নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ সরল কিন্তু প্রয়োজনে হিংস্র....

I

খোলা-জানালা

To Remove Evil Forces......

খোলা-জানালা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহুয়ার বন

১৬ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১২:২৯

অনেকদিন পরিষ্কার না করায় বইগুলো কেমন যেন বেশি পুরোনো হয়ে গেছে। যদিও সেলফ অনেকদিন আগের। দাদার ছিলো, তারপর বাবা এবং কালের এগিয়ে যাওয়া পথে আমি এখন মালিক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেলফ খুব যত্নেই আছে, আমি কিংবা বাবার কখনো মনে হয়নি ভেঙে নতুন একটা তৈরী করি। বরং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বাবা তার বাবার রেখে যাওয়া জিনিসটি রক্ষা করেছেন, বর্তমানে আমি তা করে চলছি। জানিনা, ছেলেমেয়েরা এর কদর বুঝতে পারবে কি-না।



বেশ কয়েকদিন পর সেলফ থেকে একটা বইয়ে হাত দিলাম। অমনি চোখের সামনের সমস্ত দৃশ্য পাল্টে গেলো । মনে পড়ে গেলো পেছনের কথা। বাবার কথা । এখান থেকেই বাবা বই পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ পড়তেন। কেমন মোচড় দেয়া অনুভূতি। বই হাতে তুলতে পারিনি। শরীর কাঁপতে শুরু করলো । কিছু সময় বিছানায় শুয়ে থাকলাম। নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না । মায়ের কথাও মনে পড়ে গেলো। আলমারিতে রাখা দশ বছর আগের সেই চশমাটা এখনো যতন করে রাখা আছে, যদিও আমি রাখিনি-- রেখেছে আমার ছোট বোন তনুষা । মায়ের একটা স্মৃতিকে ধরে রাখার কতো আকুলতা ওর চোখে। যখনই বাড়ী আসে তখন আমাকে বলে ভাইয়া মায়ের চশমাটা দেন তো একটু, বের করে দিই । সে চশমা ধরে অনেকক্ষণ কাঁদে। আমি কিছু বলিনা... ওর কান্না দেখি, ভালবাসা হারানোর কান্না, মায়ের আঁচল হারানোর কান্না। এই তনুষা মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতোনা, মাকে ছাড়া ভাত খেতো না। মায়ের অসুখ বিসুখ হলে সারা জেগে জেগে মায়ের মাথা টিপে দিতো, পা টিপে দিতো। বিয়ের সময় মা এবং তনুষা বরফ হয়ে গিয়েছিলো, মা কারো সাথে কথা বলেনি এক মাস। আজ এই তনুষা মাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে আছে ? আমি নিজেও ভাবতে পারিনা । সেদিন তনুষার মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "মামা! আম্মু কখনো কখনো মা মা বলে চিল্লায়া ওঠে।" আমি বললাম, "তোমার মা তোমার নানীকে বড় বেশী ভালবাসতো তাই আজ দশ বছরেও স্বাভাবিক হতে পারেনি।"



আজ তনুষা নয় আমি মায়ের চশমা বের করে বসে আছি। শেষ বয়সে মাকে এ চশমা পড়লে দারুণ লাগতো। আমি মফস্বলের একটা কলেজে পড়াতাম। মাস দেড়েক পড়ে আসতাম। মায়ের সেই ধবধবে স্নেহময়ী মুখ আমাকে মুগ্ধ করতো। মা আমাদের অনেক গল্প শোনাতেন এই চশমা পরে। আমি আর তনুষা পাশাপাশি বসে শুনতাম। বাবার গল্প বলতেন, দাদার গল্প করতেন, আর দাদীর প্রতি ছিলো মায়ের সেকি টান, দাদীর কথা বললেই মা চোখ মুছতেন। সাধারণ বউ-শাশুড়ির মতো তাদের অবস্থা ছিলো না। দাদীর কোন মেয়ে না থাকায় মাকে মেয়ের মতো করে দেখতেন।



পুরাতন চশমাটা উলট পালট করে দেখছি, ময়লা লেগেছে । গোলাকার কাচ, লাল ধাতব ফ্রেম, মধ্যম সাইজের ডাণ্ডি। বারান্দায় বসে টিস্যু পেপার দিয়ে চশমাটা পরিষ্কার করে চলছি। বাবা এটা পরিষ্কার না করে ফেলে দিন, এটা ঘরে রাখলে তো আর দাদীর কিছু হবেনা, আমি ছেলের মন্তব্য শোনার পরও চশমাটির প্রতি আকর্ষণ না হারিয়ে পরিষ্কার করেই চললাম। মনে মনে ভাবলাম বাবা, তুমি এই অনুভূতি বুঝবেনা । এই চশমার ভেতরে লুকিয়ে আছে আমরা দু' ভাই বোনের সোনালী দিন। এখনো আমরা মায়ের স্পর্শ পাই চশমার পরশে। চশমাটা ফের হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। হা এখন আর পুরাতন মনে হচ্ছে না ।



স্ত্রীকে ডাকলাম । এই ধরো এটা রেখে দাও, সাথে সাথে স্ত্রী ক্ষেপে গেলো ! তুমি বের করতে পারলা রাখতে পারো না। তোমাদের এই আজগুবী কাজ আমার ভালো লাগেনা । এই চশমা দিয়ে তোমাদের কী হয় আমি বুঝিনা। মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন জেগে ওঠলো , ছেলেও বললো এই কথা, ছেলের মাও বলে । বিষয় কি ? ওদের ধারণা কি - তাহলে এই চশমা তাদের ভালবাসা অনেক কমিয়ে দিয়েছে ? আমি কি তাদের পাওনা অনুযায়ী ভালবাসা দিতে পারছিনা। পূর্ণ ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমাকে চশমাটা থেকে বিচ্ছিন্ন করা? শিকড়হীন একটা মানুষে পরিণত করা? আমি স্থিরদৃষ্টিতে মোহনার দিকে তাকাই। স্পষ্টভাবে ওর জীবনের অতৃপ্তির কথা আগে কখনো শুনিনি, বুঝতেও পারিনি, ভেতরে ভেতরে এত অপূর্ণতা নিয়ে ও বেঁচে আছে ।



বুকের ভেতরে সাজানো বাড়ীটা ভেঙে গেলো মূহুর্তে। কিছুক্ষণ নির্বাক । আমি কি করবো বুঝে ওঠতে পারলাম না । এই চশমা সম্পর্কে স্ত্রী-ছেলের এমন মন্তব্য আমি মেনে নিতে পারছি না। চশমাটা যে আমার শরীরের, জীবনের, অস্থিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মায়ের অদৃশ্য আদরের হাত বুলানো অনুভব করি মাথায় । চশমাটার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেছি – নিজেই জানি না কতক্ষণ কেঁদেছি!



অসহ্য যন্ত্রণা, কষ্টের সমুদ্রে সাঁতার কেটে সারারাত কেটেছে। ভাবনার আকাশ জুড়ে ঝাঁপিয়ে নেমেছে দুর্ভাবনা, আতঙ্ক, মাকে হারানোর কষ্টটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে। আমি জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছি । অতীত লুণ্ঠনের ভয়ে, মায়ের স্মৃতি হারানো ভয়ে ।



পাগলের মতো ঘুম থেকে জেগে ওঠলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। চোখে হাত দিয়ে দেখি চোখও ভেজা। ফ্যান ঠিকই চলছে, বাইরে বৃষ্টিও হচ্ছে তারপরও আমি ঘামে গোসল করছি। তারপর...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.