![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯১২ সালে নভেম্বর মাসে লন্ডনে ইন্ডিয়া সোসাইটির আনুকূল্যে ৭শ’ ৫০ খানা গীতাঞ্জলি (ইংরেজীতে song offerings) মুদ্রিত হয়। প্রধানত সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে বিতরণের জন্যই তা প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন আমেরিকায়। ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাকমিলান কোম্পানি বইটির প্রচার ভার গ্রহণ করে। এখানে উল্লেখ্য গীতাঞ্জলি বাংলা কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই কাব্যে ১ শ’ ৫৭ টি গান ও কবিতা আছে। যদিও ইংরেজী song offerings গ্রন্থ ও বাংলা গীতাঞ্জলি এক না, বইটিতে গীতালী,গীতিমাল্য,খেয়া,উৎসর্গ ইত্যাদি কাব্য থেকে কবিতা নেয়া হয়েছে। তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবি ডব্লু বি ইয়েটস বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন। এজরা পাউন্ড poetry পত্রিকায় লিখেছিলেন অভিসন্দর্ভ।
গীতাঞ্জলি কাব্য এক দীর্ঘ আবাহন ‘তুমি’র আবাহন, ‘আমি’র মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার জন্য ‘তুমি’র প্রতি আকুল আবেদন। কিন্তু এই ‘তুমি’ কোন প্রেমিক বা প্রেমিকা নয়,কোন ব্যক্তি বা ঈশ্বর নয়,‘আমি’র মধ্যে অবস্থিত দ্বিতীয়, আর এক ‘আমি’। এই ‘আমি’ মানুষের চৈতন্য সত্তা,অস্তিত্ববাদী দর্শনে যাকে মুক্ততা বা মুক্তিস্বরূপ বলা হয়ে থাকে। এই ‘তুমি’ ‘আমি’র মধ্যেই নিমজ্জিত এক সত্তা,যেন ‘আমি’র মধ্যে লীন অনাবিস্কৃত,নিগুঢ় এক ‘আমি’।
এক অস্পষ্ট ‘আমি’র দেড় শতাধিক কবিতাগুচ্ছ রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ,যার নাম দিয়েছেন গীতাঞ্জলি। গীতাঞ্জলির শুরুর কাবতায় কবি চেয়েছেন তাঁর স্বাভিমান বা অহঙ্কারকে চূর্ণ করতে,যে অহঙ্কার অবিদ্যা বা অবোধির মধ্যে তাকে আবদ্ধ রাখে। এই মিথ্যা অহংবোধের আবরণে চাপা পড়ে থাকে তাঁর প্রকৃত সত্তা, তাঁর মুক্ত চৈতন্য। কবির আপন প্রকৃত সত্তা বা সত্য ‘আমি’ হচ্ছে‘তুমি’। কবি তাঁর মিথ্যা ‘আমি’ কে নত করতে চান,এবং সত্য ‘আমি’ বা ‘তুমি’র প্রতিষ্ঠা; আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও তোমার চরণ তলে।’
এক কথায় বলা যায়, গীতাঞ্জলি এক অভিনব রাবীন্দ্রিক অস্তিত্ববাদী দর্শনের দলিল এবং একই সঙ্গে রবীন্দ্র কবি প্রতিভারও এক অসাধারণ নিদর্শন।
রয়টার (বার্তা সংস্থা) পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবরটি। এই খবরে বিশ্বময় বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ভাল, মন্দ, ভলো-মন্দের মিশ্রণে নানারূপ মতামত। ুদ্র একখানি কবিতার বই সেটাও আবার অনুবাদ, কী করে জগতের সর্বশ্রেষ্ট সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত বলে গণ্য হলো তারই গবেষণা শুরু হলো সারাবিশ্বে। সমসাময়িক এমন কোন সংবাদপত্র ছিল না যে, তাতে বাঙালি কবির নোবেল জয় এবং কৃতিত্বের সংবাদটি এবং এর সঙ্গে কিছু না কিছু মন্তব্য প্রকাশ হয়েছিল।
নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পান ১৫ নভেম্বর। কবি ছিলেন বোলপুর শান্তিনিকেতনে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ কলিকাতা থেকে টেলিগ্রাম মারফত খবরটি প্রেরণ করেন কবি জামাতা নগেন্দ্রনাথ, রান্নাঘরে সকলে যখন খাবার গ্রহণ করছিল তখনই তা উপস্থিত সকলকে জানান। এই খবরে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। কবি তখন রথীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথকে নিয়ে চৌপাহাড়ি শালবনে বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর হতে সমালোচনা চললো কবিকে নিয়ে, কবিতা নিয়ে নয়। কারণ বহু দেশের লেখকগণ এই পুরস্কারের আশায় ছিলেন। ব্যর্থ হয়ে তারা সকলেই কবিকে, কবির কবিতাকে এবং সুইডিশ একাডেমীকে আক্রমণ শুরু করে। একদলের আপত্তির কারণ রবীন্দ্রনাথ ককেশীয় শ্বেতাঙ্গ নন, তিনি অনুন্নত প্রাচ্যদেশীয়, তাঁর নামও উচ্চারণ করা কঠিন। পরাধীন ভারতের একজন কবিকে এই পুরস্কার! ইংরেজদের অভিযোগ, টমাস হার্ডি থাকতে বৃটিশের পদানত ভারতের এক কবিকে বিশ্বের সেরা পুরস্কার দেয়া হলো কেন? ফ্রান্সের অভিযোগ,আনাতোল ফ্রাঁসের মত সেরা বা তার মত বিশ্ববরেণ্য ঔপন্যাসিককে সম্মানিত না করে একজন এশিয়ানকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্মান দান করা হলো কেন! জার্মানরা রোসেগ্গার ( Rosegger) নামের একজন সাহিত্যিকের জন্য বহুকাল হতে প্রচার কাজ করছিল। তাদের মুখপাত্র জার্মানী একটি কাগজে ঘোষণা করল “The protest of all European nation will be raised against Rabindranath Tagore” শুধুমাত্র উষ্মা প্রকাশ করেই ক্ষুুব্ধ জাতীসমূহ ক্ষান্ত হলো না; তারা এর মধ্যে গুঢ়- অন্তর্নিহিত বিষয়টি অনুসন্ধান করতে লাগলো। ভিয়েনার একটি জার্মান ভাষার কাগজ (New Freie Press) লিখলো “This will remain the secret of the Judges in Stockholm” – তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত ইংরেজী দৈনিক Daily News and leader (২৪ নভেম্বর ১৯১৩) মন্তব্য করলো, সুইডস একাডেমীর সদস্যগণ প্রচীনপন্থী তাদের পে আনাতোল ফ্রাঁসের scepticism ও হার্ডির Pessimism বরদাস্ত করা কঠিন। আর একজন সম্পাদক ক্রুদ্ধ হয়ে লিখেছিলেন যে, ওইরূপ কবিতা যে-কেহ লিখতে পারতো! তবে ইউরোেেপর কয়েকজন সহিত্যিক Song offerings কে বাইবেল হিসেবে গণ্য করে মন্তব্য করেন।
ইংরেজী পত্রিকাগুলোতে তখন মন্তব্য লেখা হয় সুইডিশদের মধ্যে কেউ রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার কথা পূর্ব থেকেই জানতেন। ১৯১১ সালে জার্মান যুবরাজ (শেষ কাইজার উইলহেলমের জৈষ্ঠ পুত্র বা ক্রাউন প্রিন্স) ভারত ভ্রমণে আসেন;তিনি এ দেশ সম্বন্ধে বহু তথ্য সংগ্র্রহ করেন। এরপর আসেন সুইডেনের রাজকুমার উইলিয়াম। তিনি অবনিন্দ্রনাথের চিত্রশালা দেখতে এসে রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচিত হন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনী ‘যেখানে সূর্য আলো দেয়’ গ্রন্থে লেখেন, ÒIn all my life,I never spent moments so poignant as at the house of the Hindu poet Rabindranath tagore.” কে বাইবেল হিসেবে গণ্য করে মন্তব্য করেন।
ইংরেজী পত্রিকাগুলোতে তখন মন্তব্য লেখা হয় সুইডিশদের মধ্যে কেউ রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার কথা পূর্ব থেকেই জানতেন। ১৯১১ সালে জার্মান যুবরাজ (শেষ কাইজার উইলহেলমের জৈষ্ঠ পুত্র বা ক্রাউন প্রিন্স) ভারত ভ্রমণে আসেন;তিনি এ দেশ সম্বন্ধে বহু তথ্য সংগ্র্রহ করেন। এরপর আসেন সুইডেনের রাজকুমার উইলিয়াম। তিনি অবনিন্দ্রনাথের চিত্রশালা দেখতে এসে রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচিত হন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনী ‘যেখানে সূর্য আলো দেয়’ গ্রন্থে লেখেন, (D lit) উপাধিতে ভূষিত করেন(২৬ ডিসেম্বর ১৯১৩)।
