![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাংস্কৃতিক কর্মী শিল্প তৈরি করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন..... তবে শিল্পীর শিল্প তৈরি হওয়া চাই-ই-চাই.......সাংস্কৃতিক কর্মীর মূল কাজ শিল্পীর তৈরি শিল্পকর্ম এবং জনগনের মধ্যে মেল বন্ধন অর্থাৎ সহজ ভাষায় বললে, সেতু তৈরি করা..... আর এই সেতু তৈরির কাজ সাংস্কৃতিক কর্মীর করা চাই ই-চাই....এখানে ফাঁকিবাজির সুযোগ নাই.....সুযোগ নাই শিল্পীর মতো ব্যক্তি কেন্দ্রিক চিন্তা করার..... সাংস্কৃতিক কর্মীকে তাই মাঝে মাঝে শিল্পীর চাইতে সংগঠকের ভুমিকায় বেশি অবতীর্ণ হন...... এতে দোষের কিছু দেখি না....সব ঠিকঠাক থাকলে সাংস্কৃতিক কর্মী নামক শব্দের উৎপত্তি ঘটতো না..... সবাই শিল্প চর্চাই করতো.....শিল্প চর্চা করতে এসে কেউ বিপ্লবের কথা বলতো না..... যেহেতু বিপ্লব একটি কঠিন সত্য...... বিপ্লব দীর্ঘজিবী হোক.....\\\\\\\\\\\\\\\\n(১৪ মার্চ ২০১৫, পল্টন ...........)
“বেজন্মার বাচ্চা”। এই গালিটা আমরা প্রায় সময়ই শুনি। এই বেজন্মার বাচ্চাদের আমরা আমাদের চারপাশে দেখি। ঘুরে ফিরে, কোন বেলা পেটে কিছু পড়ে, কোন বেলা পড়ে না। নেশা করে, স্টেশনে ঘুমায়, ভাগ্য একটু সুপ্রসন্ন হলে এতিম খানাগুলোতো আছেই। আমি মাঝে মাঝে ভাবি এই যে, আমরা বেজন্মার বাচ্চা বলে গালি দেই। এটা কি ঠিক? যার জন্ম পরিচয় নেই এটা কি তার দোষ? সমাজ বা ধর্ম প্রতিদিন এতো অন্যায় প্রশ্রয় দিতে পারলে একটা মানুষের জন্মকে কেনো স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারছে না? তাহলে আমরা কেমন আধুনিক? সমাধান যেহেতু দিতে পারি না, তাই একজন জন্মপরিচয়হীন মানুষের পরিচয় কেনো আমরা একটি গালি হিসেবে বিবেচনা করবো? আমার আরো মনে হয়, একটা দিক থেকে তারা আমাদের থেকে এগিয়ে। সেটা হলো পিছুটান। যা ওদের নাই। এই পিছুটানহীন মানুষগুলোকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে এরা আমাদের চাইতে সমাজে অনেক বেশি ভুমিকা রাখতে পারতো। যেকোন সময় সৎ সিদ্ধান্তটি নিতে পারতো সবার আগে। সে যাই হোক আজ এ নিয়ে লিখেত বসিনি। বসেছি জন্ম পরিচয়হীন এক “জালালের গল্প” নিয়ে। যে জালালের গল্প আমরা দেখতে পাই সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া আবু শাহেদ ইমন পরিচালিত “জালালের গল্প” চলচ্চিত্রটিতে।
সম্প্রতি জালালের গল্প চলচ্চিত্রটি দেখার সুযোগ হয়েছে। দল বেঁধে যায়নি। একটু আয়েশ করে একা একা দেখবো বলেই ঘর থেকে বের হওয়া। পরে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সিনিয়রের একটা দলের সাথে দেখা হয়ে গেলো সিনেমা হলে। সে যাই হোক একজন দর্শক হিসেবে “জালালের গল্প” নিয়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কেননা চলচ্চিত্রটি দেখার পর মনে হলো এটি নিয়ে কথা বলা যায়। তবে আগেই বলে রাখছি, শুধুমাত্র একজন দর্শকের চোখ দিয়ে যা দেখেছি যা বুঝেছি তাই বলছি, এর বেশি কিছু নয়। আর টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কথা বলা আমার মনে হয় উচিৎ হবে না।
