নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

বঙ্গ ও আসামের সংগ্রামী মহান সংস্কারক

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:০২

ছবিঃ অন্তর্জাল।

বঙ্গ ও আসামের সংগ্রামী মহান সংস্কারক

তিনি পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন ৭৫ বছর। এই ৭৫ বছরের জীবনে ৫৭ বছর ব্যয় করেছেন ইসলাম প্রচার এবং সমাজ সংস্কারের কাজে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেড়ে বসা কুসংস্কার, শিরক এবং বিদআতের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করার দৃপ্ত শপথে ছুটে চলেছেন গোটা বঙ্গ আসামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে সফর করেছেন বছরের পর বছর। বাড়ি ঘর কোথায়, সহায় সম্পদ কোথায় - ভুলে গেছেন সব। লিপ্ত ছিলেন একমাত্র মানুষের কল্যানে। মানবতার কল্যান সাধনে কেটে গেছে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়কাল। বজরা (এক ধরণের নৌকা) ভ্রমনে শুধু বঙ্গ আসাম অঞ্চলেই কেটেছে তাঁর জীবনের প্রায় ৫২ টি বছর। বস্তুতঃ মহান এই সংস্কারকের জীবনের গোটা সময়টাই তিনি অতিবাহিত করেছেন শিরক, বিদআত এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তাঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টায়, অবিরাম দাওয়াত ইলাল্লাহর আহবানে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহনে ধন্য হন। জ্বি, বলছিলাম আমাদের গর্বের ধন, এ জনপদের মহান সন্তান, হাদিয়ে কামেল মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা।

তাকে 'হাদিয়ে কামেল' নামে অনেকে জানেন। কিন্তু কেন এই নাম তাঁর? ইসলামী পরিভাষায় ‘হাদী’ একটি অতি মর্যাদাপূর্ণ শব্দ এবং এর অর্থ- হেদায়েতকারী, সত্যের পথ প্রদর্শক, হকের দিশারী। ইসলাম ধর্মের প্রচারকমাত্রই ‘হাদী’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার যোগ্য।

তবে বঙ্গ-আসামে বিশেষভাবে হজরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইসলামের তবলীগ-প্রচারে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে তিনি বঙ্গ-আসামের ‘হাদী’ নামে খ্যাত।

আবির্ভাব কালে তৎকালীন বাংলার সমাজচিত্রঃ

মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ভিন্নতর উচ্চতার অনন্য জীবনের অধিকারী এক মহান পুরুষ। বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচার ও হিদায়াতে তিনি তাঁর সম্পূর্ন জীবন ব্যয় করেছেন। তিনি ছিলেন তাঁর কালে অন্যতম সংস্কারক। বাংলায় মুসলমানগণ যখন নানা কুসংস্কার, অশিক্ষা ও অন্ধকারে নিপতিত, তখন তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে এতদাঞ্চলের সকল মানুষের জন্য আল্লাহ তাআ'লার বিশেষ এক নিয়ামত হিসেবে। মানুষকে তিনি আলোকের পথে ডেকেছেন। প্রেরণা যুগিয়েছেন ইহ-পারলৌকিক মুক্তির পথে চলতে।

এমন একটি সময়ে তাঁর এ দেশে আগমন, যখন এখানকার মুসলমানগণ অধ:পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন। অথচ ইসলামের সেই প্রথম যুগেই আরব বণিক ও পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে এ দেশে ইসলামের আলো পৌঁছে গিয়েছিল। ১২০৩ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এ জনপদে সূচনা হয়েছিল মুসলিম শাসনের, ইসলামের উত্থানের।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই তখন থেকে, অর্থাৎ, ১২০৩ খৃস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ শ’ বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে মুসলমান সুলতান-সুবেদার-নবাব-নাযিমগণ তৎকালীন বঙ্গ অঞ্চল তথা বাংলাদেশ শাসন করেছেন। তবে এর মধ্যে গণেশ (১৪১৪-১৪১৮) নামে একজন হিন্দু রাজা মাত্র চার বছর বাংলায় রাজত্ব করেন। মাঝখানে রাজা তোডরমল (১৫৮০-৮২) এবং মানসিংহ (১৫৮৯-৯৬) বাংলাদেশ শাসন করলেও তারা ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রতিনিধি নাযিম। আলোচ্য নিবন্ধে হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবন-চিত্র তুলে ধরার আগে সে সময়ের এখানকার মুসলমানদের সামাজিক অবস্থার সামান্য বিবরণ তুলে ধরা প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। শুনতে আশ্চর্য্য মনে হলেও প্রকৃত সত্য এই যে, মুসলমানরা সাড়ে ৫ শ’ বছর শাসন করলেও (১২০৩-১৭৫৭) এদেশে এমনকি পুরো ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসকবৃন্দ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আশানুরূপ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেননি। অথবা, করতে সক্ষম হননি।

এটিও একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, এতদাঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে পীর, মাশায়েখ এবং আউলিয়ায়ে কেরামগণের অক্লান্ত সাধনা, অনিঃশেষ ত্যাগ-তিতিক্ষা আর কোরবানির মাধ্যমে। যুগে যুগে পীর-আউলিয়া-দরবেশগণই এদেশে ইসলাম প্রচারের মহান দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। এই পীর, মাশায়েখ এবং আউলিয়ায়ে কেরামগণের অধিকাংশই এসেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের আরব, ইয়েমন, তুরস্ক, ইরান প্রভৃতি দেশ থেকে। আবার এ দেশেও জন্ম হয়েছিল অনেক পীর-আউলিয়ার। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এ দেশের শাসনভার চলে যায় কার্যত: ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা ক্ষমতায় আসায় এদেশীয় হিন্দুরা ইংরেজ শাসকদের আনুকূল্য লাভ করেন। আর শাসনক্ষমতা হারিয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকেন মুসলমানরা। শুধু তাই নয়, ইংরেজগণ যেহেতু মুসলিম শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন, সেহেতু মুসলিমদেরকে তারা সবসময় শত্রুজ্ঞানে নিপীড়নের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতেন। যার ফলে মুসলিমদেরকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখে, তাদেরকে দাবিয়ে রাখার বিশাল ষড়যন্ত্রই ছিল ইংরেজদের তথাকথিত শাসন নীতি। এরই ফলশ্রুতিতে দু'শো বছরের ইংরেজ শাসনকালে এদেশের মুসলিম জমিদারগণ পরিণত হন ভিখারিতে। শিক্ষিত মুসলিমগণের গলে পরিয়ে দেয়া হয় অশিক্ষা, অজ্ঞতা আর গোলামীর জিঞ্জির।

