নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবীর অদ্ভুত এই টেলিফোন বুথে আজও কথা বলে কারা....

মৃতের সহিত কথোপকথন

মানুষ মারা গেলেও তো কথারা থেকেই যায়।কে শুনবে সেসব গোঙানি, সেসব গেরস্থালির রোজনামচা, কে নতুন করেই বা আর শুনতে চাইবে ‘ভালোবাসি’।

মৃতের সহিত কথোপকথন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙলায় যখন ক্রাচিন এলো

২৮ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১০:৩৬


Pic: কোরা

ইতিহাস বলে যে, ঊনবিংশ শতকের শেষ ধাপে ও বিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশে দেশলাই-এর প্রচলন ঘটেছিল। বহু আগে থেকেই বাঙলায় অবশ্য চকমকি পাথরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল, সেগুলো ঠোকাঠুকি করলেই আগুন জ্বলে উঠত। তারপরে এসেছিল ডগায় গন্ধক-মাখানো পাটখড়ি। তখন ঘরে ঘরে তুষের আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত; সেই আগুনের মধ্যে ওই পাটখড়ির ডগা ধরলেই নতুন আগুন জ্বলে উঠত। বাঙলার ঘরে ঘরে তখন রেড়ির তেলের এল জ্বালানো হত। পিলসুজের ওপরে সলতে দেওয়া প্রদীপ থাকত, ধনীর বাড়িতে সেই প্রদীপ পিতলের, আর সাধারণ মানুষের ঘরে মাটির তৈরী হত। কিন্তু হাওয়ার প্রকোপে সেগুলো নিভে যেত বলে ধনীদের জন্য চারদিকে কাঁচ-বসানো টিনের লণ্ঠন তৈরী হয়েছিল। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে বাঙলায় কেরোসিন তেলের আগমন ঘটেছিল। প্রথমে টিনের তৈরী সলতে দেওয়া তেলের কুপাতে কেরোসিন জ্বালানো হত, বিংশ শতকে কেরোসিনের আধুনিক লণ্ঠন এসেছিল। আঠারো-ঊনিশ শতকের ধনীরা সাধারণতঃ ওলন্দাজদের কাছ থেকে ঝাড়লণ্ঠন কিনতেন; তাতে মোমের বাতি জ্বালানো হত, সেই মোম মৌচাকের ছিল, খনিজ ছিল না। পরবর্তীকালে বঙ্গদেশ থেকে ঝাড়লণ্ঠনের পাট চুকে গেলেও, একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কেরোসিন তেলের বাতি বা হ্যারিকেন, এবং মোমবাতির আধিপত্য বজায় ছিল। এরপরে সেই সময়েরও পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে বিদ্যুতের আলোর যুগে কেরোসিনের বাতিও লুপ্তপ্রায়। কিন্তু সেই সময়টা কেমন ছিল, যখন বাংলার মানুষ প্রথম কেরোসিন তেলের বাতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন? উত্তর পাওয়া যায়, জলধর সেন রায়বাহাদুর লিখিত ‘সেকালের কথা’ গ্রন্থের ‘কেরোসিন তেল’ নামক প্রবন্ধে। তিনি লিখেছিলেন,

“এই লেখাটার শিরোনাম দেখে হয় ত কেহ ভাববেন, আমি কেরোসিন তেলের জন্ম-বৃত্তান্ত, তার কোষ্ঠী দাখিল করতে বসেছি। আমার সে অভিপ্রায় মোটেই নেই; আমি কেরোসিনের জন্ম-বৃত্তান্ত দিতে আসি নি; তবে কেন যে ঐ শিরোনাম দিলাম, তাই বলছি।

