নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে ...

পেলব চক্রবর্তী

ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম...

পেলব চক্রবর্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নীল স্বাধীনতা

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:২৩

আজ রিনির মনটা বড়ই খারাপ।



খুব বাজেভাবে বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে।



দুদিন ধরে অনেক যত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা লালরঙ্গা জামাটায় কালো চিটচিটে একটা দাগ পড়ে আছে। কিভাবে পড়ল কে জানে।



আজ পাপিয়ার জন্মদিন। রিনির সবথেকে ভালো বন্ধু।ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিজের পছন্দের জামাটা পড়ে যেতে না পারলে তার থেকে দুঃখের আর কিছুই হয় না।



মা এ নিয়ে আবার রাগ করেছে। ‘একটা জামা নষ্ট তো আরেকটা জামা পড়ে যাবি…’ বেশ কড়াভাবে জানিয়ে দিয়েছে মা। কিন্তু মা বুঝতে পারেনা যে রিনি এখন অনেক বড় হয়েছে। ক্লাস এইটে পড়ে। ছোটবেলা রিনির পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা ছিল না। কিন্তু এখন তো ওর পছন্দের একটা দাম আছে।



বিকেল গড়িয়ে এল। পাপিয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে হলে এখনই রওনা দিতে হবে। কিন্তু পছন্দের জামা নষ্ট হয়ে গ্যাছে। তাই রিনি আর যাবে না-সে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবন্ধ।



দরজা খুলে গেল। পায়ের মৃদু একটা শব্দ তুলে এগিয়ে এল বাবা।



রিনি তাকালো বাবার দিকে। বাবার চোখ-মুখে কৌতুকমিশ্রিত হাসি।



বাবার পেছনে জড়ানো হাত দুটো সামনে আনার সাথে সাথেই রিনির চোখে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল লাল রঙ্গের একটা জামা। কি যে অদ্ভুত সুন্দর সে জামাটা।রিনির মন গলে গেল। এতক্ষণের কষ্টেও কান্না পায়নি, কিন্তু নতুন জামাটা পেয়ে রিনির চোখে জল চলে এল।



তবে বাবার জন্য কষ্টও হতে লাগল রিনির। এই বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে বাবা নতুন জামা কিনতে গ্যাছে শুধু মেয়ের কারণে। এ বোধহয় একমাত্র বাবার পক্ষেই সম্ভব।



তবে রিনিকে যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, তুমি বাবাকে বেশি ভালোবাসো, নাকি মা বেশি ভালোবাসো।



রিনি অন্যের সামনে এ উত্তর দেবে না। কিন্তু মনে মনে উত্তর দিতে হলে সে মা’র কথাই বলবে। তবে বাবাকে যে ভালোবাসেনা, তা নয়। তবে মা ব্যাপারটাই আলাদা। এর সাথে কোন কিছু্রই তুলনা হয় না।









রিনি শহরের এক নামকরা স্কুলে পড়ে।



সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে হয়।



স্কুলের প্রধান দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে দাড়োয়ান চাচ্চু। শুকনো, উস্কো-খুস্কো চেহারা, পরণে একটা ময়লা ঈষৎ হলদে ইউনিফর্ম। সেই ছোট থেকেই দাড়োয়ান চাচ্চুকে দেখে আসছে রিনি, কিন্তু কোনদিন তাকে কারও সাথে খুব ভালোমতো কথা বলতে দেখে নি।



কিন্তু রিনির সাথে দাড়োয়ান চাচ্চুর বেশ ভাব। রিনিকে দেখলেই দাড়োয়ান চাচ্চু গাল ফুলিয়ে হাসি দেয়। মাঝে মধ্যে চকলেট দেয় রিনিকে।



ছোটবেলায় নির্বিবাদে রিনি দাড়োয়ান চাচ্চুর চকলেট নিত। কিন্তু এখন ও অনেক বড়। তাই আর চকলেট নিতে ইচ্ছে করে না।



