![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধানের গোলার নিচে যদি ছিদ্র থাকে, তবে যতই ধান ভরা হোক না কেন, গোলা কখনওই ভরবে না। আবার বালতিরও নিচে যদি কোন অদৃশ্য ছিদ্র থাকে, তবে যতই জল ঢালা হোক না কেন, বালতি ভরবে না। সে যত দামী বালতিই আনা হোক না কেন। তেমনি বলা যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা যদি না শিখে, না পড়ে, বা যথেষ্ট না জেনে এ প্লাস পেয়ে যায়, সেটা অনেকটা ওই ফুটো হওয়া বালতির মত। তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের বা শিক্ষার মানের কোন উন্নতি হয় না।
সাফল্যে মানুষ অভিভূত হয়, বিস্মিত হয়, কিন্তু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় না। এবারের পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সাফল্যের হার আমাদের বিস্মিত করেছে, করেছে দুশ্চিন্তাগ্রস্থও। পরীক্ষায় ছেলে-মেয়েরা ভালো করবে, সে তো খুশির কথা। কিন্তু যখন বিশাল পরিমাণে পরীক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে শুরু করে, তখন কিছুটা সন্দেহ জাগে মনে, আসলে সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে তো? সেই সন্দেহ গাঢ় হয় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক বলে ওঠেন যে তাঁর সন্তান এ প্লাস পাওয়ার মত ছিল না। কিন্তু সে এ প্লাস পেয়েছে। তাকে নাম্বার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সন্দেহ আরও গাঢ় হয় যখন লালমনিহাটের হাতিবান্ধায় পিএসসি পরীক্ষায় এমন একটি ছেলে এ প্লাস পায় যে কি না পরীক্ষাই দেয় নি। কিন্তু পরীক্ষা দিয়েছে এমন একটি মেয়ের ফলাফল পাওয়া যায় না। সন্দেহ আতঙ্কে রূপ নেয় যখন আমরা শুনি যে, শুধুমাত্র সুনাম কুড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয় ছেলে-মেয়েদের নাম্বার বাড়িয়ে দেয়ার। বড় বড় শহর থেকে শুরু করে মফস্বলের শিক্ষকরাও সে আদেশ মেনে চলে। যে ছেলেটি ৬০ পায়, তাকে ৯০ দিয়ে দেয়া হয়, যে মেয়েটি ৪০ পায়, সে মেয়েটিকে ৮০ দেয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা অসম্ভব রকম আনন্দিত হয় অভাবনীয় ফলাফল দেখে। বাবা-মায়েরা অবাক হয়ে যায় তাদের সন্তানদের মেধা দেখে। আর গভর্নমেন্ট আনন্দিত হয় গত বছরের তুলতায় এবছর সাফল্যের হার কত বেশি, তা দেখে।
স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা-কাচ্চাদের সাথে আমি মাঝে-মধ্যেই তাদের পড়াশোনার সুবিধা-অসু্বিধা নিয়ে কথা বলি। তাদের অধিকাংশের কাছ থেকেই শুনেছি, সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে তাদের মাঝে সন্দেহ কাজ করে। স্কুলে বাংলার শিক্ষক একভাবে পড়ান, তো গণিতের শিক্ষক আরেকভাবে। ওরা রাগ করে বলে ওঠে, আসলে টিচাররাই জানে না কিভাবে পড়াতে হয়। আমি ওদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করি। বলি, শিক্ষকরা গুরুজন। তাঁদেরকে এভাবে বলতে নেই। কিন্তু আমার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে, যখন শুনি শিক্ষকরা ক্লাসে নির্দিষ্ট কিছু গাইড দেখে পড়ান এবং বাচ্চাদেরকে সেই গাইড কিনে পড়তে বলেন। ব্যাপারটা আসলেই অবাক করা। যদি সবকিছু সৃজনশীলই হবে, তবে বাজার থেকে এইসব গাইড বইগুলো কেন উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে না? শিক্ষকরা কোন সাহসে ক্লাসে গাইড বই দেখে পড়ান আর কেনই বা বাচ্চাদেরকে সেই গাইড বই কিনতে বলেন, এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বিদ্যালয়ের