের বাড়ী বরিশালের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জ্ঞান হবার পরে তমিজ জানতে পারে, তার জন্মের আগেই তার বাবা তার মাকে ফেলে চলে যায়। এরপরে তমিজের মা, এবাসা সেবাসায় কাজ করে তমিজকে মানুষ করে। তমিজ ক্লাস থ্রিতে ওঠার পরে আর পড়াশুনা করে নাই। এদিক ওদিক কাজ করার চেষ্টা করেছিল। ইটের ভাটা, মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির যোগালি সহ অনেক কাজই তমিজ চেষ্টা করেছে, পারেনি। প্রায়শই অসুস্থ্য হত আর নিজে কিছুটা অলস প্রকৃতিরও ছিল। তমিজের যখন বিশ বছর বয়স, তখন প্রথম উরুতে একটি ফোড়া ওঠে। অসম্ভব ব্যাথা। সেই ফোড়াটা এমনিতেই একসময় ফেটে যায়। এর ছয় মাস পরে কাঁধের এই ফোড়াটা ওঠে। এটি এতটাই বড় এবং ভয়ংকর চেহারা ধারন করে যে, তমিজের মা ভয়ই পেয়ে যায়। পাশের গ্রামের এক কবিরাজ ঔষধ দেয়, কিন্তু ঠিক হয় না। কবিরাজ বলে এটি বিষ ফোঁড়া। সেই ফোঁড়ার ব্যাথার তমিজ কখনও চিৎকার করে, সারারাত গোঙ্গায়। মায়ের মন মানে না। পাশের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে অনেকগুলি টেষ্ট করতে দেয়। সেই টেষ্টের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে তমিজের মা তার জীবনের শেষ সম্বল, পাতলা একগাছি সোনার চুড়ি বিক্রি করে দেয়। আশপাশের লোকজন বলে, এই ক্লিনিকের অত সুনাম নাই। যে টাকা খরচ, তা দিয়ে তমিজ ঢাকায় যেয়ে সরকারী ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় গিয়া শুইয়া পরলেই চিকিৎসা হবে। আর এখানে টেষ্ট আর অপারেশনের টাকা দিতেই সব শেষ হয়ে যাবে, এরপরে ঔষধপত্রের খরচ? ঢাকা মেডিকেলে সব ফ্রি। তমিজ রওনা করে ঢাকা। বরিশাল এসে লঞ্চে ওঠে।
লঞ্চে তমিজ রাতের খাবার খাবার পরে ডেকের উপরে শুয়ে ব্যাথায় গোঙ্গাতে থাকে। এক পর্য্যায়ে বমিও করে। পাশের বয়স্ক মুরুব্বী তমিজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন -
- বাবা, ব্যাথা কি খুব বেশী? কই যাও?
- হ বেশী। ঢাকা মেডিকেলে যাই চিকিৎসা করাতে।
- ভাল, আল্লাহ তোমারে সুস্থ্য করুক।
তমিজ আরেকবার বমি করার পরে, মুরুব্বি তাকে একটি পান খেতে দিয়ে বলে -
- বাবা, চমনবাহার মসলা আছে পানে। বমির সময় গন্ধটা ভাল লাগবে। বমি হবে না।
পান খাবার পরে তমিজ দেখে, সে সদরঘাটের বাইরে ফুটপাথে শুয়ে আছে। তার সাথের পোটলাটি নেই। কিন্তু, বেশ কিছু পয়সা তার পাশে। তখনও সে বোঝেনি যে, এগুলো ভিক্ষার পয়সা। তারপরে দুদিন ব্যথা আর জ্বরে তমিজের কিছুই মনে নেই। তৃতীয় দিন উঠে বসার পরে, ফুটপাথের চায়ের দোকানদার তার হাতে পাচশ বিরাশি টাকা দিয়ে বলে -
- নাম কি তোমার জানি না ভাই, টাকাগুলা নিয়া তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাইয়া ফোড়াটা অপারেশন করাও। এই দুইদিন রুটি আর কলা খাওয়াইয়া বাঁচায় রাখছে উপরওয়ালা, আমারে অছিলা কইরা। সেইগুলার দাম দেওন লাগবে না। যাও অপারেশন করাও গিয়া।
