নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইস আমি তো ভুলতে পারিনি

পিকেকে টিটু

পিকেকে টিটু › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুন্দরবন ধ্বংস হলে বাঁচবে না বাংলাদেশ.........মুনাফার গ্রাসে সবুজ বন

৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:২৫

সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে দেশ ও বিদেশে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। কেন্দ্রটির বাংলাদেশ অংশের মালিকানার ইক্যুইটি বাবদ ৩০ কোটি ডলারেরও সংস্থান হয়নি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না এ মর্মে দেশে ও বিদেশে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের এ কৌশলে মানুষ আশ্বস্ত তো হতেই পারেনি বরং তাদের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কেন্দ্রের স্থাপনাকাজের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। কেন্দ্রের কাজ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে আমন্ত্রণ জানাতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ সবুজ এ বন যদি ধ্বংস হয়, তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। উপকূলের এই প্রাকৃতিক ঢাল বা সবুজ বেষ্টনী কি আমরা নিজেরাই ধ্বংস করতে নেমেছি! তাতে লাভ কার? সে বিষয়ে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আরিফুজ্জামান তুহিন



রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন দেশ ও বিদেশের পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তবে এ প্রকল্পটি আদৌ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য লাভবান হবে কি না সে বিষয়ে তারা কমই খতিয়ে দেখছেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য গত বছরে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ বিদ্যুৎ কম্পানি (বিআইএফপিসি) নামে একটি যৌথ কম্পানি গঠন করেছে। এ কেন্দ্রের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ঋণ নেওয়া হবে। বাকি ৩০ শতাংশের অর্ধেক দেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বাকি অর্ধেক দেবে ভারতের এনটিপিসি। সেই হিসাবে পিডিবিকে মালিকানা বাবদ দেওয়া লাগবে ৩০ কোটি ডলার। তবে এ পরিমাণ অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা পিডিবির নেই এই মর্মে সম্প্রতি বিদ্যুৎ সচিব চিঠি দিয়ে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত মাত্র ১৫ শতাংশ মালিকানার অর্থ বিনিয়োগ করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা বনে যাবে। আর বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশ মালিকানার জন্য অর্থ তো দিতেই হবে, পাশাপাশি দিতে হবে মূল্যবান জমি। আর সুন্দরবনের অস্তিত্ব বন্ধক বা বাজি রেখে কেন্দ্র নির্মাণের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। অথচ এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বিক্রি করে লাভের সমান সমান মালিকানা নেবে ভারত। অর্থাৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর ঝুঁকিরও কোনো প্রশ্ন নেই। কেন্দ্র থেকে বিক্রি করা বিদ্যুতের অর্থ ভারত নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না তাদের। আর বিপরীতে বাংলাদেশকে নিতে হবে সব ঝুঁকি। ভালো তো, ভালো না!



অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয়

প্রকল্পটির জন্য জমি প্রয়োজন সর্বোচ্চ ৭০০ একর; অধিগ্রহণ করা হয়েছে এক হাজার ৮৪৭ একর। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন কয়লা প্রয়োজন হবে ১৩ হাজার টনের বেশি। এ বিষয়ে ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি), ভেল ইঞ্জিনিয়ারিং ও টাটা। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য প্রয়োজন দশমিক ৪২ একর জমি। এ হিসাবে বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ৫৫৫ একর জমি। এর সঙ্গে এমজিআর ও কুলিং টাওয়ারের জায়গা হিসাব করলে জমি লাগবে সর্বোচ্চ ৭০০ একর। অথচ রামপালের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এক হাজার ৮৪৭ একর জমি; যার অবস্থান মংলা বন্দর থেকে আট কিলোমিটার দূরে রামপালের গৌরম্ভার কৈকর দশকাঠি ও সাতমারী মৌজায়।