ছোট্ট করে জালালের গল্পঃ লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরিতে চলচ্চিত্রের গল্পটি অল্পস্বল্প না বললেই নয়। চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায় জালালকে একটি পাতিলে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে অভিনেতা নূরে আলম নয়ন, যিনি চলচ্চিত্রে জালালের প্রথম পালিত পিতা। চলচ্চিত্রের এই অংশে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন মিতালী দাশ। এই চরিত্রটি প্রথমে কুড়িয়ে পাওয়া জালালকে অন্যে কারো কাছে দিয়ে আসার কথা বললেও পরবর্তিতে এক ধরনের মমতা আমরা দেখতে পাই তার কাছ থেকেই। অপরদিকে পালিত বাবা যখন বুঝতে পারলেন গ্রামের মূর্খ মানুষগুলোকে জালালের মিথ্যে অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলে অর্থকড়ি উপার্জন করা যায় তখন তিনি ধর্মের নামে ব্যবসা করতে দ্বিধাবোধ করলেন না। অপরদিকে মা বরাবরই এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। চলচ্চিত্রের এই অংশে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জালালকে কুফা আখ্যায়িত করে আবারো ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে এবং এর পেছনে নেপথ্য ভুমিকায় কাজ করেছে ক্ষমতাধরদের পরবর্তী নির্বাচন কেন্দ্রিক হিসেব নিকেশ এবং জালালকে ব্যবহার করে জালালের বাবার একচেটিয়া ব্যবসা যা অন্যদের গাত্রদাহ হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখলাম বালক বয়সি জালালকে। খুব নীরব প্রকৃতির একটি ছেলে। তার দ্বিতীয় পালিত বাবা হিসেবে এ অংশে অভিনয় করেন তৌকির আহমেদ। তিনি একটি নতুন বিয়ে করেন। আগের স্ত্রীরা সন্তান দিতে জন্ম দিতে না পারায় তৃতীয় বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ আনেন। এবং এবারও একই দশা দেখে তৌকির এক দরবেশের স্মরণাপন্ন হন। সেখানে আমরা দেখতে পাই দরবেশে নানান ভন্ডামি, ঝাড়ফুকের নামে ধর্ষণ ইত্যাদি। অনবরতো ভন্ডামি এবং চিকিৎসার নামে ধর্ষণে এক প্রকার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় জালাল। তাই আগের বারের মতো এবারও জালালকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এবারের ঘটনার পেছনেও সেই একই যুক্তি কাজ করে। আর তা হলো ভোটের হিসেব কিতেব। সন্তান জন্ম না দিতে পারায় জালালের দ্বিতীয় পালক পিতা এলাকায় চেয়ারম্যান ইলেকশন করতে পারছে না। আর যখনই একটি সন্তানের আশায় কবিরাজ এনে এতো আয়োজন, তখন জালাল হয়ে ওঠে তার প্রধান প্রতিপক্ষ।
তৃতীয় অংশে জালালকে একটু যুবক বয়সের দেখা যায়। এখানেও শান্ত জালাল। আর জালালের আশ্রয়দাতা হিসেবে এখানে দেখা যায় প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ও সন্ত্রাসী রুপে মোশারফ করিমকে। যে কিনা যাত্রাপালা থেকে একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে এসে দিনেরপর দিন ধর্ষণ করে ভালোবাসার নাম করে। শিলা নামে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী হামিদ। এক পর্যায়ে মৌসুমী গর্ভবতী হলে একসময় মোশারফ করিম এই সন্তানকে জালালের সন্তান বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিন্তু তা পারে না। চলচ্চিত্রের শেষ দিকে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৌসুমির মৃত্যু ঘটে। এবং নবজাতককে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এখানেও নবশিশুকে ভাসিয়ে দেয়া হয় এই কারণে যে এই শিশুর যে আসল জন্মদাতা ‘মোশারফ করিম’ তিনিও নির্বাচন কেন্দ্রিক একটি হিসেব নিকেশে ব্যস্ত, এবং এ সময় জারজ সন্তানের দায়িত্ব নেয়া মানেই ভোটে ভরাডুবি। আমার এই স্টোরি টেলিংয়ে তেমন বোঝা যাবে না মুল গল্পটি। আমি নিজেও চাইছি না পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে চলচ্চিত্রে কি ঘটেছে। কেননা সিনেমা হলে গিয়েই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে জানা দরকার।
