![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিষয়টি নিয়ে লিখব কি লিখব না, তা নিয়ে কাল থেকে বেশ কয়েকবার ভেবেছি। বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং অনেকেই আছে যারা ব্যাপারগুলোকে একটু ভিন্নভাবে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেতে ভালোবাসে। আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য কাউকে আনন্দ দেয়া না, বরং কিছুটা সচেতনতার তৈরী করা। আমি যতটা পারা যায় সংযতভাবে বিষয়টাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর, রাতে বাড়ি ফেরার পথে ভারতের দিল্লীতে চলন্ত বাসে মেডিকেল পড়ুয়া এক মেয়েকে নির্যাতন করা হয়। আমি খুব অল্প করে সে নির্যাতনের বর্ণনা লিখছি। মেয়েটিকে ৬ জন পুরুষ মিলে নির্যাতন করে(ওরা সবাই বাসের ড্রাইভার ও হেল্পার), মেয়েটির শরীরর বিভিন্ন স্থানে মানুষের দাঁতের কামড়ের গভীর ক্ষত পাওয়া যায়, সবশেষে একটি রড দিয়ে মেয়েটির আন্ত্রিক প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে দেয়া হয়। মেয়েটিকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নির্যাতনকারীরা এবং পালিয়ে যায়।
গোটা ভারত জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, সববয়েসী, সব পেশার মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশ তাদের উপর জলকামানের হামলা চালায়, লাঠিচার্জ করে। কিন্তু বিক্ষোভ দমাতে পারে না। মেয়েটিকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করা হয়, ভারতের সবথেকে ব্যয়বহুল ট্রমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, কিন্তু মেয়েটিকে বাঁচানো যায় নি। অপরাধীরা ধরা পড়ে। ওদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয় হয়।
এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে BBC(British Broadcasting Corporation) এর তথ্যচিত্র নির্মাতা লেসলি উডউইন ‘India’s Daughter’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র তৈরী করেন। প্রতিবেদনে সেই নির্মম ঘটনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী উঠে আসে। ভারতে নারীদের বর্তমান পরিস্থিতি কি, তারা কেমন আছে, কেন এই নির্যাতন প্রবণতা দিন দিন এত বাড়ছে, এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে যায় আসামি মুকেশ সিং এর নির্লজ্জ কথা শুনে। তার কথাগুলো মোটামুটি এরকম,
‘‘একজন ভদ্র মেয়ে কখনো রাত নয়টার দিকে ঘুরে বেড়ায় না। ধর্ষণের জন্য একটা ছেলে যতটা দায়ী, একজন মেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী। মেয়েদের কাজ হলো ঘরের কাজ করা, সংসার সামলানো। রাতে ডিসকো নাচে যাওয়া ও বারে ঘুরে বেড়ানো, আজেবাজে কাজ করা, ভুলভাল পোশাক পরা তাঁদের কাজ নয়। এ ধরনের মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার অধিকার অন্যদের আছে। কেবল ২০ শতাংশ মেয়ে ভালো।"
সত্যি কথা হল, যে মেয়েটির সাথে এমন বর্বরতা হয়েছিল, সে মেয়েটি একটি কল সেন্টারে চাকুরী করত। সারা দিন ক্লাস হত, তাই তাকে রাতের শিফট্ এ কাজ করতে হত। মেয়েটি স্বনির্ভর ছিল। সে নিজের উপার্জনে লেখাপড়া করতে চেয়েছিল। জীবনের প্রয়োজনে রাত করে বাড়ি ফিরলেই তাকে খারাপ মেয়ে ভেবে নির্যাতন করতে হবে, এ কেমন যুক্তি?