এখন সহরে বাস করলেও ছেলেবেলায় আমি গ্রামেই থাকতাম; গ্রামেই আমাদের বাড়ী ছিল, এখনও আছে। আর আমাদের সে ছেলেবেলা - বিশ-পঁচিশ বৎসর আগের কথা নয় - প্রায় ষাট বৎসর আগের কথা। তখন আমার বয়স ছিল - এই আট নয় বৎসর। সেই সময় আমি সর্ব্বপ্রথমে কেরোসিন তেল দেখেছিলাম এবং সে কথা এখনও আমার বেশ মনে আছে। এখন ঘরে-ঘরেই কেরোসিন তেল দেখতে পাওয়া যায়, বড় মানুষের বাড়ী থেকে আরম্ভ করে অতি দীনহীন গরিবের ঘরেও আজ কেরোসিন বৰ্ত্তমান। কিন্তু আমরা যখন বালক ছিলাম, তখন দেখা দূরে থাক, দ্রব্যটীর নামও জানতাম না। তখন আমাদের দেশে বড়-মানুষেবা লণ্ঠনের মধ্যে নারকেল তেলের আলো জ্বালতেন, আর গরীবেরা হয় সরষের তেল, না হয বেড়ির তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে বাড়ির অন্ধকার দূর করতেন। এমন যে কলকাতা সহর, সেখানেও তখন ঐ প্রথা ছিল - বোধ হয় সে সময় গ্যাসের আলোও জ্বলেছে। কিন্তু বিজলী-বাতির কথা কেহ কল্পনাও করতে পারতেন না। যাকগে সে কথা। আমার সৰ্ব্বপ্রথম কেরোসিন তেল দর্শনের ইতিহাসই বলি।

আমাদের গ্রামখানি একেবারে নিছক পাড়াগাঁ ছিল না। গ্রামে অনেক ব্যবসায়ী বড়মানুষের বাস ছিল, ইংরাজী বাঙ্গালা লেখাপড়াও তখন গ্রামে প্রবেশ লাভ করেছিল। যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁরা অনেকে বিষয়কৰ্ম্ম উপলক্ষে কলকাতাতেও যাওয়া-আসা করতেন, আর তাঁদের মধ্যে যাঁরা যুবক দলের ছিলেন, তাঁরা কলকাতা থেকে দেশে ফিরে কলকাতাব সম্বন্ধে কত গল্প বলতেন, আর আমরা অবাক হয়ে সেই সব কাহিনী শুনতাম এবং বড় হ’লে কলকাতায় গিয়ে সেই আজব সহর দেখবার বাসনা মনের মধ্যে পোষণ কবতাম। সেই সময় একদিন আমাদের প্রতিবেশী একটী যুবক কলকাতা থেকে বাড়ী ফিরে এলেন। তিনি বড়মানুষের ছেলে। অল্প বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হওয়ায়, আমি যে সময়ের কথা বলছি তখনও, তাঁর জ্যেঠামশাই তাঁর পোষাকী নাম প্রচলিত হতে দেন নি - শিশুকালের সেই সনাতন ‘খোকা’ নামই তাঁর বাহাল ছিল; আমবা অত-বড় যোয়ান মানুষটাকে খোকা-দাদা বলেই ডাকতাম।

আমাদের এই খোকা-দাদা যখনই দু’দশ দিনের জন্য কলকাতায় গিয়ে বাড়ী ফিরে আসতেন, তখনই এমন সব জিনিস নিয়ে আসতেন, যা আমরা - অর্থাৎ পল্লী-বালকেরা - কখন চোখেও দেখি নি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সাবান, বুরুষ, পমেটম, ফিতে, ষ্টকিন প্রভৃতির নাম বলতে পারি। আমি যেবারের কথা বলছি, সেবার তিনি বাড়ী এসেই পাড়ায় ঘোষণা করে দিলেন যে, তিনি এমন একটী আশ্চর্য্য জিনিস এনেছেন, যা আমরা ত কোন দিন দেখিই নি, আমাদের পাড়াগেঁয়ে অভিভাবকেরাও দেখেন নি। তবে সেটা দিনের বেলায় দেখিয়ে লাভ নেই, সন্ধ্যার সময় দেখাতে হবে। আর তিনি বললেন, তার এমন গুণ যে, উঠানে বসিয়ে দিলে সারা বাড়ী আলো হয়ে যাবে - চাঁদের জ্যোছনা তার কাছে লাগেই না। এই বর্ণনা শুনেই ত’ আমাদের চক্ষুস্থির। কখন বিকেল হবে, কখন সন্ধ্যা আসবে, আমরা তারই জন্য সময় গুণতে লাগলাম। আর এমন একটা দ্রব্য আমাদের পাড়য় দেখানো হবে, সংবাদ অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের দিয়ে বাহাদুরী প্রকাশ করবার লোভও সংবরণ করতে পারলাম না। বাড়ীতে পিসিমা বললেন, ‘ও-বাড়ীর খোকা একটা টিনের বাক্সের মধ্যে কি একটা ভয়ানক দ্রব্য এনেছে। যে ঘরে সেই বাক্সটা রেখেছে, সে ঘরে কেউ যেন আগুন নিয়ে না যায়, এ কথা বারবার সকলকে বলে দিয়েছে। ঘরের মধ্যে কোন রকমে আগুন নিয়ে গেলে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড হবে, তাঁদের বাড়ী তো পুড়ে যাবেই, পাড়াপড়শী আমাদেরও রক্ষে নেই। খবরদার, তোরা আজ ও বাড়ীতে যাস নি, শেষে কি অপমিত্যু হবে। যেমন বাতিক - মরুক গে ঐ হতভাগা!’ পিসিমার নিষেধ-বাক্য আমাদের আরও উৎসাহিত করল। বিকেল না হতেই আমরা সবাই খোকা-দাদার প্রকাণ্ড উঠানে উপস্থিত হলাম ৷ আমাদের তর সইছিল না - ‘খোকা-দা, কখন জিনিস বার করবে?’ ‘খোকা-দা, বেলা ত আর নেই’ - এই রকম অনুরোধ উপরোধ আমরা ক্রমাগত করতে লাগলাম, কিন্তু তিনি সুধু বল্লেন ‘এখনও দেরী আছে।’ কি করা যায়, অপেক্ষাই করতে হোলো।

