![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তখন বর্ষাকাল। ২০০৩ সাল। একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের বেডে শুয়ে জীবনের শেষ সময় কাটাচ্ছিলেন আমার মা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, বহুতল ভবনের শ্যওলামাখা দালান বেয়ে একটানা ভেসে পড়ছে বৃষ্টির জল।
গভীর রাত। ঢাকার রাস্তা তখন নীরব হয়ে পড়েছে। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি একবার উপর তলা, একবার নিচতলা, সবার ঘুমন্ত চেহারাগুলো দেখে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু মা যে ঘরটিতে, সেখানে যাবার সাহস আমার হচ্ছিল না। মা’র এলোমেলো বিভৎস মুখাবয়ব, অস্বাভাবিক ফেঁপে যাওয়া শরীর, হাতে বিভিন্ন রকমের সিল, শরীরে প্যাঁচানো অগনিত নল- ওসব দেখে আমার মাথা গুলিয়ে যায়। পেট পাকিয়ে আসে। ওর চেয়ে যে মা’কে আমি ছোট থেকেই চিনে এসেছি, তার সেই ছবিটি মনে ধরে রাখাই ভাল।
২
ক্লাস সিক্স এ পড়ি তখন। আমি যেঘরে পড়তাম, তার ঠিক পাশেই পূজার ঘর। নতুন নতুন হাইস্কুল। পড়াশোনার অনেক আগ্রহ। ক্লাসে ভালছাত্র হবার প্রবল ইচ্ছা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই বই নিয়ে বসে পড়ি। পাশের ঘরে মা পূজা করেন। পাঁচালী পড়েন। মা’র হাতের শাখার আওয়াজ ভেসে আসে আমার কানে। এগুলো পড়াশোনার মনোযোগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
প্রথম স্কুলে যাবার দিনটা পুরোপুরি মনে নেই। তবে কিছুটা এখনও মনের পাতায় ভাসে। নীল রঙ্গা প্যান্ট আর সাদা সার্ট পড়ে প্রথম দিন একটি একচালা স্কুলে গিয়েছিলাম আমি মা’র হাত ধরে।
রাতে ঘুমোতাম মা’র সাথে। প্রায় রাতেই বেশ ভালই ঘুমোতাম। মাঝে মাঝে ঘুম আসতে চাইত না। গভীর রাতে মাকে বলতাম, মা, ঘুম আসে না। মা তখন তার কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। আমার আবার লজ্জাও করত। টু বা থ্রি তে পড়তাম তখন। ভাবতাম, অনেক বড় হয়ে গ্যাছি। এখনও আমাকে এভাবে ঘুম পাড়াতে হয়। তবে ভাবনা-চিন্তুা যাই করি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তাম মা’র মায়াবী পরশে।
৩
আমার মায়ের চেহারাটা ছোট থেকেই আমার কাছে দেবীর মত লাগত। ফর্সা চেহারা, কপালে সিঁদুর – একেবারেই যেন আরাধ্য দেবী। দিনদিন এত বেশি মা নির্ভর হয়ে পড়ছিলাম যে আমার মা নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন। খামখেয়ালী স্বভাবের ছিলাম ছোট থেকেই। প্রায়ই বই, কলম, খাতা, স্কুলের ড্রেস, জুতার মোজা ইত্যাদি ইত্যাদি খুঁজে পেতাম না। যখনই চিত্কার শুরু করতাম ঠিক তখনই মা প্রয়োজনীয় জিনিসটি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াতেন। বকাবকি করতেন না। কিন্তু আমি নিজেই খুব ভয় পেয়ে যেতাম। মায়ের চেহারাটা এমন, যেখান থেকে প্রয়োজনের সময় সাহস নেয়া যায়, বিপদে আশ্রয় নেয়া যায়, অপরাধ করলে শাসন নেয়া যায়, বাঁচার জন্য ভালবাসা নেয়া যায়। যারা নিতে পারেনা তারা দুর্ভাগা।
৪
২০০৩ এর শুরুর দিকে। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গ্যালো আমার। মা’র দম আটকানো একটানা কাশির কর্কশ শব্দে জেগে উঠলাম। মা গলায় হাত দিয়ে কাশছিলেন, শ্বাস টানার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। পারছিলেন না। বিচলিত হয়ে পড়লাম আমি।আমি তখন অনেক ছোট। কী করা উচিত্, বুঝতে পারছিলাম না। বাবা দ্রুত রিক্সা জোগাড় করলেন। রাত অনেক। চারপাশ নীরব। এমনিতে রাতে আমার প্রচুর ভয় করত। কিন্তু সে রাতে আমার কোন ভয় ছিল না। ভয় কোথায় যেন উবে গিয়েছিল।