সেইখান থেকে ঢাকা মেডিকেলের রাস্তা মানুষকে জিজ্ঞেস করে হাঁটা শুরু করে তমিজ উদ্দিন। হাঁটতে হাঁটতে বংশালের কাছে এসে, একটি হোটেলে পানি খেয়ে তমিজ ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে যায়। আবার একই ঘটনা। জ্বর, এবার সে পায় আরো চারশ টাকা। জ্বর থেকে ওঠার পরে তমিজ টের পায় ব্যথাটা কম। এরপরে দুইদিন সেখানে থাকার পরে, তমিজের মস্তিস্কে এই মনুষ্যত্ব হারানোর চিন্তাটা মাথায় আসে। সে দেখে, একদিকে যেমন ফোড়াটার ব্যথা কম, অন্যদিকে এই ফোড়া দেখেই সে দিনে দুই থেকে তিনশ টাকা আয় করতে পারে। তমিজের ফোড়াটা শক্ত হয়ে যায়, আর আয়ও পোক্ত হতে থাকে। মগবাজারে আসার আগেই তার ফোড়ার ব্যথাটা সম্পূর্ণ চলে যায়। কিন্তু, তমিজ ভিক্ষাবৃত্তির এই ব্যবসা থেকে আর সরে আসতে পারে না। তাই, সে ফোড়াটাকে পুজি করে, সেটিতে লাল রং মাখিয়ে কাচা টকটকে লাল ফোড়ায় পরিণত করে। ফোড়া শক্তের সাথে সাথে তমিজ উদ্দিনও তার ভিক্ষাবৃত্তি পোক্ত করতে পুরোন ঢাকা থেকে মগবাজার হয়ে শাহজাদপুরে চলে আসে।

৫।
তমিজ উদ্দিন রাস্তার পাশে দাড়িয়ে উদাস মনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সে ভিক্ষা করতে আসবে না, আসবে না মনে করেও এসেছে। এ এক বড় নেশা। পৃথিবীতে এর চেয়ে সহজ পথে টাকা কামানোর সুযোগ আর নেই। আজ তমিজ আলীর পাঁচ নম্বর বউ সুফিয়াও চলে গেছে, তাই মনটা খারাপ। তমিজ শুনেছে - বিলেতে নাকি বিয়া না করেও এক ঘরে ঘুমান যায়। তাই, তমিজ উদ্দিন ভাবে সে এই তিনজনকে বিলেতি বিয়ে করছে। কয়েকজন কাছের মানুষকে ডেকে, একটা গরম সিঙ্গারা আর একটা লাড্ডু খাইয়ে, কোন একজন মুরুব্বির দোয়ার মধ্যেই বিয়ে শেষ। এই বউগুলো সব ভিক্ষুক শ্রেনী থেকেই আসা। তমিজের থেকে ভাল প্রস্তাব পাওয়াতেই, তমিজকে ফেলে চলে গিয়ে। বউ গেলে আরেকটা বউ যে তমিজ জুটিয়ে নিতে পারবে, সেটা জানে। কিন্তু, লোকে নানান কথা কয়। কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল যে তার এই বৌটাও চলে যাবে, সেই রিক্সাওয়ালার সাথে। গত রাতে তমিজ তার হাতে ধরে বলেছিল, সে এই রাস্তায় আর আসবে না, তারপরেও চলে গেল। অবশ্য আগেও কয়েকবার সে এই কথা বলেছিল, তাই বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। প্রতিবারই তমিজ মনে করে এবার ফোড়াটা অপারেশন করে সে কাজকর্ম শুরু করবে, কিন্তু পারে না। একবার সে ডাক্তারের সাথে কথাও বলেছিল। খরচাও বেশী না, শুধু একদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। সেবার সে গিয়েছিল সালেকার জন্য। তমিজের মনের ভেতর থেকে আবার উঠে আসে সালেকার মুখ আর শরীরটা।
বিয়ের পরে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রতিটি দিনই সালেকা নীচে ঘুমায়। আজ কাল করে তমিজ সালেকাকে বলে -
- সালেকা, আমার কি কোন অন্যায় হইছে? তুমি নীচে ঘুমাও। খারাপ দেখা যায়।
- খারাপ দেখা গেলে আপনে নীচে ঘুমান।
- তা না হয় ঘুমাইলাম। তয়, তুমি আমার লগে ঘুমাও না কেন?
