![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
প্রথম ঢাকায় এসে
জীবনের প্রথম বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর। ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য চলে আসি ঢাকায় কোচিং করতে।
উঠি ফার্মগেটের একটা ম্যাচে। ছোট্ট রান্নাঘরের মত একটি ঘরে আমরা দু’জন থাকতাম। তখন গরমকাল ছিল। সেবছর এমনিতেই খুব গরম পড়েছিল। আমার ঠিক পাশের রুমটিই ছিল আবার রান্নার ঘর। মাঝে-মধ্যে আমার রুমের সিলিং ফ্যানও নষ্ট হয়ে থাকত। এই ত্রীমুখী উষ্ঞতার অত্যাচারে আমার জীবন অতিষ্ঠ প্রায়। খটখটে সরু বিছানাটায় শুয়ে চোখ বুজলেই বাড়ির রাস্তাটাকে দেখতে পেতাম, পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে পেতাম। একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম।
আলো-আঁধারী আর মায়া-ছলনায় ভরা ঢাকা শহরে আমি কখনওই স্বচ্ছন্দে ছিলাম না। এখনও নই।
কোচিং করতে যেতাম বুয়েটের এক ভাইয়ের কাছে। ভাই খুবই মেধাবী মানুষ। বুয়েটের সি.এস.ই তে পড়ছেন ফাইনাল ইয়ারে।
স্বাভাবিকভাবেই শুরুর দিকে ঢাকার রাস্তা-ঘাট একেবারেই চিনতাম না বা চিনে ফেললেও মনে রাখতে পারতাম না ।
বুয়েটে যাবার জন্য আমাকে লেগুনা করে নিউমার্কেট যেতে হত। সেখান থেকে হেটে বা রিক্সায় বুয়েটে।
প্রথম যাবার দিন বুক টিপটিপ করছিল। একেবারেই কিছু চিনি না। ঢাকা শহরে আগে কখনওই একা একা এভাবে চলি নি। কিন্তু মানুষ যেন কোনভাবেই বুঝতে না পারে আমি নতুন। বুঝলেই বিপদ। তাই সব-সময় নিজের ভেতর খুব স্বাভাবিক ভাব-ভঙ্গি রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। কেউ একজন আমার দিকে তাকালেই ভাবতাম, ও বোধহয় বুঝে ফেলেছে যে আমি নতুন। আমি আরও ভাব-ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়াতাম। বলা বাহুল্য, আমার এসব আচরণই প্রকাশ করে দিত যে আমি ঢাকা শহরে একেবারেই নতুন।
লেগুনার হেল্পারকে আমি বারবার করে শুরুতেই বলে দিয়েছি আমি নিউমার্কেটে নামব। শুরুতেই ছয় টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। আবার বললাম, ভাই, আমি কিন্তু নিউ মার্কেটেই নামব। আসলে আমি নিউমার্কেট চিনি না। কখনওই যাই নি। চিনব কি করে!
লেগুনার জানলার সরু ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আমি অনেক কষ্ট করে বর্ণিল ঢাকা শহর দেখার চেষ্টা করছি। গাদাগাদি করে বসে আছি আমরা আটজন যাত্রী।
লেগুনা নিউমার্কেট ছাড়িয়ে একটু এগিয়েছে। আমি বলে উঠলাম, ‘নিউমার্কেট এসেছে?’
হেল্পার বলল, ‘নিউমার্কেট তো ছাড়ায় আসছি।’ শোনার সাথে সাথে বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠল। কিন্তু না। স্বাভাবিক থাকতে হবে। ভয় পেয়েছি বোঝানো যাবে না। বেশ মোটা গলায় বললাম, ‘তোমাকে না বললাম আমাকে নিউমার্কেট নামিয়ে দিতে। নামিয়ে দাও নি কেন?’
হেল্পার বলল,‘ক্যান, আপনি নিউমার্কেট চেনেন না?’
