নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিরোনামহীন....

আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই

পথেরদাবী

সাংস্কৃতিক কর্মী শিল্প তৈরি করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন..... তবে শিল্পীর শিল্প তৈরি হওয়া চাই-ই-চাই.......সাংস্কৃতিক কর্মীর মূল কাজ শিল্পীর তৈরি শিল্পকর্ম এবং জনগনের মধ্যে মেল বন্ধন অর্থাৎ সহজ ভাষায় বললে, সেতু তৈরি করা..... আর এই সেতু তৈরির কাজ সাংস্কৃতিক কর্মীর করা চাই ই-চাই....এখানে ফাঁকিবাজির সুযোগ নাই.....সুযোগ নাই শিল্পীর মতো ব্যক্তি কেন্দ্রিক চিন্তা করার..... সাংস্কৃতিক কর্মীকে তাই মাঝে মাঝে শিল্পীর চাইতে সংগঠকের ভুমিকায় বেশি অবতীর্ণ হন...... এতে দোষের কিছু দেখি না....সব ঠিকঠাক থাকলে সাংস্কৃতিক কর্মী নামক শব্দের উৎপত্তি ঘটতো না..... সবাই শিল্প চর্চাই করতো.....শিল্প চর্চা করতে এসে কেউ বিপ্লবের কথা বলতো না..... যেহেতু বিপ্লব একটি কঠিন সত্য...... বিপ্লব দীর্ঘজিবী হোক.....\\\\\\\\\\\\\\\\n(১৪ মার্চ ২০১৫, পল্টন ...........)

পথেরদাবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘ইদ্রিস চৌকিদারের বাড়ি….’

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৭

আমি সেদিন ঘুম থেকে খুব সকালে উঠে যাই। বেরিয়ে পড়ি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে। কুয়াশও তার চাদর জড়িয়ে দিয়েছিলো আমার পুরো গ্রাম। খালি পায়ে হেটে যাই বাড়ির পেছনের রাস্তা ঘেসে চলে যাওয়া রাধা-কৃষ্ণ খালের কাছে। রাধা-কৃষ্ণ খালে থোকা থোক কচুরিপানারা ভাসে। জল দেখা যায় মাঝে মাঝে। এসবের মাঝে ধীরে ধীরে সূর্য ওঠে। এক হাত দুরের কুয়াশা কাটতে শুরু করে মূহুর্তে। কচুরিপানার ফাক গলে সূর্য জলের গায়ে এলিয়ে পড়লে দেখি, ঝিলমিলিয়ে ফিক করে হেসে দেয় রুপলী পুটি। কিন্তু সেদিন আমার এসব দেখে ভালো লাগে না। আমি পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করি আর রাস্তার ধারে বসে বসে ভাবি সেদিনটিতে কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে, সাথে বিগত দিনের অনেক কথা। চোখের সামনে ভাসতে থাকে অগনিত পরম আত্মীয়দের মুখ। চোখ ভেসে যাচ্ছিলো জলে। সে জলেও সূর্য এসে গা এলায়, আর জল চিকচিক করে উঠলে একটা সাদা বক তা দেখে ফেলে। আমি সেদিক তাকাই না, লুকাতে চেষ্টা করি ঝিলমিল করা চোখের জল।

সেদিন বাদ জুম্মা আমার বাড়ির নাম পরিবর্তন হবার কথা। বাবার বহুদিনের শখ ছিলো বাড়ির পূর্বের পরিচয় যেনো মুছে যায়। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে চেষ্টাই করে গেছেন। যে মাটির উপর আমার এক তলা ইটের বাড়িটি উঠেছে সে মাটি আমাদের ছিলো না আগে। ছিলো না এটা বলা ঠিক হবে না। ছিলো দাদার আমলে। দাদা অনেক কষ্ট করে যে জায়গা কিনেছিলেন তার ছয় ছেলের জন্য। কিন্তু দারিদ্রতা এতোটাই তাকে ভর করে যে শেষ জীবনে এসে তা বিক্রি করে একেবারে শুন্য হাতে আমার দাদি বিবি শরিফা খাতুনকে রেখে যায়, সাথে তার ছয় ছেলেকও। আমার বাবা ছিলেন ভাইদের মধ্যে পঞ্চম। ঘরের নিত্য অভাব তাকে এমন ভাবে ভাবাতো যে নানা উপায়ে লেখাপড়া শেষ করে শহরে যায়গা করে নেয়, তারপর শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা। তবে তার গল্প এমন ভিন্ন কিছু নয় এ জন্য যে, এই শহরের অনেক সাহেবদের গল্প প্রায় কাছাকাছি,একই রকম, বেদনার আবার কারো কারো গল্প খুবই অশ্লিল।