স্কুল ছুটি হয় দুপুরে। বাড়ি আসার সময় রিনি লক্ষ করল, একজন কর্মচারী দাড়োয়ান চাচ্চুর সাথে খুব বাজেভাবে কথা বলছে। রিনি বুঝতেই পারে না, একজন লোক কিকরে তার বাবার বয়েসী একজন লোকের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে।



রিনি এগিয়ে গেল। বলল, ‘দাড়ান, আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন ওনার সাথে। উনি তো আপনার বাবার বয়েসি। ওনার সাথে ভালো করে কথা বলুন।’



লোকটি বলল,‘শোন খুকি, তুমি ছোট মানুষ। তুমি এসবের মধ্যে এসো না। যাও, বাসায় যাও।’



রিনি আবার বলল, ‘আমি বাসায় যাবো না। আমি হেডস্যারের কাছে আপনার নামে কমপ্লেইন করব।’



‘তুমি আমার নামে কমপ্লেইন করবে। জানো ও কি করেছে ?’



কথা কাটাকাটি শুনে এগিয়ে এলেন হেডস্যার। রিনি হেডস্যারকে খুব ভয় পায়। কিন্তু আজ আর ভয় পেল না। হেডস্যারকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। ভাবল, হেডস্যার নিশ্চই এর একটা বিহিত করবেন।



রিনি বিস্মিত হল। হেডস্যার লোকটিকে কিচ্ছু বলল না। বরং দাড়োয়ান চাচ্চুকেই বকা দিল বাজেভাবে।



রিনিকে চলে যেতে হল ওখান থেকে।



রিনি আগেও খেয়াল করেছে, হেডস্যার বিনা কারোনেই দাড়োয়ান চাচ্চুর উপর রেগে যান। কারণে-অকারণে বকাবকি করেন। আর হেডস্যারের দেখাদেখি অন্যরাও দাড়োয়ান চাচ্চুর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে।









পরীক্ষা চলে এসেছে। পড়াশোনার অনেক চাপ।দিনরাত শুধু পড়াশোনা নিয়েই থাকতে হচ্ছে। এভাবে কি জীবন চলতে পারে।



ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছে রিনি। রিনির কখনওই ছেলে-মেয়েরা সব একসাথে মিলে ফুল তুলতে যাবার সুযোগ হয়নি। কিংবা ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাবারও সুযোগ হয়নি। ও ছোট থে্কেই শুধু পড়াশোনাই করছে।কখনও ছবি আঁকা শিখেছে। কখনও গানের ক্লাসে গিয়েছে। কখনও বা নাচের ক্লাসে। আর প্রতিটি ক্লাসে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার দুশ্চিন্তা ওর নিত্যসঙ্গী।



প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। দাড়োয়ান চাচ্চুর দেখা নেই।



অসুখ-বিসুখ হয়েছে নাকি।



কার কাছ থেকে জানা যাবে তার খবর। এমন তো কেউ নেই যে তার খবর বলতে পারবে।



রিনি ভাবতে লাগল। ও নিজেই যাবে দাড়োয়ান চাচ্চুর বাড়ি।



স্কুল ছুটি দিল দুপুরে।



স্কুলের অফিস থেকে জানা গেল তার ঠিকানা। কিন্তু ও দিকটা ভালোমত চেনেনা রিনি। কখনও যায়ও নি। তবুও যেতে হবে ওখানে। যে করেই হোক।



বাসায় না গিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে ও চলল দাড়োয়ান চাচ্চুর বাড়ির খোঁজে।



জায়গাটা বেশ নোংরা। ছোট ছোট রাস্তা। দুটো রিক্সা পাশাপাশি চলতে পারবে না।রাস্তার পাশে ভাঙ্গা ড্রেন। সেখান থেকে উৎকট গন্ধ আসছে। নাক চেপে হাটতে হয়। খুব বেশি লোকজনও দেখা যায়না এখানে। আশেপাশে কয়েকটা বস্তি। তবে বেশ রহস্যময় একটা ব্যাপার আছে সবকিছুতে।