নারী চরিত্রগুলো কি বলতে চেয়েছে: ঘটনাচক্রে চলচ্চিত্রে পুরুষ চরিত্রগুলো নারী চরিত্রগুলোকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছে। আবার আমাদের চিরায়ত বাংলার মায়েদের, বোনেদের, প্রেমিকা বা স্ত্রীদের যে দায়িত্ববোধ বা মমতা যাই বলি তার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে। আমার মনে হয়েছে জালালও এখানে পুরষ না হয়ে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং নারী চরিত্রগুলোর সাথে সে নিজেও পুরুষ চরিত্রগুলোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়তো প্রথম অঙ্কে আমরা দেখেছি যে মা ছোট্ট জালালকে অন্য কারো কাছে দিয়ে আসতে বলেছে সে মা’ই তাকে গর্ভবতী অবস্থায় এবং আরেকটি সন্তান থাকারপরও নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। অপর দিকে বাবা জালালকে নিয়ে ব্যবসা করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি।
দ্বিতীয় অঙ্কে দেখলাম তৌকির আহমেদের কাছে ছোট থেকে বড় হবার পরও অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে তৌকিরের নববধু(শর্মীমালা)’র সাথে জালাল এক মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। তাইতো তারা দ্বিতীয় পালক বাবা যখন তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন মা মা বলে চিৎকার করে পুরো পরিবেশকে গুমোট করে তোলে।
তৃতীয় অঙ্কে দেখলাম, মৌসুমীকে জোর করে ধরে এনে ধর্ষণ এবং পরবর্তীতে প্রেমের নাটক করে তাকে একটি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখায় “মোশারফ করিম”। এখানে তৌকিরের সাথে মৌসুমীর সম্পর্ক একটা পর্যায়ে শত্রু ভাবাপন্ন থাকলেও সন্তানের আগমনে মৌসুমী অনেকটা কোমল হয়। এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে মৌসুমীকে জালালসহ অন্যত্র পাঠিয়ে দিলে জালাল মৌসুমীর সেবায় নিয়োজিত থাকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় এখানে পুরোপুরি বোঝা যায় না জালাল আর শিলা’র সম্পর্কটি। এ ক্ষেত্রে লেখক শহীদুল জহিরের “সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো” উপন্যাসের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেলো। উপন্যাসটিতে মূল চরিত্র মফিজুদ্দিন একজন বেশ্যার দ্বারা ডাকাতদের কাছ থেকে জীবন ফিরে পায়। বেশ্যা নিজের জীবন দিয়ে মফিউদ্দিনকে নতুন জীবন দান করে। সেখান থেকে ফিরে গ্রামে এসে যখন একটি নতুন হাটের নামকরণ করা হয় তখন এর নাম রাখা হয় নয়নতারা হাট। এই নয়নতারার হাট নাম রাখতে গিয়ে মফিজুদ্দিন বলেছিলো যে, হাটের নাম হবে নয়নতারার হাট এবং নয়নতারা একটি নষ্ট মেয়ে মানুষের নাম; সে বলেছিলো, মা হইক কিম্বা না হইক, ম্যায়া মানুষ ম্যায়া মানুষই, ম্যায়া মানুষেক মাথায় কইরা রাইখপেন। সে অজ্ঞাত নয়নতারাকে মফিজুদ্দিন কখনো মায়ের রুপে, কখনো বোনের রুপে, কখনো প্রেয়সীর রুপে দেখেছিলো সেদিন। আমাদের জালালও “মৌসুমি”র সাথে অল্প কিছুদিনের জন্য কোন সম্পর্কে জড়িয়েছেন তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তবে শিলাকে দেখেছি খুবই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো তাদের দু’জনের সে নীরব বসবাসে। জালালও হয়তো পরিবার নামক কিছু খুঁজে পেতে যাচ্ছিলো।