অবশেষে দেখতে দেখতে কালক্রমে এমন একটা সময় এল যে, শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে মুসলিমগণ নিজেদের স্বকীয়তা, মর্যাদা এবং আভিজাত্য সকল কিছুই বিস্মৃত হতে থাকেন। এমনকি গ্রাম-গঞ্জের মুসলমানগণ তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকেও ভুলে যেতে থাকেন। ভুলে যেতে থাকেন ইসলামী শরীয়ত ও জীবন বিধান। তাদের আচার-আচরণে এসে যায় হিন্দুয়ানী প্রথা। চাল-চলন ও পোশাক-পরিচ্ছদে আসে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক এবং ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে বাংলার মুসলমানরা এভাবেই পিছিয়ে পড়েছিলেন।

এ সময় অনেক ভণ্ড পীরের উদ্ভবও তাদের বিপথগামী করে। তারা ইসলামের মূল বিষয়, তথা কুরআন হাদিসের আলোকে উদ্ভাবিত শরীয়ত ভুলে গিয়ে নানা কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়েন। অনেক মসজিদে আযান বন্ধ হয়ে যায়। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রোযার কথাও ভুলে যান অনেকে। গ্রাম-লোকালয়ে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি মুসলমানদের জীবন-যাত্রায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মুসলমান পুরুষেরা শুরু করেছিলেন হিন্দুদের ধুতি ও নেংটি পরা। গ্রাম-বাংলায় হিন্দুদের পূজা-পার্বণে অনেক মুসলমান ঘরেও দেখা যেত উৎসব।

আগেই বলেছি, এতদাঞ্চলে ইসলাম এসেছে পীর, মাশায়েখ এবং আউলিয়ায়ে কেরামগণের মাধ্যমে। ঠিক তেমনিভাবে, বাংলাদেশের মুসলমানদের এমনই এক দুর্দিনে আবারও এগিয়ে এসেছিলেন পীর, মাশায়েখ, আউলিয়ায়ে কেরাম এবং দরবেশগণ। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও হিদায়েত কাজে তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার গ্রামে গ্রামে। মুসলমানদের ফিরিয়ে এনেছেন সঠিক পথে। এ দেশের মসজিদে মসজিদে শুরু হয়েছিল আবার আযান। রোযা-নামায ও শরীয়ত মোতাবেক শুরু হয়েছিল মুসলমানদের জীবন যাপন। নেংটি-ধুতির বদলে আবার চালু হয়েছিল ইসলামী পোশাক। শুরু হয়েছিল সর্বত্র ঈদ এবং জুমুআর নামাযসহ অন্যান্য ইবাদত আমল।

তৎকালীন সময় এভাবে বাংলায় ইসলামের এই পুনর্জাগরণে যেসব পীর, মাশায়েখ অলি-আউলিয়াগণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। এ দেশে ইসলামের পুনর্জাগরণে হযরত কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অবদান সত্যিই বিশাল। মুসলমানদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে, তাদেরকে ইসলামী আদর্শ ও নিয়ম নীতির বাস্তবভিত্তিক দিশা দিতে তিনি একাধিক পন্থায় কাজ করার সংকল্প করেন। এর জন্য তিনি শুরু করেছিলেন দুই পদ্ধতির সংগ্রাম। প্রথমত: তিনি বঙ্গ ও আসামের গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইসলামের প্রচার কাজ চালাতে থাকেন। তিনি তাঁর যুক্তি ও ব্যাখ্যা দ্বারা মুসলমানদের ভুল-ভ্রান্তি দূর করার উদ্যোগ নেন। দ্বিতীয়ত: হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুসলমানদের কুসংস্কার নির্মূলে এবং তাদেরকে ইসলামের সঠিক পথে নিয়ে আসতে রচনা করেছিলেন প্রায় অর্ধ শত ইসলামী গ্রন্থ। যেগুলো মুসলমানদের সেই দুরবস্থা থেকে উত্তোরণে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে।

এ ছাড়াও ঊনিশ শতকে বাংলায় মুসলমানদের মাঝে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তবে এই সংস্কার আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁদের অনেকের মধ্যেই কাজ করেছে বেশি আবেগ। ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা অনেক ক্ষেত্রেই তেমন ছিল না। এ ছাড়াও বাতিলপন্থী ওহাবী, ফারায়েযী ইত্যাদি নানা আন্দোলনও দানা বেঁধে ওঠে। এ সবগুলো আন্দোলনেরই লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় সংস্কার। কিন্তু এসব সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যেও ছিল নানা মত-পার্থক্য, বিশেষ করে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে জুমুআ ও ঈদের নামায জায়েয কি না, এ নিয়েও ছিল নানা মত। হাজী শরীয়ত উল্লাহ’র ফারায়েযী আন্দোলন মনে করতো, এ দেশে জুমুআ ও ঈদের নামায জায়েয নয়। ফলে সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে মত-পার্থক্যের কারণেও তখন মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। হযরত কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সকল বিভ্রান্তি দূর করে মুসলমানদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর আহবানে সারা দিয়ে মুসলিমগণ জেগে উঠেছিলেন।

জন্ম ও শৈশবঃ

হযরত মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরের মোল্লাটোলা মহল্লায় ১২১৫ হিজরীর ১৮ মুহররম (১১ জুন, ১৮০০ সাল, মতান্তরে ১৭৯৭ সাল) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা আবূ ইবরাহীম শেখ মুহাম্মদ ইমাম বখ্শ। মাতার নাম আবীদা। পিতা ও মাতা দু’জনেই ছিলেন উচ্চ বংশীয়। বংশের দিক থেকে হযরত কারামত আলী জৌনপুরী (র.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর বংশধর।

ভারতে মুসলিম শাসনামলে হযরত কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির পরিবার ছিল বিখ্যাত। মুসলিম আমলে এই পরিবারের লোকেরা খতীবী করতেন। সকলেই ইমামত এবং খেতাবতের দায়িত্ব বেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। আবূ ইবরাহীম শেখ মুহাম্মদ নিজে ছিলেন একজন শায়েখ। তিনি ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। ছিলেন সুবিজ্ঞ, ফারসী ভাষায় একজন কবি, দক্ষ লিপিকার এবং জৌনপুর কালেক্টরেট -এর সেরেস্তাদার। এরকম এক উচ্চ বংশে জন্ম হযরত কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহির। জৌনপুর তথা পুরো ভারতবর্ষের অবস্থাই তখন বাংলাদেশের মত। সর্বত্রই ইসলামের ঘোর দুর্দিন। দেশ শাসন করছিল দুর্ধর্ষ ইংরেজরা। আর এদের সাথে সমঝোতা করে শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরির ক্ষেত্রে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়। শাসন ক্ষমতা হারিয়ে জমিদারী-জোতদারী থেকে বঞ্চিত হয়ে অভিমানে ও ক্ষোভে ইংরেজদের কাছ থেকে দূরে থেকেছেন মুসলমানরা। সারা ভারতেই মুসলমানদের মাঝে তখন নানা কুসংস্কার। জৌনপুরও এ থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। এখানেও দিনের বেলায় অনেক মসজিদেই আযান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