তখন ভরদুপুর।রিনির একটু একটু করে ভয় লাগতে শুরু করল। ভাবল, একা একা এভাবে কাউকে না জানিয়ে এতদূর আসাটা ঠিক হয় নি।



কিন্তু ভয় পেলে চলবে না।মনে সাহস আনার জন্য ভাবতে লাগল, আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। আমার কি আর বাচ্চাদের মত ভয় পাওয়া মানায়।



পাশ দিয়ে একজন হকার গলায় বিকট শব্দ তুলে এগিয়ে গেল।



সামনে একটা চা-পানের দোকান। এখানেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।



দোকানটা ছোট। দুজন মধ্যবয়েসী মানুষ বসে আছে।



রিনি বেশ ভরাট গলায় বলল, এখানে কি দাড়োয়ান চাচ্চু থাকেন? মানে শহীদ আনোয়ার হোসেন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যিনি দাড়োয়ান, তিনি কি এখানে থাকেন?



দোকনদার, দোকানে বসা দুজন লোক, সবাই রিনির দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।



রিনির অস্বস্তি বোধ হয়।



গলায় ইচ্ছাকরে কাশি এনে রিনি আবারও একই প্রশ্ন করে।



এবার যেন লোকগুলো সম্বিত ফিরে পায়।



একজন বলে ওঠে, উনি তো এদিকে নয়। একটু পাশে অন্য গলিতে থাকেন।



রিনি বলল, আমাকে দেখিয়ে দিতে পারবেন?



‘হ্যা, পারব না কেন? কিন্তু আপনি কে? আর শহিদুল মিয়ার খোঁজ কেন করছেন। তার খোঁজে তো কখনও কেউ আসে না।’



‘আসে না তো কি হয়েছে? আজ আমি এসেছি। আপনি কি আমাকে দেখিয়ে দেবেন?’ দৃপ্ত কন্ঠে বলল রিনি।



‘দেখিয়ে দিলে যেতে পারবেন না। আপনি আমার সাথে চলুন। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’



রিনির ভেতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। যা দিনকাল পড়েছে। এই লোকটাকে বিশ্বাস করে কি যাওয়া ঠিক হবে?



এদিকে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির দিন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মাথার উপর এখন কড়কড়ে রোদ্দুর।



হঠাৎ রিনির ভয় পেতে লাগল। ওর মনে হল কেউ ওর হাত ধরেছে শক্ত করে। অন্য একটি হাত ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু রিনি হাতটা সরিয়ে নিল সজোরে।



রিনি দৌড়োচ্ছে। লোকটা দৌড়োচ্ছে রিনির পিছুপিছু।



রিনি প্রাণভয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।লোকটা ওকে ধরে ফেলছে…।



রিনির মাথা ঘুরছে।রিনি সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ও ছিল এতক্ষণ। আসলে এমন কিছুই হয়নি।



মধ্যবয়েসী লোকটা রিনির চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। রিনি চোখ খুলে দেখল, লোকটা হাসছে। উজ্জ্বল তার হাসি। কি সুন্দর একটা মানুষ। তার সম্পর্কে যে এতক্ষণ ও এসব ভেবেছে, সেজন্য রিনির লজ্জা পেতে লাগল।



রিনি উঠে দাঁড়ালো। এখন আর ওর কোন সমস্যা হচ্ছে না।







নোংরা শ্যাওলা পড়া ঘর।মাথার উপর টিনের চাল।ওতে বেশ কয়েকটা ফুটো। দরজা জানালা বন্ধ থাকলেও চালের ফুটো দিয়ে সরু পথে রোদ এসে ঘরটাকে কিছুটা উজ্জল করেছে।



কিন্তু এবারের বর্ষায় ঘরটার যে কি হাল হয়েছিল, আর তাতে কি করেই বা মানুষ ছিল, তা বোধহয় সৃষ্টিকর্তাই জানেন।



বেশ নোংরা বিছানা, উৎকট একটা গন্ধ আসছে সব কিছু থেকে।



একটা হাড় জিরজিরে মানুষ মরার মত পড়ে আছে বিছানায়। অনেক কাছে গিয়ে দেখে রিনি বুঝল এটা দাড়োয়ান চাচ্চু।



চমকে উঠল রিনি। দাড়োয়ান চাচ্চুকে তো চেনাই যায় না। এ তার কি হাল হয়েছে!