পুরুষ চরিত্র, রাজনীতি ও ধর্ম: চলচ্চিত্রটি দেখে আমার একটা বিষয় উপলব্ধি হয়েছে, সমাজের সকল কিছু পুরুষই নির্ধারণ করছে এবং এর ভোক্তভুগি হচ্ছে নারী, শিশু ও সত্যিকার সাধারণ মানুষেরা। ক্ষমতার মোহ, এর জন্য হানাহানি সবই আমার কাছে পুরুষতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ মনে হয়। কেননা ধর্মের কলাকানুন, সামজিক রীতিনীতি সব তৈরি করছে কিন্তু পুরুষ, একথা অস্বীকার কি করে করি। চলচ্চিত্রটিতে সবগুলো নারী চরিত্রই ছিলো প্রতিবাদী। কিন্তু পুরুষের যে ক্ষমতা সে ক্ষমতার কাছে তাদের জোরালো আওয়াজ সবসময়ই পরাস্ত হয়েছে। জালালের দ্বিতীয় পালক পিতা ‘তৌকির আহমদ’কে দেখেছি নিজের ব্যর্থতা একের পর এক নারীর উপর চাপিয়ে দিতে। দেখেছি নারীর প্রতিবাদের মুখেও তার ক্ষমতা প্রদর্শন। সন্তান জন্ম না দিতে পারা যে জালালের দ্বিতীয় পালক পিতার শারিরিক প্রতিবন্ধকতার অংশ এটা সে কোনভাবেই জানতে চায়নি। তিন তিনটে বিয়ে করার পরও সন্তান জন্ম যখন হচ্ছে না তখন বুঝা উচিৎ ছিলো সমস্যা তার নিজের। নাকি ‘তৌকির’ বুঝতো কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতো না এই কারণে যে পুরুষের তথাকথিত ক্ষমতা প্রকাশের অন্যতম একটি হাতিয়ার হচ্ছে সন্তান জন্ম দেয়া। আর এই অক্ষমতা যদি প্রকাশ পায় তবে নির্বাচনে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব না। অর্থাৎ এখানেও নারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার, এখানেও পুরুষতন্ত্র, তার তৈরি নিয়মকানুন, ধর্মীয় কুসংস্কার, রাজনীতি, ক্ষমতার মোহ।
প্রথম দু অংশে আমরা দেখেছি পুরুষের প্রচন্ড ধর্ম ভক্তি এবং একই সাথে ভন্ডামী। চলচ্চিত্রে এ দুটোই খুব স্পষ্ট দেখা গেলেও নারী চরিত্রগুলো কিন্তু এসবের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলো। লোভ দেখা গেছে প্রত্যেকটা পুরুষ চরিত্রে। লোভি পুরুষগুলো তাদের ক্ষমতার জন্য নারীকে ব্যবহার করেছে নানানভাবে। ক্ষমতার প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যতো না বাইরের কেউ ছিলো তার চাইতে ঘরের নারীকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখেছে পুরুষ চরিত্রগুলো। তাইতো মোশারফ করিম যখন মৌসুমি হামিদকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিলো তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে মোশারফ করিমের কথোপকথনে আমরা বারবার শুনতে পাই, “অপজিশনকে সব সময় দৌড়ের উপর রাখবি, অপজিশনকে কখনো সুযোগ দিবি না”। এই সংলাপের মাধ্যমে মোটা দাগে বলা যায়, চলচ্চিত্রের মধ্যে থাকা যে প্রতিপক্ষগুলোকে বারবার নানানভাবে ঘায়েল করা হয়েছে তা এক প্রকার স্পষ্ট হয়েছে আবার খুব সূক্ষভাবে দেখলে বলতে হয় আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতি বাস্তবতাও যে ফুঁটে ওঠেনি তা কি করে বলি?