দাওয়াতি মিশনের বন্ধুর পথেঃ

বঙ্গ ও আসামে ইসলামের তবলীগ, তথা প্রচার ও প্রসারে বিখ্যাত পীর মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর জবান ও কলম দ্বারা যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, এ দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে তা এক স্বতন্ত্র অধ্যায়রূপে পরিগণিত।

প্রথমে মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর নিজের জেলা ও তার আশপাশের এলাকায়, যথা- আজমগড়, গাজীপুর, ফয়েজাবাদ ও সুলতানপুরে ইসলাম প্রচার করেন। অতঃপর তিনি বঙ্গ, অর্থাৎ, বাংলাদেশ ও আসামে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে জৌনপুর থেকে কলকাতায় আসেন। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ ও আসামের প্রায় সর্বত্র প্রচার তৎপরতায় লিপ্ত থাকেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এমন এক সময়ে প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যখন বঙ্গ-আসামসহ গোটা হিন্দুস্থানে চলছিল ইসলামের করুণ অবস্থা। অজ্ঞতা-মূর্খতার সয়লাবে জাতি তখন দিশেহারা। বিদআত, কুসংস্কার ও অন্যান্য ধর্মের প্রভাবে মুসলমানদের দ্বীন ঈমান ছিল তখন নিভূ নিভূ।

এ কারণে আধুনিক যুগের একজন প্রখ্যাত আরব লেখক হজরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সংস্কারক, অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপ্রিয় বলে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আমিলা আলা তাতহিরিল ই'তিকাদাতিল ইসলামিয়াহ আলাল হিন্দিয়াহ, মিনাল আদাতি ও ছানিয়াহ।’

অর্থাৎ, পৌত্তলিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণ থেকে হিন্দুস্থানী মুসলমানদের যাবতীয় এতেকাদ বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কাজ করে গেছেন। তিনি জৌনপুরে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় বঙ্গ-আসামে।

‘কারামত’ নাম যেভাবেঃ

হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর মত বড় বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁর কালে এই উপমহাদেশে খুব কমই ছিলেন। তবে শৈশবে তাঁর নাম কারামত আলী ছিল না। ইসলামী বিশ্বকোষ থেকে জানা যায়, শৈশবে তাঁর নাম ছিল-মুহাম্মদ আলী জৌনপুরী। পরবর্তীতে তিনি নিজে তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ে নাম লিখেছেন- ‘খাকসার আলী জৌনপুরী’।

কিন্তু আল্লাহ’র পথে ও দ্বীন ইসলামের সেবায়, মানুষের খিদমতে তাঁর বাকী জীবনে অসংখ্য অলৌকিক (কারামত) ঘটনা ঘটে। আর এই ‘অলৌকিক’ তথা কারামতের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সকল মহলে। সেই থেকে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী নামে।

শিশু ‘আলী’ ছিলেন ধীর ও শান্ত স্বভাবের। তিনি ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। অন্যান্য শিশুর মত তিনি খেলধুলায় মত্ত থাকতেন না। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন পাক্কা নামাযী। আর মনোযোগী ছিলেন পড়াশোনায়। ইসলাম ও নামায-রোযা বিষয়ে জানার তাঁর ছিল খুবই আগ্রহ। শৈশবে পিতার কাছেই তাঁর লেখা-পড়ায় বিসমিল্লাহ্।

শিশুকালেই তিনি ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, মাত্র ৫ বছর বয়সে শিশু ‘আলী’ কুরআনের আমপারা মুখস্ত করে ফেলেন। সে সাথে এই শৈশবকালেই আয়ত্ত করেন ফারসী ও আরবী ভাষা। ১০ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের ৩০ পারা মুখস্ত করে ফেলেন। তিনি নিয়মিত নামায-রোযা শুরু করেছিলেন মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে। ১০ বছর বয়সে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী পরিপর্ণতা লাভ করে। ছোটবেলা থেকেই হযরত মাওলানা কারামত আলী ছিলেন আর দশ জন শিশু থেকে আলাদা। তিনি যে কালে একজন বুযুর্গ হবেন, তা তাঁর শৈশবেই বোঝা গিয়েছিল। বাল্য বয়স থেকেই তিনি শিশুসুলভ আচরণ, খেলাধুলা ও অহেতুক কাজ থেকে দরে থাকতেন। মুরব্বিদের কথাবার্তা শুনতেন- বিশেষ করে ধর্মীয় কথাবার্তা। তাঁর এ আচরণ দেখে অনেকে কৌতুক করে বলতেন- ‘এই বালকটির মধ্যে বৃদ্ধ লোকের রূহ্ রয়েছে। এজন্য সে সমবয়স্কদের সঙ্গে চলাফেরা না করে বৃদ্ধ লোকদের মজলিসে উঠা-বসা করে।’

মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বাল্যকাল থেকেই যেমন বুদ্ধিমান ছিলেন, তেমন ছিলেন চালাক-চতুর। তাঁর বুদ্ধি, স্মরণশক্তি ও জ্ঞান দেখে অনেকে অবাক হতেন। তিনি বলতেন, একেবারে শিশুকালের ঘটনাও তাঁর মনে আছে। এমনকি সেই ভূমিষ্ট কালের কথাও। তিনি বলতেন, ‘আমি যে বিছানায় ভূমিষ্ট হয়েছি, তার কোন্ পার্শ্বে প্রদীপ জ্বলছিল তা ¯স্পস্ট স্বপ্নের মত এখনও আমার স্মরণ আছে।’ শুধু তাই নয়, মায়ের বুকের দুধ পানকালীন অনেক ঘটনাও তিনি বলতেন। আর বয়স্ক লোকেরা ওই সব ঘটনার সত্যতাও স্বীকার করতেন। শৈশবে তাঁর এসব আলামত থেকেই অনেকে আঁচ করেছিলেন- কালে এ ছেলে অনেক বড় ওলী হবেন। কারণ এ ধরণের কথা ওলীদের পক্ষেই বলা সম্ভব। এটা অনেকটা কারামতের পর্যায়ভুক্ত।