-‘চিনব না কেন। অবশ্যই চিনি। খেয়াল করিনি আর কি। যাই হোক এখানেই নামিয়ে দাও।’
সেদিন ওখানে নেমে খুব ভয় পেয়ে রিক্সা নিয়ে শেষে জায়গামত পৌঁছেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, আসলে লেগুনা আমাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল, সেটি আমার রাস্তাকে আরও সংক্ষেপ করে দেয়। পাঁচ-ছয় মিনিট হাটলেই আমি বুয়েটে চলে যেতে পারি সেখান থেকে। কিন্তু নিউমার্কেটে নামলে আমাকে অবশ্যই রিক্সা নিতে হবে।
রাস্তার বাঁকগুলো চেনার চেষ্টা করতাম আকাশ সমান বিল্ডংগুলোকে স্মরণে রেখে। কিন্তু একটু পরেই আাবার এলোমেলো হয়ে যেত।কারণ, সব বিল্ডিংই তো দেখতে একই রকম। পার্থক্য করা খুবই কঠিন।
ফেরার সময় আজিমপুর হয়ে ২৭ নম্বর বাসটি ধরে আবার ফার্মগেট ফিরে আসতাম।
প্রথম দিন। টিউশনি পড়ে ফিরে আসছি। আজিমপুরে এসে ২৭ নম্বর বাসটি ধরলাম।
বাসে ওঠার আগে বাসের গায়ে লেখা দেখে নিলাম। হম্, সেখানে লাল কালিতে ‘ফার্মগেট’ শব্দটি লেখা আছে।
কিন্তু আমি তো ফার্মগেটও চিনি না। বাস কখন ফার্মগেট পৌঁছবে, তা বুঝবো কি করে?
বাসে ওঠার সময় দু’জন হেল্পার মামাকে বলে রাখলাম যে আমি ফার্মগেট নামব। তারা আশ্বাস দিল, তারা আমাকে ফার্মগেট নামিয়ে দেবে।
আমি ভরসা পেলাম না।
বাসের একদম শেষ সারিতে বসে আছি। পাশে দেখলাম বুড়ো মতন একজন লোক বসে আছেন। ওনাকে বললাম, ‘চাচা, আমি তো ঘুমিয়ে পড়তে পারি, ফার্মগেট আসলে আমাকে একটু ডেকে দিবেন?’ চাচা রাজি হলেন। কিন্তু বয়স্ক চাচার উপর খুব বেশি ভরসা পেলাম না। সেই চাচার সামনের একজন মধ্যবয়স্ক লোককেও বললাম আমাকে ফার্মগেট আ্সলে ডেকে দেবার কথা। সেই লোকও আবার আমার মত, ফার্মগেট চেনে না!
আমার বা-পাশে দুজন লোক বসা। ওনাদেরকেও একই কথা বললাম। ওনারা রাজি হলেন। এভাবে বাসে বেশ ক’জন লোক সেট করে রাখলাম ফার্মগেট আসলে আমাকে ডেকে দেবার জন্য। এবার আর কোন ঝুঁকি নেই।
বেশ কিছুক্ষণ লাগল আসতে। হঠাৎ সামন থেকে হেল্পার মামা আমাকে ডাক দিল, ‘এই যে মামা, আপনার ফার্মগেট আইসা গেছে।’
পাশ থেকে বয়স্ক চাচা আমাকে ডাকছেন, ‘বাবা, ফার্মগেট চইল্যা আসছে। নামো।’
বা-পাশ থেকে দু’জন লোক আমাকে ডাকা শুরু করল, ‘এই যে ভাই, ফার্মগেট আসছে, নামেন।’
এভাবে সামন থেকে আরও দু’জন……।
ততক্ষণে বাসের সবার চোখ আমার দিকে।বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই গোল গোল চোখ করে আমাকে দেখছে। একটি পুচকে ছোকড়াকে ফার্মগেট নামানোর জন্য এতগুলো লোক ডাকাডাকি করছে, ভাবা যায় ?