প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন ১০ টন কয়লার প্রয়োজন হবে। এ হিসাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন প্রয়োজন ১৩ হাজার ২০০ টন কয়লা। আন্তর্জাতিকভাবে কয়লা পরিবহনের জাহাজ সাধারণত সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার হয়ে থাকে। এ ধরনের জাহাজ বন্দরে আসার জন্য পানির যে গভীরতা দরকার, তা মংলা কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরে নেই। মূল জাহাজ বহির্নোঙরে রেখে লাইটারেজে করে কয়লা খালাস করতে হলে বন্দরে জাহাজের জট সৃষ্টি হবে। এতে পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। প্রাথমিকভাবে মংলা বন্দরে কয়লা মজুদের জন্য ২৫ একর জমি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মংলা থেকে রামপালে কয়লা পরিবহন ব্যয়বহুল মনে হওয়ায় লাইটারেজ জাহাজেই রামপালে কয়লা পরিবহনের সিদ্ধান্ত হয়। এসব মিলিয়ে কয়লা আমদানি ও পরিবহন-প্রক্রিয়ার কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়বে আট টাকার বেশি।

কয়লা পরিবহনের বিবেচনায় রামপাল এলাকাটি প্রকল্পের জন্য যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বক্তব্যের প্রমাণও মিলেছে কানাডার ন্যাশনাল এনার্জি বোর্ড পরিচালিত একটি গবেষণায়। এতে দেখা যায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবশ্যই কয়লাখনির কাছে হতে হবে। তা না হলে এটি হতে হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাছে কিংবা রেললাইনের পাশে। অথচ রামপাল কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ তিনটির কোনোটিই মিলছে না।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রামপালসহ অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার জোগান দিতে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির জন্য আনুষ্ঠানিক চিঠি দিতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ-সংক্রান্ত অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গত ১০ জুলাই কয়লা আমদানিবিষয়ক একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিক থেকে কয়লা আমদানির সুপারিশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিতে কয়লার টনপ্রতি দাম পড়বে যথাক্রমে ১৪০, ১৫২ ও ১৩২ ডলার।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কয়লা রপ্তানি করে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বিশ্ব কয়লাবাজারের ২৭ দশমিক ১ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ার ও ২৬ দশমিক ১ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার দখলে। ইন্দোনেশিয়ার হাতে মাত্র ১৭ বছরের কয়লা মজুদ অবশিষ্ট থাকায় ধীরে ধীরে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করছে দেশটি। তাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি করতে হলে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে।



পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়

পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১১ সালের ২৩ মে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্রের অনুমোদন দেয়। ওই অনুমোদনপত্রে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ণ সম্মতি ইআইএ- এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাবে না। পাশাপাশি জলাভূমিও ভরাট করা যাবে না। যদি এসব শর্ত ভঙ্গ করা হয়, তবে অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঈদের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর এক রকম চুপিসারেই পরিবেশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পিডিবিতে। এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে সায় দিল। যদিও সরকার পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিকে থোড়াই জ্ঞান করে। কারণ হিসেবে এটা বলাই যায়, পরিবেশের চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার আগেই প্রায় ১৯০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে পিডিবি। এরপর সেখানকার কৃষকদের উচ্ছেদ করে মাটি ভরাটের কাজটিও প্রায় শেষের দিকে। অথচ পিডিবিকে এর আগে পরিবেশ অধিদপ্তর অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছিল। যার শর্ত ছিল, পিডিবি সেখানে কোনো ধরনের নির্মাণ কাজ করতে পারবে না। তবে এসব শর্ত মানেনি পিডিবি। ফলে শেষ মুহূর্তে পরিবেশের এ ছাড়পত্রকে মনে করা হচ্ছে নাটুকে ও লোক দেখানো।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম রব্বানীর সঙ্গে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, 'এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কথা বলুন।'

তবে পরিবেশের চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অদৃশ্য চাপ ছিল নজিরবিহীন। এ কারণে বারবার অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে সরকারের এ অধিদপ্তরটি। এ জন্য তারা সাতবার ফেরতও পাঠিয়েছে ইআইএ প্রতিবেদন। সর্বশেষ আটবারের মাথায় সরকারের চাপে বাধ্য হয়েই মিলেছে প্রতিবেদন। অনেকে একে এভাবে বলেছেন যে মৃত্যুর জন্য হত্যাকারী নিয়োগ করে, সম্ভাব্য নিহতের জন্য ডাক্তারকে বলে রাখা।



ভারতে বাতিল হওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে মরিয়া পিডিবি