লেখাপড়াঃ

মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর পড়াশোনা তাঁর পিতার কাছে। তিনি কুরআন পড়া শেষে মনোযোগ দেন ইলমে কিরআতে। এদিকে তিনি শরীয়ত ও ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্বীয় বিষয়েও জ্ঞান লাভ করেন। হাদীস বিষয়ে তিনি জ্ঞান লাভ করেন মাওলানা আহমদ উল্লাহ্ থানবীর নিকট। এছাড়া মাওলানা আহমদ আলী চেরিয়াকুটির কাছে ইলমে মা’কুলাত তথা জ্ঞানতত্ত্ব, ক্বারী সৈয়দ ইব্রাহীম মাদানীর কাছে কুরআন পাঠতত্ত্ব, ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ সিকানদারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর নিকট ইলমে তাজবীদ ও ফন-ই-কিতাবাত বা লিখন-কৌশল বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। লিখন কৌশলে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী।

শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই নয়। ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞান, তর্ক বিদ্যায়ও তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। এসব বিষয়ে যেমন বিভিন্ন পন্ডিতের কাছে জ্ঞান চর্চা করেছেন, তেমনি অধ্যয়ন করেছেন এসব জ্ঞানের ওপর বিভিন্ন তত্ত্বীয় কিতাব।

আরবী ও ফারসী ভাষায় লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি এত ভাল লিখতে পারতেন যে, এ নিয়ে অনেক সুনাম রয়েছে তাঁর। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে-একটি ধানের ওপর বিসমিল্লাহ্ সহ সূরা ইখলাস লিখে, সেখানে নিজের নামও লিখতে পারতেন। অবশ্য এটা কেবল তাঁর লিপি-কৌশলই ছিল না, ছিল কারামতও বটে। তিনি সাত ধরণের লেখা লিখতে পারতেন। এক কথায় হস্তলিপি-কলায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। বিশেষ করে তাঁর কালে এদেশে কুফিক, নাসতালিক ও ফারসী লিপি কৌশলে তাঁর মত পারদর্শী খুব কমই ছিলেন। তিনি লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন হাফিয আবদুল গনী সাহেবের কাছ থেকে।

দ্বীন প্রতিষ্ঠায় এবং বিধর্মীদের মুকাবিলায় মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন খাঁটি মুজাহিদ। জিহাদে অংশ নিতেও তিনি ছিলেন প্রস্তুত। এ জন্য শৈশব থেকেই তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে শিখদের সঙ্গে তখন মুসলমানদের চলছিল তীব্র বিরোধ। তিনি জানতেন, যে কোন সময় জিহাদের ডাক আসতে পারে। এ জন্য চাই সামরিক শিক্ষা। লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ। কিন্তু কোথায় পাবেন এ প্রশিক্ষণ? এ নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। ভাবতে ভাবতেই কিনারা পেয়ে যান।

তখন জৌনপুরে বিহারী নামে এক মল্ল ছিল। আশ-পাশে তার ছিল বেশ খ্যাতি। নানা চিন্তা-ভাবনা করে মাওলানা কারামত আলী এই বিহারী মল্ল’র কাছে গিয়েই হাজির হলেন। বিহারী মল্লও ছিলেন রাজি। ফলে প্রতি সন্ধ্যায় বিহারীর কাছে চলতো তাঁর মল্ল বিদ্যা চর্চা, তথা সামরিক কলা-কৌশল শিক্ষা। খুব অল্প দিনেই তিনি সামরিক কলা-কৌশলে দক্ষ হয়ে উঠলেন। সমর্থ হয়ে ওঠেন দুশমনদের হাত থেকে নিজকে রক্ষায়। এই মল্ল বিদ্যার কৌশলেই তিনি একবার শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। শত্রুরা একটি কোঠাবাড়িতে তাঁকে খুন করার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি মল্লযুদ্ধের কৌশলে তাদের সহজেই পরাজিত করে নিজকে রক্ষা করেছিলেন।

মুর্শিদের সান্নিধ্যেঃ

মুর্শিদের কাছে তাঁর আধ্যাত্বিক জীবনের সুত্রপাত হয়েছিল ১৮ বছর বয়সে। ১৮১৯ সালে। পিতার অনুমতি নিয়ে রায়বেরেলীতে গিয়ে আযাদী আন্দোলনের সিপাহসালার তরীকতের ইমাম হযরত সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর কাছে তিনি বাইআাত হন। সৈয়দ আহমদ তখন রায়বেরেলীর শাহ আলামুল্লার খানকায় অবস্থান করছিলেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুর থেকে সোজা চলে যান সেখানে। তাঁকে কদমবুসি করে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কারামত আলীকে দেখেই বুঝতে পারেন এই ছেলের ভেতর রয়েছে আধ্যাত্বিকতার সম্ভাবনা। তিনি তাঁকে বুকে টেনে নিলেন।

আধ্যাত্বিকতার শিক্ষা ছাড়াও মাওলানা কারামত আলী ‘ইলমে মাকুলাত’ ও ‘ইলমে মানকুলাত’-এর শিক্ষা নিয়েছেন দেশ-বিদেশের সেরা আলিম ও বুযর্গদের কাছে। এ জন্য তিনি দেশের বাইরেও গেছেন। এভাবেই নিজেকে জাগতিক ও আধ্যাত্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। মাওলানা কারামত আলী কাদিরীয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দদিয়া এবং মুহাম্মদীয়া তরীকায় খিলাফত লাভ করেছিলেন।

ধর্মীয় শিক্ষা প্রচারঃ

হযরত সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর কাছে বাইয়্যাত তথা খিলাফত লাভের পর মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুর্শিদের নির্দেশেই ফিরে আসেন জৌনপুর। তিনি তাঁর মুর্শিদের কাছে মাত্র তিন সপ্তাহ ছিলেন। এই তিন সপ্তাহেই তিনি মুর্শিদের কাছ থেকে আধ্যাত্বিক জীবন তথা তাসাউফের গঢ়-তত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।

জৌনপুর ফিরে এসেই মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মহল্লায় মহল্লায় ও ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে রোযা-নামায এবং ইসলামী শরীয়ত বিষয়ে বোঝাতে শুরু করলেন। তাদের হিদায়াতের দাওয়াত করতে লাগলেন। বললেন, পাঁচ-ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করতে। মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে। মানুষকে সৎপথে আসার ডাক দিলেন। বললেন, আল্লাহ্তায়ালার নাম ব্যতীত অন্য কারে কাছে মানত করা জায়িয নয়। কবর যিয়ারত জায়িয; কিন্তু গোর পূজা, দরগাহ পূজা হারাম। অর্থাৎ সেজদা করা গান-বাজনা ইত্যাদি শরিয়তবিরোধী কর্মকান্ড করা যাবে না। বিয়ে-শাদী’তে ইসলামী রীতি অনুসরণ করতে হবে। কোন মুসলমানের বিয়ে হিন্দুয়ানী রীতিতে হওয়া উচিত নয় ইত্যাদি।

