![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বলিউডের ছবি দেখছিলাম সেদিন। নায়ক অক্ষয় কুমার। সে একজন পুলিশ অফিসার। কি তার সততা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অকুতোভয় সংগ্রাম! শুধু বলিউড কেন, বাংলাদেশের ছবিগুলোতেও অনেক সাহসী পুলিশ অফিসার আছেন। যেমন মান্না, রুবেল; ওনারা আমার খুবই প্রিয় অভিনেতা। ছবিগুলো দেখতে দেখতে খুব ছোট থেকেই ভাবতে শিখেছিলাম, পুলিশ মানেই অসম্ভব রকম সৎ ও সাহসী। একবার তো ভেবেই বসলাম, বড় হয়ে পুলিশ হব!
ভাবনা-চিন্তা মানুষের পাল্টায় ঠিকই। বাস্তবটাকে চিনতে শিখলেই মানুষের চিন্তা-ধারা পাল্টায়। যেমন, যখন একটু বড় হলাম, তখন বুঝলাম, মান্না বা রুবেল; ওনারা আসলে পুলিশের লোক নন, ওনারা শুধুই অভিনেতা। আরও একটু বড় হয়ে বুঝে ফেললাম, পুলিশ মানেই সৎ ও সাহসী নয়। অনেক নোংরা ও কাপুরুষও পুলিশের পোষাক পড়ে থাকে। এরপর আমি আরও একটু বড় হলাম। আশে-পাশের মানুষের কথা বুঝতে শিখলাম। তারপর নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগলাম। কেন? ‘বড় হয়ে পুলিশ হব’- এমন জঘন্য একটি চিন্তা মনে আনার জন্য!
এই কথাগুলো বলার আসলে কোন প্রয়োজন ছিল না। কারন, এই কথাগুলো একদমই নতুন নয়। তবুও, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা মনে করে ক্ষোভে-দুঃখে কথাগুলো লিখে ফেললাম।
২
অতি সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনা দেশে ঘটে গেছে, যেগুলো নিয়ে শুধু দেশে না, মোটামুটি গোটা পৃথিবীতেই আলোচনার ঝড় উঠেছে। প্রথম ঘটনাটা মনে করতে আামার একদমই কষ্ট হচ্ছে না। আর সেটি হচ্ছে ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার দিনটি, ২৬ ফেব্রয়ারী,২০১৫। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা অনুসারে, পাশেই পুলিশ সদস্য ছিল, তারা নির্বাক পুতুলের মত দাঁড়িয়ে ছিল। হত্যা তো ঠেকাতে পারেইনি, এমনকি হত্যাকারীদের ধরতে পর্যন্ত পারেনি।
তার অল্পকয়েকদিন পর, ৩০ মার্চ ঘটে দ্বিতীয় ঘটনা। ওয়াশিকুর বাবু নামের একজনকে দিনের আলোয় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী ধরা পড়ে। কারা ধরে হত্যাকারীকে? না, কোন পুলিশ নয়। ধরে কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তারা ধরে হত্যাকারীকে পুলিশের কাছে এনে দেয়।
তারপর আসল আমাদের প্রাণের উৎসব নববর্ষ। কয়েকটি বখাটে গোটা উৎসবটাকে কলঙ্কিত করল। সাংবাদিক, ফেইসবুকার ও ব্লগাররা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের মুখমন্ডল, ঐ সময়ে তাদের গতিবিধি, অপকর্ম সবই উদ্ধার করে ফেলল। এমনকি জোগাড় করে ফেলল তাদের নাম-ঠিকানাও। কিন্তু হায়, আমাদের পুলিশ সদস্যরাই শুধু উদ্ধার করতে পারল না। শাস্তি দিতে পারল না দোষীদের
পরের গল্পটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাকিব হোসেনের। বিমান বন্দরে যাবার পথে এক পুলিশ সার্জেন্ট কর্তৃক লাঞ্ছিত হন। সেই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকতা নিয়ে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করেন। প্রশ্ন হল, পুলিশ এত সাহস পায় কোথা থেকে?
