![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নূর মোহাম্মদ (নূর)::- "হুজুর, হুজুর নুরিয়া গীত গার" মক্তবে হুজুরের দেয়া আরবি পাঠ ফেলে রেখে গান গাইত বলে পাশের ছেলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত যে ছেলে শাস্তি ভোগ করত কালক্রমে সে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার এম. এন. আখতার। পুরো নাম মোহাম্মদ নুরুল আখতার। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা, কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রবর্তক, গীতিকার, সুরকার এম এন আখতার । মিডিয়ার অগোচরে থাকা সংগীতের বিস্ময়কর এই প্রতিভা ১৯৩১ সালের ১ জুলাই রাউজানের মোহাম্মদপুর তাজ মোহাম্মদ চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের চব্বিশ পরগণার বশির হাট টাউনে সঙ্গীতজ্ঞ বাবু অমল মুখার্জির কাছে সঙ্গীতে হাতে খড়ি তাঁর। প্রতিভাবান এম. এন. আখতার পেশাগত জীবনে ১৯৪৯ সাল থেকে সরকারি চাকুরে। তাঁর কর্মস্থল ছিলো সাতক্ষীরা কাস্টমসে। ১৯৫৯ সালে চাকরি সূত্রে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম আসেন । সে থেকে চট্টগ্রামই তাঁর চাকুরী, সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চা। এ শিল্পী ১৯৬২ সালে বেতার শিল্পী হিসাবে যোগ দেন।
কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যুম তোয়ারে, মাঝি পাল তুইলা দে, বাছুরে, জি জি জি, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, ও পরানের তালতো ভাই, যদি একখান সুন্দর মুখ পাইতাম, ও আকাশ তারার প্রদীপ সহ এরকম অসংখ্য মন মাতানো এবং কালজয়ী গানের রচয়িতা এম এন আখতার। তিন প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক গান লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য নাটক, গ্রন্থ আর কবিতাও ।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চুড়িওয়ালা, সোনার কলসী, নাতিন জামাই, কানের ফুল, লট্টন কইতর, রাঙ্গাবালির চরে, বৈশাখী মেলাসহ অনেক নাটক ছিল উল্লেখযোগ্য। পবিত্র কুরআনের ১১৪টি সূরা হতে বিশেষ বিশেষ তথ্যগুলো নিয়ে বাংলায় তার লিখিত "করুণার বাণী" গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। এম. এন. আখতার বেতার টেলিভিশন তথা মঞ্চে দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও নন্দিত শিল্পী ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রসার লাভ করেছে। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান সাবিনা ইয়াসমিন, শেফালি ঘোষ ছাড়াও আবদুল জব্বার, আবিদা সুলতানা, সুবীর নন্দী, ফেরদৌসী রহমান, ফেরদৌস আরা, রুমানা ইসলাম, আনোয়ার উদ্দিন খান, আপেল মাহমুদ, সামিনা চৌধুরী, উমা ইসলাম, মিনা বড়ুয়া, আলাউদ্দিন তাহের, জুলি শরমিলি, বুলা মোস্তফা, সন্ধ্যা রানী, আবদুর রহিম, বীণাপানি, এম. এ. খালেক, বদরুন্নেসা ডালিয়া, এ. জে. মারুফা বেগম, সাইফুদ্দিন মাহমুদ, পাকিস্তানি শিল্পী নিঘাত সীমা, মুন্নি বেগম ভারতের শ্রাবন্তী মজুমদার প্রমুখ শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়েছে। এম এন আখতারের কথা ও সুরে পাকিস্তানের শিল্পী মুন্নি বেগম গেয়েছেন "ন যাইওম আঁই যাইতাম ন, লাল মিয়ার বাড়ি/ ইতা আঁর লয় হতা কয় চোগ মারি মারি"।
গীতিকার, নাট্যকার, কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর অবদান আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। লেখা ও সুর করার পাশাপাশি এম এন আখতার নিজেও গাইতেন। তিনি ১৯৬২ সালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের উদ্বোধনী আধুনিক গানের প্রথম শিল্পী। আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী বলে পরিচিত শিল্পী শেফালী ঘোষের ওস্তাদ ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ও সুর করা গান গেয়ে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ খ্যাতি পান। তাঁর অনেক গান চলচ্চিত্রেও নেওয়া হয়েছে। ৩৫ বছর আগে গ্রামোফোন রেকর্ডে শিল্পী আখতার ও সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছিলেন "কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোয়ারে" গানটি। শুধু আঞ্চলিক গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। একুশের গান, দেশাত্ববোধক গান, আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ভাবের গান, বিচ্ছেদি গান, হামদ-নাত, পীর-আউলিয়ার গান এবং চট্টগ্রামের হাওলা গানেও তার পদচারণা ছিল। তাঁর সর্বশেষ রচিত হাসির নাটক "রসিক দাদুর স্কুলে মানুষ গড়ার কল"।
জানা গেছে, এম এন আখতারের রচিত অনেক গানের মধ্যে একটি সাড়া জাগানো গান ছিল "বকশি হাইট্টা পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম"। এই গানটি বিভিন্ন সময় প্রখ্যাত শিল্পী ওমা ইসলামের কণ্ঠে প্রচার হয়েছিল ভয়েস অব আমেরিকা বেতার থেকে। বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। তার রচিত যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, তুমি যে আমার জীবনের উপহার, বর্গী এলো দেশে, ও মধুমিতা ছবিতে স্থান পেয়েছে। এছাড়া ষাটের দশক থেকে তিনি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক ভাষায় আটটি ও শুদ্ধ ভাষায় চারটি গীতিনাট্য রচনা করেন। তিনি সংগীত বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছেন। এর মধ্যে মনুআ-১, মনুআ-২ এবং ৩০ দিনে অভিনব সঙ্গীত শিক্ষা উল্লেখযোগ্য।
মরমী সুরসাধক এম এন আখতার কাজের স্বীকৃতি পাননি। এত বড় শিল্পী, অথচ জীবদ্দশায় এই শিল্পীর জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ১৮ এপ্রিল, ২০১২ সালে ৮১ বছর বয়সে তিনি শেষ বিদায় নেন। সঙ্গীত ভূবেনে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য জাতি এ গুণী শিল্পীর কাছে ঋণী। এম. এন. আখতার তাঁর সৃষ্টির মাঝেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল আর রাউজানবাসী গর্ববোধ করবে এই শিল্পীকে নিয়ে কাল থেকে কালান্তরে....
©somewhere in net ltd.