![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি যাচ্ছেতাই টাইপের একজন মানুষ। কোন কিছুতেই ভেবেচিন্তে হ্যা কিংবা না বলতে পারিনা.।জীবনটাকে সাধ্যের মধ্যে যথেষ্ট উপভোগের চেষ্টা করি.।
অফিস থেকে বের হয়েই একটা রিকশা নিলেন আফতাব সাহেব। গন্তব্য কমলাপুর রেলওয়ে কবরস্থান। আজ সপ্তাহের শেষ দিন। ঘড়িতে সময় ৪ টার কাছাকাছি...গত কয়েকবছর ধরেই নিজেকে একটা রুটিনের মধ্যে চালাচ্ছেন তিনি। এই যেমন প্রতি
সপ্তাহের শেষ দিনটাতে উনি অফিস থেকে অন্যদিনের চাইতে একটু আগে আগেই বের হন। চলে যান কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশেই তার বাবা মায়ের কবরে।। নিজের গাড়ি থাকা সত্বেও এই দিনটা উনি রিকশা চড়েই ওখানে যান...
আজ আকাশটা কেমন জানি মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই আকাশভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। রিকশা থেকে নেমেই রেললাইনের পাশ দিয়ে হাটা শুরু করেন আফতাব সাহেব। ওই সময়টাতে বড় রুটের কোন ট্রেন না থাকায় ষ্টেশনে মানুষের আনাগোনাও তুলনামুলক কম।
হাটতে হাটতে চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নেয় আফতাব সাহেব। অনেকদিনের পড়ে থাকা নষ্ট বগিগুলোর পিছনে বসে গাঁজা আর মাদকে মেতে আছে গনাকয়েক যুবক। আজকের এই আফতাব সাহেবও হয়ত এদেরই একজন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যেরলীলা যেন তাকে দেওয়ার জন্যই হাতখুলে বসে ছিলেন। তাইতো এই নোঙ্গরা বস্তিতে জন্ম নেয়া আফতাব সাহেবই আজ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর। জীবন কতটা রঙ্গিন হতে পারে আফতাব সাহেব সব দেখে ফেলেছেন...
তার বয়স যখন ৬/৭ তখন থেকে বদলে যাওয়া দুনিয়া দেখছেন তিনি। এই কমলাপুর ষ্টেশনেই তার জন্ম। বাবা দিনভর গাঁজা মদ আর ফেন্সিতেই মগ্ন থাকতেন। আর মা ষ্টেশনের যাত্রিদের হাতে পায়ে পড়ে যা পেতেন তাই দিয়েই চলত তাদের সংসার...সংসার বলতে কি আসলে চটের বস্তার এক খুপড়িই ছিল তাদের ঘর আর খাবারের যোগান টা পরিবারের প্রত্যেকটা সদদ্যকে নিজেরটা নিজেই যোগাড় করে নিতে হত। তিনি ছাড়াও তার দুটো ছোট ভাই ছিল। আজ তারা কোথায় আছে কেমন আছেন জানেনও না। যেহেতু নিজেদের খাবার নিজেরাই যোগার করতে হত তাই ২৫ বছর আগের কোন এক সন্ধায় রাতের খাবারের সন্ধানে মানুষ জনের কাছে ছুটে যায় তার তিন ভাই তিন দিকে। কিন্তু রাতে শুধু আফতাব সাহেব ছাড়াই কেউই ফিরে আসেনি তাদের বস্তির খুপড়িতে...
