![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রতীক ওমর
চর। ধুধু মরু এলাকা। মাঝে মধ্যে মানুষের বসবাস। ছোট ছোট ঘর। ছোট ছোট পাড়া। শুস্ক মৌসুমে বালির পথে। বর্ষাতে নৌকায় পাড়ায় পাড়ায় সহজেই যাতায়াত করা যায়। বালির সেই পথে হাটতে হাটতে অনেকটা ক্লান্ত শরীর। পেশাগত কাজ শেষে ঘাটের দিকে ফিরছিলাম। ডাকাত মারি চরের ঘাট। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা অসংখ্য চরের একটি ডাকাতমারী। সাথে আরো দুই গণমাধ্যমকর্মী ইমরান হোসেন রুবেল ও জাহাঙ্গীর আলম ছিলো। পথে দেখা মেলে শার্ট-প্যান্ট পড়া এক ভদ্র লোকের। হাতে ডাক্তারদের ব্যবহারের ব্যাগ। গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো। দূর থেকে লোকটাকে দেখে মনের মধ্যে কৌতুহলের উদয় হয়। কাছাকাছি আসতেই একটা সালাম দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। ভদ্রলোক সায় দেন। পরিচয় পর্বে তার নাম জানালেন আব্দুল মান্নান ওরফে বাবু ডাক্তার। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কলাকোপা গ্রামে তার বাড়ি। সারিয়াকান্দির চরের মানুষদের কিচিৎসা করেন করেন তিনি। এক সময় নান্দিনীর চরে এক সময় চেম্বার ছিলো। এখন গ্রামের বাজারে চেম্বার। ফোন কলে বিভিন্ন চরে ছুটে যান। কোথায় ডাক্তারি পড়েছেন জানতে চাইলে বাবু ডাক্তার উত্তরদেন উপজেলা পর্যায়ে থেকে ডাক্তারি পড়েছেন। কোথায় পড়েছেন সেই কথা বলতে পারলেন না। পড়ে গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটি হাতে নিয়ে দেখা যায় ‘বাংলাদেশ ভিলেজ ডক্টরস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ কর্তৃক আইডি কার্ডটি দেয়া হয়েছে। সেখানে সংগঠনের বগুড়া জেলা সভাপতি রফিকুল ইসলামের একটি স্বাক্ষর রয়েছে। ইংরেজিতে সভাপতির নামের আগে লেখা গ্রাম ডাক্তার। ওই এসোসিয়েন কাদের সে সম্পর্কেও বিস্তারিত জানাতে পারেননি বাবু ডাক্তার।
কিভাবে রোগীদের ওষুধ দেন জানতে চাই বাবু ডাক্তারের কাছে। তিনি উত্তরদেন আমার ডাক্তারি পেশার বয়স চল্লিশ বছর চলছে। রোগী দেখতে দেখতে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাতলা পায়খানা হলে স্যালাইনের সাথে মেট্টো, টেট্টাসাইক্লিন বড়ি দেই। তাতেও কাজ না হলে এন্টিবায়েটিক মেরে দেই। কাজ হয়ে যায়। আবার অনেক রোগী আছে টেবলেট বড়িতে কাজ না হলে স্যালাইন পুশ করে দেই। চরের মানুষদের এভাবেই সেবা দিয়ে আসছি দীর্ঘ চল্লিশ বছরধরে।
থানা লেবেল থেকে ডাক্তারি শেখা বাবু ডাক্তার কথার ফাঁকে বললে তিনি ১৯৭৭ সালে চন্দনবাইশা থেকে এসএসসি পাস করেছেন। রোগী দেখে ফি নেন না। ওষুধের দাম নেন। এতেই তার ভালো চলে যায়। পাইকারীতে ওষুধ কিনে রোগীদের কাছে খুচরা মূল্যে বিক্রি করেন।
আন্দাজ করে এন্টিবায়েটিক ব্যবহার কতটা ভংঙ্কর সেটা জানানে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু হবে না। হয়ও না। বরং তারাতারি রোগী ভালো হয়ে যায়। কোন দিন কারো সমস্যাতো হয়নি।
