![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন শিল্পের শিক্ষার্থী। শিল্প নিয়ে জানতে ও জানাতে ভালোবাসি।
যুগের আবর্তনে শিল্প পরিপূর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিল্পে বিভিন্ন রীতি শিল্পের গতিধারাকে করেছে পরিশালিত। রেনেসাঁর সময় শিল্পের চরম উন্নতি সাধিত হয়। আর এই রেনেসাঁর ধারাকে অবলম্বন করে সৃষ্টি হয় ম্যানারিজমের। তখন শিল্প বাস্তবতার আদল থেকে বেরিয়ে এসে আবেগধর্মী হয়ে ওঠে। আর ম্যানারিজমের পর যে রীতির জন্ম হয় তাকে ‘বারোক’ নামে অভিহিত করা হয়। এটি পর্যায়ক্রমে উন্নততর অবস্থায় উন্নীত হয় এবং অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকে। এই রীতি একটি পর্যায়ে বিশুদ্ধ রূপ ধারণ করে যাকে বিলম্বিত বা উচ্চ বারোক বলা হয়।
বারোক রীতি: বারোক শব্দটির অনেক অর্থ আছে। আইবেরীয় উপদ্বীপের মণিকারেরা অনিয়িমিত মুক্তাকে বলত বারোক। যার অর্থ অসম্পূর্ণ। প্রাথমিক পর্যায়ে বারোক শব্দটি দিয়ে বোঝানো হতো অযৌক্তিক, অদ্ভুত নক্সা, এমনকি কুরুচিপূর্ণ শিল্পকর্মও। যা পরবর্তীতে ভিন্নতর অর্থ অর্জন করে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝে রেনেসাঁ এবং নিওক্লাসিক শিল্পকলার মধ্যবর্তীতে ইতালিতে এই বারোক শিল্পরীতির জন্ম হয়। সময় এবং স্টাইলের দিক থেকে ‘বারোক’ ম্যানারিজম থেকে শুরু করে ‘রোকোকো’য় এসে সমাপ্ত হয়। ম্যানারিষ্টদের বিশেষ রীতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়াই এই শিল্পরীতির উদ্দেশ্যে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, চিত্রকলা এবং নাটকের সম্পূর্ণ সমন্বয়ে বারোক যখন সর্বোচ্চে তখন তাকে উচ্চ বারোক নামে অবিহিত করা হয়। আলো-ছায়ার নাটকীয়তা, টুইস্টেড ফিগার এই রীতির শিল্পকর্মের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে পোপ ও অভিজাত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় রোম পুনরায় সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রাধান্য অর্জন করে। বিশপ এবং পোপের মন্ত্রণা-সভার সদস্যরা শহরটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। বার্নিনি এবং বোরোমিনির স্থাপত্য এতে বিশেষ সাহায্য করে। তাঁদের নক্সায় জাঁকজমকের পরিচয় পাওয়া যায়। বার্নিনির নক্সা অবলম্বনে নির্মিত সেন্ট পিটার্সের সম্মুখে অবস্থিত স্তম্ভের সারিযুক্ত সাধারণের ব্যবহারের জন্য উদ্যান স্থাপত্যে স্থান সম্পর্কে নতুন ধারণার সৃষ্টি করেছে। দুটি অর্ধ গোলাকৃতি স্তম্ভের সারির জন্য সেন্ট পিটার্স গির্জাকে অতিকায় রঙ্গমঞ্চের অংশ বলে মনে হয়। এটা উদ্যান ও গির্জার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
বারোক স্টাইল সর্বপ্রথম স্থাপত্যের ক্ষেত্রেই প্রচলিত হয়। পরে এ রীতি চিত্রকলা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্পকলায়ও ব্যবহৃত হয়। শিল্পীরা চিত্রকলায় আলো-ছায়ার তীব্র বৈষম্য, চঞ্চল ও গতিবেগপূর্ণ ফিগার ব্যবহার করেন এবং এমনভাবে নক্সা অঙ্কন করেন যা দেখলে মনে হয় প্রত্যেকটি উপাদান যেন নিজেদের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে এই রীতি বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করলেও এই ঐক্য বজায় ছিল। সেই সাথে রাফায়েল এবং তিসিয়াননের চিত্রে যে শান্ত ও কোমলভাব ছিল তা শপ্তদশ শতকে অর্থাৎ বারোক রীতিতে এসে পরিত্যক্ত হয়।