আফতাব নামটা তার আগের নাম ছিলনা। বাবা মায়ের রাখা নাম বাদল।যদিও হুজুর ডেকে আকিকা করিয়ে নাম রাখানো বস্তির ছেলেমেয়েগুলোর হয়ে উঠেনা। নিজেরাই নিজেদের একটা নামে ডাকে আর সেইভাবেই তাদের নাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও বাকী দুই ভাইকে খুজে পায়নি তার বাবা মা। অনেক খোঁজাখুঁজি বলতে স্বাভাবিক পরিবারগুলোতে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েরা হারিয়ে যাওয়ার পর যেমন মাইকিং কিংবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় অথবা থানায় জিডি করা হয় এসবের কিছুই করা হয়নি তখনকার বাদলদের হারিয়ে যাওয়া দুই ভাইকে খোজার জন্য। শুধু বাদলের দুই ভাই কেন? বস্তি আর ফুটপাতে জন্ম নেয়া এমন হাজার ছেলেমেয়ে কালে কালে হারিয়ে যায়...।হারাবেইনা কেন? যেখানে স্বামী জানেনা স্ত্রী কোথায় কিংবা বাবা মারাই জানেনা তাদের সন্তাঙ্গুলো কোথায়। সামাজিক ভাবে জন্ম নেয়া একটা ছেলে যখন আস্তে আস্তে বড় হয় তখন খেলাধুলা করে আর বস্তিতে জন্ম ওই একই বয়সী ছেলেটাকেই মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার পর নিজের খাদ্য মিজেকেই যোগাড় করতে হয়। এরপর শুরু হয় শিক্ষার অভাবে সমাজের সবচেয়ে নোংরা জগতে ঢুকে পড়া। শিশু বয়স ফেলে যখন কিশোরে পা বাড়ায় তখন থেকেই শুরু হয় নেশাগ্রস্ত জীবন। নেশাটাই যে তাদের সবচেয়ে সেরা অপশন তা কিন্তু নয় কালের পরিক্রমায় পূর্ব পুরুষদের এতিহ্য ধরে রাখতেই এই সমাজের ছেলেমেয়েগুলো এই নোংরা জগত থেকে বেরিয়ে আস্তে পারেনা কিংবা চেষ্টাও করেনা...।
আজকের আফতাব সাহেবু হয়ত আফতাব সাহেব না হয়ে রেললাইনে পড়ে থাকা কন এক জগন্য চরিত্রের বাদল হতে পারতেন...
সে আজ থেকে ২০ বছর আগের ঘটনা। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন অনেকগুলো সঙ্গঠনের একটা হল “ অন্বেষণ”। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতেই বেশকিছু বছর আগে ধানমন্ডিতে অবস্থিত কিছু কলেজ ভার্সিটির তরুন তরুণী মিলেই গড়ে তোলে অন্বেষন। তাদের নিজেদের একটা পাঠশালাও ছিল। যেখানে শুধুই পথশিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চলে নিজস্ব অরথায়নে। সাথে বিভিন্ন উপলক্ষ আর দিবসে পথশিশুদের নিয়ে সুন্দর কিছু সময় কাটানোই ছিল তাদের কাজ। এমনই এক দিবস সম্ভবত ঈদেই রেলওয়ে ষ্টেশনের পথশিশুদের নতুন জামা কাপড় দিতে আসে অন্বেশনের সদস্যরা। সাথে তাদের সাথে কিছু সময় কাটাতে চায় অন্বেষন সদস্যরা। তারই রেশ ধরে বাদলদের মত জনা পঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছিল সদস্যরা আর তাদের মেধামত্তা পরীক্ষা করে দেখছিল যাতে তাদের মাঝথেকে কিছু শিশুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে পারে। আর সেই আড্ডার মধ্যমনি হয়ে উঠে বাদল। কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই একের পর এক নজরকাড়া জবাব দিয়ে অন্বেষনের দৃষ্টি কাড়ে...
বাকিটা শুধুই যেন সিনেমার গল্প। ওইদিনই তাদের সাথে করে নিয়ে যায় বাদলকে। শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষাদান তাদের নিজেদের প্রতিষ্টানেই। অন্বেষনের সদস্যদের মায়ামতায় নিজেকে সুখী দের কাতারেই ভাবতে শুরু করে বাদল। মাঝে মাজে এসে বস্তিতে নিজের বাবা মায়ের সাথে দেখা করে যেত বাদল। যদিও বেশীরভাগ সময়েই বাবার দেখা পেতনা সে। অন্বেষন থেকে প্রাইমারি লেভেল শেষ করেই নিজের নাম বদলে ফেলে বাদল। অন্বেষন সদস্যদের দেয়া আফতাব নামেই বড় হতে শুরু করল বাদল। নামের সাথে সাথেই জীবনটাও সম্পূর্ণ বদলে যায় । অন্বেষন পাঠশালা থেকে প্রাইমারি শেষ করে নিজ মেধাবলেই নগরীর নামকরা এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চান্স পায় আফতাব। মাধ্যমিক পর্যন্ত অন্বেশনের তত্ত্বাবধানেই ছিল সে। পড়াশোনা করছে ভালোভাবেই। মাঝে মাঝে কমলাপুর বস্তিতে আসত বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে। বাবাকেতো পেতইনা বরং মাকে কিছু কিছু সময় এসে পেতনা সে। মাধ্যমিকে লেটার মার্ক সহ ১ম বিভাগ পায় সে...
এরপরঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক তাও ১ম বিভাগে পাশ। এর মধ্যে অবশ্য সে অন্বেষন থেকে বের হয়ে যায়। তিনটা টিউশনি করে। এভাবেই নিজের টাকায় নিজে পড়াশোনা চালাচ্ছিল সে...
নিজের উপার্জনের কিছু অংশ মায়ের জন্য ব্যয় করত আফতাব। মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকার মত অবস্থা না হলেও সপ্তাহে একদিন মায়ের জন্য ভাল খাবার আর ফল নিয়ে যেত সে।
এভাবেই কাটছিল সময়। ভেবেছিল আর তো মাত্র কয়েক বছর এরপরেই মাকে নিয়ে একসাথে ভালো কোন জায়গায় থাকতে পারবে সে। কিন্তু সেখানেও বিধিবাম। তার কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের কোন একটা সময়ে বৃষ্টিস্নাত সন্ধায় তার কাছে খবর আসে বস্তিতে থেকে রেললাইনের অন্যপাড়ে যেতেই ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যায় তার মা। নিজেকে তখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অসহায় মনে হয় তার কাছে। বাবা থেকেও কোথায় থাকেন জানেন না। দুটো ছোট ভাই ছিল তারাও হারিয়ে গেল। বেঁচে থাকার সম্ভবল বলতে মা এ ছিল। সেও হারিয়ে গেল। দাপন করা হয় বস্তির পাশেই জীর্ণ শীর্ণ জায়গায়। সে টানেই আজও কমলাপুর রেলওয়ে বস্তিতে ছুটে যান আফতাব সাহেব।
ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাবস্থাপনায় ভর্তি হন আফতাব। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ভালো রেজাল্টের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হয় সে। ভার্সিটি তে পড়া অবস্থাতেই পরিচয় তারই ব্যাচমেট রুমার সাথে। সেই পরিচয়ই পরে প্রেমে গড়ায় আর আজ তারা সুখী দম্পতি।
রুমাও এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। গ্রামের কোন কলেজ থেকে পাশ করেই মেধার জোরে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে...
তাই বোঝাপড়াটাও ভালো ছিল দুজনের। আজ তারা গুলশানে নিজেদের কেনা ফ্লাটে থাকেন। শুরুর দিকে রুমা নিজেও চাকরী করতেন। এখন ছেলেমেয়েদের দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধেই। তাদের এখন গাড়ি বাড়ি কোন কিছুরই অভাব নেই। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে ক্লাস থ্রিতে আর মেয়ে এখনো বাসায় হাটা শিখছে।।
এত সুখের মাঝেও নিজের অতীত ভুলতে পারেনি আফতাব সাহেব। ভুলতে পারেনি তার জীবন বদলে দেয়া অন্বেষনের মত সংগঠনকে।। তাইত সে প্রতি সপ্তাহের শেষদিনটিতে বিকেলের দিকে রিকশা চড়ে চলে আসেন কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে তার মায়ের কবর পাড়ে। অনেক্ষন চুপচাপ বসে থাকেন একা একা। এরপর মাগ্রিবের নামাজ পড়ে বস্তি থেকেই কোন এক অসহায় কে নিয়ে চলে যান বাসায়। ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে একটা ভালো পরিমানের টাকা দিয়ে দেন। আর তার পিতামাতাতুল্য অন্বেষনের খুব বড় মানের একজন ডোনার এখন তিনি। টার অর্থায়নেই বলতে গেলে চলে আধুনিক ভাবে এগিয়ে আসা অন্বেষন। একটা শিশু বেড়ে ওঠার সব উপকরণই এখন এখানে আছে। গত ৬ বছর ধরেই এই সমাজসেবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছে আফতাব সাহেবের নাম। এভাবে গত কয়েকটা বছর পার করছেন আফতাব সাহেব। আজও তারই ধারাবাহিকতা চালিয়ে যেতেই মায়ের কবরে ছুটে এসেছেন তিনি। কিছুক্ষন পরেই হয়ত মাগ্রিবের আযান পড়বে আর নামায শেষে কোন এক অসহায়ের সাথে বাসায় ফিরবেন আফতাব সাহেব।।
©somewhere in net ltd.