নোবেল’ পুরস্কার ঘোষণার পর ভারতবর্ষের লোকজন বিস্মিত হয়েছিল। অনেক লেখক নিজ নিজ রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইংল্যান্ডে পাঠান; অনেক লেখকই ভেবেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ওই সরল গীতাঞ্জলি যদি পুরস্কারের উপযুক্ত হয়ে থাকে, তাদের রচনাই বা কেন হবে না।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণা মাত্রই ইউরোপের রাজনীতি-নিয়ন্ত্রক ধনিকশ্রেণী পরিচালিত পত্রিকাসমূহের সুর বদলে যায়। ১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলি প্রকাশের সময় থেকে ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে নোবেল’ পুরস্কার ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও দর্শন সম্মন্ধে যে সব সমালোচনা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে আর যাই থাক না কেন তাতে রাজনীতির কূটপ্রশ্ন ছিল না। ওই সময় গীতাঞ্জলির উপর আলোচনা-সমালোচনা করেন ইংল্যান্ডের সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ,এদের মধ্যে ছিলেন, লোয়েস ডিকিন্সনস,ষ্টপফোর্ড ব্রুক, আরনেস্ট রীহ্স, এডমন্ড গস, ল্যাসলে আ্যাবরকম্বি,স্টার্জ মূর, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এজরা পাউন্ড প্রমুখ। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর বৃটিশরা কবির সাহিত্যকর্মের চেয়ে কবির দেশ এবং কবিকে নিয়ে সমালোচনা শুরূ করে। এর সবই ছিল উদ্দেশ্যমূলক, শ্বেতবর্ণের ইউরোপয়িরা প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে কুন্ঠিত ছিল। কারণ এতে তাদের আধিপত্য খর্ব হয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পূর্র্র্বে যখন গীতাঞ্জলি’র ইংরেজী সংস্করণ ÔSong offerings’ প্রকাশিত হয়, তখন কিছু ইংরেজ সমালোচক ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীন গন্ডি (বা প্রাচীনধর্ম নিয়ে আলোচনা) অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সাহিত্যের সূত্রপাত করেছেন, এমন মন্তব্য করে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর, কবির ও তার কাব্যের যারা সমালোাচনা করেন তারা তৎকালীন ওই সময়ে রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদি ইংরেজ অর্টিষ্ট, সাহিত্যাঙ্গনের বা ভাবুক সমাাজের সেরা কেউ ছিলেন না ।
নোবেল’ পুরস্কারের সংবাদ পেয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি তাঁর বন্ধু রোটেনস্টাইনকে (শিল্পী রোটেষ্টাইনের লন্ডনের বাড়িতে song offerings শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইংরেজ কবি- সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা) চিঠি লেখেন। (১৮ নভেম্বর ১৯১৩)- “যে মূহুর্তে নোবেল পুরস্কার দানের সংবাদ পাইলাম, তদ্দন্তেই আমার অন্তর আপনার প্রতি ভালোবাসায় ও কৃতজ্ঞতায় স্বতই ধাবিত হইয়াছিল। আমি জানি আমার বন্ধুদের মধ্যে এই সংবাদে আপনার মত তৃপ্ত আর কেহ হইবেন না। যাহারা আমার অতিপ্রিয় তাহারা সুখী হইবে ইহাতেই পরম আনন্দ। কিন্তু এই সম্মান আমার পে বিষম পরীার বিষয় হইয়াছে। পাবলিক উত্তেজনায় রীতিমত যে ঘূর্ণিবায়ু উঠিয়াছে, তাহা বিভিষিকাময়। একটি কুকুরের লেজে টিন বাঁধিয়া দিলে, বেচারা নড়লেই যেমন শব্দ হয় এবং চরিদিকে লোকজন ভিড় জমে, আমার দশা তদ্রƒপ। গত কয়েক দিন টেলিগ্রাম ও পত্রের চাপে আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতেছে; যে সব লোকের আমার প্রতি কিছু মাত্র শ্রদ্ধা নাই বা যাহারা আমার রচনার একটি ছত্রও পড়ে নাই তাহারাই তাহাদের আনন্দজ্ঞাপনে সর্বাপো অধিক মুখর। এই সব উচ্ছ্বাস আমাকে যে কী পরিমাণ কান্ত করিয়াছে আমি বলতে পারি না, এই বাস্তবতার আধিক্য ভয়াবহ। সত্য কথা কী, ইহারা আমি যে সম্মান লাভ করিয়াছি, সেই সম্মান কে সম্মান দেখাইতেছে। আমাকে নহে।”
