![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নূর মোহাম্মদ (নূর) :: ১৯৫২ ও '৭১-এর এক অতন্দ্র প্রহরী অমর একুশের প্রথম কবিতা 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি'র জনক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সংবেদনশীল কবিসত্তার অধিকারী এই মহান মানুষটির জন্ম ৭ই নভেম্বর, ১৯২৭ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা আসাদ চৌধুরীর বাড়িতে। পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা রওশন আরা বেগম।
সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, সমাজ সংস্কারে, মানবসেবায় - সব ক্ষেত্রেই তিনি আদর্শবাদী, ত্যাগী, সাহসী কণ্ঠস্বর ছিলেন। এ ভূখন্ডে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যত আন্দোলন, সংগ্রাম হয়েছে তার প্রতিটিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন রাউজানের গহিরা হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র অবস্থায় তখনকার পূর্ব বাংলার গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে কলেজ মিলনায়তনে বক্তৃতাকালে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কটু মন্তব্য করে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৪২ সালে তিনি সপ্তদশ বা অষ্টাদশ বর্ষীয় তরুণ তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসে যোগদান এবং ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে যোগদান করেন ছাত্র ফেডারেশনে। একই সালে চট্টগ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কলকাতা থেকে আসেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। সম্মেলনে তিনি এর কর্মী হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওই বছর তিনি চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্মজয়ন্তীর অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি।
১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের নতুনপাড়ায় অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২ জন সৈনিক নিকটস্থ কাহারপাড়া গ্রামে এক মহিলার শ্লীলতাহানি করলে পাড়ার লোকেরা তাদের মারধর করে। পরের দিন সেনাবাহিনীর একটি দল পেট্রল দিয়ে কাহারপাড়া পুড়িয়ে দেয়। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। বিশ্ব শান্তির পক্ষে বাংলাদেশে প্রথম প্রচারক ও স্বাক্ষর সংগ্রহের কৃতিত্বও তাকে দিতে হবে। কারণ বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৮ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি ওই সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রগতিশীল মাসিক "সীমান্ত" তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় (১৯৪৭-১৯৫২)। তার "সীমান্তের দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা" (১৯৫০) দুই বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে তার প্রচেষ্টায় রাউজানের গহিরা হাইস্কুলের সাহায্যার্থে স্কুল মাঠে "ইন্সপেক্টর জেনারেল" নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ওই বছরেই তার সম্পাদনায় "সীমান্ত" পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২২ ও ২৩ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় দেশবন্ধু পার্কের বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। সেই সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং শহীদ সাবের যোগদান করেন। ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবদুস সালাম। সেখানে কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, শান্তির সংগ্রাম ও বাঁচার সংগ্রাম এক হয়ে গেছে। সম্মেলন শেষে মিছিল বের হলে পুলিশ মিছিল থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে কলকাতার তালতলা থানায় নিয়ে যায় এবং পরে তাকে আলীপুর জেলে প্রেরণ করে। ৩ দিন পর তাদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫০ সালে তিনি চট্টগ্রামে দাঙ্গা-বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন এবং ২শত পৃষ্ঠা সম্বলিত দাঙ্গাবিরোধী সীমান্ত প্রকাশ করেন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে ১৬ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠক।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। একই বছর কুমিল্লায় যে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হয়, সেই সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রায় ১শত জন শিল্পী সাহিত্যিক তার নেতৃত্বে যোগদান করেন। সম্মেলনে অনুষ্ঠিত নজরুল সঙ্গীতের আসর তিনি উদ্বোধন করেন।
৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কর্মী শিবিরের আহ্বায়ক ছিলেন। একই বছর ঢাকায় কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিকের যে প্রতিনিধি দল যোগদান করে মাহবুব উল আলম চৌধুরী তার দলনেতা ছিলেন তিনি চট্টগ্রামে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ এবং কৃষ্টিকেন্দ্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হলে তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি অংশের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে দলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকেন।
কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি তার উল্লেখ্যযোগ্য কাব্যগ্রন্ত। আবেগ ধারা তাঁর ছোট বেলায় লিখিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকে ইস্পাত এবং অঙ্গীকার নামে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
তিনি হুমায়ুন কবিরের ভূমিকা সম্বলিত দারোগা ও আগামীকাল নামে ২টি নাকটও লেখেন। ১৯৪৬ সালে বিষের নেশা নামের একটি উপন্যাসও লিখেছেন। ১৯৪৭ সালে লিখিত তাঁর পুস্তিকা বিপ্লব তদানিন্তন ব্রিট্রিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। তাঁর কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি কবিতার পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং তার নামে হুলিয়া বের হয়।
১৯৫৬ সালে মিশরের মুক্তিযুদ্ধ নামে আরো একটি পুস্তিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- কাব্যগ্রন্থ সূর্যাস্তের রক্তরাগ, সূর্যের ভোর, গরাদভাঙার সংগ্রামীরা জাগো, অদর্শনা, ক্লান্ত বাঁশির সুর, এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে, শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়ায় ছড়ায় নামের একটি ছড়ার বই; প্রবন্ধ সংগ্রহ সংস্কৃতি জাতীয় মুখশ্রী, গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি, আলোর সন্ধানে দেশ এবং স্মৃতিকথা মূলক গ্রন্থ স্মৃতির সন্ধানে।
১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করে সম্মানিত করে ২০০১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাঁকে একুশের পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি ৩য় স্বাধীনতা বইমেলা পুরষ্কার (২০০৪), চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সম্মাননা পদক (২০০০), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট (২০০২), চট্টগ্রাম সমিতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ও পদক পেয়েছেন (২০০৩)।
এছাড়াও তিনি বহু সংবর্ধনা ও পদক লাভ করেন। ২০০৬ সালে জাতীয়ভাবে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। ব্যাপক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকে পূর্ব বাংলায় হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তি পুরুষ।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী নানা বিষয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে বহু কবিতা, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম মর্যাদাবান মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সীমান্ত (১৯৪৭-১৯৫২)। সত্তর দশকে সম্পাদন করেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা (১৯৭২-১৯৮২)। কবির প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: কবিতার বই: আবেগধারা (১৯৪৪), ইস্পাত (১৯৪৫), অঙ্গীকার (১৯৫৬), কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি (১৯৮৮, ২০০২, ২০০৫), সূর্যাস্তের রক্তরাগ (২০০৪), সূর্যের ভোর (২০০৬)। প্রবন্ধের বই: সংস্কৃতি : জাতীয় মুখশ্রী (২০০৬), নির্বাচিত কলাম : গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র (২০০৬), ছড়ার বইয়ের মধ্যে ছড়ায় ছড়ায় (২০০৪), নাটক : দারোগা (১৯৯৪), (হুমায়ুন কবিরের ভূমিকা সংবলিত), আগামীকাল (১৯৫৩) (সীমান্ত পত্রিকায় ক্রম প্রকাশিত), পুস্তিকা : মিসরের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৫৬); বিপ্লব (বাজেয়াপ্ত ১৯৪৬)।
সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম ও মননশীল চিন্তাশৈলী দিয়ে মানুষের মধ্যে যাঁরা চিরস্মরণীয় তাঁদেরই একজন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ যুগে যুগে বাঙালি জাতির সাহস ও শক্তির উৎস হয়ে থাকবে।
ভাষা সৈনিক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। বর্তমান প্রজন্ম এ কবি সম্পর্কে অনেক কথাই জানে না। তাই রাউজানসহ চট্টগ্রামবাসীর দাবি ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য বইয়ে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে জানতে পারে। --- সংগৃহীত ---
©somewhere in net ltd.