মিনিট দশেক কথা বলার পর বাবু ডাক্তার তার গন্তব্যে পথ চলা শুরু করেন। এমন আজব ডাক্তারের দেখা পেয়ে মনের মধ্যে নানা ধরণের প্রশ্নে উদয় হতে থাকে। মাথা নিচু করে জমির আইল বেয়ে আমরাও আমাদের গন্তব্যপাণে ছুটলাম। চরের মানুষরাও মানুষ। এদের আসলে বাবু ডাক্তার ছাড়া করার কিছুই নেই। ডাক্তারাতো আর কষ্টের পথ বেয়ে পায়ে হেটে এভাবে রোগী দেখতে আসবেন না কখনো। আমাদের দেশের মহান ডাক্তারদের কাছে এমন প্রত্যাশা আহাম্মোকি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। নিরুপায় চরের মানুষ। বিপদে যেই পাশে দাঁড়ায় সেই তাদের কাছে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। নেই স্কুল, নেই হাসপাতাল, নেই মশৃণ পথও। ভোটাধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের নাগরিকত্ব। রাষ্ট্রিয় সুযোগ সুবিধার ছিঁটে ফোটাও দেখা পায় না হতভাগারা। ঝাড় ফুঁ, কবিরাজি চিকিৎসার উপরেই ভরসা এসব মানুষের। তড়িৎ চিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য মানুষ মারা যায় চরাঞ্চলে। বিশেষ করে প্রসূতি মায়েরা সন্তান প্রসবকালে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর মুখে পতিত হয় বেশি। প্রতিদিন কোন না কোন অঞ্চলে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু হয়। এসব মৃত্যুর দায় নেয়ার মত কেউ নেই। কোন দপ্তর নেই। মৃত্যুর পরিসংখ্যানও হয়তো কোন দপ্তরে তালিকাতে পাওয়া যাবে না।
কিছু নামিদামী এনজিও চরের অসহায় মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের নামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়। লোক দেখানো দায়সারা কিছু কাজ করে মিডিয়া কাভারেজ করেই তাদের প্রকল্প শেষ হয়। কোটি কোটি ডলার, টাকা এসব মানুষদের নামে এনজিওগুলো দেশ বিদেশ থেকে এনে নিজেদের ব্যক্তিগত ভাগ্যের পরিবর্তন করেন। যাদের দেখিয়ে এসব বরাদ্দ আনা হয় তারা হয়তো জানেই না তাদের মাথা অন্য কেউ বিক্রি করছে অবলীলায়। এনজিও কর্মীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও চরের মানুষদের ভাগ্য ভাগাড়েই পড়ে রয় জনম জনমধরে।
এদিকে এন্টিবায়েটিকের অবাধ ব্যবহার নিয়ে কথা হয় বগুড়ার একজন বিজ্ঞ চিকিৎসক ও ফোর আর আধুনিক হাসপাতালের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম (ডক্টর’স অব মেডিসিন) মানবজমিনকে জানান, এন্টিবায়েটিক শরীরের খারাপ ব্যাকটোরিয়াগুলো ধ্বংসে কাজ করে থাকে। আর শরীরে যত রোগ হয় তার মাত্র ২৫ শতাংশ হয় ব্যাকটোরিয়াজনিত। বাকি ৭৫ ভাগ রোগ হয় মনোদৈহিক কারণে। সে ক্ষেত্রে কোন ভাবেই এন্টিবায়েটিক প্রয়োজন হয় না। সুতরাং সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ছাড়া এন্টিবায়েটিকের ব্যবহার করা খুবই ভংঙ্কর। তিনি বলেন, এন্টিবায়েটিকের ডোজ মেইনটেন করতে হয় রোগের ধরণ অনুযায়ী। যদি কেউ সঠিকভাবে ডোজ শেষ না করে তাহলে ভবিষ্যতে তার শরীরে ওষুধ কাজ করবে না। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। এই চিকিৎসক আরো বলেন, এখন গ্রাম ডাক্তার, কবিরাজ, ফার্মেসির ওষুধ ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ মানুষও এন্টিবায়েটিক আন্দাজ করে কিনে খাচ্ছে। বিষয়টি খুবই ভাবনার। এন্টিবায়েটিকের সঠিক ব্যাবহার এখনি নিশ্চিৎ করতে না পারলে অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষ হয়তো আরো বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে।
©somewhere in net ltd.