বারোক স্টাইলের প্রথম দিকের স্থপতি ছিলেন ‘ভিনোলা’। তিনি চিত্রশিল্পী হিসেবে শিক্ষা গ্রহণের পর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৫৬৮ সালে তিনি রোমে ‘জেসু’ গির্জার নক্সা প্রণয়ন করেন। এটি তাঁর বিখ্যাত কীর্তি। গির্জার ভিতরে প্রধান ঘরটি গম্বুজ থেকে আসা আলোয় আলোকিত হতো। প্রকৃতপক্ষে বারোক স্থাপত্যগুলো হলো গথিক ও রেনেসাঁ যুগের একত্রিত ফল। তাঁরা গির্জার দেয়াল গোলাকৃতি করে, অনেক ক্ষেত্রে দুটি চূড়াও ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে স্থপতিবিদ বোরোমিনি ইমারতের সম্মুখের অংশগুলো বেঁকিয়ে গতি প্রদান করেন।
ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বার্নিনির নির্মিত ভাস্কর্যগুলো প্রচন্ড গতি এবং প্রকাশভঙ্গিতে পরিপূর্ণ ছিল। তাঁর মূর্তি নির্মাণের কৌশল অনতিক্রম্য। অসীম উচ্চাশা , নতুন এবং দুর্লভ সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তাঁর নির্মিত ভাস্কর্যের সম্মুখীন হলে দর্শকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- এগুলি কি জীবন্ত না মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত?
চিত্রকলায় রুবেন্স নিজস্ব স্টাইল তৈরীতে সমর্থ হন। বিশবছর বয়সে ইতালিতে এসে প্রায় আট বছর শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি জন্মভ‚মি এন্তওয়ার্পে ফিরে যান এবং নিজস্ব স্টুডিও স্থাপন করে বহু চিত্র আঁকেন। চিত্রগুলো বর্তমানে লুভর -এ আছে। পরবর্তীতে উত্তর ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী রেমব্রান্ড তাঁর চিত্রকলা নিয়ে এগিয়ে যান অনেক দূর। বহু পৌরাণিক কাহিনীকে তিনি চিত্রে স্থান দিয়েছেন। তাঁর অঙ্কিত প্রতিকৃতিতে আলো-ছায়ার ব্যবহার, অন্ধকার পশ্চাদভ‚মি এবং নাটকীয় ভঙ্গি ‘বারোক’ রীতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
নিম্নে বারোক স্টাইলের কিছু চিত্রকলা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. The Evolution of the Cross:
এই ছবিটি এন্তোয়াপ গির্জার জন্য ১৬১০ সালে মহান শিল্পী পিতার পল রুবেন্সের আঁকা। বিশাল এই ছবিটি ১৮২ দৈর্ঘ্য ও ১৩৪ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট। তেল রঙে আঁকা তিনি এই চিত্রকলায় ম্যানারিজমের আবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে বিপরীতধর্মী গতি নিয়ে আসেন। সেই সাথে আলোছায়ার সার্থক ব্যবহারের সঙ্গে খ্রিষ্টের শরীরে এনেছেন এক উজ্জ্বল দ্যুতি।
২. The Rape of The Daughters of Leucippus:
এটিও পিতার পল রুবেন্সের আঁকা বিখ্যাত একটি চিত্রকর্ম। ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে অত্যন্ত গতিশীল কম্পোজিশন ও ধীরগতিসম্পন্ন ঘূর্ণায়মান গতির মাধ্যমে তিনি এটি রচনা করেন। চিত্রটিতে এক অক্ষের ওপর যেন সমস্ত ফিগার আবর্তন করছে।
মেসেনিয়ার লুসিপ্পাসের কন্যা ফোবে এবং হিলেইরাতেকে অপরণকারী ক্যাসর এবং পল্লক্সকে শিল্পী চিত্রিত করেছেন। তবে এতে ফোব ও হিলারাতের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য বুঝা যায় না। ছবির সারফেস কোনাকুনি এবং আড়াআড়ি প্যাটার্ন দ্বারা বিভক্ত। নারী দেহগুলো অত্যন্ত মসৃন, পক্ষান্তরে পুরুষের শরীরগুলো তামাটে বর্ণে অঙ্কিত। ঘোড়ার গতি এবং চকচকে অস্ত্রও এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ। ছবিটি দৈর্ঘ্য ৮৮ ও প্রস্থ ৮২ ইঞ্চি বিশিষ্ট।
৩. Death of the Virgin:
এই ছবিটি ১৬০৪ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যে শিল্পী কারাভাজ্জোর আঁকা। মাধ্যম অয়েল অন ক্যানভাস। ১৪৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৯৬ ইঞ্চি প্রস্থের এই ছবিটিতে কুমারী মেরির মৃত্যুদশা ও যিশুর শিষ্যদের শোক প্রকাশ দেখানো হয়েছে। ছবিটিতে মেরি বিছানায় পড়ে আছেন। তাঁর তাঁর ডান হাত বুকের ওপর রাখা যা একটু দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে বাঁ হাত তাঁর বামদিকে বিছানায় ফেলে রাখা। সেই সাথে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেক শিষ্যের মাথা শিল্পী নত করে এঁকেছেন। মেরির পাশে বসে থাকা ব্যক্তি দুহাত কপালে ধরে আছেন। সমগ্র চিত্রে উজ্জ্বল লালচে আলো ও অন্ধকারের সংমিশ্রণও লক্ষণীয়।
৪. Charles I Dismounted:
এই ছবিটি রুবেন্সের উত্তরসূরি সহকারী অ্যানথনি ভ্যান-ডাইক এর অঙ্কিত। ছবিটিতে এক ভাগ্যহত রাজার পূর্ণদেহের প্রতিকৃতি আঁকা। পেছনে থেমস্ নদী। চার্লসকে ক্যানভাসের এক পাশে ভেনিসীয় ল্যান্ডস্কেপে দাঁড় করানো। ভারসাম্যের জন্য চার্লসের অপর পাশে আরেকটি ফিগারও লক্ষণীয়।
৫. Miracle of The Slave:
এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের কারণে একজন ক্রীতদাসকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। তেল রঙে করা এই চিত্রে শিল্পী তিনতরেত্তো গতিময়তা এবং ফিগারগুলোকে বিপরীতধর্মী অবস্থানে রেখে নাটকীয় করে তুলেছেন। ছবিটির সর্ব বামে স্তম্ভের পাশে দন্ডায়মান রয়েছে একটি দল যেখানে ২ জন পুরুষ, ১ জন নারী ও ১টি শিশু। প্রধান গ্রæপটির পেছনে অনেকটা স্পেস বর্তমান এবং মাঝখানে একটি ফিগার ওপর থেকে ঝুলে পড়ছে।
৬. The Supper at Emmaus:
শিল্পী রেমব্রান্ডের আঁকা এই ছবিতে তীব্র আলো ও গভীর অন্ধকার বর্তমান। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর, বিনয়ী এবং সেই সাথে প্রেমময় ও দুখঃভারাক্রান্ত যিশুকে আলোর বিপরীতে স্থাপন করার কারণে ছবিতে এক নাটকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
৭. The Night Watch:
এই ছবিটি শিল্পী রেমব্রান্ডের আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত ডাচ গোল্ডেন এজ পেইন্টিং। ১৬৪২ সালে ক্যানভাসে তেল রঙে করা এই চিত্রটির মাপ ৩৬৩ সেমি. দ্ধ ৪৩৭ সেমি.। চিত্রটি তিনটি বিষয়ের জন্য বিখ্যাত- ১) চিত্রটির বিশালাকার, ২) হালকা মৃদু ছায়ার নাটকীয় ব্যবহার এবং ৩) ঐতিহ্যগতভাবে স্থিতিশীল সামরিক গ্রুপের প্রতিকৃতি। চিত্রটিতে একদল লোকের মাঝে তিনটি ফিগারকে ফোকাস করা হয়েছে। ক্যানভাসের একেবারে ডান পাশে একটি ড্রামার বিদ্যমান। মাঝের ফিগার দুটির একটির কালো টুপি ও কালো পোশাক পরিহিত, অন্যটি সাদা টুপি ও সাদা পোশাক পরিহিত।
ছবিসূত্র: উকিপিডিয়া।
©somewhere in net ltd.