নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে ...

পেলব চক্রবর্তী

ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম...

পেলব চক্রবর্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পে গল্পে ক্রিকেট

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৩

বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সবদিক থেকে পরাজিত করেছে। আঙ্গুল দিয়ে গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ক্রিকেট দল। এটা আমাদের জন্য কতটা আনন্দের ব্যাপার, কতটা সম্মানের ব্যাপার, তা বোধহয় আমরা পুরোটা ভাবতেও পারছি না। বাংলাদেশ ক্রিকেটে উন্নতি করছিল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড সহ পৃথিবীর সব পরাশক্তিগুলোকে হারিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনভাবেই জয় আসছিল না।একবার পাকিস্তানে গিয়ে একটা টেস্ট ম্যাচে আমরা পাকিস্তানকে প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ইনজামাম-উল-হক পাকিস্তানকে জিতিয়ে দেয়। আমি তখন অনেক ছোট। হেরে যাওয়ার খবর শুনে প্রায় কান্না চলে আসছিল। এমনটা আরও কয়েকবার হয়েছে। সর্বশেষ আমাদের সেই ফাইনালে ওঠা ঐতিহাসিক এশিয়া কাপে। আমরা সব দলকে হারালাম। কিন্তু কেন যে বারবার পাকিস্তানের কাছে হেরে যাই! মনে কষ্ট জমত, পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকাগুলোকে ফলাও করে তাদের এ সাফল্যের কথাগুলো লিখত। আর প্রতিবেদনের নিচে জঘন্য সব মন্তব্য করত ওদের দেশের কিছু পাঠক। দেখে খুব কষ্ট হত। কিন্তু বলার কিছুই ছিল না। সত্যিই তো, এতগুলো বছর হয়ে গেল, আমরা পাকিস্তানকে একবারও হারাতে পারিনি। ওরা তো গর্ব করতেই পারে।



আমার মনে হয়, পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের এই জয়টির আনন্দ-গৌরবের পুরোটাই নির্ভর করছে আমাদের অনুভবের উপর। পাকিস্তানকে হারানোর জন্য আমরা কতটা তৃষ্ঞার্ত ছিলাম! সেই ১৯৯৯ সালের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে আর কোন জয় নেই। কিছু দিন পরপরই রমিজ রাজা, নভোজিৎ সিং সিধু’রা আমাদের ক্রিকেট নিয়ে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করছে। আমরা জানতাম, ওদের মত অসভ্য কথা বলে এর উত্তর দেয়া যাবে না। উত্তর দিতে হবে ভালো খেলেই।



অর্থাৎ, মাঠের ভেতরে এবং বাহিরে, আমাদের খেলোয়াড়রা এবং আমরা- সবাই চাপে ছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় চাই। এখন সেই শুভক্ষণটি এসেছে। আমরা পুরো জাতি গর্বিত, আনন্দিত।



আজ আমি সবাইকে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কিছু গল্প শোনাবো। গল্পগুলো ঐতিহাসিক। অনেকেরই জানা থাকতে পারে। তারপরও আবার নতুন করে আজ বলতে খুব ইচ্ছে করছে। এখন তো আমাদের আনন্দ-উল্লাস করারই সময়, সাথে গল্পগুলো সবাইকে শোনানোরও এই উপযুক্ত সময়।







গল্পটা শুরু করতেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎই অতীতের কিছু ভুল মনে পড়ল। এবার আর কোন ভুল করব না। খেলার সাথে অন্য কিচ্ছু মেশাবো না। শুধু ক্রিকেটের গল্পই বলব।



২০০৯ সালে পাকিস্তানে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছিল। জানেন, কি ছিল সেই টুর্নামেন্ট এর নাম? বলছি, ‘আলবদর টুর্নামেন্ট’। ‘আলবদর’ ব্যাপারটা কি সেটা হয়ত বুঝিয়ে বলতে হবে না। যাকগে, ওদের দেশ- ওরা যা খুশি তাকে খেলাক। আমাদের কি?



আমরা বরং একটি অন্য গল্প শুনি। ক্রিকেটার রকিবুল হাসানকে তো আমরা চিনি। তিনি একবার ভয়ংকর এক কাজ করে ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। হঠাৎই তিনি ব্যাটে জয় বাংলা লেখা ও স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা স্টিকার নিয়ে খেলতে নেমে পড়লেন। তারজন্য মূল্যও দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল তাঁকে। কি সাহস ছিল লোকটার, তাই না? রকিবুল সেদিন বোঝেন নি যে খেলা শুধু খেলাই, এর সাথে কিসের রাজনীতি, কিসের স্বদেশপ্রেম, কিসের ভালোবাসা!