আপনারা শুনে অবাক হবেন, মুসলমানরা তখন ইসলামী শরীয়তের নিয়ম-কানুন ভুলে গিয়ে, বিয়ে-শাদীতে অনেকে হিন্দুয়ানী রীতি-নীতি অনুসরণ করতো। এমনকি চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদেও দেখা যেত হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির ছাপ। জৌনপুরও এ থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। মাওলানা কারামত আলী এসব শরীয়ত বিরোধী কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই জৌনপুরবাসীর মাঝে নিয়ে এলেন ইসলামী পুনর্জাগরণ। এ জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেকে এ কাজে বাধা দিয়েছে। এমনকি অনেক মুসলমানই তাঁকে এসব কাজের জন্য তিরস্কার করেছে। কিন্তু তিনি থামেননি। কোন হুমকি তাঁকে হিদায়াতের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এর ফলে ইসলামী চেতনার আলো যেন নতুন করে ছড়িয়ে পড়লো জৌনপুরে।

মসজিদে নিয়মিত আযানঃ

মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর জন্মস্থান জৌনপুর ছিল এক সময় দ্বীনি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। দ্বীন-ইসলামের তালিম নিতে অনেক মুসলমানই তখন বাংলা থেকে জৌনপুর যেতেন। সেখানে মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পরিবেশ ছিল সুন্দর। মসজিদে মসজিদে হত আযান। অন্যতম ইসলামী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল জৌনপুর। সুলতানুল আউলিয়া ইসা তাজ রাহেমাহুল্লা’র মত অনেক বুযুর্গ এখানকার মসজিদে পাঞ্জেগানা নামায আদায় করতেন। সে সময়ে এখানে মসজিদে জুমআর নামায আদায়ের জন্য উলামায়ে কিরামের প্রায় ন’ শত পালকি এসে মসজিদের সামনে জমায়েত হতো। কিন্তু মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর সমকালিন জৌনপুর তার সেই পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দিনের বেলায় মসজিদে আযান। এমনকি পাঞ্জেগানা নামায আদায়েও মানুষ মসজিদে যেতনা। মসজিদ পরিণত হয়েছিল খেল-তামাশার আড্ডাখানায়। অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, মসজিদ থেকে ভেসে আসতো-হারমোনিয়াম, সেতার ও ঢোল-তবলার আওয়াজ। কেউ এর প্রতিবাদও করতো না। অথচ মসজিদকে যারা এই হালে পরিণত করেছিল, তারা ছিল সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তারা ছিল দুশ্চরিত্র। খুবই খারাপ লোক। ফলে তাদের বাধা দিতে সাহস পেত না কেউ। জৌনপুরী ছাহেব মসজিদের এই হাল দেখে খুবই কষ্ট পান। প্রতিজ্ঞা করেন এই সব দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আল্লাহ’র ঘরকে রক্ষা করতে হবে। বিদআতি কর্মকান্ড থেকে জৌনপুরকে রক্ষা করতে হবে। তিনি প্রথমে ঘুরে ঘুরে পাঁচজন সাহসী ও ঈমানদার লোক খুঁজে বের করলেন। এদের নিয়ে মসজিদে নিয়মিত পাঞ্জেগানা নামায আদায় শুরু করলেন। শুরু করলেন আযান। তাঁদের ঈমানী জোশ ও সাহস দেখে কেউ আর বাধা দিল না। দুষ্টু লোকরাও আর আড্ডা জমাতে সাহস পেত না মসজিদে। নিয়মিত পাঞ্জেগানা নামায ছাড়াও শুরু হলো জুমআর নামায। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে মসজিদে পাঞ্জেগানা ও জুমআর নামায পড়ার জন্য বুঝাতে লাগলেন। তাঁর কথায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হলো। দলে দলে লোক মসজিদে গিয়ে নামায পড়া শুরু করলো। শুধু সন্ধ্যায় নয়, এখন দিনের বেলায়ও নামাযের সময় মসজিদ থেকে আযান শোনা যেতে লাগলো। পাল্টে গেল জৌনপুরের পরিবেশ। মানুষ ফিরে এলো দ্বীন-ইসলামের রাস্তায়।

কুচক্রি মহলের বদ মতলবঃ

খুব অল্প দিনেই ১৮ বছরের তরুণ মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জৌনপুরে ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন। মানুষ নিয়মিত মসজিদে নামায আদায় শুরু করলো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান শোনা যেতে লাগলো। কিন্তু বদ লোকদের এটা পছন্দ হলো না। তারা তরুণ কারামত আলী (রহঃ)’র পেছনে লাগলো। একবার তিনি জৌনপুরের এক গলি দিয়ে হাঁটছেন। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক বৃদ্ধা। হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়ার জন্য সে বের হয়েছিল। কিন্তু মাওলানাকে দেখেই বৃদ্ধা তার একটি পাতিল সজোরে মাওলানার মাথায় ছুঁড়ে মারে। আর বলতে থাকে, ‘এই লোকটিই তো সেই নতুন মৌলভী যে দিনের বেলায় আযান দিতে শুরু করেছে।’

তবে খুব দেরি হয়নি। শিগগিরই এসব বিদআতীরা তাঁর পথ থেকে সরে পড়ে। তাদের সকল ষড়যন্ত্-ই ব্যর্থ হয়। একজন লোক তাঁকে খুন করার জন্য লোক ঠিক করেও ব্যর্থ হয়। কোন রক্তচক্ষুই মাওলানা কারামত আলীকে হিদায়াতের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাঁর চেষ্টায় খুব দ্রুত সাধিত হয় জৌনপুরে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও আমল পরিবর্তন।

শিক্ষার বিস্তারে জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহিঃ

মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর একান্ত চেষ্টায় ইসলামের আলোয় নতুন করে আলোকিত হলো জৌনপুর। নামায-রোযা কায়েমের পর তিনি দৃষ্টি দিলেন জৌনপুরে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে। তিনি ভাবলেন কুসংস্কার দূরীকরণে চাই শিক্ষা। সে সাথে তরুণ ও নবীনদের গড়ে তোলা। প্রয়োজন আধুনিক ইসলামী শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা। জৌনপুরের বিখ্যাত দানবীর হাজী ইমাম বখশ সাহেবের কাছে গেলেন তিনি। তাঁর কাছে মাদ্রাসার জন্য একটি জায়গা চেয়ে নিলেন ওয়াক্ফ করে। তারপর প্রতিষ্ঠা হলো মাদ্রাসা। নাম মাদ্রাসায়ে হানিফিয়া।