ইংরেজীতে গীতাঞ্জলি (Song offerings) প্রকাশের এক বছর পর নোবেল’ পুরস্কার ঘোষিত হয়। ইংল্যান্ডের রয়াল একাডেমির সদস্য T. Sturge Moore রবীন্দ্রনাথের নাম সুইডিস একাডেমীর নিকট নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে সুপারিশ করেন। ফরাসী সাহিত্যিকরা ওই বছর নাম পাঠান Emile Faguet (১৮৪৭-১৯১৬) এর নাম।
সুইডিস একাডেমীর সদস্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ‘নোবেল’ পুরস্কার দেবার জন্য মতপার্থক্য দেখা দেয়। সুইডিস লেখক Peir Hallastam এর উৎসাহ ছিল সর্বাধিক। এই সভায় Heidenstam (1859-1940) এর লিখিত বিবৃতি পাঠ করা হয়, এবং এর পরই গীতাঞ্জলি’র জন্য রবীন্দ্রনাথকেই নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য ঘোষণা দেয়া হয়। উল্লেখ্য Heidenstam ইংরেজি গীতাঞ্জলি সুইডিস ভাষায় রূপান্তর করেছিলেন। সুইডিস একাডেমির সদস্য Esais Tegner বাংলা পড়তে পারতেন। ওই বছর সুইডিস একাডেমীতে শুধুমাত্র গীতাঞ্জলীকেই চূড়ান্ত বিচারে উপস্থাপিত হয়েছিল।
নোবেল পুরস্কার সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক মনে করি। নোবেলে’র পুরা নাম আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। সুইডেনের রাজধানী স্টকহল্মে ১৮৩৩ সালে তাঁর জন্ম। ১৮৬৫-৬৬ সালে তিনি ডিনামাইট আবিস্কার করেন। আমেরিকার পেটেন্ট নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশ কয়েকটি ডিনামাইট কারখানা খোলেন এবং অঢেল ধন সম্পদের অধিকারী হন। ১৮৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি প্রায় বিশ লাখ পাউ- মূল্যের সম্পত্তি পাঁচটি পুরস্কার প্রদানের জন্য দান করে যান। (বর্তমান মূল্য প্রায় ৭’শ কোটি টাকা)। এই টাকার সুদ থেকে পদার্থ, রসায়ন,অর্থনীতি, চিকিৎসা, সাহিত্য ও বিশ্বশান্তির জন্য শ্রেষ্ট সাধাকদের ‘নোবেল পুরস্কার’ প্রদান করা হচ্ছে। পুরস্কারের মূল্য মান ৮ হাজার পাউন্ড। রবীন্দ্রনাথ তখন পান একলাখ ২০ হাজার টাকা।
সুইডিস একাডেমি নভেম্বের মাসের প্রথম ভাগে প্রতি বছর এই পুরস্কার ঘোষণা করে থাকে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে ১২ বছরে সাহিত্যে ৪ জন জার্মান, তিন জন ফরাসি, একজন সুইডিস, একজন নরওয়েজিয়ান, একজন পোলিস এবং একজন ইংরেজ নোবেল পুরস্কার পান।
কলিকাতা থেকে প্রকাশিত Empire (সান্ধ্য দৈনিক) পত্রিকায় রয়টার এর বরাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর প্রকাশিত হয়(১৩ নভেম্বর ১৯১৩)। প্রত্রিকাটিতে লেখা হয়, “It is the first recognition of the indigenous literature of the Empire as a world force. It is the first time that am Asiatic has attained distinction at the hands of the Swedish Academies and this is the first occasion upon which the £ 8000 Prize has been awarded to a poet who writes in a language so entirely foreign to the awarding Country is to Sweden. খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্র ভক্তরা কবিকে বিশেষভাবে সম্মানিত করবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যদিও কলিকাতার রবীন্দ্র ভক্তরা টাউন হল প্রাঙ্গণে কবিকে সংবর্ধনা দেয়ার মনস্থির করেছিলেন। নভেম্বর মাসে কবি বিলেত থেকে ফিরলেই অনুষ্ঠান করা হবে এমন আয়োজন চলছিল। কিন্তু এই সংবর্ধনার আনন্দ আরও বহুগুণে বেড়ে গেল যখন ‘নোবেল’ পুরস্কার প্রপ্তির খবরটি কলিকাতাবাসী পেলেন। ২৩ নভেম্বর একটি বিশেষ ট্রেনে কলিকাতা থেকে প্রায় ৫শ’ রবীন্দ্রভক্ত শুভার্থি বোলপুরে