অবশেষে শুভ সময় এসে পড়ল। চাকরদের কাউকে ছুঁতে না দিয়ে খোকা-দা নিজেই সেই টিনের বাক্সটা এনে উঠানের মাঝখানে রেখে দিলেন। বাক্সটী দেখবার জন্য আমরা সবাই যখন ঝুঁকে পড়লাম, তখন খোকা-দা চীৎকার ক’রে উঠলেন - ‘সর্ সর্, এত কাছে কেউ আসিস নি। পুড়ে মরবি।’ এই কথা শুনে আমরা সভয়ে দশ হাত পিছিয়ে গেলাম। তিনি তখন এই দর্শক দলকে সেই বাক্সটী হ’তে দশ বার হাত দূরে গোল হয়ে দাঁড়াতে বললেন। সকলেই তাই করলাম। সুধু আমরা ছেলেমেয়ের দল কেন, বয়োবৃদ্ধেরাও এই ব্যাপার দেখতে এলেন। তারপর খোকা-দা তালা খুলেন, বাক্সের ডালা তুলেন। আমরা দূর থেকে সভয়ে দেখলাম যে, বাক্সটা খড়ে বোঝাই - আর কিছু - দেখা গেল না। তিনি তখন ধীরে ধীরে সেই খড়গুলি তুলে বাইরে ফেলতে লাগলেন; - আমরা ভয়ে আরও একটু পিছিয়ে গেলাম। তখন সেই খড়ের মধ্যে থেকে যিনি বের হলেন, তাঁর পরিচয় এখন সকলের কাছে এক কথায় দিচ্ছি। তিনি হচ্ছেন, একটী অতি সাধারণ কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প। সবাই হয় ত হাসছেন, কিন্তু এমন আশ্চর্য্য অদৃষ্টপূর্ব্ব দ্রব্যটী তখন আমরা যে কি ভাবে, কি সতৃষ্ণ নয়নে দেখেছিলাম, তা কেউ ভেবেও উঠতে পারবেন না।

যাক, খোকা-দা তখন বাক্সের পার্শ্বে ল্যাম্পটী বসালেন। কেনবার সময়ই বোধ হয় দোকানদাব ল্যাম্পে ফিতে পরিয়ে দিয়েছিল; তাই সে প্রক্রিয়াটা আর আমরা দেখতে পেলাম না। তার পরই বাক্সেব মধ্য থেকে এলেন কাগজে মোড়া একটী দ্রব্য; মোড়ক থেকে বের হলেন এক আশ্চৰ্য্য বস্তু। আমরা কখনও দেখি নি, তাই আশ্চর্য্য মনে হয়েছিল। তিনি আর কেউ নন, একটা পেট-মোটা মাথা-সরু কাঁচের চিমনি! সে রকম চিমনি এখন আর বাজারে বড়-একটা দেখতে পাই নে।