- যে ফকিরের মাইয়া শুইনা মালেকার বাপ চইলা গেল, সেই ফকিরের সাথে আমি ঘুমামু? জন্মের উপরে হাত নাই। তাই বইলা কারে শইলে হাত দিতে দিব, সেইটা আমার ব্যপার।
তমিজের মুখে কোন কথা আসে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রাতে ঘুমানোর সময় তমিজ মেঝেতে তার বিছানা দেখে আর সেরকম কষ্ট পায় না।
পরের দিনই তমিজ ঢাকা মেডিকেলে যায়। দিনটা তমিজের ভালই কাটে। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়া মাত্রই তার এত বড় ফোঁড়া দেখে পনের মিনিটের মধ্যে এপোয়েন্টমেন্ট পায় তমিজ। সুন্দর চেহারার একজন প্রফেসর তার ফোঁড়া দেখে বলে -
- কেটে ফেলা দরকার ছিল আগেই। তবে এখন কাটলেও কোন সমস্যা নাই। একদিন থাকতে হবে। এই ঔষধগুলো তিনদিন খাবেন, তারপরের দিন সকালেই চলে আসবেন।
এই বলে ডাক্তার খসখস করে কিছু লিখে একজনকে ডাক দেয়। সে তমিজকে নিয়ে যেয়ে রক্ত নেয় ও সমস্ত ঔষধ হাসপাতাল থেকেই দেবার পরে বুঝিয়ে দেয় - কোনটা কখন খেতে হবে?
তমিজ রাতে এসে সালেকাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঔষধগুলো খায়। সালেকা কিছু জিজ্ঞেস না করলে, তমিজ নিজে থেকেই বলে -
- সালেকা, ঢাকা মেডিকেলে গেছিলাম। তিনদিন পরে ডাকছে। অপারেশন কইরা ঠিক কইরা দিবে, ডাক্তারে কইছে। এরপরে ভাল কোন কাম ধরুম তোমার লাইগা। বয়স তো মাত্র বাইশ তেইশ বছর। যে কোন কামই পারুম।
বয়সের কথাটা বলে তমিজ সালেকার দিকে তাকায়। তার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় -
- ভালা হইলে ভালা। তয় এই কাম থাইকা বাইর হওন সোজা নয়। বাইর হইয়া কাম শুরু কইরা কিছুদিন গেলে তারপরে আমার লগে কতা কইয়েন। আর, আমারে মালেকার মা ডাকবেন। সালেকা আপনের মুখে শুনতে ভালা লাগে না। মালেকার বাপে সালেকা ডাকছে।
তমিজ প্রথম দুইদিন ঔষধ খেলেও তৃতীয়দিন যেন অনেকটা ইচ্ছে করেই ঔষধ খায় না। দুপুরে আবার খায়। বিকেলে তমিজের -
- ভিক্ষার বড় অস্ত্রটা কেটে ফেলতে মন চায় না। সেইটা না থাকলে, তার মত জোয়ান পোলারে কে ভিক্ষা দিবে। তাই তমিজ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেও সকালে ঢাকা মেডিকেলে এসে ভিক্ষা করে চলে যায়। তমিজের আজ মনে হয়, যেদিন ঢাকা মেডিকেলে সে এসেছিল, সেদিনই তাকে শয়তান ধরেছিল। তা না হলে, মেডিকেল থেকে বের হবার পরে আধা ঘন্টার মধ্যে সেদিন কি করে সে এক হাজার টাকা পায়? আজব ব্যপার। বাসায় ফিরে সেদিন মালেকার মাকে বলে -
- ডাক্তার আরও তিনদিন পরে যাইতে কইছে।
মালেকার মা কোন উত্তর দেয় না। তিনদিনের জায়গায় সাতদিন পার হয়ে যায়, তমিজও কিছু বলে না, মালেকার মায়েও কিছু বলে না।