২
টি-ব্যাগে চা
ছোটবেলার মামা’র সাথে একটি অফিসে মাঝে-মধ্যেই যেতাম। আমি যেতাম বেড়াতে। আমার তখন কোন কাজ ছিল না। স্কুলে যেতাম-আসতাম। পড়াশোনাও তেমন করতাম না।
একটু বড় হয়েছি। তখন হাইস্কুলে পড়ি। সেই অফিসে আবার বেড়াতে গেলাম। হঠাৎ দেখি আমার সামনে একটি চায়ের কাপ।
নিজেকে খুব সম্মানিত বোধ করতে লাগলাম। আগে কোথাও আমাকে কেউ চা খেতে দিত না ছোট মানুষ মনে করে। এখন আমাকে চা খেতে দিচ্ছে, তার মানে ওরা ধরে নিয়েছে যে আমি বড় মানুষ।
ভালো কথা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল যখন দেখলাম যে চায়ের কাপে শুধুই গরম জল ছাড়া আর কিছুই নেই। তার সাথে অবশ্য পাতলা সাদা সুতোয় লাগানো কিছু একটা কাপের গরম পানিতে ডুবে আছে। আর চায়ের সাথে যে প্লেট ছিল, ওতে রাখা আছে একটি চকচকে চামচ।
মহা মুশকিলে পড়লাম। এ গরম জল চায়ের কাপে আমাকে দেবার মানে কি? আমার সাথে কি ওরা ঠাট্টা করছে? নাকি ছোটদের চা এটা। কি জানি বাবা। আজকাল কতকিছুই তো নতুন নতুন বাজারে আসছে।
কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো একটা করতেই হবে। কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই হয়ে যায়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে সবাই হাসাহাসি করবে। বলবে, দেখ, ছেলেটা চাও গিলতে পারে না।
এমন সব ভাবার পেছনে অবশ্য আমার দায় ছিল না। হাইস্কুলের প্রথম দিকের বয়সটাতে এমন হীনমন্যতাবোধ প্রায় সবার মধ্যেই কাজ করে।
সবথেকে ভালো উপায় হল অন্য কাউকে দেখে শেখা। কিন্তু এই রুমটিতে আর কেউ নেই। আমি একা একটা চায়ের কাপ আর গরম পানি নিয়ে বসে আছি(সাথে অবশ্য ওই সুতোয় লাগানো জিনিসটা আর চামচ ছিল)।
পাশের রুমে কয়েকজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওখানে গেলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। পা টিপেটিপে এগুলাম ওই রুমটার দিকে।
ওখানে কয়েকজন কথা বলছে আর চা গিলছে। আমি বুঝেই উঠতে পারলাম না, ওই গরম জলগুলো কি করে লোকগুলো হাসিমুখে গিলছে আর সুখ-দুখের গল্প করছে।
পেছনের দরজা দিয়ে এমন সময় এলেন অফিসের এক লোক। আমাকে বললেন, ‘বাবু, ওভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখছ? ও মা, তুমি তো দেখছি চা ও খাওনি। চা খাবে না তুমি?’
ওই সময় যদি আমি বলে দিই চা খাবনা, তাহলেই সব ঝামেলা মিটে যায়। লোকটা চায়ের কাপ নিয়ে চলে যাবে। আর কিছুই বলবে না।
কিন্তু না, এর সমাধান না করলে আমার শান্তি হবে না, আমি বাসায় গিয়ে ডিমের পোজ দিয়েও ভাত খেতে পারব না (ডিমের পোজ আমার ছোটবেলার সবথেকে প্রিয় খাবার ছিল)।
হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘হ্যা আঙ্কেল, খাবো না কেন, খাবো। নিশ্চই খাব।’
এইকথা বলে খুব হাবভাব নিয়ে চাপের কাপের সামনে গিয়ে বসলাম। মান-সম্মান বাঁচাতেই হবে। প্রয়োজনে শুধু গরম জল গিলে হলেও।
কাপের গরম জলগুলো মুখে দেব, ঠিক এমন সময়ে আসলেন অফিসের বস্। খুব মোটা(আমার থেকেও), ভুড়ি ওয়ালা।দেখলেই ভেতরে আতঙ্ক চলে আসে। দুনিয়ার মোটা লোকগুলো বোধহয় এরকমই। উপরটা ভয়ঙ্কর। কিন্তু ভেতরটা শান্ত, মরা ঘাঘটের মত।