ভারতে এনটিপিসি ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে সে দেশের সরকার। কৃষি ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের যে প্রকল্প ভারত সরকার বাতিল করেছিল, তার চেয়েও বেশি সমস্যা থাকার পরও বাংলাদেশে সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি করেছে পিডিবি। ২০১০ সালের ৮ অক্টোবর ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত NTPC’s coal-based project in MP turned down বা 'মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসির কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল' শীর্ষক খবরে বলা হয় : জনবসতিসম্পন্ন এলাকায় কৃষিজমির ওপর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গ্রিন প্যানেল মধ্যপ্রদেশে ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি)-এর ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি। অথচ বাংলাদেশে সেই এনটিপিসিকে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে সুন্দরবনের মতো সংরক্ষিত একটি বনাঞ্চল, কৃষিজমি, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর তোয়াক্কা না করেই।

ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইও সংবাদটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, 'পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক্সপোর্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটি (ইএসি) মনে করে, প্রকল্প এলাকার বিশাল অংশ দোফসলি কৃষিজমি। এর ওপর তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহণযোগ্য নয়।' তা ছাড়া ওই এলাকার নর্মদা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য ৩২ কিউসেক পানি নিতে হবে। সেটাও ঠিক হবে না বলে কমিটি মনে করে।

ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠানটি এনটিপিসি মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামের এক হাজার একর জমির ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর বাংলাদেশে একই রকম প্রকল্পের জন্য বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারী, কাটাখালী ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় এক হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে কয়লা রাখার জন্য (কোল ডিপোজিট) আরো ৬০০ একর জায়গা অধিগ্রণের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার আয়তন পাঁচ হাজার ১২৫ দশমিক ৫৫ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গকিলোমিটারে ১৮৭ জন। এর বিপরীতে বাগেরহাটের আয়তন তিন হাজার ৯৫৯ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার। আর প্রকল্পের স্থান রামপালের আয়তন ৩৩৫ দশমিক ৪৬ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গকিলোমিটারে ৩৮২ জন, যা ভারতের নরসিংহপুরের প্রকল্প স্থানের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।



কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যেসব বিপদ

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে থাকেন বিপজ্জনক শিল্প হিসেবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, কার্বন মনোঅক্সাইড, মারকারি বা পারদ, আর্সেনিক, সীসা, ক্যাডমিয়ামসহ পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়। কয়লা পুড়ে ছাই তৈরি হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় আরেকটি বর্জ্য কোল স্লাজ বা স্লারি বা তরল কয়লাবর্জ্য। ছাই এবং স্লারি উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত। কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে।



বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

৫ মে, ২০১১ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ওপর গবেষণা করে। তাঁরা নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরেন। এসব ক্ষতির মধ্যে রয়েছে- সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো, বাঘ, হরিণ ও কুমির ধরা। কয়লা পোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলকে বিঘি্নত করবে। বায়ুমণ্ডলের সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগগুলো থেকে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বনের জন্য অতি মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে এবং তা শুধু সময়ের ব্যাপার।

অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের ওই গবেষণা শেষে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলা হয়, 'কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সব কার্যক্রম শিগগিরই বন্ধ করা উচিত।'

বন ধ্বংসের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের কারণে পানির আধার ধ্বংসের কথা বলছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রচুর মিষ্টি পানির প্রয়োজন হয়। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পানি আসবে সংলগ্ন পশুর নদী থেকে। এ জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারীদের লবণাক্তমুক্তকরণ প্ল্যান্ট বসানোর প্রয়োজন পড়বে। পশুর নদী এমনিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। আর যদি মাটির নিচ থেকে মিষ্টি পানি তোলা হয়, তাহলে ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, প্রতি ঘণ্টায় রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ১৪৪ কিউসেক পানির প্রয়োজন পড়বে। এ ধরনের বড় প্রকল্পে সাধারণত দুই কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর নলকূপ বসানো হয়। এগুলোর প্রতিটির চারপাশে এক হাজার ফুটের মধ্যে আর কোনো নলকূপ বসানো যায় না। ১৪৪ কিউসেক পানি তোলার জন্য রামপালে ৭২টি গভীর নলকূপ বসাতে হবে।



বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই কেন্দ্রটি নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই। এসব সমস্যার একটি হলো পানি সমস্যা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনে ভুগর্ভস্থ পানি টেনে নেওয়ার কারণে এলাকাবাসী চাষাবাদ ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের পানি পাচ্ছেন না। গ্রামবাসীর অভিযোগ, বিদ্যুৎকেন্দ্রসংলগ্ন ১৪টি পাম্পের কারণে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার দুধিপুর, তেলিপাড়া, ইছবপুরসহ আশেপাশের গ্রামে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। পানি ছাড়াও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কঠিন বর্জ্য ছাইব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ২৫০ মেগাওয়াটের এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রতিদিন কয়লা জ্বালাতে হয় দুই হাজার ৪০০ টন। এতে ছাই হয় প্রতিদিন ৩০০ মেট্রিক টন। একাধিক পুকুরে এই ছাই প্রতিদিন জমা হচ্ছে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত চার বছরে মোটামুটি দুই লাখ ৬০ হাজার ৬১৩ টন আর্দ্র ছাই পুকুরে জমা করে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এসব পুকুরের চার ভাগের তিন ভাগের বেশি ছাইয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এই ছাইয়ের পানি চুইয়ে বিভিন্ন জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে, যা পরিবেশ দূষণ করছে। যেখানে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না, সেখানে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির ছাই কোথায় রাখা হবে?

এক মুখে দুই নীতি

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল হলে হারিয়ে যাবে বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয় ও ইরাবতি ডলফিন। যে ডলফিন শুধু বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার পশুর নদীতেই দেখা যায়। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাটের মংলা, চাঁদপাই ও শরণখোলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদী ও পশুর নদী চ্যানেলের শ্যাওলা নদীতে বিরল প্রজাতির ডলফিন গাঙ্গেয় ও ইরাবতির বাস। ডলফিন সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির স্বার্থে গত ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ওই অঞ্চলকে বন্য প্রাণী 'অভয়ারণ্য' হিসেবে ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ঘোষিত 'অভয়ারণ্য'-এর মধ্যে সাপমারি পড়েছে, যে অঞ্চলে পিডিবির প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রয়েছে। আইন অনুযায়ী, অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো ধরনের পানিদূষণ যা জলজ প্রাণী ও ডলফিনের আবাস নষ্ট করে এমন কিছু করা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে শুধু জলজ উদ্ভিদ নয়, ডলফিনের খাদ্য ও আবাস সম্পূর্ণই নষ্ট হবে।



বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ

সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যম বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করেছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ২০১১ সালের ২২ জুন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদারকে চিঠি দিয়েছে রামসার। রামসারের পাশাপাশি বন অধিদপ্তরের পক্ষে প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দীন আহমদ গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রামপালে সুন্দরবনের কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর। সচিবের কাছে লিখিত এক চিঠিতে বলা হয়, 'কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ রামসার কনজারভেশনে (Ramsar conservation) স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিকভাবে আরো বেশি দায়িত্বশীল। খুলনা অঞ্চল সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' প্রধান বন সংরক্ষকের ওই চিঠিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

ভারতের পরিবেশবাদীরাও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন। ভারতের প্রখ্যাত পরিবেশ আন্দোলনকর্মী বিটু সায়গলের একটি সাক্ষাৎকার গত ২ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব 'ডুবন্ত তরীর মতো' উল্লেখ করে বিটু সায়গল আরো বলেন, বর্তমান হারে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকলে সুন্দরবন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের এই ইস্যুতে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

২০১২ সালের ২২ মার্চ হাইকোর্টে কেন রামপালে বিদ্যুৎ নির্মাণ অবৈধ নয়- এ বিষয়ে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট সুন্দরবনের ভেতরে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তকে কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সর্বশেষ সুন্দরবন রক্ষায় ১০১ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনকে সদস্যসচিব করে ওই কমিটি গঠন করা হয়। দেশব্যাপী ও বিশ্বজুড়ে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিটি।



সবুজ বাঁচাতে লংমার্চ

তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ থেকে সরে আসার দাবিতে আগামী ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর লংমার্চ কর্মসূচি দিয়েছে। বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা ক্ষমতায় আসতে পারলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকেদেরও রয়েছে তীব্র আপত্তি। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের কেন্দ্রের কাজ উদ্বোধন সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে।



Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.