এর মাঝে একদিন তমিজ খবর পায়, পাড়ার পেছনের ফুচকাওয়ালার সাথে নাকি মালেকার মায়ের খাতির হইছে ফুচকা খাইতে গিয়া। তমিজ এর মাঝে একদিন তার ওস্তাদের সীমানা রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে আসলে কফিল মিঞা নামের আরেক ফকিরের সাথে আলাপ হয়। কফিল মিঞা তাকে বলে - এইদিকে নাকি আয় রোজগার ভালই। সে চাইলে ওস্তাদের সাথে দেখা করায় দিবে। তার কয়েকদিন পরেই তমিজ খবর পায়, সেই ফুচকাওয়ালা নাকি ফুচকা নিয়া বাসার ভেতরে ঢুকছিল। তমিজ রাগে চিন্তা করে - আর না, মালেকার মাকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। পরদিন সকালে তমিজ তার ফোড়া রং করবার শিশিটা বের করে। সেখানে একটা টমেটোর রসের সাথে পোলাওয়ের রং মিশায় রাখে তমিজ। সকালে বের হবার আগে দুই ফোটা মাখলেই মনে হয় ফোড়া পেকে টসটস। বাসার পেছনে মাখার সময় মালেকার মা দেখে এগিয়ে আসে। তমিজ মালেকার মাকে ফুচকাওয়ালার বিষয়ে আর কি জিজ্ঞেস করবে? তার আগেই মালেকার মা এসে তমিজের সামনে এক দলা থুথু ফেলে বলে -
- এইরহম জোয়ান পোলার গলায় দড়ি দিয়া মরা উচিত।
তমিজ সেদিনই শাহজাদপুর এসে সেই সর্দারের সাথে কথা বলে। তার কাঁধের ফোড়াটা যে অনেক বড় অস্ত্র, সেটি তমিজ সেদিন আবারও বোঝে, যখন সেই ফোড়া দেখেই সর্দার তাকে চলে আসতে বলে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই তমিজ তার শ্বশুর সুরুজ সর্দারের আলমিরা থেকে ছয় হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে শাহজাদপুরে চলে আসে। সর্দারকে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। এই কারণেই তার শ্বশুর শাহজাদপুরে এসেও, তমিজের কিছুই করতে পারে নাই। মালেকার মায়ের এক গাছি সোনার চুড়ি কোথায় আছে? তমিজ জানলেও কেন যেন তার মন সায় দেয় না নিতে। পরে তমিজ বুঝে - তার মন আসলে মালেকার মায়ের কাছে পরে আছে।

৬।
তমিজ উদ্দিনকে বশির আজকে আবারও মিলাদের দাওয়াতের কথা মনে করিয়ে দেয়। একবার নয়, কয়েকবার বলেছে আসতে। আগামীকাল মিলাদ। তমিজ এখন বশিরের দোকানের সামনে আর বসে না। মাঝে মাঝে আসে। তমিজ আজ একই সাথে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কারণের অনুভুতি নিয়ে বসে আছে।
- প্রথমত, তমিজ উত্তেজিত। শেষ বউ সুফিয়া চলে যাবারও বছর পেরিয়েছে। তমিজের ইদানিং রাতের বেলা শরীরটা বউ খোঁজে, মানতে চায় না বাঁধা। যদিও তমিজ দুই এক জায়গায় গিয়েছিল। দুনিয়ায় ফকির থেকে রাজা সবারই সব ব্যবস্থাই করা আছে। তবে, সেই মেয়েগুলোর কাছে যেয়ে তার মন ভেজে না। কয়েকটা মেয়েকে তমিজ দেখেছে। । আজ সে পনের বছরের একটা মেয়ে দেখে এসেছে। মেয়েটার মুখের গড়ন সেরকম ভাল না হলেও, শরীর স্বাস্হ্য মালেকার মায়ের মতই। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল বাদ জুম্মা বিয়া। খরচও বেশী না। আর তমিজ এখন অনেক টাকার মালিক। ইতোমধ্যে বশিরের যেমন ব্যবসার প্রসার হয়েছে, ঠিক তেমনি তমিজেরও হয়েছে। তমিজ এখন গুলশানে ভিক্ষা করে। ওস্তাদ খুশী হয়ে দিয়েছে। ওস্তাদেরও ইনকাম ভাল হয়। তমিজ গুলশান আজাদ মসজিদের আশে পাশে ভিক্ষা করার অনুমতি পায় আরও মাস ছয়েক আগে। এখানে লোকজনের অনেক টাকা। পাঁচশ টাকাও যে ভিক্ষা পাওয়া যায়, সে এই এলাকাতে এসে বুঝতে পেরেছে - একবার নয়, দুইবার নয়, পাঁচ পাঁচবার। তমিজের এই রং মাখিয়ে রক্ত ন্যায় লাল করা বিষ ফোড়াটা যে তার ইনকামের প্রধান কারণ, সেটি তমিজ বোঝে। তা না হলে এই পচশোর্ধ বয়সের তাকে কেউ ভিক্ষা করতে দেখলে মারতেও পারত।
- তমিজের একই সাথে মনে হতাশাও ভর করে। পনের বছরের মেয়েটাকে দেখার এক ঘণ্টা পরেই তমিজের সেই মুখটা চিন্তা করে শরীর আর গরম হয় না। সেখানে ভেসে আসে মালেকার মায়ের মুখ। তমিজ একটা জিনিস বুঝে গিয়েছে - তার ইনকাম যেমন বেড়েছে, তেমনি হতাশাও বেড়েছে। তমিজ যেবার শেষ পাঁচশত টাকা নোটটা হাতে পায়, সেদিন তার মন আর আগের মত নেচে ওঠে নাই। তমিজ বোঝে, তার টাকার আসলে কোন মূল্য নাই। এই বশির একবার বিপদে পরে পাশের গলির দোকানদারের কাছে পঞ্চাশ টাকা ধার করল, কিন্তু তার কাছে চাইল না পর্য্যন্ত। তখন তার কাছে যে পাঁচশত টাকার উপরে আছে, বশির সেটা জানত। কিছুক্ষণ আগেই তমিজ, বশিরের সামনেই টাকাগুলো গুনেছিল। তমিজ সেদিন বুঝতে পারে, সব পঞ্চাশ টাকার মূল্য পঞ্চাশ টাকা হইলেও, তার পঞ্চাশ টাকার মূল্য আসলে শূণ্য। ইদানিং তমিজের মনে হতাশাটা আরও বেশী আর ঘন ঘন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।
- সর্বশেষ অনুভুতি আজ তমিজের মনোবল বেশ শক্ত। মালেকার মায়ের জন্য বিয়ের পরদিনই ডাক্তার দেখিয়ে তমিজ ঔষধ খাওয়া শুরু করবার পরে মাঝে আরও একবার ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খেয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু শেষে পারেনি। এবার আজাদ মসজিদে আসে, এরকম একজন ডাক্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি সব খরচ দিতে চেয়েছেন। আজ একটু আগেই তমিজ ওনার চেম্বারে গিয়ে একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে এসেছে। আগামী পরশুদিন অপারেশন। ঘর পোড়া গরুর মত তমিজ বারবার ভাবে, আল্লাহ শক্তি দাও। গত দুবারই কিন্তু তমিজের মনে জোর ছিল আরও বেশী, শেষে পারেনি। এবারও না পারার একটা ভয় কাজ করছে থেকে থেকে। এই মুহুর্তেই তমিজের সাথে কফিল মিঞা ফকিরের দেখা হয়। সেই কফিল মিঞারে একজন নাকি মগবাজারে নিয়েছিল গতকাল। তার কাছেই তমিজ মালেকার মায়ের খবর পায়। এই তিন চার বছরে নাকি মালেকার মা আর বিয়া করে নাই। তবে, দেখতে নাকি এখনও সুন্দর আছে। এটি শুনে তমিজের আজ যে মলোবল ছিল তা আরও পোক্ত হয়। সেই মনোবল ধরে রাখতে তমিজ ভিক্ষার থাল ব্যাগে ঢুকিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয়। পরের দিন বিয়েটা তমিজ এক সপ্তাহ পিঁছিয়ে দেয়। এটি করতে পেরে তমিজের খুব ভাল লাগলেও পর মুহুর্তে মনে হয়, কেন সে না করে দিতে পারল না? সে তো ভাল হয়ে মালেকার মাকে বিয়ে করার কথা। প্রচন্ড অস্থিরতায় তমিজের মনে হয় বশিরের মিলাদের কথা। সকাল থেকে তমিজ আজ ভিক্ষে করতে বেরোয়নি। শুক্রবার, অথচ তমিজ ঘরেই ছিল। তমিজ হন হন করে বশিরের দোকানের দিকে রওনা করে।
মৌলানা সাহেব মোনাজাতের এক পর্য্যায়ে বলেন -
- হে আল্লাহ, তুমি বশির মিঞাকে সৎ পথে আরো অধিক উপার্জনের সামর্থ্য দান কর। তার রোজগার বৃদ্ধি করে দাও।
তমিজ উদ্দিনের বুকটায় শূন্যতা ভর করে। না, তাকে পারতেই হবে। বশিরের ছেলে সবুজকে দেখে তমিজ। বশির তার এক দুই বছরের ছোট হইলেও পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে। কি মায়া চেহারাটার মধ্যে! আহা। তমিজের মনে পিতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। তমিজ বশিরের তোবারক হাতে নিয়ে হনহন করে বাসার দিকে রওনা করে। তোবারকের খুরমা মুখে দেবার পরে তমিজ বুঝতে পারে সে গতকাল সন্ধ্যে থেকে কিছুই খায়নি। বাসার আগে হোটেলে ভাত খেয়ে অবেলায় তমিজ ঘুমিয়ে পরে। রাত নয়টায় উঠে অভ্যাসমত টিভিটা ছেড়ে সে রোলিং চেয়ারটায় শুয়ে রাজার মত দোল খায়। হিন্দি গানের সাথে কম কাপড়ের নায়িকাদের নাচ আজ তমিজের ভাল লাগে না। ঘরে থাকা মুড়ি খেয়ে তমিজ আবার শুয়ে পরে।
ভোরবেলাতেই আজ তমিজের ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাতে না খাবার কারণে শরীরটা একটু দূর্বল লাগে। তমিজ ভাবে - শয়তানের কারসাজি। সে ঘুমোলে আর উঠতে পারবে না।,ঘরে থাকা মুড়ি পানিতে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে খায় তমিজ। শরীরে কিছুটা বল পায়। গতরাতে প্রথমবারের মত স্বপ্নে তমিজ বাবা মাকে দেখে। তাদের মুখ খুবই শুকনা। তমিজের আজ মনে হয় -
- সারা দুনিয়াটাই যেন তমিজ, আর সে নিজেই একটা বিষ ফোড়া।
আর না, আজ সে ডাক্তারের কাছে যাবেই যাবে। এর আগেও তমিজ দুই দুইবার প্রতিজ্ঞা করে বাসা থেকে বেরিয়েও পারেনি। আজ পারবে কিনা তমিজ সেটা জানে না। তবে আলমিরা থেকে একটা নতুন ফতুয়া বের করে তমিজ। খাটের নীচে লুকিয়ে রাখা টিনের কৌটা থেকে আট হাজারের মত টাকা বাহির করে। মেঝের ভেতরেও তমিজের টাকা আছে। ফতুয়াটা গায়ে চাপিয়ে টাকাগুলো নিয়ে তমিজ আজ তৃতীয়বারের মত বাসা থেকে বের হয় তার বিষ ফোড়াটা অপারেশন করতে।
দাঁতে দাঁত চেপে তমিজ, পায়ের চপ্পলের কিছুটা শব্দ করে হাঁটতে থাকে বিষ ফোড়া মুক্ত একটি নতুন জীবনের সন্ধানে। ভোরের আলো ফুটেছে। সে আলোয় তমিজের চোখ জোড়া চকচক করে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.