তবে তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় খুব গুদুম-গাদুম ছিলাম, তাই সবাই আমাকে ভালোবাসতো।
বরাবরের মতই তিনি এসে আমার সাথে হাসিমুখে কথা বললেন। তারপর তাঁর জন্য নির্ধারিত বিলাশবহুল চেয়ারটাতে বসলেন। সাথে সাথে তাঁর জন্য এককাপ চা চলে আসল।
ঠিক আমারই মত। একটি কাপ। ওতে একটি সুতো ঝুলছে। প্লেটে একটি ঝকঝকে চামচ।
এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম, আমাকে কোন ছোটদের চা দেয়া হয় নি, আমাকে বড়দের চা-ই দেয়া হয়েছিল।
আমার মনটা আনন্দে দুলে উঠল। এইবার আমি মুসকিল আসান করতে পারব।
নিচের দিকে মুখ করে টেরা চোখের চাহনিতে লক্ষ রাখতে লাগলাম, বস আঙ্কেল কি করে ওই গরম জল গেলেন।
বস আঙ্কেল বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে খুব সাবলীল ভাবে ওই সাদা সুতোটা ধরে নাড়াচাড়া করলেন কিছুক্ষণ। তারপর চামচটা দিয়ে চা-টা একটু নাড়লেন। তারপর মুখে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
ততক্ষণে আমিও তৃপ্ত।চা বানানোর কৌশলটা আমি শিখে গেছি।
ঠিক একই ভাবে আমি আমার চায়ের কাপের সাথে লাগানো সুতোটা নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, চায়ের গরম জল মহূর্তেই রঙ পাল্টিয়ে হালকা খয়েরি রঙ্গের হয়ে গেল, ঠিক যেমনটা চায়ের রঙ হয়।
খুব ভালো কথা। তারপর চামচ দিয়ে নাড়লাম চা-টাকে। এবার নিশ্চই খুব সুস্বাদু একটা চা তৈরী হয়েছে।
অনেক আশা নিয়ে মুখে দিলাম চা। খুব ভালো হয়েছে। শুধু চা না হয়ে শরবত হয়ে গিয়েছে। গরম জল আর এতক্ষণ কি গরম থাকে? আর ঠান্ডা জলে চিনি মেশালে সেটা তো শরবতই হয়, তাই না?
না, এ চা গেলা যাবে না। পেট খারাপও করতে পারে। বস্ আঙ্কেল বের হয়ে যাবার সাথে সাথে আমি জানালা দিয়ে চা-টাকে দিলাম ফেলে।
আর কোন চিন্তা নেই। কেউ বলতে পারবে না আমি চা খাইনি।
বাসায় এসে অনেকবার ভেবেছিলাম, আসলে ব্যাপারটা কি হল?
অনেক পরে, প্রায় বছর তিনেক পরে, আমি জানতে পারি, ওই সুতোয় বাঁধা দ্রব্যটির নাম আসলে টি-ব্যাগ। গরম জলে চুবোলেই সে জল চায়ের রঙ ধারণ করে। আর তাতে চিনি মিশিয়ে খুব কম পরিশ্রমে চা পান করা যায়।।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঘাঘট: উত্তরবঙ্গের একটি পরিচিত কিন্তু অখ্যাত নদী। একসময় জলে ভরা থাকলেও এখন ঐশ্চর্যহীনা।
৩
খরগোস
পশু-পাখিপ্রীতি আমার কখনওই খুব বেশি পরিমাণে ছিল না। দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা কত পাখিরই নাম শুনেছি। আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখলে খুবই ভালোলাগে। কিন্তু, কোনটা দোয়েল, কোনটা কোয়েল, কোনটা শ্যামা- তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
তখন বোধহয় সাত-আট বছর বয়স আমার। হঠাৎ, খবর পেলাম, আমার রতন দাদা দুটো খরগোস কিনেছে। সেগুলো নাকি দেখতে অসম্ভব রকম সুন্দর। দেখলেই নাকি ছুঁতে ইচ্ছে করে, আর ছুঁলেই নাকি কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে।
জিদ করতে লাগলাম দাদা’র কাছে খরগোসগুলো এনে দেবার জন্য।
আমার দাদা আবার আমার কোন আবদারই ফেলতে পারেন না।
আমার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য এনেই দিলেন খরগোসজোড়া।