এখানে এভাবে পড়ে থাকলে সে নিশ্চই মারা যাবে। তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার।



রিনি তার সাথে আসা মধ্যবয়েসী লোকটাকে বলল দাড়োয়ান চাচ্চুকে হাসপাতালে নেবার জন্য। লোকটার মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, হাসপাতালে যে ভর্তি করাবেন, টাকা-পয়সা কে দেবে? ওর তো ত্রিকূলে কেউ নাই যে ওকে দেখবে।



শুধু টাকার জন্য একটা মানুষ মারা যাবে, একথা রিনি ভাবতেও পারেনা। ও বলল, ‘টাকার ব্যবস্থা আমি করব। আপনি ওনাকে দয়াকরে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করুন।’



নোংরা বিছানার চাদরের নিচে একটি কুচকানো কাপড় পাওয়া গেল। রং জ্বলে গেছে। ঠিক মত বোঝাও যাচ্ছে না। সেটিকে চোখের খুব কাছে নিয়ে এল রিনি।এটা তো পতাকা।ছিন্ন পতাকা। আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।









-‘হ্যালো বাবা, আমি রিনি। আমি এখন সদর হাসপাতালে। তুমি আসবে এখানে?’



-‘তুমি ওখানে কি করছ মা? আমি গোটা শহর তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’



-‘বাবা, আমি একজন রুগী নিয়ে এসেছি। আমাদের স্কুলের দাড়োয়ান চাচ্চু আছে না, তাকে। তার খুব অসুখ। তুমি এসো না বাবা।’



-‘তুমি ওখানেই থাকো মা। কোথাও যেও না। আমি এখনই আসছি।’



রিনির মা কাঁদছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। বাবা থানা-পুলিশে খবর দিয়ে ফেলেছেন মেয়ে নিখোঁজ বলে।



শান্তির শীতল ধারা বইল মা’র হৃদয় জুড়ে।বাবাও শান্ত হলেন।



রিনির বেশ ভয় লাগছিল। বাসায় নিশ্চই বাবার বকুনি আর মায়ের প্রহার অপেক্ষা করছে তার জন্য।



হল উল্টো। বাসায় আসার সাথে সাথেই মা রিনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল।



রিনি বুঝতে পারছে মা কেন কাঁদছে। রিনি বুঝতে পারছে বাবা কেন এত বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। একটা মেয়ে বড় হলে তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তা যে দিনে দিনে বাড়তে থাকে, রিনি তা বোঝে।



দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে। সপ্তাহখানেক সময় আছে বড়জোর।



চলছে নাক-মুখ বন্ধ করে পড়াশোনা।



দাড়োয়ান চাচ্চু আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি আবার স্কুলে আসেন।



দেখতে দেখতেই পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। পড়াশোনা আর চাপের পাহাড় সামনে। তাকালেই অন্ধকার দেখতে হয়।সামাল দিতে দিতে হাপশে ওঠে রিনি।



পরীক্ষা শেষও হয় দেখতে দেখতেই। চাপ নেমে যায় কিছুটা। আবার পরের পর্ব পরীক্ষার চোখ রাঙ্গানি শুরু হবে অল্পকিছুদিনের মধ্যেই।



মাঝখানে কয়েকদিন বন্ধ।বাবা বলল, চল, সেন্টমার্টিন থেকে ঘুরে আসি।



রিনির সে কি আনন্দ। রিনির একটু আবহাওয়া পরিবর্তনের দরকার। সেজন্যই বাবার এ পরিকল্পনা।