শান্তি নিকেতনে উপস্থিত হন। শান্তিনিকেতনের আমবাগানে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এই দলের প্রধানদের মধ্যে ছিলেন, বিচারপতি আশুতোষ চৌধুরী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র বসু, ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, মৌলভি আবুল কাশেম, অধ্য সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূশন, পূরনচন্দ্র নাহার, ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র প্রমুখ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প থেকে এবং ব্যাক্তিগতভাবে কবিকে পুষ্পার্ঘ প্রদান করা হয়। ফুলে ফুলে ভরে যায় বিরাট মঞ্চটি। নানা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের দেওয়া শ্রদ্ধাঞ্জলিতেও কবি নিশ্চুপ মঞ্চে বসে ছিলেন। সেদিনের শ্রদ্ধা নিবেদনে বাঙালির কোন কপটতা ছিল না। সবারই মনে গর্বের উদ্রেক হয় যে, বৃটিশ পদানত ভারতের সুসন্তান রবীন্দ্রনাথ একটি স্বাধীন দেশ থেকে প্রতিভার যথোচিত সম্মান পেয়েছেন। এতে ভারতবর্ষ ও বাঙালিরা গর্বিত।
কবি প্রতিনিধিদের ভাষণের উত্তরে যে ভাষণ দেন, তা অনেকেরই ভাল লাগেনি, কারণ তিনি তার সমালোচকদের সম্পর্কেও কিছু রূঢ় কথা বলেছিলেন। যদিও এই ভাষণ আবার অনেকের কাছে ভালও লেগেছিল। তিনি বলেন, “আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হইয়াছেন তা অসংকোচে সম্পুর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই। ...... যাঁরা জনসাধারণের নেতা, যাঁরা কর্মবীর সর্বসাধারণের সম্মান তাঁদেরই প্রাপ্য এবং জন পরিচালনার কাজে সেই সম্মানের তাঁদের প্রয়োজনও আছে। যাঁরা লক্ষ্মীকে উদ্ধার করার জন্য বিধাতার মন্থনদন্ডস্বরূপ হয়ে মন্দার পর্বতের মতো জনসমুদ্রে মন্থন করেন, জনতা-তরঙ্গ উচ্ছ্বোসিত হয়ে উঠে তাঁদের ললাটে সম্মান ধারায় অভিষিক্ত করবে এটাই সত্য, এইটেই স্বাভাবিক।
“ কিন্তু কবির সে ভাগ্য নয়। মানুষের হৃদয় েেত্রই কবির কাজ এবং সেই হৃদয়ের প্রীতিতেই তার কবিত্বের সার্থকতা। কিন্তু এই হৃদয়ের নিয়ম বিচিত্র- সেখানে কোথাও মেঘ কোথাও রৌদ্র। অতএব প্রীতির ফসলই যখন কবির দাবি তখন এ কথা তার বলা চলবে না যে, নির্বিশেষে সর্বসাধারণেরই প্রীতি তিনি লাভ করবেন। যাঁরা যজ্ঞের মোহাগ্নি জ্বালাবেন তাঁরা সমস্ত গাছটাকেই ইন্ধন রূপে গ্রহণ করতে পারেন; আর মালা গাঁথার ভার যাঁদের উপরে তাদের অধিকার কেবলমাত্র শাখার প্রান্ত ও পল্লবের অন্তরাল থেকে দ’ুটি চারটি করে ফুল চয়ন করা।
“ কবি বিশেষের কাব্যে কেউ বা আনন্দ পান, কেউ বা উদাসীন থাকেন, কারো বা তাতে আঘাত লাগে এবং তারা আঘাত দেন। আমার কাব্য সম্বন্ধেও ওই স্বভাবের নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়নি এ কথা আমার এবং আপনাদের জানা আছে। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁচেছে তার পরিমাণ অল্প হয়নি এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কিজন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভালো করে উপলব্ধি করতে পারিনি। আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে বসে যাঁকে পূঁজার অঞ্জলী দিয়েছিলেম তিনিই সমুদ্রের পশ্চিম তীরের সেই অর্থ গ্রহণ করবার জন্য যে তাঁর দণি হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে কথা আমি জানতুম না। তাঁর সেই প্রসাদ আমি লাভ করেছি- এই আমার সত্য লাভ।