সাদা-তুলতুলে পশম ওগুলোর। শীতপ্রধান দেশে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া বরফখন্ডগুলো মাটিতে পড়ে যেমন শ্বেতশুভ্রতা সৃ্ষ্টি করে, ওগুলোর গায়ের পশমও তেমনি শ্বেতশুভ্রতার সৃষ্টি করেছে। চোখদুটো লাল। চোখের মণিটা কালো। এত ছোট্ট একটা দেহে যে এত বিচিত্র আর নিষ্পাপ সৌন্দর্য কি করে এল, তা আমি আজও জানতে পারিনি।
গোটা বাড়িজুড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল ওগুলো। বড়রা সাবধান করে দিত আমাকে, ওদের কামড়. আঁচড় নাকি খারাপ। ওতে রোগ করে। ওদের পশম পেটে গেলে পেট খারাপ করবে- ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এত সব বিধি-নিষেধ মেনে চললে আর যাই থাকুক, ভালোবাসা থাকতে পারে না।
কিন্তু ওদেরকে আমি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছি যে ততদিনে আমার পক্ষে আর কোন বাঁধা-নিষেধ মানা সম্ভব নয়।
পশুদের মাঝে যে ভালোবাসা আছে, মানুষের মত পশুরাও যে একে-অপরকে ভালোবাসে, তা প্রথম শিখি খরগোসদুটোর কাছ থেকেই। কিভাবে? একটা ছোট্ট কাহিনী বলি।
খরগোসদুটো সব-সময় একসাথেই থাকত। যা করত সব একসাথে করত। কখওই আলাদা হত না ওরা একে অন্যের থেকে।
একদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল।আমি পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল, খরগোসগুলোকে ঘরে তোলা হয় নি। ওরা পেছনের মাঠেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।তখন শীতকাল। এই শীতের রাতে বাহিরে থাকলে তো ওরা এমনিতেই মারা যাবে। এ শীতে তো মানুষও বাঁচে না।
ভর সন্ধ্যায় ওদের খুঁজতে গেলাম মাঠে। একটু খোঁজাখুঁজি করেই একটিকে পেয়ে গেলাম। কিন্তু অন্যটিকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে কাঁদছি, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না।
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। ভাবলাম, ওরা তো সবসময় একসাথেই থাকে। তার মানে, যেটিকে খুঁজে পেয়েছি, সেটি নিশ্চই জানে, অন্যটি কোথায় আছে।
হাতে রাখা খরগোসটিকে ছেড়ে দিলাম।আর ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম ওরে পিছু পিছু।
তখন রাত প্রায় নেমেই এসেছে। সেই আবছা আলোতেও খরগোসটি ছুটে গেল অন্যটির কাছে, যেটিকে আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ওরা আলু খেতে ভালোবাসতো। আর খেত গাছের পাতা, ঘাস। বাজার থেকে কিনে আনা আলু ওদের মুখে তুলে দিতাম। আমাকে দেখা মাত্র ওরা একসাথে ছুটে আসত। মুখ এগিয়ে দিত খাবারের জন্য।
ছোটবেলায় সবাই আমাকে খুব আদর করত বলে কোন কাজই আমার করতে হত না। আমি ছিলাম একেবারেই আলালের ঘরের দুলাল।
কিন্তু খরগোসগুলোর জন্য ঘাস কাটতে হবে। সে তো অনেক কঠিন একটা কাজ।
মাঠে চলে গিয়ে ঘাস কেটে আনতে লাগলাম ওদের জন্য। আমার বেশ কষ্ট হত ঘাস কাটতে। যদি কেউ কখনও মাঠে গিয়ে ঘাস কেটে থাকেন, তিনিই হয়ত বুঝবেন ব্যাপারটা।
আর ওদের জন্য গাছের পাতা জোগাড় করতাম একটি অন্যরকম উপায়ে।
শৈশবে আমার পাড়ায় আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব-সমবয়েসী চেলে-মেয়ে ছিল। তাদের সবার সাথেই আমার খুব ভালো মিল। একসাথে ক্রিকেট,ফুটবল,গোল্লাছুট,দাড়িয়াবান্ধা,বৌছি- খেলি।