মা বললেন, ‘কিন্তু এখন তো সেন্টামির্টিনে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় সমুদ্র উত্তাল থাকে।’



-‘দেখ।সময় সবসময় হাতে পাওয়া যায় না। আর আমাদের মেয়ের প্রয়োজনেই এই আয়োজন।ও দিনদিন ক্যামন যেন হয়ে যাচ্ছে।আগে না জানিয়ে ও কোন বন্ধুর বাসাতেও যেত না।আর এখন অচেনা-অজানা যাওগায় নির্বিবাদে চলে যায়।আমার মনে হয়, ওকে আমাদের একটু সময় দেয়া দরকার। ভয় পেওনা। কিছুই হবে না।’



সেন্টমার্টিন যাবার পথে রিনি খেয়াল করল, কতগুলো পিচ্চি ছেলে, বিশাল বিশাল ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাবলীলভাবে। দেখে মনে হয় ব্যাগের ওজন ওদের নিজেদের থেকেও বেশি। কিন্তু সেটা টানতে ওদের কোন কষ্টই হয় না।



সেন্টমার্টিনের জল স্বচ্ছ। এতটাই স্বচ্ছ যে নিচের পাথরগুলোও পরিষ্কার দেখা যায়।



সারাদিন সমুদ্র শান্ত থাকে। রাতে আসে জোয়াড়।সমুদ্রজলের হৃদয়কাঁপানো শব্দ মনকে ভয়ার্ত করে তোলে।



অবারিত আকাশ। বিশুদ্ধ বাতাস।নারিকেল বাগান।রিনির ইচ্ছে হয় চিরটাকাল এখানেই থেকে যেতে।



কিন্তু স্কুলে ক্লাস শুরু হযে গেছে। বাবারও ছুটি শেষ। তাই ফিরতেই হবে। কিছুই করার নেই। ফেরার সময় রিনির দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভাবে, মানুষের সাধ অনেক। সাধ্য কম।একজীবনে এ সাধ কখনওই পূরণ হবার নয়।







স্কুলের গেটে একজন নতুন লোক। দাড়োয়ানের পোষাক পড়ে আছে।



রিনি তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?



লোকটি বলল, আমি দাড়োয়ান।



রিনি জানতে চাইল, দাড়োয়ান চাচ্চু মানে আগের জন কোথায়?



লোকটি বলল, তা তো আমি বলতে পারব না খুকি। বলে বিশ্রী দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগল।লোকটি বোধহয় পান খায় তাই ওর দাঁতগুলো লালচে। আর বোধহয় সিগেরেট খায়, তাই ওর ঠোঁটগুলো কালচে।



আজ শুক্রবার। বন্ধের দিন।তবে স্কুলের অফিস খোলা থাকে। এমাসের বেতন দেয়া হয়নি।



রিনি নিজেই মায়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আর বেতনবই নিয়ে চলল স্কুলের দিকে।ও বড় হয়েছে। ও নিজের বেতন এখন নিজেই দিতে পারে।



হেডস্যারের রুম বন্ধ।তবে ভেতর থেকে একটা কথাকাটাকাটির মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।



রিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল হেডস্যারের রুমের দিকে। ওর হাতে টাকা আর বেতনের বই।



গলাটা দাড়োয়ান চাচ্চুর মত।তিনি বলছেন, ‘দ্যাখো কিবরিয়া, তুমি এখন অনেক ধনী। অনেক বড়লোক। কিন্তু একসময় তোমার কিছুই ছিল না।তোমারে কেই না চিনুক। আমি চিনি।’