দাদার বিক্রি করা সে জমি আমার বাবা আর ছোট চাচা মিলে আবার দখলে নেয়, জমি হারানো প্রায় বিশ বছর পর। এই বিশ বছরে অভাব বেশ ঘুচিয়ে যায় তাদের, তাই হারানো জমির সাথে আরো বেশ খানিকটা অংশ এই দফায় কিনে ফেলে। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছিলো বাড়ির একটা নাম হবে। কিন্তু যে নামে এ বাড়িকে সবাই চেনে সে নামে নয়। অন্য কোনো নামে। কিন্তু বাবা পারেনি। তার আগেই বিদায়। আমার বাবা বিদায় নিয়েছে তাও আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। এর মধ্যে আমার জীবনের বাক পরিবর্তন করেছে নানা দিকে। আমি এখন কবি, দেশের নাম করা কবি। বয়স আমার ষাট পেরিয়েছে আরো পাঁচ বছর আগে। কবিতা বেচে আমার আয় হয়েছে অনেক। দেশের অবস্থাও এখন বেশ ভালো। মানুষ এখন কবিতা পড়ে। কবিদের না খেয়ে মরতে হয় না তাই। অন্তত একতলা একটা বাড়ি করা যায় গ্রামে যদি আমার মতো বাবার রেখে যাওয়া কিছু জমি থাকে।

সে যাই হোক, আগেই বলেছি সেদিন বাদ জুম্মা আমাদের বাড়ির নাম পরিবর্তনের কথা ছিলো। আমার নতুন ইটের বাড়ির সামনের সদর দরজায় যে নেইম প্লেটটি লাগবে তার মাধ্যমেই পুরো বাড়ির প্রায় একশ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো নাম পরিবর্তনের ঘটনা ঘটবার কথা ছিলো। কথা ছিলো বাবার ইচ্ছাও পূরণ হবার, কিন্তু তা হলো না। আর তা না হবার পেছনে একটাই কারণ, সেদিন আমি আমার পরম আত্মিয়দের মুখ মনে করলে আমার মনে ভেতর কি যেনো হতে থাকে। আমি রুপলী পুটির ঝিলমিল করা হাসি সহ্য করতে পারি না। আমি সাদা বক আর পরম আত্মিদের থেকে মুখ লুকাই। কেননা আমার মনে হয় তারা সকলে আমাকে নিয়ে উপহাস করছে। সে অনুতাপ থেকেই বাড়ির নাম আর পরিবর্তন হয় না। নেইমপ্লেটে ‘কবি ইখতিয়ার উদ্দিনের বাড়ি’ লেখা থাকলেও তা আর বাড়ির সদর দরজায় ঝুলানো হয় না, তার বদলে বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়, ‘ইদ্রিস চৌকিদারের বাড়ি’।

আবারও বলছি, আমি রুপলী পুটির উপহাসের হাসি দেখার পর- সেদিন সকালে, অর্থাৎ আমার চোখের জল আর সে জলে সূর্য়কে বক দেখে ফেলার সময়- বিগত পরম আত্মীয়দের যে মুখগুলো দেখেছিলাম তারাও ঠিক একই রকম হাসছিলো। আমি এদের সকলের কাছ থেকেই মুখ লুকাতে চেষ্টা করেছিলাম সেদিন সকালে। কেননা তাদের সকলের চোখে মুখে আমাকে দেখে যে তীব্র অসহায়ত্ব আর চরম মাত্রার বিদ্রুপ ফুটে উঠছিলো, আমি তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম এবং লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছিলাম। হ্যা, পুনর্বার বলছি, সেদিন আমি রুপলী পুটি, সাদা বক আর পরম আত্মিয়দের থেকে মুখ লুকাচ্ছিলাম।

সেদিন, সবার শুরুতে আমি দেখেছিলাম আমার বড় জ্যাঠাকে। যিনি ছিলেন একজন পাটকল শ্রমিক। দেখতে পুরো মাওলনা ভাসানীর মতো। কখনো তাকে প্যান্ট পরতে দেখিনি। দেখেছি মাস তিনেক পরপর আমাদের ফকিরেরপুলের গরম পানির গলির হানিফ উকিলের বাসায়। মাথায় একটা টুপি, গায়ে পাঞ্জাবী, আর পায়ে বাটার চপ্পল ছিলো তার ড্রেস কোড। আর সাথে একটা ঝোলা থাকতো সব সময়। সে ঝোলায় কাপড়, পানের কৌটা, আতর, লাইফবয় সাবান, আর তার সাদা ধবধবে দাড়িগুলো আঁচড়ানোর জন্য ছোট একটা চিরুনী। তিনি সেদিন সত্যিই হাসছিলেন। তারপর দেখি আমার আরেক জ্যাঠাকে, যিনি দারিদ্রতার মেধা তালিকায় তার কোন ভাই থেকে কম যাননি। আদমজি জুট মিল বন্ধ হয়ে গেলে শহরের বিলাশ বহুল ভবনগুলোর রাতের পাহারাদার বনে যান। যেনো পিতার অর্পিত দায়িত্ব পুরনে পুত্র সদা জাগ্রত। তিনিও সেদিন হাসছিলেন। বিদ্রুপের হাসি।

তারও পর দেখি, আমার মেঝ জ্যাঠাকে। যিনি ছিলেন একজন প্রবাসী। প্রবাসে নির্মান শ্রমিক হিসেবে তিনি কাটিয়েছেন প্রায় দুই যুগ। তিনি প্যান্ট পরতেন। বিদেশ থাকার বদৌলতে মাঝে মাঝে দেশে ফিরলে সব সময় সাফারি পরে ঘুরতেন। তিনি কি রোগে মারা যান আমার জানা নাই। খালি শুনেছি, সিমেন্টের বস্তা টানতে টানতে ফুসফুসে কি যেনো হয়েছে। ওই ওতোটুকুই। তারপর চোখের সামনে আসেন আমার ছোট চাচা। যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে রুপগঞ্জ পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটে যোগ দেন। না ছাত্র হিসেবে নয়। সেখানকার ৫০০ টাকা বেতনের একজন পিয়ন হিসেবে। সে থেকে চাচার শুরু। এই পেশায় তিনিও তার মেঝ ভাইয়ের মতো দু্ই যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন খুব সৌখিন মানুষ। পার্ফিউম কেনার টাকা ছিলো না তাতে কি? কাপড়ে গন্ধ ছড়ানোর জন্য সবসময় কসকো সাবান দিয়ে কাপড় ধুতেন। আর শার্ট প্যান্টের ভাঁজ ঠিক রাখতে রাতে ঘুমানোর আগে খাটের তোষকের নিচে সেগুলো দিয়ে রাখতেন। সেই চাচাও এখন আর নেই। চাচার হাসি পুরোপুরি আমার বাবা মতো। তাই চাচার জন্য আমার মায়া ছিলো সবার থেকে বেশি। চাচা হাসছিলেন, বিদ্রুপের হাসি।

কিন্তু যেদিন সকালে যখন বকটা উড়ে গেলো আমার চোখের জল দেখে আর রুপলী পুটিটা ফিক করে হেসে দিলো সেদিন আমি তাদের মুখ কেনো দেখলাম তা আমি বুঝতে পারি আরো অনেক পরে। চাচা জ্যাঠাদের দেখারপর মুখ ভেসে ওঠে আমার বড় মামার। যিনি ছিলেন একজন ট্রাফিক পুলিশ। মারা যান কিডনি ড্যামেজ হয়ে। সারাদিন রোদ আর বৃষ্টির সাথে সঙ্গম করে মামার কিডনি পচে গলে শেষ হয়ে যায় মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়েসে। বড় মামা আমাকে বলতেন, ইখতিয়ার উদ্দিন তুমি পরিবারের বড় তোমার অনেক দায়িত্ব। আমি বুঝতাম না কি সে দায়িত্ব, আমি তখন ভিষণ ছোট ছিলাম। মামা শেষ যেবার আমাদের গরম পানির গলির হানিফ উকিলের বাড়ি্ এসেছিলেন তখন আমার বয়স মাত্র তের কি চোদ্দ বছর। সেবার ব্যারাকে ফিরে যাবার সময়ও একই কথা বলেছিলো। পরে তার মৃত্যুর দশ বছর পর বাবা যেদিন মারা যান সেদিন আমি ঠিক ঠিক বুঝি আমার অনেক দায়িত্ব। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমার বাড়ির নাম পরিবর্তন করা। যেটি বাবা করে যেতে পারেননি। কিন্তু আমি সে দাযিত্ব পালনে একই সাথে সফল এবং ব্যার্থ দুটোই হয়েছিলাম। কারণ সেই হাসিগুলো।

এতোগুলো মুখ দেখার পর আমার কিছু ঘটনা মুখগুলোর সাথে মনে পড়তে থাকে। আমি ছাত্র অবস্থায় পার্টি করার সময় একটা বিষয় আমার ভালো লাগতো না। সে ভালো না লাগাগুলোও সেদিন মনে পড়ে। পার্টিতে দেখতাম শ্রমিকদের জন্য এক ধরনের মায়া কান্না হয়। এবং সে মায়া কান্না আমার একদম সহ্য হতো না বলে আমি ভিষণ অভিমান করে পার্টি ছেড়ে দেই। এবং কবি হতে শুরু করি। আমার কাছে সব সময় মনে হতো চৌকিদারের নাতি আর শ্রমিক, পুলিশ, দারওয়ান আর পিয়নের ভাতিজা বা ভাগনে হবার কারনে এদেরই রক্ত আমার শরীরে বইছে। কাজেই আমি যতাটা আমার ব্যবসায়ী বাবার সন্তান ঠিক ততটা আমার চাচাদের, জ্যাঠাদের, আর মামাদের সন্তান। শ্রমিক, কৃষক, চৌকিদার, পিয়ন, পুলিশ, দারওয়ানের কথা বলা মানে আমার কথা বলা। কিন্তু এরা আমার কথা বলছে না। তাই আমি নেতা না হয়ে আমার কথা বলতে কবি হয়ে গেলাম। আমার ভিতর যে কি যন্ত্রনা বোধ কাজ করতো তা আমি বোঝাতে পারতাম না কাউকে। নিজের কথা বলতেই আমি কবি হয়ে গেলাম।

একবার তো অফিসের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারিদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছি বলে চাকরি চলে গিয়েছিলো। তারচেয়ে বড় সমস্যা বাঁধলো, কর্মচারিরা নিজেদের নিয়ে না ভেবে আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। তাদের এই চিন্তিত হওয়াকেও আমি ঠিকঠাক ভাবে নিতে পারিনি সেবার। কেননা, আমি যতোই তাদের বোঝাতে চাচ্ছিলাম আমি আমার কথা বলতে এসেছি, কাউকে উদ্ধার করতে নয়, আমি মহৎ কেউ নই। আমি তাদের এও বলি,, আমি যতোটা এই অফিসে আপনাদের উপরে বসবাস করি, কিন্তু রক্ত বলে ভেতরে ভেতরে ঠিক ততটা আমার আর আপনাদের মাঝে এক ইঞ্চিও ব্যবধান নাই। কিন্তু তারা বুঝতে চাইছিলো না, পরে এক রাতে সাইফুল দারওয়ানের বাড়িতে বাংলা মদ খেতে খেতে যখন নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করলাম তখন তাদের ভিতরে জ্বলতে থাকা অনুতাপ কিছুটা প্রশমিত হয়।

এমন আরো একটা ঘটনা ঘটেছিলো আমার জীবনে। এক কবি বন্ধুকে থাপ্পড় মেরে বসেছিলাম, কেননা যেবার সার্ক কবিতা উৎসবে অংশগ্রহন করতে গিয়ে যখন বিমান বন্দরে যাই, সেবার সৌদি থেকে ফেরত এক শ্রমিকের সাথে কি নিয়ে সে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। আমি তাকে থামাতে অনেক চেষ্টা করি এবং সে থামে। কিন্তু সেই সৌদি ফেরত শ্রমিককে উদ্দেশ্য করে বলে ‘কুত্তার বাচ্চারা চামার, বিদেশে তো ঠিকই মালিকের লাথি খায়, আমারে চেনে।’ আমি সেদিন তাকে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মেরে পরে সেই ঘটনা নিয়েই আমার 'মজুর' কবিতাটা লিখি। আমি এভাবে কবি হয়ে উঠি।

আমি যে কবি হয়ে উঠি তার পেছনে আরো একটি কারণ ছিলো, মানুষ কেনো কালো হয় সে কারণ খুঁজতে গিয়ে। এক সময় নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। আমার মনে হতে থাকে, পৃথিবীর সকল নিপীড়িত মানুষের গায়ের রং কালো। অথবা কালো মানুষদের পূর্ব পূরুষরা সকলে নিপীড়িত ছিলো। কারণ, তাদের যতোই সোনা রং হোক শরীরের, রোদে পুড়ে পৃথিবীকে প্রতিদিন নতুন আকার দিতে গিয়ে তাদের গায়ের রং কালো হয়ে যায়। পরবর্তিতে তাদের বংশধরদেরও একই অবস্থা হয়। আমার এও মনে হতে থাকে, আমার দাদা সারা রাত- 'ইদ্রিস চৌকিদার হাজির, সাদু সাআআআআধান' বলে যে হাক দিতেন তাতে তার পরিবারের ভরণ পোষণ হতো না বলে দিনের বেলা জমিদারদের মাটি কাটা, ধানের বস্তা টানাসহ নানা কাজ করে শরীরের রং কালো করেছেন। তা না হলে আরব বা আফ্রিকার খনির মজুরদের মতো আমার বাবাদের সব ভাইয়ের রং এবং চেহারা একই রকম হবে কেনো? নাকি আমার দাদাদের নিপীড়িত হবার ইতিহাস আরো সহস্র বছরের পুরোনো? এসব ভেবেই আমি একদিন লিখে ফেলি- 'সোনা রং পুড়ে চাই/ খনির শ্রমিক অথবা ইদ্রিস চৌকিদার জাত ভাই, জাত ভাই'। আমি ধীরে ধীরে কবি হয়ে উঠি।

তাই সেদিন এতোগুলো মুখ আর এতোগুলো ঘটনা মনে করতে করতে হঠাৎ মনে হয়েছিলো, আমি যাদের জন্য আজ কবি। তাদের নাম আমি কি করে মুছে দেই? তাদের কি করে ভুলে যাই? তাই চোখ মুছে, বাড়ির নাম আগেরটাই থাকবে ঠিক করি। এবং সেরকইম হয়, পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, আগে কোন নেইমপ্লেট ছিলো না, এখন নেইমপ্লেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ইদ্রিস চৌকিদারের বাড়ি’। সে যাই হোক, সেদিনটি ছিলো আমার জন্য ভিষণ অনুতাপের এবং একই সাথে পরম শান্তির, যেদিন সাদা বক উড়তে উড়তে আমার চোখের জলে সূর্যকে দেখেছিলো। রুপলী পুটি হেসেছিলো- আমি তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আমার মুখ লুকাই। এবং পরে তারাই আমার অনুতাপ ভাঙে। আমি আর মুখ লুকাইনা।

(০৬ নভেম্বর ২০১৫, আইয়ুবপুর, নোয়াখালি)

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২২

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:



মানুষের অতীত কখনও ভোলা উচিৎ নয় বিশেষ করে যাদের কারণে এই বর্তমান।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.