আমি বারান্দায় দু-মুঠো চাল নিয়ে গিয়ে বসতাম। সবাই আসত দেখার জন্য যে আমি আসলে কি করছি। আমি সবাইকে বলতাম, ‘তোমাদের সবাইকে আমি একটি সুন্দর পাতার বিনিময়ে একটি করে চাল দেব। আমাকে যে ক’টি পাতা এনে দেবে সে ক’টি চালের দানা পাবে। তবে হ্যা, পাতাগুলো অবশ্যই সুন্দর হতে হবে।’
আমার বন্ধুরাও আমার কথায় সাড়া দিতে লাগল। আমিও পাতা সংগ্রহ করতে লাগলাম। সে পাতাগুলো নিয়ে গিয়ে খরগোসদুটোকে দিতাম। ওরা খেত। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম।
পরীক্ষা চলে আসায় ওদের যত্ন আর ঠিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হত। কিন্তু গুরুজনের চোখরাঙ্গানীকে অনেক বেশি ভয় পেতাম তখন।
একদিন সকালে উঠে দেখি, একটা খরগোস চুপ করে বসে আছে। আর একটা শুয়ে আছে, নড়ছে না। ভেতরটা ছ্যাত্ করে উঠল। কাছে গিয়ে দেখলাম, কিছু একটা খরগোসটার গায়ে কামড় দিয়েছে, একটা গভীর গর্ত হয়ে আছে সেখানটাতে।
খরগোসটা মারা গেল।
বাড়ির এক কোণায় গিয়ে কাঁদলাম। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলাম না। ভাব দেখালাম, মরেছে তো কি হয়েছে। ও মরেছে তাতে আমার কি?
অন্যটি আর আগের মত চঞ্চল থাকে না।স্থির হয়ে বসে থাকে সারাদিন। খাবার দিলে খায়। না দিলেও কোন আগ্রহ দেখায় না।
প্রথমটি মারা যাবার এক সপ্তাহের মাথায় অন্যটিও মারা গেল।
বাড়িতে রাখলে গন্ধ ছড়াবে, তাই বড়দের কথামত ওকে ফেলে দিয়ে আসলাম দূরে বিলের কিনারায়।
শুনেছি, প্রতিটি প্রাণীরই আত্মা আছে। সে আত্মার কোন ধ্বংস নেই, বিনাশ নেই।
মাঝে মাঝে মনে হয়, খরগোস দুটো নিশ্চই আমাকে অভিশাপ দিয়েছে, আমি ওদের যত্ন করিনি, তাই তো ওদের মরতে হল। ওদের সুন্দর ভালোবাসটাও মারা গেল।
পরক্ষণেই ভাবি, আমি ওদেরকে যেভাবে ভালোবেসেছি, এভাবে ওদেরকে আর কেউ ভালোবাসেনি। এই প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রতিদান কখনওই অভিশাপ হতে পারে না।
আমি নিশ্চিত, ওরা আমাকে কখনওই অভিশাপ দেয়নি। ওরা আমাকে ভালোবাসত, এখনও ভালোবাসে।।
০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:০৭
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: Thanks @NIL-DORPON.
২| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪৫
দূষ্ট বালক বলেছেন: ফার্মগেটে নামার ঘটনাটা চরম।
এই বিপদটায় আমিও খুব পরি। ঢাকা শহরের এক প্রান্ত উত্তরাতে থাকি, এটাই স্থায়ী আবাস। কিন্তু তারপরও ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক ও স্থান গুলো এখনও চিনি না। কিছুদিন আগে বৎসরখানিক সময় পল্টন এলাকায় চাকরী করলাম, সে সময় ইচ্ছে ছিল ঢাকার প্রতিটা এলাকা চিনে নেব। এক বৎসর পর মনে হল অফিস আর বাসা ছাড়া আর কিছুই চিনি না। এখনও কোন কাজে সেদিকে গেলে গুগুল ম্যাপের সাহায্য নিতে হয়।
০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৫২
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: ব্যাপারটা একটু ভাবুন, এই ঢাকা শহরেই আমাদের এত সমস্যা হয়। আমরা যদি পৃথিবীর আরও বড় কোন শহরে যাই, তবে কেমন হবে ?