দেশে এখন অরাজকাতার শেষ নেই। তাই চাইলেই এই তালিকাকে আরও বড় করা যায়। কিন্তু তাতে কি হবে। আপাতত এই ক’টি ঘটনাকে যদি কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গোটা জাতির কাছে ব্যাখ্যা করতেন(প্রথাগত অসাড় কথাগুলো না বলে), তবে আমরা কৃতজ্ঞ থাকতাম।
৩
প্রশাসন ও দুর্নীতি নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। টিআইবি’র রিপোর্টে উঠে আসে এই সব অস্বচ্ছতার কথা। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা সেগুলা অস্বীকার করেন। উপরন্তু দোষ চাপান গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানটির উপর। আর দুদক কে নিশ্চই আলোচনার মধ্যে না আনাই ভালো। পুলিশের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায় কিছু পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে। তথ্যগুলো হুবুহু তুলে দিচ্ছি,
‘পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিমাসে গড়ে ১২ শতাধিক ছোট-বড় অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত তিন বছরে অর্ধ লক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল এবং ডিসিপ্লিন বিভাগে। গত বছরেই প্রায় ১৫ হাজার অভিযোগ জমা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুর্নীতি ও শৃঙ্খলাভঙ্গসহ নানা অপরাধে পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৩৪ হাজার ১২৯ জন পুলিশ সদস্য শাস্তি পেয়েছেন।’ (মানবজমিন: পুলিশের অপরাধ খুঁজে পায়না পুলিশ, বেড়েই চলছে অপরাধ প্রবণতা)।
‘পুলিশ সদর দফতরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত আড়াই বছরে ১১৪ জন ইন্সপেক্টরকে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০৯ জনকে লঘু দণ্ড এবং ৫ জন ইন্সপেক্টর গুরুদণ্ড পান। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৪৬ ইন্সপেক্টর, ২০১৩ সালে ৩৯ জন ইন্সপেক্টর এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২৯ ইন্সপেক্টরকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয়। এদিকে ওই সময়ের মধ্যে পুলিশের কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ৩৩ হাজার ৯৮৫ জন সদস্য তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সাজা পান। এর মধ্যে নানা অপরাধে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ২৮৫ জনকে। বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে ১৬ জনকে, লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৬০২ জনকে এবং গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৮২ জন পুলিশ সদস্যকে।’(দৈনিক ইত্তেফাক: আড়াই বছরে ৩৪ হাজার পুলিশের শাস্তি)।
আমরা সাধারণ মানুষ। এতসব নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। আমাদের চিন্তা হল, রাস্তা-ঘাটে কোন অপরাধী যদি আমার কাছের কাউকে হত্যা করে, তবে আমি কেন তার বিচার পাব না। আমাদের প্রশ্ন হল, রাস্তা-ঘাটে যদি কেউ আমাকে অপমান করে, লাঞ্ছিত করে, এবং আমি যদি অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারি, তবে আমি কেন তার বিচার পাব না। গাড়ি আটকিয়ে কাগজ-পত্র দেখার নাম করে ঘুষ খাওয়ার সাহস পুলিশ পায় কোথা থেকে। শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়কে গালি দেয়ার সাহস একজন পুলিশ পায় কোথা থেকে। সেকি জানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার জন্য কত পড়াশোনা করতে হয়? জানেনা, কারন জানলে নিশ্চই এমন আচরন করত না। আর আমাদের শিক্ষক মশাইয়েরও ভুল। কোথায় ওই সার্জেন্ট ইমরানকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাঁচবেন, তা না করে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন। স্যার ভুলেই গেছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওইসব পুলিশের নৈতিকতার মাত্রা কোথায়।
৪
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীর কাজ আইন রক্ষা করা। কিন্তু তারা যখন আইন ভাঙেন সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আর তাই সাধারণ কেউ আইন ভাঙলে যে শাস্তি হওয়া উচিত, পুলিশের ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি হওয়া উচিত।’