আসামি মুকেশের উদ্ধত্য থামে না। সে বলতে থাকে, 'মৃত্যুদণ্ড মেয়েদের জন্য পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। আমরা যেমন মেয়েটিকে ধর্ষণের পরই ছেড়ে দিয়েছিলাম, এখন আর কেউ তা করবে না। এখন ধর্ষণের পর মেয়েটিকে হত্যা করা হবে। আগে ধর্ষণের পর বলা হতো, “ওকে ছেড়ে দাও, ও কাউকে কিছু বলবে না।” এখন যখন কেউ ধর্ষণ করবে, বিশেষ করে সন্ত্রাসী কায়দায়, তাঁরা মেয়েটিকে জানে মেরে ফেলবে।’
আরেক অপরাধী অক্ষয়। তার ঘরে বউ আছে, একটি কোলের বাচ্চা আছে। তার বউ কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার স্বামী এমন কিছু করতে পারে। সবাই আশা করে অপরাধের পর অপরাধী লজ্জিত হবে, ক্ষমাপ্রার্থী হবে। কিন্তু অপরাধীদের এমন আচরণ আসলে কি বোঝায়? আমার মনে হয়, অপরাধীদের এমন আচরণ আসলে ভারতে মেয়েদের বর্তমান অবস্থাকেই বোঝায়। তথ্যচিত্রটি থেকে জানা যায়, ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী নির্যাতিত হয়। ২০১৪ সালে ‘India Today’ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গোটা ভারতবর্ষে প্রতিদিন প্রায় ৯২ জন নারী নির্যাতিত হয়, আর শুধুমাত্র দিল্লীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৪! ২০১৪ সালে গোটা ভারতবর্ষে ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধ ৩১% বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের কারাগারে এমন অনেক অপরাধী আছে, যারা একেকজন ২০০ টি নারী নির্যাতনের ঘটনার অপরাধে অপরাধী। তবুও অধিকাংশ নির্যাতনের ঘটনাই চাপা থাকে। চাইলেই এমন আরও ভয়ঙ্কর তথ্য ও পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরা যায়। কিন্তু তাতে কি হবে? তার থেকে বরং আরও একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তুলে ধরি।
‘India’s Daughter’ এর মত একটি মর্মস্পর্শী এবং তথ্যবহুল তথ্যচিত্র নির্মিত হবার পর একটি প্রচারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে বলে দিলেন, “not allow any organization to leverage such an incident and use it for commercial purpose.” ভারতে ‘India’s Daughter’ এখন নিষিদ্ধ। তবে ইউটিউব থেকে সরানো যায় নি এখনও। বর্তমানে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র্। তাই হয়ত ইউটউব থেকেও একসময় তথ্যচিত্রটাকে সরিয়ে ফেলবে তারা। কিন্তু এই নিষিদ্ধ করার খেলা খেলে কি লাভ হবে? বরং মন্ত্রীদের কি এটা বোঝা উচিত নয়, কেন একজন ধর্ষক এমন কথা বলছে? কোথা থেকে সে এসব বলার সাহস পাচ্ছে? তাদের এই বিকৃত মনস্তত্ত্ব কোথায় থেকে তৈরী হচ্ছে? সমস্যার মূলটা কোথায়?
তথ্যচিত্রটি দেখে জানা যায়, সমস্যার মূল হল ভারতের দারিদ্র্য।দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষগুলো খুব ছোট বয়স থেকেই দেখে আসে পুরুষরা মেয়েদেরকে অত্যাচার করছে, পুরুষরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারছে ইত্যাদি। আর খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করতে পারে না, তারা কিল-চড়-লাথি খেয়ে বড় হয়। একসময় তাদের মানসিকতা মরে যায়। তারা হিংস্র হয় ওঠে। কিন্তু এই ব্যাপারটিকে পুরোপুরি মানা যায় না। ভারতে অনেক ধনীলোকের ছেলেদের বিপক্ষেও এমন নারী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তারা তো অভাবে থাকে না, তারা অতিপ্রাচুর্যে অমানুষ হয়ে যায়, এই ব্যাপারটি তথ্যচিত্রে অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে যে গর্ব করব, তার উপায় নেই। এ সংক্রান্ত কোন পরিসংখ্যান আমি তুলে ধরব না, তবে আমাদের অবস্থা সুখপ্রদ নয়। উন্নত দেশগুলোর দিকে যদি তাকাই, তাহলে আরও হতাশ হতে হয়। সেসব দেশে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো দেখে হা করে তাকিয়ে থাকি। অর্থাৎ, অভাব এবং বিত্ত-দু রকম অবস্থাতেই মানুষ অমানুষ হয়ে উঠতে পারে। যদি একটি মাত্র উপাদান এই প্রবণতার লাগামে টেনে ধরতে পারে, সেটা হল শিক্ষা।