৩| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৮
মোঃ আনারুল ইসলাম বলেছেন: খরগোসের গল্পটা মনছুয়ে গেছে।
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৩৮
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: ধন্যবাদ ।
৪| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪৩
নাজমুল_হাসান_সোহাগ বলেছেন: ঢাকাতে কোচিং এর সময়ের গল্পটা পড়তে গিয়ে আমার নিজের কথা মনে পরে গেল। অসাধারণ ভাবে গুছিয়ে লিখেছেন কথাগুলো। ভালো লাগলো। আপনার প্রতি শুভ কামনা রইলো।
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৪১
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: শুভকামনা রইল আপনার জন্যও।
৫| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪৬
ভীতু সিংহ বলেছেন: ভাই ঢাকা শহরের কথা আর কি বলব। আমি বিশ বছর ধরে ঢাকায় আছি। এখনো মনে হয় এর তিন ভাগের এক ভাগও চিনি না। এই তো কয়েক মাস আগের কথা শেওড়া পাড়া ফুট ওভার ব্রিজের নিচ থেকে পূর্ব দিকে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। কাফরুল, ইব্রাহিম পুর, কচুখেত বাজার হয়ে যেতে হয়। রিকশা না পেয়ে ভাবলাম হেঁটে চলে যাই। অনেক্ষন হাটার পর খেয়াল করলাম আমি মিরপুর ১৪ পুলিশ লাইনের সামনে চলে এসেছি। :!> :!> :!>
খরগোশের গল্পটা পড়ে চোখে পানি চলে এসেছে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন যশোরে থাকতাম। আমার বাসার পিছনেও একটা বড় মাঠ ছিল আর আমার দুটো খরগোশ ছিল। খুব ছোট বেলার ঘটনা তাই অনেক কিছুই মনে পড়ছে না। তবে এখনো মনে আছে ঘরগশ দুটো মরে যাবার পর অনেক কেঁদেছিলাম। আপনার মত লুকিয়ে কাঁদিনি, সবার সামনেই কেঁদেছিলাম। বাবা কান্না থামানোর জন্য খেলনা কিনে দিয়েছিলেন। তার পরও কান্না থামেনি।
কমেন্ট বড় হয়ে গেলো বলে দুঃখিত। পোস্টে++++
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১৮
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: অসহায় প্রাণীদের প্রতি মানুষের ভালোবাসার ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। শরৎ বাবুর ‘মহেষ’ নামে একটি গল্প আছে। আমরা ছোট বয়সে পড়েছিলাম।
আর ঢাকা শহরের ব্যাপারে আমি আর কি বলব। আপনি অনেক অভিজ্ঞ মানুষ। আপনি নিশ্চই ব্যাপারটা ভালো বোঝেন।
চমৎকার একটি মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা থাকল।।
৬| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৮:০৬
ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
বেশ লাগলো পড়ে ||
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৩৫
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: জনাব মুন, আপনাকে ধন্যবাদ ।।
৭| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২৯
ইরফান আহমেদ বর্ষণ বলেছেন:
মজা পাইলাম!!!!!
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৩৭
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: নিজেকে সার্থক বলে মনে হচ্ছে ।
৮| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৮
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: একজন সাধাসিধে মানুষের নিষ্পাপ জবানবন্দী।
লেখায় ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৭
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: Thanks.
৯| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:১৮
দড়ি বাবা বলেছেন: আমারও এক মজার ঘটনা আছে। শ্যামলি যাবার জন্য রাস্তায় দাড়ায় আছি কিন্তু জানিনা শ্যামলির বাস কোন দিক দিয়ে যায়
একবার রাস্তার এই পাশে দাড়াই তো একটু পড়ে অন্য পাশে দাড়াই
০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:২২
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: এই ঘটনাগুলো সত্যিই খুব মজার এবং কখনও ভোলার মত নয়।
১০| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৩৯
তাসজিদ বলেছেন: ঢাকা তে প্রথম কয়েক দিন সমস্যা হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়
১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১৯
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: হয়ত আপনি ঠিকই বলেছেন।
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪৪
নীল-দর্পণ বলেছেন: বাস থেকে ফার্মগেট নামার ঘটনা চরম !