হেডস্যারের গলা চেনা যায় না। তিনি আজ এক অন্য মানুষ।শেয়ালের মত খেকিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘ওই ছোটলোকের বাচ্চা শহিদুল। আমাকে স্যার বল, স্যার।আমি আর আগের কিবরিয়া নাই। আমারে আর কেউ রাজাকার বলে না। যারা বলতে পারে, তাদেরকে হয় আমি শেষ করে দিয়েছি অথবা টাকা দিয়ে মুখ চেপে রেখেছি। আমার এখন অনেক ক্ষমতা। কি করলি জীবনে তুই বল। মু্ক্তিযুদ্ধ করলি।স্বাধীন বাংলাদেশ করলি। করে কি পেলি বল। এখন তুই আমার স্কুলের দাড়োয়ান।আমি সেই স্কুলের হেডস্যার। হা হা হা।’



হেডস্যারের হাসি রিনির বুকে এসে বিঁধে ভয়ানকভাবে। মুখ থেকে আর্তচিৎকার বের হয়ে আসতে চায়। নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরে রিনি।



দাড়োয়ান চাচ্চু বলছেন,‘হ্যা, যুদ্ধ করছি। দেশের জন্য লড়ছি। তোর মত দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।তুই বিশ্বাসঘাতক। তুই রাজাকার।’



-কেউ বলবে না। একথা বলার মত আর কেউ নেই। শুধু তুই আছিস। তাই তোকে আমি সরিয়ে দিয়েছি। এখন তুই না খেয়ে মর। চাইলে তোকে আমি এখনই মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু না, আমি তা করবনা। আমি তোকে তিলে তিলে মারব। এটাই তোর শাস্তি। মুক্তিযুদ্ধ করার শাস্তি।



- এ কাজ করিসনা। এই বুড়ো বয়সে আমি কি করে চলব। আমাকে আমার চাকরিটা ফিরিয়ে দে।



- শালা ছোটলোকের বাচ্চা। শালা মুক্তিযোদ্ধা।তোরা মুক্তিযোদ্ধারা সবকয়টা শয়তান।তোরা পাকিস্তানের শত্রু।



কথা আরও অনেকক্ষণ চলল।



রিনির মাথা ঝিমঝিম করছে। কোনরকম উঠে দাঁড়ালো। রাস্তায় এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।



চোখ মেলে ও নিজেকে খুঁজে পেল নিজের বিছানায়।মা হাত ধরে বসে আছে। বাবা হাসছে। অপূর্ব সুন্দর সে হাসি।







কিছুদিন পর রিনির বাসায় কিছু লোক এলেন। তারা সোসাল ওয়ার্কার। প্রতিটি এলাকায় জীবিত মু্ক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার কাজ তাদের।



সরকার থেকে নির্দেশ এসেছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাদের একটি তালিকা তৈরী করার জন্য।



রিনির বাবা বললেন, ‘আমার পক্ষে তো আপনাকে খুব বেশি সাহায্য করা সম্ভব নয়। আমি তো এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা।’



উড়ে এল রিনি। মুখ ও চোয়াল শক্ত।মনটা গম্ভীর।



ও বলল,‘বাবা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি যার খবর আর কেউ জানে না।’



- ‘মা তুমি এসব কি বলছ? তুমি মুক্তিযোদ্ধাকে চেন?’



- হ্যা বাবা।আমি একজন রাজাকারকেও চিনি যাকে আর কেউ চেনে না।



বাবা রিনিকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।



রিনি বলল, ‘বাবা, আমি সত্যিই বলছি, আমি একটুও মিথ্যে বলছি না।আমি সত্যিই একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি ।’



-ঠিক আছে মা। তুমি সত্যিই বলছো। আমি তো বলিনি যে তুমি মিথ্যে বলছ।



-বাবা তুমি যাবে আমার সাথে তার বাড়িতে।



-যাব মা। অবশ্যই যাব।



-এখনই যাবে বাবা? তিনি খুব অসহায়। তার কেউ নেই। তিনি বোধহয় মারাই যাবেন।



-এখনই ।ঠিকআছে মা। যাব। তুমি রেডি হও।



-আমি রেডি বাবা। মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য রেডি হতে হয় না বাবা।



সকলে মিলে চলল রিনির দাড়োয়ান চাচ্চুর বাড়িতে। সেই জঞ্জালভরা যায়গা।ড্রেন থেকে আসা উৎকট গন্ধ।