চিকিৎসা চলতে লাগল। কিন্তু সেই সর্বনাশা বিভৎস কাশি প্রায় প্রায়ই মা’র কাছে ফিরে আসত। একটা সময় এমন হয়ে গিয়েছিল, কারও কাশি শুনলেই আমি আতকে উঠতাম।
মধ্যবিত্ত পরিবার মানেই মাসের শুরুতে বেতনের টাকা হাতে পেলে গোটা মাসের পরিকল্পনা করে নেওয়া। মধ্যবিত্ত পরিবার মানেই না পাওয়া গুলোকে মেনে নেওয়া। খুব কষ্ট পেলে লোক না দেখিয়ে আড়ালে কাঁদা।
আমিও একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। মা’র চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রচুর টাকা খরচা হচ্ছিল। সারা মাসের পরিকল্পনাগুলো ভেঙ্গে যাবার হতাশা মা’র চোখে-মুখে বেশ ভালই ফুটে উঠেছিল। আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু এ অব্যক্ত কষ্টগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হত না।
চিকিৎসায় যক্ষা ধরা পড়ল মা’র। বিকট আকারের একগুলো ইংজেকশন দেয়া হত মা’কে ।মা ওগুলো দিতে চাইতেন না। খুব ব্যথা পেতেন হয়ত।
কিন্তু মা’র শরীর স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনতি ঘটতে লাগল। শেষে অন্য ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসা করানো শুরু হল। চিকিৎসায় ধরা পড়ল, এতদিন মা’র ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে। কিন্তু ভুল চিকিৎসার দরুণ মা’র অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। আক্রান্ত হয়ে গ্যাছে মা’র লিভার। সম্ভবত লিভার ক্যান্সার।
তাঁকে নিতে হল ভারতে। উন্নত চিকিৎসার জন্য। ভারতে যাবার আগে একবার এসেছিলেন বাসায়। অসুস্থ অবস্থায়। ঠিকমত হাটতে পারতেন না। খুব কষ্ট করে কথা বলতেন। সেই তার সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর মা’র সাথে আমার দেখা হয় তার মৃত্যুশয্যায়।
সেই সময় ভারতীয় টাকায় দিনে প্রায় দশ-বার হাজার টাকা খরচা পড়ত মা’র চিকিৎসার জন্য। এদিকে আমাদের ব্যাংকের তিলেতিলে জমানো টাকা পয়সাগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হাত দিতে হল জমি-জমাগুলোর উপরে। দ্রুত টাকা দরকার। এ অবস্থার সুযোগ নিল সুবিধাভোগী কিছু মানুষ। তারা খুবই পরিচিত। কিন্তু আজ তারা যেন বড়ই অচেনা। তাদের একসময়ের হাসি হাসি মুখগুলোতে এখন অহমিকার ভাব। অনেক সকালে উঠে আমি আর আমার দিদি তাদের বাসায় যাই, বলি, যে করেই হোক, এই জমিটা কেনার একজন মানুষ ঠিক করে দেন। টাকাটার খুব দরকার। না হলে মা…..।
তাদের বাসা থেকে এসে স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলে যেতাম। ক্লাস করতাম।
৫
বেশ কয়েকদিন চিকিৎসার পর মা’কে আবার ঢাকায় আনা হল। এদিকে বাবা দিনদিন এলোমেলো হয়ে পড়ছিলেন, খুব বউপাগল মানুষ ছিলেন তো, তাই।
আমি বাসায়। ঢাকা থেকে বাসায় ফোন এল, সবাই সহ ঢাকায় চলে আসার জন্য।
পরদিন সবাই চলে এলাম ঢাকায়। এলেন না শুধু বাবা।
জুলাই মাসের ২৫ তারিখ। ভোরবেলা। পাশের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