এই সব ত বের হোলো; কিন্তু আসল যিনি, তিনি তখনও বাক্সের মধ্যেই রয়েছেন। এইবার খোকা-দাদা বললেন, ‘তোমরা সবাই আরও স’রে যাও - এখন যা বা’র ক’রব, সে অতি ভয়ানক জিনিস। তার নাম হচ্ছে ক্রাচিন।’ আমরা তখন ভয়ে আরও পিছিয়ে গেলাম। খোকা-দাদা তখন একটা জিনিস বাক্স থেকে বার করলেন; তার আকার যে কি, প্রথমে ঠাহর হোলো না - প্রকাণ্ড একটা কাপড়ের পুঁটুলি দেখলাম। তিনি ধীরে ধীরে সেই কাপড়ের আবরণ খুলতে লাগলেন। পুরা দশ হাত একখানি ধুতি লম্বার দিকে চার পাট করে সেই ভয়ঙ্কর দ্রব্যটীকে বেড়ে রাখা হয়েছে। কাপড়ের বন্ধন আর শেষ হয় না - এ যেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। এই বস্ত্রের বেষ্টনী যখন শেষ হোলো, তখন দেখা গেল একটা আধসেরী বোতল। সেই বোতলটী অতি সন্তর্পণে তুলে ধরে খোকা-দাদা ঘোষণা করলেন, ‘এর মধ্যে যে জলের মত জিনিস দেখতে পাচ্ছ, তার নাম ক্রাচিন। এই ক্রাচিন ল্যাম্পের মধ্যে ঢেলে দিয়ে, পলতেয় আগুন জ্বেলে দিয়ে চিমনি লাগিয়ে দিলে একেবারে চাঁদের আলো।’ এই ব’লে তিনি ল্যাম্পের স্ক্রু খুলে অতি সাবধানে খানিকটা তেল ল্যাম্পের তৈলাধারে ঢেলে দিয়ে স্ক্রুটা আটকে দিলেন।

তারপর পলতে জ্বেলে দেবার পালা। খোকাদা-দার বুড়া জ্যাঠামশাই এতক্ষণ কিছু বলেন নি, সমস্তই দেখছিলেন। যখন ল্যাম্প জ্বালবার কথা হোলো, তখন তিনি বলেন, ‘তোকে এখন ও সর্ব্বনেশে জিনিসের কাছেও যেতে দেব না খোকা! তুই সরে আয়, চাকরে বা কেউ জ্বেলে দিক।’ তিনি ত বললেন, চাকররা জ্বেলে দিক; কিন্তু সকলেরই মনে খোকা-দাদা যে ভয়ের সঞ্চার করে দিয়েছিলেন, তাতে অন্য লোক দূরে থাক, মাইনের চাকরেরাও কেউ প্রাণ দিতে স্বীকার হোলো না।

শেষে স্থির হোলো যে, একটী প্যাকাটীর মাথায় আগুন জ্বেলে দূর থেকে ল্যাম্পের পলতে জ্বালিয়ে দিতে হবে। সেই মত ব্যবস্থা হলে আমাদের পাড়ার একজন গাঁজাখোর কিঞ্চিৎ দক্ষিণার লোভে এই অসমসাহসিক কার্য্যে অগ্রসর হোলো। সে যথাসম্ভব দূরে থেকে ল্যাম্পের পলতেয় অগ্নি সংযোগ করল। আলো হোলো, কিন্তু বেশ জোর হোলো না। তখন খোকা দাদা বললেন, ‘পাশে যে চিমনি বয়েছে, ওটা লাগিয়ে না দিলে আলো খুলবে না।’

গাঁজাখোরটি সে ভারও নিল। সে অতি সন্তর্পণে ল্যাম্পের কাছে গেল, চারিদিকে রব উঠল - খবরদার, সাবধান! গাঁজাখোব বেশ সাবধানে চিমনি পরিয়ে দিল; আর তখনই চাঁদের আলো হোলো! বা কি চমৎকার! আমাদের ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল, আরও একটু এগিয়ে এই চাঁদের আলোটা নয়ন ভ’রে দেখি। কিন্তু এগুতে গেলেই ‘ওবে, সর, সর, ল্যাম্প ফেটে যেতে পারে’ - শুনেই দশ হাত পিছিয়ে যাই।

তার পর - তার পর আর কি? এখন ত ঘরে ঘরে কেরোসিন। সব কাজেই কেরোসিন। কেরোসিন এখন সৰ্ব্বব্যাপী। কিন্তু, এখনও, লেখাপড়া শিখেও বানান ভুল না করেও, মধ্যে মধ্যে সেই সেকালের একদিনের কথা মনে করে ছেলেপিলেদের বলি ‘ওরে, সর, সর, খবরদার, এর নাম ক্রাচিন।’ …”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.