এ এলাকায় সাধারণত গাড়ি আসে না। একটি গাড়ি আসতে দেখে এলাকাবাসী এসে ভিড় করেছে।



দাড়োয়ান চাচ্চুর ঘরে তালা লাগানো। ভিড়ের মধ্যে থেকে রিনি খুঁজে নিল সেদিনের সেই মধ্যবয়েসী লোকটাকে যে রিনিকে দাড়োয়ান চাচ্চুর বাড়িতে সেদিন নিয়ে এসেছিল। লোকটি জানালো, শহিদুল মিয়ার খবর কেউই জানে না। গত দুদিন হল ঘরে তালা দেয়া।



রিনির জোরাজুরিতে তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকা হল। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু্ই নেই। নোংরা কিছু কাপড়, কিছু ব্যাগ, অনেকদিনের ধুলো জড়ানো।



বিছানার চাদর উল্টোনোর সাথে সাথেই চোখে ঝলক দিয়ে উঠল একটি নতুন পতাকা। লাল সবুজের পতাকা। রিনি বলল, ‘যাবার সময় দাড়োয়ান চাচ্চু পতাকাটা নিয়ে যান নি। হয়ত ফেলে রেখে গেছেন আমাদের জন্য।’



রিনিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা, ‘সত্যিই মা। যারা এই পতাকা এনেছিলেন, তাঁদের অনেককেই আমরা আর চিনতে পারি না। ধরেও রাখতে পারি না।’









‘বাবা, আমি আর এ স্কুলে পড়ব না’, রিনি বলল।



- কেন মা? স্কুলের কি হল?



-বাবা, আমাদের ইস্কুলের হেডস্যার রাজাকার।



-কি বলছ ‍তুমি রিনি।তোমাদের স্কুলের হেডমাস্টার কিবরিয়া সাহেব একজন সম্মানিত ব্যক্তি।



-আমি ঠিক বলছি বাবা। আমি নিজ কানে শুনেছি।বাবা, যে স্কুলের হেডস্যার রাজাকার, ‍তুমি কি চাও আমি সে স্কুলে পড়ি?



রিনির বাবা চুপ হয়ে থাকল অনেকক্ষণ। উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেল।









আজ রিনির মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ পেয়েছে।রিনি জি.পি.এ ৫ পেয়েছে। রিনি আজ খুবই আনন্দিত।রিনির ক্লাসমেট অনিন্দ্য আজ রিনিকে একটা লাল গোলাপ দিয়েছে। ভালো ফলাফলের জন্য। কিন্তু ভাল রেজাল্টের জন্য কি মানুষ লাল গোলাপ দেয়?



অনিন্দ্যকেও খারাপ লাগেনা রিনির। অনিন্দ্যর চোখ দুটো খুবই সুন্দর। তাই ও যখন রিনির দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন রিনির বেশ লাগে। রিনিরও ইচ্ছে হয় অনিন্দ্যর চোখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে।এক নজরে।



কিন্তু ভয় হয়। লজ্জা লাগে। এটুকু লজ্জা না থাকলে কি হয় ?



ক্লাস নাইনে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় রিনি। প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিল। নতুন জায়গা। সব ঠিকঠাক মত হবে তো?



শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ভাবেই এগিয়েছে।রিনির রেজাল্টও ভালো হয়েছে।



পুরোনো স্কুলের দিকে আর ফিরেও তাকায় না রিনি।



তবে আজ ও একবার ওদিকে যাবে। গেটের সামন থেকে ঘুরে আসবে। দাড়োয়ান চাচ্চু যেখানে বসত, সেখানে ও একটু দাঁড়াবে। তারপর চলে আসবে।



রিনির হাতে আছে দাড়োয়ান চাচ্চুর ঘর থেকে পাওয়া দেশের পতাকাটা। পতাকাটাকে ও সামনে মেলে ধরল। পতাকা জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.