যাকগে, গল্পটিকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাই। সেই ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ক্রিকেট ম্যাচ মার্চ মাসেও গড়াল। ১৯৭১ সাল, মার্চ মাসের ১ তারিখ। সুন্দর খেলা চলছে। দুপুরের দিকে রেডিওতে হঠাৎ শোনা গেল, ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল করে দিয়েছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ল চারদিকের মানুষ। গ্যালারিতে আগুন জ্বলল। পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হল। সেদিনের সেই বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিশ্চই খেলার সাথে অন্যকিছু মেশানোর বোকামি সম্পর্কে জানাতে হত। আমাদের দেশে আজকের দিনের পাকিস্তান ক্রিকেটের সমর্থক জ্ঞানী-গুণী তরুণরা যে কেন সেদিন ছিলেন না!



থাক। বরং গল্পটা আরেকটু এগিয়ে যাক। এই ঘটনার পর পাকিস্তান ক্রিকেটদলকে সম্ভবত ৩ তারিখ পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখা হয়। বিদায়ের সময় রকিবুল হাসানের এক সতীর্থ তাঁকে বলেছিলেন, আবার দেখা হবে। জবাবে রকিবুল বলেছিলেন, হ্যা আবার দেখা হবে, তবে দুজন ভিন্ন দেশের হয়ে, ভিন্ন মানচিত্রের হয়ে, ভিন্ন পাসপোর্ট নিয়ে! লোকটার সাহস আছে বলতে হয়।





পরের গল্পটা শুরু করি। সে গল্পের নায়ক জুয়েল নামের একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার। বিধ্বংসী ওপেনার ছিলেন তিনি। চেষ্টা করে গেলে জাতীয় দলে সুযোগ হয়ত হয়েও যেত। তা না করে ছেলেটি যুদ্ধে নেমে গেল। কেনই বা নামবে না। জুয়েলের প্রিয় বন্ধু মুশতাক(তিনিও একজন অসাধারণ ক্রিটেকার ছিলেন), তাঁকে যে ২৫ মার্চ রাতে মেরে ফেলা হল। জুয়েল আর কি করে স্থির থাকে। ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধে।



নারায়নগঞ্জে অপারেশন চালানোর সময় তাঁর ডান হাত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জুয়েল ধরা পড়ে সম্ভবত ২৯ আগস্ট। তাঁর ক্ষতিগ্রস্থ হাতে পাকিস্তানিরা চালায় অমানুষিক নির্যাতন। তাঁর মৃত্যুর কোন নিশ্চিত খবর পাওয়া যায় না।





আমি মাঝে-মধ্যেই সুযোগ পেলে এই গল্পগুলো আশেপাশের মানুষজনকে শোনাই। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে শোনে। আবার কেউ কেউ বিরক্ত হয়। ফলে এই গল্পগুলো হয়ে গেছে খুবই সাধারণ। দু-চারটি বই-পত্র ঘাটলেই এসব জানা যায়। তবুও, অন্তত আজকে গল্পগুলো নতুন করে জানানোর প্রয়োজন পড়েছে। অন্য ক্ষেত্রে যা খুশি তা হোক, কয়েকজনকে দেখে খুব অবাক হতাম। ওরা বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তান জিতলে আনন্দ পেত এবং তার বিকৃত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো অনলাইনে। সুখের কথা, এখন এই প্রবণতা আর চোখে পড়েনা। অন্তত দেশের ব্যাপারে সবাই এক থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।





আর এসব কারনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়টা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা পাকিস্তানের কাছে হারতে রাজি না। ক্রিকেট তো এখন আমাদের সবকিছুর সাথেই মিশে আছে। পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেটে হারলে আমার মনে হতে থাকে, আমাদের সবকিছুই যেন ওদের কাছে আবার হেরে গেল। ভেতরে অনেক কষ্ট হয়।



এই জয় দিয়ে আমরা অনেককেই মুখের উপর উত্তর দিয়েছি। প্রিয় ক্রিকেটাররা হয়ত জানেনও না তারা এতগুলো বছর পর আজ আমাদেরকে কি দিয়ে ফেলেছেন। আমরাও আসলে জানি না। কিন্তু অনুভব করতে পারি। খুব অল্পদিন পর এমন দিন আসবে যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো বাংলাদেশকে তাদের দেশে ডেকে ধন্য হবে। সবথেকে খুশি হব তখন, যখন শুনবো, ভারত বাংলাদেশ ক্রিকেটদলকে তাদের দেশে খেলতে ডেকেছে।



ক্রিকেটকে কিভাবে যে আমরা এত আপন করে নিয়েছি, তা বোধহয় কেউ বলতে পারব না। কিন্তু বলতে পারব, এই ক্রিকেটই এখন আমাদের আনন্দ দেয়, সম্মান দেয়। হেরে গেলে দেয় যন্ত্রণা, অপমান। আমাদের ক্রিকেট আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নয়, আমাদের আন্দোলন নয়, আমাদের জাতীয়তাবোধের চেতনা নয়- কিচ্ছু নয়। কিন্তু আবার সবকিছুই। ভালোবাসা এমনই হয়, কিছুতেই থাকেনা, আবার সবটা জুড়েই থাকে।আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমরা আমাদের ক্রিকেটকে অনেক বেশি ভালোবাসি। এ কি আমাদের অনেক বড় পাওয়া নয়?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.