জৌনপুর এবং উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে এই মাদ্রাসায়ে হানিফিয়ার অনেক অবদান রয়েছে। আজো এই মাদ্রাসা বিদ্যমান। এই মাদ্রাসার প্রথম শিক্ষক হলেন বিখ্যাত আলিম হযরত মাওলানা আবদুল হালীম। তিনি উপমহাদেশের আরেক বিখ্যাত মাওলানা আবদুল হাই লকনভীর পিতা। বিশিষ্ট আলিমগণ এই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই বিশিষ্ট বুযুর্গে পরিণত হন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহির বড় ছেলে মাওলানা হাফিয আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম খলিফা মাওলানা আবদুল হাই রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

জিহাদ ও বালাকোট যুদ্ধঃ

আপনারা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছেন যে, মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জিহাদের জন্য ছিলেন সদা প্রস্তুত। এ জন্য তিনি সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। তরুণ বয়সেই তিনি সদা হাতিয়ার-বন্দ্ অবস্থায় থাকতেন।

এদিকে শিখদের বিরুদ্ধে তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই যুদ্ধ তথা জিহাদের ডাক দিয়েছেন। যুদ্ধের আগে তিনি মুজাহিদ সংগ্রহে উত্তর ভারত ও বাংলা সফর করেন। শেষে আফগান সীমান্তে বালাকোটে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হতে সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন পাঞ্জাবে রওনা হলেন, তখন মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও এই জিহাদে অংশ নেয়ার ইছা ব্যক্ত করেন।

কিন্তু মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র দুঃখ, তাঁর মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে জিহাদে যেতে অনুমতি দিলেন না। হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এই তরুণের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য এক জিহাদ। তাঁর জন্য বালাকোট যুদ্ধ নয়। আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা তাঁকে দিয়ে অন্য জিহাদ করানো। কিন্তু কি সেই অন্য জিহাদ ?

বালাকোট যুদ্ধে শরীক হতে না পেরে যখন মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত, তখনই তাঁর মুর্শিদ তাঁকে যবানের জিহাদে অংশ নেয়ার নির্দেশ দিলেন। কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে লক্ষ্য করে সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা তোমাকে দিয়ে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ওয়ারিসের কাজ, অর্থাৎ তাবলীগ ও হিদায়াতের কাজ করানো। তার জন্য আল্লাহ্পাক তোমাকে সেই দান দিয়েছেন, যা তোমার প্রয়োজন। তোমার জন্য দ্বীনের দাওয়াত ই হচ্ছে জিহাদে আকবর। তোমার কলম ও যবান আমার হিদায়াতের বিস্তার ও তরজমা করবে।’

পরবর্তীকালে তাঁর মুর্শিদের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচার এবং বহুসংখ্যক কিতাব রচনাই তার প্রমাণ।

বালাকোট যুদ্ধ এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে অংশ না নেয়ার জন্য অনেকে এই অভিযোগ করেন যে, মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছাহেব ছিলেন ইংরেজ সমর্থক। কিন্তু মোটেই তা ঠিক নয়। কারণ তাঁর জিহাদে অংশ নেয়ার ইচ্ছে ছিল পর্ণ মাত্রায়। তাঁর মুর্শিদই তাঁকে বিরত করেন। সৈয়দ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি জানতেন তাঁর এই মুরীদকে দিয়ে কি করাতে হবে। তিনি কাশ্ফের মাধ্যমে জানতে পারেন- আল্লাহতায়ালা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে অন্য কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তিনি কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সশ্বরীরে জিহাদে অংশ নিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘তুমি বাকযুদ্ধে লিপ্ত হও, জনসাধারণকে হিদায়াত কর। এটা অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’

এরপর সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরীকে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও হিদায়াতের জন্য বাংলা ও আসাম যাওয়ার নির্দেশ দেন। জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা দমন করে মাওলানা কারামত আলী মুর্শিদের নির্দেশ-ই মাথা পেতে নিলেন। জিহাদে না গিয়ে তিনি রওনা হলেন বাংলা ও আসাম। ইসলামের প্রচার কাজে বাংলা ও আসামের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাঁর বাকী জীবন কাটিয়ে দেন।

দ্বীনের সেবায়ঃ

জিহাদে শরীক হওয়ার অনুমতি পেলেন না বটে; তবে সেই থেকে মুর্শিদের নির্দেশে শুরু হলো তাঁর অন্য রকম জিহাদ। আল্লাহ’র দ্বীনকে জয়ী করার জিহাদ। এ এক কঠিন দায়িত্ব। মুর্শিদের নির্দেশ পেয়ে তিনি খুব দ্রুত কাজে নেমে গেলেন। প্রথম ৬ বছর কাটে তাঁর উত্তর প্রদেশেই। সেখানে জৌনপুর, গাজীপুর, আজমগড়, ফৈজাবাদ ও সুলতানপুর অঞ্চলে ইলমে দ্বীন-এর সেবায় নিজকে নিয়োগ করেন। তারপর বাংলা ও আসাম। এ সকল অঞ্চলে হিদায়াতের কাজ করে স্থায়ীভাবে দ্বীনি শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজও আন্জাম দিলেন।

জৌনপুর থেকে বাংলা ও আসামের উদ্দেশ্যে প্রথম যাত্রা করেন কলকাতায়। বাংলাদেশে তখন দ্বীন ইসলামের চলছে এক চরম বিপর্যয়। অধিকাংশ মানুষ নামায-রোযার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তারা দূরে সরে পড়েছিল ধর্মীয় শিক্ষা থেকে। ধর্মের নিয়ম-কানুন পালন বন্ধ করে তখন হিন্দুয়ানী প্রথা অনেককাংশে চালু হয়ে গিয়েছিল বাংলার মুসলমানদের মাঝে। বিপদে আপদে মানুষ ছুটতো ভণ্ডদের আস্তানায়। ভন্ডকে করত সিজদা। ইসলামী পোশাকের বদলে, হিন্দুয়ানী পোষাক পরার চল শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে শাদীতেও হিন্দুয়ানী রীতি। এমনকি হিন্দুয়ানী নাম রাখার চলও শুরু হয়ে যায়। মুসলিম রমণীদের মাঝে পর্দা প্রথার বিশেষ কোন বালাই ছিল না। এক কথায় বাংলায় তখন দ্বীন ইসলামের ঘোর দুর্দিন। এই দুর্দিনে বাংলার পথে রওনা হলেন মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহঃ) । লক্ষ্য, বাংলার মানুষকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া। হিদায়াত করা। ইসলামের কথা বলা। তওহিদ ও রেসালতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নবীর সুন্নাতের প্রচলন করা।