এই চলচ্চিত্রের একটা মজার দিক হলো আমাদের দেশে বা বিশ্বময় ধর্ম আর রাজনীতির সুপ্রাচীণ সম্পর্কটি আমরা দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখেছি ধর্মের প্রয়োজনে রাজনীতি অথবা রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মের ব্যবহার। প্রথম অংশে জালালের প্রথম পালিত পিতার ধর্ম নিয়ে যে ব্যবসা তা বন্ধ করার জন্য যে উদ্যোগ আমরা দেখি তাতে কোন সৎ উদ্দেশ্য ছিলো না। শুধু মাত্র টাকা পয়সার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দই ছিলো এর একমাত্র কারণ। এবং মাজার বিষয় হলো যিনি টাকার ভাগ চান জালালের বাবার কাছ থেকে তিনি ব্যর্থ হয়ে গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে তোলে। কাজেই গ্রামবাসীর ধর্মীয় অনুভূতি এবং তাদের চাপের কারণে আসন্ন নির্বাচনের কথা চিন্তা করেই ভেসে আসা জালাল যে কিনা কিছু আগেও গ্রামবাসীর জন্য পূণ্য বয়ে নিয়ে এসেছিলো সে আবার ভেসে যায় কুফা আখ্যায়িত হয়ে। অর্থাৎ এই ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করার পেছনে খুব সৎ বা মহৎ উদ্দেশ্য ছিলো তা কিন্তু নয়। পুরোটাই অর্থের লেনদেন এবং ক্ষমতায় যাওয়া। নিশ্চই যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন তারা দেখবেন, জালালকে প্রথম পিতার কাছ থেকে ভাসিয়ে দেয়ার আগে একজন বলেছিলেন, “শালিশ মাইন্যা ল, নতুন চর উঠছে ভোটে জিতলে তোরে ৩ কানি জায়গা দিমু”। আবার আমরা দেখেছি মোশারফ করিম এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, একটি মেয়েকে দিনের পর দিন তার বাড়িতে রেখে ধর্ষণ করে, আবার এমন অপরাধ সংগঠিত করেও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু অপরদিকে শিলা আর শিলার গর্ভের সন্তানের কিন্তু সমাজের কোথাও স্থান হয় না। সন্ত্রাসী মোশারফ করিমের অর্থের কাছে সামাজ আর ধর্ম বিক্রি হয় এবং এদের সাথে বিক্রি হয় মানবিকতাকে। আমার কাছে সে মুহুর্তে মনে হয়েছে ধর্ম, ধর্ম ব্যবসা, ধর্ম ব্যবসা বন্ধের নামে ভোটের হিসেব, রাজনীতি, অর্থকড়ির লেনদেন এবং নির্বাচনপূর্ব আশ্বাস- সবই আমরা আমাদের চারপাশে দেখছি প্রতিনিয়ত। পরিচালক হয়তো এসবই দেখাতে চেয়েছেন।
তবে জালাল একজন পুরুষ হলেও তার নেই কোন ধর্মপরিচয় নেই কোন জাত। ভেসে ভেসে বড় হওয়া এই মানুষটা পুরুষ হয়ে ওঠেনি উঠেছে মানুষ হয়ে। চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় অংশে তৌকিরের স্ত্রীকে কবিরাজ হাঁস কাটার মন্ত্র দিয়ে যেভাবে প্রতিরাতে ধর্ষণ করছিলো তা বালক জালাল কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। কবিরাজ প্রতিদিন একটি হাঁস কাটতো আর রাতে ধর্ষণ করতো তার নতুন মাকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে তৃতীয় হাঁসটির পালা যখন আসে তখন জালাল তৃতীয় হাঁসটি জীবন্ত ভাসিয়ে দেয়। হয়তো সে ভেবেছিলো হাঁসকে ভাসিয়ে দিলে তার মায়ের আর এমন অমানবিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে না। অথবা শুধু হাঁসের জন্যই তার মায়া ছিলো বলে এমনটা করেছে। আবার এমনও হতে পারে একই সাথে তার পাষুন্ড পিতা এবং ভন্ড কবিরাজের হাত থেকে তার মা এবং হাঁস এই দুটো প্রাণীকে বাঁচাতেই এমনটা করেছিলো জালাল। এছাড়া তৃতীয় অঙ্কে জালাল শিলাকে বিয়ে করার জন্য মোশারফ করিমকে অনুরোধ করে। কিন্তু মোশারফ করিম তা না শুনে জালালকে শাসিয়ে যায়। মেয়েটার জন্য জালালের অন্যধরণের অনুভূতি আমরা এই অংশের শুরু থেকেই দেখি। শেষ দিকে জালালকে একটু কথা বলতে দেখা যায় এবং সেখানেও দেখা যায় এক মানবিক জালালকে। যে কিনা মোশারফ করিমের সকল অপকর্মের ডান হাত ছিলো এক সময়।
শিলার সন্তান অর্থাৎ নতুন জালালকে যখন নদীতে জালালের মতো করেই ভাসিয়ে দেয়া হয়, আমার যেনো জালালের গল্পটাই খুঁজে পাই। কিন্তু নতুন এ জালালকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেও পারে না জালাল কেননা নদীতে ভেসে ভেসে বেড়ালেও সাঁতার তার শেখা হলো না। যেমনটা এই সমাজে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য আমার সাঁতার কাটছি কিন্তু জানিনা কি করে সাঁতার কাটতে হয়, জালালের মতো আমরাও ডুবে যাচ্ছি। এক জালাল ডুবে গিয়ে আরেক জালালের জন্ম হলো। এরও ধর্ম কি, মা কে বাবা কে, জাত কি কেউ জানবে না। নতুন জালালও হয়তো পুরোনো জালালের মতো এই পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে পুরুষ না হয়ে আমাদের মানুষ হবার শিক্ষা দিয়ে যাবে যতোদিন না সব ঠিক হয়।