মানুষের ভেতর এমন পৈশাচিতার প্রভাব কোথা থেকে আসে, হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’, সিমোন দ্য বেভোয়ার এর ‘Second Sex’ বইগুলোতে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ফ্রয়েডও মানুষের এমন মনস্তত্ত্ব নিয়ে লিখে গেছেন। মেরি ওলস্টনক্র্যাফট্ তাঁর ‘ A Vindication of the Rights of Woman’ বইটিতে অনেক সাহস নিয়ে ঘোষনা করেন, নারী আর পুরুষের কোন পার্থক্য নেই, নারী ও পুরুষ- উভয়কেই সমানভাবে ভাবা উচিত।
বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত যখন সরকার নিল, তখন আমরা সবাই একবাক্যে প্রতিবাদ করেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল যে, ব্যাপারটি নিয়ে আমাদের কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মন্ত্রী মহোদয়রা কোন বেফাঁস কথা বলে ফেলেননি। আমাদের সে প্রতিবাদ সফল হয়েছে। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ই থাকছে, কিন্তু বাবা-মা চাইলে নাকি মেয়েদেরকে ১৬ বছর বয়সেও বিয়ে দিতে পারবেন! উচ্চপদস্থ লোকেরা বারবার কেন যে এমন কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন, তা ভেবে পাই না। বোধহয় এ নিয়েও আবার নতুন করে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
আগামীকাল বিশ্ব নারী দিবস। মুক্তি বলতে বোঝায় বাক্য,কর্ম ও চিন্তার মুক্তি। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় বাক্য,কর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা। তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করে কখনও নারী স্বাধীনতা আনা যাবে না। অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তা-ঘাটে একা চলাচল করাই স্বাধীনতা না। আবার অপরাধীদের ভয়ে নারীদের রাস্তা-ঘাটে চলাচল বন্ধ করে দিলে বা কালো কাপড় পড়িয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলেও নারী স্বাধীনতা আসবে না। স্বাধীনতা আসতে পারে স্বাধীন হবার দুদর্মনীয় ইচ্ছে থেকে। নারীদের সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন হবার ইচ্ছে মনে আনতে হবে। অনেক আগে বেগম রোকেয়া নামের একজন মহীয়সী নারী বলে গিয়েছেন, মেয়েরা যেন পুরুষের সমকক্ষ হবার চেষ্টা করে। কথাটি আজও খুবই সত্য। তার সাথে, প্রসারিত করতে হবে শিক্ষার আলো। কমাতে হবে দারিদ্র্য, কমাতে হবে বেকারত্ব সমস্যা। এতগুলো বড় বড় কাজ একবারে হবেনা, সেটা সত্য। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে সবাই যে বিষয়টিতে একমত হবে, সেটা হচ্ছে এই নির্যাতন ও সহিংসতা কমানো। তার জন্য এই বড়বড় কাজগুলো করতেই হবে। এসব অবকাঠামোর উন্নতি হলেই সমাধান আসবে। এমনিতেই কখনও সমাধান আসে না। অতএব, আপাতত এই অবকাঠামোগুলো উন্নত করাই প্রদান দায়িত্ব, অন্তত ভারত সহ উপমহাদেশের দেশগুলোর জন্য। এর ব্যর্থতা আমাদের সবাইকেই মেরে ফেলবে, আর সফলতা বাঁচাবে অনেক দিন।।
তথ্যসূত্রসমূহ:
১। BBC ‘India’s Daughter’: https://www.youtube.com/watch?v=mxkMzBqjgw8
২। Click This Link
৩। Click This Link
৪। Click This Link
৫। Click This Link
৬। Click This Link
৭। Click This Link
©somewhere in net ltd.