পুলিশের অপরাধ প্রবণতার এই ভয়ঙ্কর চিত্র দেখে সহজেই বুঝে ফেলা যায়, বাংলাদেশের পুলিশের অপরাধের মাত্রা কি বিশাল মাত্রায় বেড়ে গেছে ও যাচ্ছে। আর এত উচ্চ মাত্রার অপরাধপ্রবণতায় পুলিশের নৈতিক মূল্যবোধের অবস্থান কোথায় হতে পারে? প্রশাসনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ঘুষ না দিয়ে কোন কাজ হয়, এটা শুধু আমার কথা না, অনেক ভুক্তভোগীর কথা।
আর এই যদি হয় পুলিশের আচরণ, তাদের চারিত্রিক গুণাবলী(!), তাহলে সাধারণ মানুষ তাদের উপর কি করে আস্থা রাখবে? মানুষ কি আদৌ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বন্ধু ভাবতে পেরেছে? থানায় আটকে রেখে ঘুষ চাওয়া. অনাদায়ে অমানবিক অত্যাচার, হত্যা- এগুলোও বেশ পরিচিত ঘটনা(গতপরশু সাভারে এমন একটি হত্যাকান্ড ঘটেছে)।
এরপর যদি মানুষজন পুলিশকে নপুংশক বলে গালি দেয়, ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের জন্য হাতের চুড়ি নিয়ে শাহবাগ থানা ঘেরাও করে, অপরাধীদের বিচারের দাবীতে ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও করে- সেটা কি অপরাধ হবে? কিন্তু সেখানেও পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে কি আগ্রাসী কর্মকান্ডটাই না করল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে আটকাতে তারা জলকামান ব্যবহার করল। আন্দোলনকারী মেয়েদের উপর হামলা করল। আমি টেলিভিশনে সেগুলো অবাক হয়ে দেখলাম। কিন্তু, এতকিছুর পরও পুলিশের কাছ থেকে কোন জবাবদিহিতা পাওয়া গেল না যে কেন তারা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এতসব স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখের অপরাধীদের ধরতে পারছে না।
৫
অপরাধী কে, তা পুলিশ জানে না, এমন কথা আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করব না। পুলিশ নিশ্চই জানে অপরাধী কে বা কারা। যেমন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি কে কারা হত্যা করেছে, আমার বিশ্বাস গোয়েন্দা সংস্থা বা পুলিশ তা জানে। আমরাও এটা জানি যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলেই অনেক কিছু করতে পারেনা, অনেক কিছু বলতে পারেনা। তার কারন, অসাধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের চাপ। যেসব ক্ষেত্রে এমন রাজনৈতিক চাপ নেই, সেসব ক্ষেত্রে পুলিশ কিন্তু বেশ সফল। যেমন, সাভারের ব্যাংক ডাকাতি। অপরাধীদের ধরা গেছে, ওদের বিচারও চলছে। বেশক’জন পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকারীকে ধরা হয়েছে। দেশে জঙ্গী তৎপরতাকেও যথাসম্ভব থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী পারে না, এটা অসত্য। যেটা সত্য সেটা হল, তাদেরকে পারতে দেয়া হয় না। কিছুসংখ্যক কুলাঙ্গার পুলিশ স্বভাবদোষে আর বাকিদের অনেকেই পরিবার চালাতে গিয়ে, অর্থকষ্টে ভুগে রাস্তা-ঘাটে গাড়ি আটকায়। ঘুষ খায়। মানুষকে হয়রানি করে।
কিন্তু যদি এই সংস্কৃতিই চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ কি। পুলিশ তো শুধু দামী-দামী গাড়িতে চেপে বেড়ানো মন্ত্রী-এমপি দের জন্য নয়। পুলিশকে একজন শিল্পপতি থেকে শুরু করে একজন দরিদ্র কৃষক- সবারই নিরাপদ জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ এটাই চায়। সিনেমার নায়কের থেকে বাস্তবে নায়কসুলভ কাজ করা অনেক বেশি কঠিন। আমাদের পুলিশের সে ক্ষমতা অবশ্যই আছে। প্রয়োজন শুধু তাদেরকে গডফাদারদের চাপমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া।
একবার যদি শুধু এমনটা হয়, নিশ্চই দেশে অপরাধ প্রবণতা অস্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসবে। মানুষ পুলিশকে নপুংশক বলে গালি দেবে না, হাতের চুড়ি নিয়ে থানা ঘেরাও করবে না। বাবা-মা বাচ্চাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে, তারা যেন বড় হয়ে পুলিশ হয়। এখন যেমন অনেক বাচ্চাই বলে যে তারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে, তেমনি অনেক বাচ্চাই বলবে যে, তারা ভবিষ্যতে পুলিশ হয়ে মানুষের সেবা করবে। আমি কথাগুলো এমনিতেই বলছি না, আমি কথাগুলো বিশ্বাস করি বলেই বলছি। সেই দিনগুলো নিশ্চই অনেক সুন্দর হবে, তাই না?
©somewhere in net ltd.