এমন এক সময়ে "জালালের গল্প" চলচ্চিত্রটি দেখলাম যখন সারা বিশ্ব সাগরে ভাসছে। অগনিত জালাল সাগর পাড়ে ভেসে আসে। রুহিঙ্গাদের দেখছি এবছর। গত বছর তো কয়েক'শ রুহিঙ্গা শিশু আমাদের কক্সবাজারে ভেসে এসেছিলো, মনে আছে? আর ক'দিন ধরে দেখছি আয়লানের মতো কতো শিশু। ফিলিস্তিন দেখলাম গত বছর। আমরা বললাম আই সাপোর্ট গাজা। "জালালের গল্প" সাথে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির তেমন মিল নেই। আবার মেটাফোরিক্যালি মিল খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হলো, অগনিত জালাল এই শহরে ভাসছে, সাগরে ভাসছে, নদীতে ভাসছে। তাদের সাথে ভেসে যায় সভ্যতা নিজে। তবে প্রত্যাশা করি বেজন্মা নামক জালালরাই পরিণত হোক সমাজের সবচেয়ে পরিচয়ওয়ালা মানুষে। স্বগৌরবে বলে উঠুক, হ্যা আমি বেজন্মা। সবশেষে একটা প্রশ্ন, তাহলে ভেসে বেড়ানোর জন্য কি শুধু জন্ম পরিচয়ই দায়ী? নাকি অন্য কিছুও আছে যা আমরা আজ দেখছি বিশ্বজুড়ে!
(বি:দ্র লেখাটি সম্পাদনা করেছেন, তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহিদ গগন)
(০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫, পল্টন)
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪১
পথেরদাবী বলেছেন: ভাই, এটাতো সিনেমা দেখে আমার উপলব্ধি সবার সাথে শেয়ার করলাম। গল্প কই পেলেন?
২| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫২
হাসান মাহবুব বলেছেন: ভালো রিভিউ।
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪০
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ...
৩| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৪
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন: সুন্দর রিভিউ
তবে জালালের গল্প দেখার ইচ্ছাটার মৃত্যু হলো!!
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৯
পথেরদাবী বলেছেন: কেনো ভাই, গিয়ে দেখে আসুন। আমার বক্তব্যের সাথে আপনার হয়তো বিস্তার ফারাক হলেও হতে পারে দেখার পর।
৪| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৫
রিকি বলেছেন: সিনেমাটা দেখার অনেক অনেক আগ্রহ রয়েছে। তৃতীয় ভালো লাগা । ++++
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪০
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ..।
৫| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৭
গেম চেঞ্জার বলেছেন: ওয়ান্ডারফুল রিভিউ
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৩
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ...
৬| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৯
জেন রসি বলেছেন: আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে শিশুরা বিচ্ছিন্ন কিছু না! তাই শিশুদের যন্ত্রণার ব্যাপারটিও শ্রেণী বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অযৌক্তিক পাশবিক আচরনের সাথে সম্পর্কিত।
রিভিউ চমৎকার হয়েছে।
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১১
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ..
৭| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৪৮
মহান অতন্দ্র বলেছেন: পড়লাম। দেখবার ইচ্ছে হল যদিও সেটা এখন পূরণ হবার নয়। তবে ' ভন্ডামী' এর অংশটা লালসালুর মত লেগেছে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১১
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ..
৮| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:৫৮
রাশেদ বিন রাদ বলেছেন: লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। -
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১১
পথেরদাবী বলেছেন: ধন্যবাদ..
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৭
সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: এতো বড় গল্প!