কলকাতায় তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে সাক্ষাৎ হয় সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর খলীফাগণের অন্যতম মাওলানা হাফিয জামালুদ্দীন সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি, মাদ্রাসায়ে আলিয়া’র হেড মাওলানা মুহাদ্দিস ওয়াজীহ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং কাযী আবদুল বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ অনেক বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে। তাঁরাও এ সময় কলকাতায়ই অবস্থান করছিলেন।

এদিকে মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে কলকাতার আলিম উলামারাও খুশি। তিনি কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-নসীহত করে। সাধারণের মাঝে ধর্মের বাণী প্রচার করলেন। ইসলাম বিরুদ্বি রীতি-নীতি বর্জনের ডাক দিলেন। এতে লোকজনের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বন্ধ হয়ে যেতে থাকে শরীয়ত বিরোধী কাজ-কর্ম। মানুষ আস্থাশীল হয়ে ওঠে ধর্মের প্রতি। মাওলানার কথা শুনে সবাই মুগ্ধ। দলে দলে লোক ছুটে এলো তাঁর কাছে। তওবা করলো বিপথগামীরা। অনেকেই তাঁর নিকট বাইয়্যাত হলেন। এভাবে খুব দ্রত কলকাতার মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় চেতনা ও ইসলামী জাগরণের সৃষ্টি করেন তিনি। কলকাতায় অবস্থান কালেই তাঁর বড় পুত্র মাওলানা হাফিয আহমদের জন্ম। পরবর্তীকালে মাওলানা হাফিয আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি পিতার যোগ্য উত্তরসসূরী, তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও দ্বীনের খিদমতগার হয়েছিলেন।

অফুরান বিলিয়েছেন হেদায়েতের আলোঃ

বিশেষত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে সফর করেন এবং শিরক-বিদআত প্রভৃতি অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকেন। তাঁর হাতে দলে দলে লোক বাইয়াত হয়ে সঠিক পথের অনুসরণ করতে থাকেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সংস্কারের কাজ করেছেন সবার মাঝে। তাঁর জীবনী পাঠে জানা যায়, দীর্ঘ দু'শো বছরের বৃটিশ দুঃশাসনের নাগপাশ ছিন্ন করার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে নানাভাবে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত ও পিছিয়ে পড়া এতদাঞ্চলের ভাগ্য বিড়ম্বিত মুসলিমদের বস্ত্র পরিধান করা পর্যন্ত তিনি শিখিয়েছেন। মুসলিমরা নিজেদের ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র্য এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি ও নির্দেশনা ভুলে গিয়ে অন্য জাতির অনুকরণে ভিন্ন ধর্মের বিশেষ পোষাক আষাক পরিধান করতে পর্যন্ত ইতস্তত করতো না। এসবের অপনোদনে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে আজও। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নগরে নগরে, গঞ্জে গঞ্জে তিনি অসংখ্য মাদ্রাসা-মসজিদ এবং শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

গ্রামবাংলার পথে পথেঃ

এ কথা আপনাদেরকে পূর্বেই বলেছি যে, বাংলাদেশে ইসলামের নবজাগরণে পীর-আউলিয়া ও সূফী-দরবেশদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। এই পীর-আউলিয়ার অন্যতম হলেন হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি তাঁর মুর্শিদ সায়্যিদ আহমদ শহিদ বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর নির্দেশ মাথায় নিয়ে হিদায়াতের কাজে বাংলা ও আসামের পথে-প্রান্তরে সফর করেন। তিনি কলকাতা থেকে প্রথম আসেন যশোর। তারপর খুলনা এবং পুরো বাংলা। এ পুরো সফরই কাটে বজরায় (বড় নৌকা) করে।

জৌনপুরী ছাহেব এ দেশের পথভ্রষ্ট মুসলামনদের নামায-রোযা, হজ্ব, যাকাত, ফিতরা, কুরবানী, জুমআর নামায আদায় অর্থাৎ শরীয়তের বিধি-বিধান বিষয়ে তাদের শিক্ষা দেন, তাদের এসব পালনে অনুপ্রাণিত করেন। এ কাজে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেন মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ্, মক্তব ইত্যাদি। তিনি তাঁর ৭৮ বছর (মতান্তরে ৭৫ বছর) জীবনের ৫৭ বছরই দ্বীন ইসলামের জন্য ব্যয় করেন। এর মধ্যে ৫১ বছরই ছিলেন বাংলা ও আসামে। আর তিনি শেষ নিঃশ্বাসও ত্যাগ করেন বাংলাতেই। তাঁর দাফনও হয় এদেশের মাটিতে, রংপুরে।

মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কলকাতা থেকে একটি বজরার বহর সহযোগে রওনা হন আজকের বাংলাদেশে (তৎকালীন পর্ববঙ্গ)। তাঁর এই বজরার বহরের একটিতে ছিলেন পরিবারের মহিলাগণ, একটিতে ছিল ভ্রাম্যমান মাদ্রাসা, একটিতে থাকতেন খাদিম ও কর্মচারীগণ, আর একটিতে থাকতেন মাওলানা ছাহেব নিজে এবং তাঁর খলীফা ও সাক্ষাৎপ্রার্থীগণ।

তাঁর এই ভ্রাম্যমান মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষার তালিম দেয়া হতো। শিক্ষার্থীরা এখানে যাহিরী-বাতিনী বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতেন। শিক্ষা শেষে তাঁরাই হতেন বিশিষ্ট বুযুর্গ ও আলিম। পরে তাঁদেরকে বিভিন্ন স্থানে খলীফা হিসাবে পাঠানো হতো। তাঁরা সেখানে হিদায়াতের কাজ চালিয়ে যেতেন। এভাবে পুরো বাংলা জুড়ে গড়ে ওঠে ইসলামী শিক্ষার পরিবেশ এবং জাগরণ। আজো বাংলাদেশের খুব কম গ্রামই আছে যেখানে তাঁর অনুসারী নেই। তৎকালীন বাংলার অশিক্ষিত সমাজে হিদায়াতের কাজ খুব সহজ ছিল না। প্রথমে নিজেদের অজ্ঞতার কারণেই নামায-রোযা ও শরীয়ত বিষয়ে কথাবার্তা অনেকের ভাল লাগতো না। তারা পছন্দ করতো না এ জ্ঞানদান। অনেকেই ক্ষেপে উঠতো। তিরস্কার করতো তাঁকে। ঢিল ছুঁড়তো বজরা লক্ষ্য করে। জৌনপুরী ছাহেব যশোর ও বরিশাল অঞ্চলের বেশ কয়েকটি স্থানে এরূপ বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাই বলে ক্ষান্ত হননি তিনি। বিরত হননি ইসলামের প্রচার কাজে।