ডাক্তার এসে মা’র মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিলেন। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে চলে গ্যালেন। মা’র দেবীর মত ফর্সা মুখমন্ডলটি তখন কালো হয়ে গিয়েছিল। এত কালো মা’র শরীরে যে কোথা থেকে এল।
৬
শ্মশান ঘাটে মা পুড়ছে। উড়ন্ত ধোঁয়াগুলোর দিকে আমি হাত নাড়ছি ।শেষ বিদায় জানাচ্ছি। আর কখনও দেখা হবে কি না তা তো আর জানি না!
আজ প্রায় দশ বছর হতে চলল মা চলে যাওয়ার। মৃত মায়ের সর্বাংশে এমন এক পবিত্রতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায়, যাকে হৃদয়ে ধারণ করে একজন সন্তান সারা জীবন পার করে দিতে পারে।
একেবারেই ব্যক্তিগত কিছু কথা লিখলাম। মা চলে যাবার প্রায় দশ বছর পর মা’কে আরও একবার একেবারে শুরু থেকে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম।
লেখাটা ব্লগে দেবার কোন ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু তবুও দিলাম। কারণ, আমরা এখন এমন অবস্থায় আছি, যেখানে সন্তানরা শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে তাদের মা’কে ক্ষত-বিক্ষত করছে প্রতিদিন। মা বেঁচে থাকতে মায়ের মর্ম না বুঝলে এরপর শত ডাকাডাকি করলেও আর মা’কে ফিরে পাওয়া যাবে না। সবার কাছেই অনুরোধ, এই মা’টাকে বাঁচান। না হলে, মা হয়ত আপনাদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ঈশ্বর কোনদিনও ক্ষমা করবেন না।।
২৭ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৪৪
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ নাহিদ ভাই ।।
২| ২৭ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৪৩
রুদ্র মানব বলেছেন: খারাপ লাগলো পড়ে , জীবন আসলেই এক কঠিন রঙ্গমঞ্চ। আপনার মায়ের আত্নার প্রতি শুভকামনা রইলো।
২৭ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৪৫
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: জীবন আসলেই এক কঠিন রঙ্গমঞ্চ। শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ ।।
৩| ২৭ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৮:৪৭
কালোপরী বলেছেন: আপনার মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি
২৭ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৪৬
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: ধন্যবাদ কালোপরী। শুভকামনা রইল আপনার জন্যও।।
৪| ২৮ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১:০৬
আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
আপনার মায়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
২৮ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৫৫
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ দূর্জয় ভাই ।।
৫| ২৮ শে মার্চ, ২০১৩ ভোর ৫:১৪
S. M. Sabbih Hossain বলেছেন: হারানোর অভিজ্ঞতা প্রায় সবার ই আছে, তবে মা হারানোর অভিজ্ঞতা যার নেই, সেই বোদ হয়, সব চেয়ে সুখীদের একজন। আপনার জন্য সমবেদনা। ভাল থাকুন ...
২৮ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৫৬
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: ঠিকই বলেছেন।
সমবেদনার জন্য ধন্যবাদ ।।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে মার্চ, ২০১৩ ভোর ৬:৫০
নাহিদ তানভীর বলেছেন: আপনার মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি ...