নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে ...

পেলব চক্রবর্তী

ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম...

পেলব চক্রবর্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরীক্ষার ফলাফল ও আত্মহত্যা

০৮ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:১০

পৃথিবীতে অনুপ্রেরণা দেয়ার মত বাণীর অভাব নেই। মহান ব্যক্তিদের জীবনী পড়লে দেখা যায় যে তাঁরা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন,তারপরও হাল ছাড়েন নি এবং একসময় সফল হয়েছেন। ছোট থেকেই শেখানো হয়, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’। আমরা বই পড়ে শিখি পিপীলিকার কথা, শিখি মৌমাছির কথা, শিখি বাবুই পাখির কথা- জানতে পারি যে তারা কত পরিশ্রমী, ভাবসম্প্রসারণ লিখি, ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’। বাবা-মা প্রতিনিয়ত আমাদের এসব সেখান, বোঝান, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একই বুলি আওড়ান। আমরা সেগুলো শুনতে শুনতে মুখস্ত করে ফেলি।

কিন্তু এত করে শেখানো মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া এই সব মহান কথাগুলো হঠাৎ করে কেন ভেঙ্গে পড়ে সামান্য ব্যর্থতায়? কেন প্রতিটি বছর প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশের পর মোটামুটি নিয়ম করে শুনতে হয় প্রাণহানির খবর? জীবনটা কি শুধুই ভালো ফলাফল করার জন্য? বিষয়টা এখন নিশ্চই আর ছেলেখেলা নয়।


ছেলেটি ফেনী জেলার,নাম আরাফাত শাওন। সে এসএসসি তে বাণিজ্য বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে ৪.৮৩ পেয়েছিল। কিন্তু ফলাফল ভালো হয় নি বলে সে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে! তার আগে লিখে যায় একটি সুইসাইড নোট। ইন্টারনেটের কল্যাণে সেটি নিশ্চই সবার পড়া হয়ে গেছে। আমি জানি এই নোটটি পড়ে আমাদের সবার দুঃখ প্রকাশের সব ভাষা হারিয়ে গেছে। নোটটিতে বেশ কিছু ভাবার মত বিষয় রয়েছে, যেমন শিক্ষাব্যবস্থা,সন্তানদের উপর বাবা-মায়ের অসহনীয় চাপ ইত্যাদি। আমার কষ্ট হচ্ছে যে এই ছেলেটিই হয়ত বড় কিছু হয়ে একসময় দেশের সম্মান বাড়াতে পারত। বর্তমান সময়ের তীব্র প্রতিযোগীতা আর এ প্লাসের ছড়াছড়ির যুগেও এমনটা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই সেরকম একটি সুযোগ হারিয়ে ফেললাম।

এ বছরই এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করে গোপালগঞ্জে সাধনা বিশ্বাস এবং নাটোরে শারমিন খাতুন নামের দুই শিক্ষার্থীও আত্মহত্যা করেছে। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় আর আমি ভয়ে ভয়ে থাকি,কখন যে আত্মহত্যার খবর শুনতে হয়। প্রতিটি বছর এমন ঘটনা ঘটে। পরীক্ষায় পাশের হার আর এপ্লাসের সংখ্যার পরিবর্তে আমি গুনতে থাকি আত্মহত্যা করা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা। এসএসসি,এইচএসএসসি এমনকি পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষায় ব্যর্থতার পর আত্মহত্যার খবরও রয়েছে। এই খবরগুলো কি ইঙ্গিত দেয়? এত ছোট বয়সের একটি ছেলে বা মেয়ে, যে জীবনটার এখনও কিছুই দেখে নি, সেকি করে আত্মহত্যার মত ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে?

ধরা যাক, আমার বন্ধু খুব ভালো একটা অবস্থানে চলে গেল। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার খারাপ লাগবেই। আবার ধরা যাক, আমার সব বন্ধু খুব ভালো চাকুরী পেয়ে গেল। কিন্তু শুধুমাত্র আমি পেলাম না। আমার অনেকগুলো ছোট বোন আছে। আমার বাবা অসুস্থ। বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। জীবনের ‍উপর চরমও পরম বিতৃষ্ঞা না আসলে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না।

কিন্তু এই ১৫-১৬বছরের ছেলে-মেয়ে গুলো কেন আত্মহত্যা করছে? তাদের উপর তো এত দায়িত্ব নেই, তাহলে? উত্তরটা হচ্ছে, তাদের মানসিকতার উপর এমনই এক পাহাড় সমান দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যে তাদের পক্ষে এটা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক পরিবারের বাবা-মা সবসময় সন্তানদের সাথে ধমকের স্বরে কথা বলেন। ফলে, পরীক্ষায় খারাপ করলে কি হবে, সন্তানরা সেটা ভাবতেও পারে না। পাড়া-প্রতিবেশী,বন্ধু-বান্ধব,সবাই উপহাস করবে, হাসবে, গোটা পৃথিবীর সবকিছুই তখন শত্রু হয়ে যাবে, সে কোন ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না, পৃথিবীর সবকিছু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে তার মাথার ‍উপর- কি অসহনীয় মানসিক চাপ! ১৪-১৫ বছরের একটি কিশোর বা কিশোরীর পক্ষে আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই পরিমান চাপ কি যথেষ্ট নয়?


একটি রোগ আছে।নাম ‘প্যারাসুইসাইড’। টিন এজারদের মধ্যে এই আত্মহত্যা প্রবণতার নাম হচ্ছে প্যারাসুইসাইড। ক্লাস এইট বা টেন, এই সময়টা বয়ঃসন্ধির সময়।এই সময় একজন ছেলে বা মেয়ের সবরকম পরিবর্তন হয়। এসময় তাদের মানসিকতার পরিবর্তন আসে।তাদের মাঝে আত্মসম্মানবোধ জেগে ওঠে। আমার মনে আছে, হাইস্কুলে আমাকে কেউ এতটুকু বিদ্রুপ করে কথা বললে আমার প্রচুর রাগ হত। আমি সারাদিন তার ‍উপর অভিমান করে থাকতাম। সত্যি কথা বলতে, এই সময়টাই এমন। বাবা-মাকে খুব সাবধানী হয়ে এই সময়টাতে সন্তানদেরকে পরিচালনা করতে হয়। বাবা-মা যদি এই সময়ে তাদের সন্তানদের বুঝতে না পারেন, তার থেকে খারাপ আর দুঃখজনক ঘটনা আর একটিও হতে পারে না।

এই সমস্যা আমাদের পাশের দেশ ভারতেও বেশ প্রকট। সেখানেও মোটামুটি নিয়ম করে পরীক্ষায় খারাপ করার কারনে আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই প্রবণতার চিহ্ন পাওয়া যায়। বাদ যায়না উন্নত দেশগুলোও।

পৃথিবীতে বছরে গড়ে ৮ থেকে ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে! বাংলাদেশে প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে গড়ে প্রায় ২৮ জন! কি পরিমান জনশক্তি আর সম্ভাবনা আমরা শুধু আত্মহত্যার কারনে হারাচ্ছি তা একটু অঙ্ক কষলেই বেরিয়ে আসবে। আত্মহত্যা মানেই ক্ষতি। তবে সবথেকে বড় ক্ষতি হয় যখন কোন কিশোর বা কিশোরী অভিমান করে আত্মহত্যা করে। যার সারা জীবনটাই বাকি থেকে গেল, সেই জীবনে কি আছে না আছে, এসব না জেনেই, দেশ ও দশের জন্য কিছু না করেই যে ছোট্ট প্রাণ চলে গেল, সে কষ্ট রাখার মত কোন জায়গা পৃথিবীতে নেই।

ছোট থেকে আমাদের মা আমাদেরকে গড়ে অন্তত ১০০ বার মরে যেতে বলেন। আমরা কিন্তু একবারও মরি না। মরে যেতে বললেই সত্যি সত্যি মরে যেতে হয় না- সন্তানদের এটা বুঝতেই হবে। ক্লাস নাইনের প্রথম পর্ব পরীক্ষায় আমি যখন খুব খারাপ করলাম, আমার উপরও অনেক রকম চাপ আসা শুরু করল। কেউ আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না, সবাই খুব হতাশ। এত সব হতাশার মাঝে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ‘শত মনীষীর জীবনী’ বইটা পড়তাম। কারন আমি জানতাম, এই অবস্থায় একমাত্র এই বইটাই আমাকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে।

বয়ঃসন্ধির সময়টাতে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক ভয় থাকে, এই বুঝি তারা বখে গেল, এই বুঝি তারা খারাপ সঙ্গে জড়িয়ে গেল, এই বুঝি তারা মাদক সেবন শুরু করল। যেটা খুবই প্রয়োজন তা হল, স্কুলের বই-পত্রের পাশাপাশি অন্যান্য বই যেমন, গল্প বা কবিতার ভালো-ভালো এবং মজার বইগুলো পড়া। ছেলে-মেয়েদেরকে গল্পের বই পড়তে দিলে এই সময়ের যে সমস্যা এবং ভয় গুলো থাকে, সেগুলোর ৫০ শতাংশেরও বেশি সমাধান হয়ে যায়। গল্পের বই পড়ে কখনও কারও রেজাল্ট খারাপ হয় নি। যে মানুষ বই পড়ে, তার পৃথিবীটা কখনও ছোট হয় না। আর যার পৃথিবী ছোট নয়, সে কখনও আত্মহত্যা করতে পারেনা, সে কখনও জীবনের প্রতি হতাশ হতে পারে না।

প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে সাফল্যে হাসবে, আর একই বয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে না ফেরার দেশে চলে যাবে, এমন ঘটনা আমরা আর একটাও দেখতে চাই না। তার জন্য আমাদের যা করা দরকার,তাই করতে হবে, যতসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সব নিতে হবে। একবার ভেবে দেখি, আইনস্টাইন পরীক্ষায় ফেল করে মনের কষ্টে যদি আত্মহত্যা করে বসতেন, তাহলে আমাদের সবার কি হত, আমরা আজও কত শত বছর পিছিয়ে থাকতাম? আজ যে ছেলেটি আত্মহত্যা করল, হয়ত সে ছেলেটিই একদিন গোটা দেশের ভাগ্য বদলিয়ে দিত। তাহলে আমরা কতটা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলাম? এ আমাদের কতটা দুর্ভাগ্য, কতটা ক্ষতি?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.