পালা শেষ। এরপর বাচ্চারা ছোটে কোচিং সেন্টারগুলোতে। বলা-বাহুল্য, সেখানেও দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয় না। তবে ব্যাবসাটা বেশ জমে। তাই, অনেক স্কুলে এখন নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি আলাদা করে কোচিং করানোর ব্যবস্থা করা হয়। ক্লাসে অবহেলা করে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোচিংএ আসতে বাধ্য করেন। যে কাজটি ক্লাসেই করা যেত, সে কাজটির জন্য আলাদা করে কেন এই ব্যবস্থা করতে হল, সেটাও বেশ বড় একটা প্রশ্ন।
সত্যি করে যদি ভাবি, তাহলে বাজারের গাইড বইগুলোই গোটা সৃজনলীল শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ছেলে-মেয়েদের চিন্তার পরিধি তো বাড়ছেই না, বরং আগে যেটুকু সুযোগ ছিল, এখন সেটুকুও নেই। যদি গাইডেই সবকিছু লেখা থাকে, যদি পরীক্ষায় সেখান থেকেই প্রশ্ন আসে, তাহলে আর সৃজনশীলতার কি দরকার।
তারপরও, যদি ফলাফল খারাপ হয়, তবে তো সরকারকে প্রচুর সমালোচনা সহ্য করতে হবে। জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার অপবাদ নিতে হবে। তাই উচ্চপর্যায় থেকে আদেশ দেয়া হয়, পরীক্ষার খাতা শিথিল করে দেখার জন্য। নির্দেশ দেয়া হয়, খাতায় কিছু না লিখলেও নাম্বার দিয়ে দেয়ার জন্য। যার জন্য একটি মেয়ে, যার হয়ত এ মাইনাস বা এ পাওয়ার কথা, সে এ প্লাস পাচ্ছে। কিন্তু, এভাবে এপ্লাস বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষতিটা কোথায়, সেটা আমাদেরকে বুঝতে হবে।
প্রথমেই যে ক্ষতিটা হয়, সেটা হল, খুব অল্প বয়স থেকেই ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল সম্পর্কে ভুল ধারণা পেয়ে পেয়ে বড় হয়। একটি পরীক্ষায় এপ্লাস পাওয়া যে কতবড় ব্যাপার, সেটা অনুভব করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। এরফলে পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলাটাও অস্বাভাবিক নয় মোটেও।
আর সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য, সেটা হল, ছেলে-মেয়েরা মুখস্ত করবে না, তারা বুঝে বুঝে পড়বে। যেরকম প্রশ্ন আসবে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সেইরকম করে উত্তর দেবে। আর সবথেকে বড় এই উদ্দেশ্যটাই মাটিচাপা পড়ছে গাইড বইগুলোর ব্যবহার আর সেগুলো থেকে হুবহু প্রশ্ন আসার কারণে।
এগুলো সব বাঁধা-বিপত্তিকেই হয়ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু, পরীক্ষার আগের রাতে যদি বাবা-মা বাচ্চাদেরকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুখস্ত করান, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার কি উপায়, সে তো আমাদের জানা নেই। সন্তানের সব থেকে কাছের মানুষ বাবা-মা, সেই বাবা-মায়েদের নামেই এমন অভিযোগ উঠছে। ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা হলে গিয়ে সব কমন পাচ্ছে। অনেক ভালো ফলাফল করছে।
তাহলে আমাদের বিপদ সবদিক থেকেই। প্রথমত, সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার সুফল ছাত্র-ছাত্রীরা পাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওরা না বুঝে মুখস্ত করছে। আবার, উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ পেয়ে শিক্ষকরা নাম্বার বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে ছেলে-মেয়েরা সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনের ভুল ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অসাধু লোকজন প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সর্বনাশের দেয়ালে শেষ পেরেকটুকু ঠুকছে।
তাহলে পরিত্রাণের উপায় কি? উপায়ান্তর না পেয়ে অনেকে বলে ফেলেন, পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হোক। এত অল্প বয়সে বাচ্চাদের উপর কেন এত চাপ দেয়া উচিত না। আমি এমন দাবীর সাথে একমত না। পরীক্ষা একটি চ্যালেঞ্জ। পরীক্ষায় বসাটা খারাপ কিছু না। কিন্তু খারাপ হয়ে যায় তখন, যখন ক্লাস ফাইভে পড়া একটি ছেলে বা মেয়েকে এ প্লাস পাওয়া- না পাওয়া নিয়ে প্রচুর চাপ দেয়া হয়। ক্লাস ফাইভের ছেলে-মেয়েরা তাদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভয়ংকর রকম চিন্তিত হয়ে পড়ে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী এইসব দুশ্চিন্তায় ফলাফল খারাপ করে ফেলে। অনেকের মানসিক বিকৃতি ঘটে।কাজেই, ফলাফল ভালো করার এই অসহনীয় চাপটা যদি আমরা তাদের ছো্ট্ট কাঁধ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি, তাহলেই সমস্যা অনেকটা কমে যাবে। ছেলে-মেয়েরা আনন্দ নিয়ে পরীক্ষায় বসবে, দুশ্চিন্তা নিয়ে নয়।
খুবই উপকার হয়, যদি উচ্চপর্যায় থেকে এমন কোন নির্দেশ না দেয়া হয়, যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতি হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় খাতায় যেমন লিখেছে, তাদের ফলাফলও সেরকমই হওয়া উচিত। এই সাধারণ কাজটা করতে কিছুই লাগে না। শুধু পরিসংখ্যান উন্নতি করার অস্বাভাবিক চিন্তা-ধারা কর্তা-ব্যক্তিদের বাদ দিতে হবে। গাইড দেখিয়ে যেন শিক্ষকরা না পড়ান, এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করাটাও খুব বেশি কঠিন নয়। প্রয়োজনে বাজার থেকে সবরকম গাইড বই তুলে দেয়া যেতে পারে। শিক্ষকদের জন্য সৃজনলীল শিক্ষাব্যবস্থার উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বড় সমস্যা হবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো। তার জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের সুনজর, কর্তা-ব্যক্তিদের সততা, যেসব নোংরা মানুষজন এই জঘন্য কাজের সাথে জড়িত, তাদেরকে শাস্তি দেয়া।
পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান কখনও পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়া নয়। ছেলে-মেয়েরা সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে সৃজনশীল হবে, তারা মুখস্ত না করে মেধা খাটিয়ে উত্তর দেবে এবং নিজেদের যোগ্যতা অনুসারে ফলাফল পাবে- এই সহজ সরল কথাগুলোকে বাস্তবায়ন করাটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। শুধু আমরা, মানে বড়রা যদি অন্যায় না করি, আমাদের স্বার্থে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোকে ব্যবহার না করি, তাহলে আর সমস্যাটা কোথায়। আমাদের বুঝতে হবে যে, ছোট বয়স থেকে যদি কোন ছেলে বা মেয়ে চুরি করা শিখে যায়, তবে বড় হয়েও সে চুরি করে পাশ করার পথটাই বেছে নেবে। আর এভাবে যদি আমরা বিশাল সংখ্যক ছেলে-মেয়েদেরকে অন্যায় পথে পাশ করিয়ে দিই, এ প্লাস পাইয়ে দিই, তার ক্ষতির সীমাটা কতদূর গিয়ে ঠেকবে, তা পরিমাপ করা যাচ্ছে না। আমাদের ছোট ছোট চেষ্টা আর সামান্য সততাই এই ভয়টাকে দমিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।
নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এটুকু আমাদের করতেই হবে।এটুকু করার সামর্থ আমাদের আছে, এখন শুধু ইচ্ছেটুকু হলেই হয়।।
©somewhere in net ltd.