“যাই হোক, যে কারণেই হোক, আজ য়ুরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনো মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানের গুণীজনের রসবোধই আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোন আন্তরিক সম্বন্ধ নেই ‘নোবেল’ প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রসবৃদ্ধি করিতে পারে না।
“অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? এ সম্মান আমি কতদিনই বা রা করব? আমার এ দিন তো চিরদিন থাকবেনা, আবার ভাঁটার বেলা আসবে, তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।
“তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড় জানাচ্ছি- যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া, তা আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। কোনো কোনো দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়া অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা যা দিলেন তা আদর করে ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমার চিত্তকে আমি দূরে রাখতে চাই। আমার রচনার দ্বারা আপনাদের যাঁদের কাছ থেকে আমি প্রীতি লাভ করেছি, তাঁরা আমাকে অনেক দিন পূর্বেই দুর্লভ ধনে পুরস্কৃত করেছেন, কিন্তু সাধারণের কাছ থেকে নতুন সম্মান লাভের কোনো যোগ্যতা আমি নতুন রূপে প্রকাশ করেছি এ কথা বলা অসংগত হবে।
“যিনি প্রসন্ন হলে অসম্মানের প্রত্যেক কাঁটাটি ফুল হয়ে ফোটে প্রত্যেক পঙ্কপ্রলেপ চন্দনপঙ্কে পরিণত হয় এবং সমস্ত কালিমা জ্যোতিষ্মান হয়ে ওঠে তাঁরই কাছে আজ আমি এই প্রার্থনা জানাচ্ছি- তিনি এই আকস্মিক সম্মানের প্রবল অভিঘাত থেকে তাঁর সুমহান্ বাহুবেষ্টনের দ্বারা আমাকে নিভৃতে রা করুন।”
রবীন্দ্রনাথের এই বক্তৃতায় অতিথিদের অনেকেই অত্যান্ত মর্মাহত হন। অতিথিরা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভোজপর্ব ত্যাগ করে কলিকাতার উদ্দেশ্যে বোলপুর ষ্টেশনে যান ট্রেনের উদ্দেশ্যে। অথচ কলিকাতা থেকে মিষ্টান্ন তৈরী করার জন্য নামকরা করিগর নেয়া হয়েছিল। প্রচুর লুচি, কচুরি, লাড্ডু, রসগেল্লা তৈরী করা হয়েছিল। পরে অতিথিদের জন্য শান্তিনিকেতনের ছাত্ররা সেগুলো মাথায় চাপিয়ে প্রায় তিন মাইল দূরবর্তী বোলপুর ষ্টেশনে অতিথিদের নিকট পৌঁছে দেয়। এ নিয়ে কলিকাতার সংবাদ পত্রে তখন ব্যাপক লেখা লেখি হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা নিয়ে যারা সমালোচনা করতেন তারাও শেষ পর্যন্ত নোবেল’ পুরস্কার প্রাপ্তির পর কবির লেখার গুণ-গান করেন। সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক এবং কবি সাহিত্যিকগণ। তাঁরা কবির লেখায়, শব্দ দুষণ, প্রসাদগুণের অভাব, ভাবের উচ্চতার অভাব ইত্যাদিসহ আরও লিখেছিলেন, ‘সহজে তার কবিত্ব বোঝা যে সে লোকের কর্ম নহে এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে তারা কলকাতাই ভাষা’ হিসাবে বিদ্রুপ করেন।
আশ্চর্য হলেও সত্য যে বিপিনচন্দ্র পাল যিনি বঙ্গদর্শন প্রত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা, কল্পনা সাধনাকে ফাঁকি বলে বিরুপ মন্তব্য করেছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন করেন এবং তার রচনার প্রশংসা করে Hindu Review নামের একটি মাসিক প্রত্রিকায় মন্তব্য লেখেন, No man of Rabindranath’s Position and Sensibilities could have been bitter under similar circumstances. সংবাদপত্রে দীর্ঘ সময় যাবৎ রবীন্দ্রনাথের উক্ত ভাষণের সমালোচনা প্রকাশ হতে থাকলেও কবি তার ভাষণের জন্য দু:খ প্রকাশ করেননি এবং সংবাদপত্রের সমালোচনা জবাবও দেননি।
সাদা কালো
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০১
পাবনা বেষ্ট বলেছেন: আমরা পারি................