পরে অবশ্য এই সব গ্রামবাসী তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পারতো। মুগ্ধ হতো তাঁর ওয়াজ-নসীহত শুনে। তারা ক্ষমা চাইতো। তওবা করতো এবং দলে দলে বাইআত হতো। তবে নোয়াখালী ও সন্দ্বীপবাসীগণ তাঁকে খুব সাদরে গ্রহণ করেছিলো । আজো এসব এলাকায় মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর ভক্ত ও অনুসারী বিপুল। এছাড়া আমরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে অধিক আলিম উলামা দেখতে পাই। এর জন্য সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর। এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক লোক তাঁর মুরীদ।

তখন এদেশ ইংরেজ শাসনাধীনে। তিনি এদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখলেন কোন কোন অঞ্চলে লোকজন জুমআ ও ঈদের নামায পড়ে না। তাদের মতে দেশ ইংরেজ শাসনাধীনে থাকায় জুমআ ও ঈদের নামায জায়িয নয়। তিনি ওয়ায, নসীহত ও যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে মানুষের এ ধারণা ভেঙে দিলেন। এভাবে সবখানেই চালু হয় জুমআ ও ঈদের নামায।

বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর গ্রন্থ ‘মুরাদুল মুরীদীন’-এ লিখেছেন- ‘এই ফকীরের অবস্থা ছিল যে, হিন্দুস্থান হতে কলকাতা, চট্টগ্রাম ও সন্দীপ পর্যন্ত এবং ঢাকা হতে সিলেট পর্যন্ত যে সমস্ত শহর ও গ্রাম পূর্ব বাংলায় আছে, তা হামেশা সফর করতে হতো এবং ইসলামের হিফাযতের চেষ্টা করতে হতো।’

আসলে সব দিক বিচারে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে একটা সর্বাত্বক ইসলামী সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই সংস্কার ও বিপ্লবের দায়িত্বই পালন করেছিলেন মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। মানুষ কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়েছিল। তারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর রাস্তায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল। মাওলানা কারামত আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শুধু আধ্যাত্বিক পুরুষই ছিলেন না। ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতা, যাঁর নেতৃত্বে এদেশের মুসলমানদের সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল।

প্রায় অর্ধশত পুস্তকের রচয়িতা তিনিঃ

মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরবী-উর্দুতে ৪৯ খানা পুস্তক প্রণয়ন করেন এবং তাঁর বেশ কিছু পুস্তক তখন মাদ্রাসার পাঠ্য বই হিসেবে গৃহিত হয়েছিল।

ইন্তেকালঃ

বাংলার এই মহান হাদী ও মুজাদ্দিদ হিজরী ১২৯০ সালের ২ রবিউসসানি মোতাবেক ১৮৭৩ সালের ৩০ মে ইন্তেকাল করেন। রংপুরে তাঁর কবর অবস্থিত। আজও তাকে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন মানুষ। তাঁর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ছুটে যান রংপুরের উদ্দেশ্যে। ভক্তিভরে দাঁড়ান তাঁর কবরের পাশে। চোখের দু'ফোটা অশ্রু ফেলে মহান রবের দরবারে মাগফিরাতের দোআ করেন তাঁর জন্য।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৪৩

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: এতোগুলো বছর ব্যয় করলেন ইসলামের সেবায় কিন্তু মানুষের সেবায় একটা দিনও ব্যয় করলেন না যেটা করে ছিলেন মাওলানা ভাসানী।

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:২০

নতুন নকিব বলেছেন:



কারও অবদানকেই খাটো করে দেখা উচিত নয়। যার যার অবস্থান থেকে তারা দু'জনই দেশ এবং মানুষের জন্য জীবনপন কাজ করেছেন। কিন্তু হঠাৎ আপনার এই তুলনামূলক প্রশ্ন কেন? মুসলমানদেরকে মানুষ বলে মনে হয় না আপনার কাছে? 'ইসলামের সেবা' বলে আপনি কি বুঝাতে চাইলেন, ঠিক ক্লিয়ার না।

মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহ আলাইহি তো মানুষের কল্যানেই তাঁর সারাটি জীবন উৎসর্গ করলেন। তাছাড়া, তিনি সমাজের কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ইত্যাদি দূরিকরণার্থে আজীবন লড়াই করেছেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর সংস্কারকর্মে উপকৃত হয়েছেন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ।

২| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:১৫

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে ভালো ভালো তথ্য আছে। আমি টূকে রাখলাম।
আমার নানী আসামে ব্যবসা করতেন।
মাওলানা কেরামত আলীর গল্প নানীর মুখে শুনেছি।

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:৫৩

নতুন নকিব বলেছেন:



আপনিও তো দারুন তথ্য দিলেন। ব্যবসা করতেন আসামে। নানাও না। স্বয়ং নানী।

তৎকালীন সময়ে নানীর ব্যবসা করাটা সহজ ছিল না। নিশ্চয়ই আপনার নানী শিক্ষিত এবং সচেতন পরিবারের লোক ছিলেন।

৩| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:৪৯

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: ইসলাম ধর্ম আর মানুষ এক জিনিস না।ইসলাম ধর্মের মানুষদের বলে মুসলমান।যে মুসলমানদের সেবা করে সে মানুসের সেবা করে,যে ইসলামের সেবা করে সে ধর্মের সেবা করে অর্থাৎ ধর্মটা টেরা বেকা হয়ে গেছে সেটাকে ঠিক ঠাক করে।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ৯:৫২

নতুন নকিব বলেছেন:



ইসলামের সেবা মানেই তো মুসলমানদের সেবা। তো, ধর্মকে সেবা দেয়ার প্রশ্ন কিংবা প্রয়োজনটা আসে কেন? আসে তো, মানুষের কল্যানের জন্যই। সর্বোপরি, ধর্ম তো মানুষেরই জন্য। তাই নয় কি? সুতরাং, ধর্মের সেবা বলেন আর ধার্মিকের সেবা বলেন, ঘুরেফিরে কথা একটাই, মানবসেবা।

মোদ্দাকথা, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমাতুল্লাহ আলাইহি মানুষের সেবা এবং কল্যানকামিতায়ই তাঁর মূল্যবান জীবন পার করেছেন।

ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.