নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা মানবতা বিরোধী তাই পরিত্যাজ্য মানবের সাধনা হোক মনুষ্যত্ব লাভ।
(১)
আমি তখন হাইস্কুলের ছাত্র।বছর দুই আগে বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকা শহরে এসেছি।পরিবার বলতে বাবা মা ও আমি।প্রথমে বাংলা মটরের একটা ঘুপচি ঘরে থাকলেও পরবর্তীতে আমরা মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের পিছনের ২১/* শের শাহ শুরী রোডের ডি ব্লকে তিন শতকের টিনশেডের একটা সেমি পাকা বাড়িতে উঠি ।
আব্বা কিছুদিন আগে মাত্র ষোল হাজার টাকায় এক বিহারি পরিবারের কাছ থেকে এই বাড়িটি কিনেছেন।বলা যায় সেই আমলে সস্তা দরেই বাড়িটি কেনা ।ততদিনে ক্রয় সূত্রে আমরা এ পাড়াতে এসেছি প্রায় ছয় মাস হতে চলল। যখন এসেছিলাম তখন মাত্র দুটি বাঙালি পরিবারের বাস ছিল আমাদের পাড়াতে।বাকি সব বিহারি পরিবার।মূলত এলাকাটি ছিল বিহারি অধ্যুষিত।এক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা সহ আরও কিছু সমস্যা হচ্ছিল আমাদের । মা'তো পুরাই বিরক্ত ছিল আব্বার উপর।প্রায় বলতো "এ কোথায় নিয়ে এলে নেহালের আব্বা। না বুঝি কারও কথা না করা যায় মেলামেশা "
এলাকাটি বিহারি অধ্যুষিত হলেও । দেশ স্বাধীন হবার পর বেশ দ্রুত ই নানা কারণে বিহারিরা এলাকা ছেড়েছে। তার পরিপেক্ষিতেই স্বাভাবিক নিয়মে এ পাড়ায় বাঙালিদের আগমন ঘটেছে একে একে।
এরকম পালাবদলের প্রেক্ষাপটে মাঘ মাসের এক পড়ন্ত বিকালে দুই ঠেলাগাড়ি ভর্তি মাল নিয়ে আমাদের পাড়াতে এক নতুন পড়শী হাজির হলো।
আমি ও আমার বন্ধুরা খেলা বাদ রেখে এগিয়ে এলাম, কাদের আগমন হলো সেই কৌতুহল মেটাতে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে আমার খেলার সাথীগুলোকে বন্ধু না বলে বান্ধবী বলাই ভালো কারণ এ পাড়াতে আমার বয়সী আমিই একমাত্র ছেলে। সমবয়সী কিছু বিহারি ছেলে যদিও ছিল কিন্তু আম্মা বিহারি ছেলেগুলোর সাথে আমাকে মিশতে দিতে চাইতেন না।অগত্যা মেয়েদের সাথেই আমাকে খেলতে হতো।
যাহোক আমরা যখন রাস্তাজুড়ে সাত চাড়া খেলছিলাম।ওরা এলো প্রায় নিঃশব্দে। ঠেলাগাড়ি ও মালামাল দেখে মুহুর্তে বাঙালি পরিবারগুলোর মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে গেল।নতুন কারা এলো খোঁজ নিতে ও স্বভাবসিদ্ধ কৌতুহল মেটাতে এগিয়ে এলো অনেকেই।আমি ও আমার বান্ধবীরা মিলেও ভিড় জমালাম।বিশেষ করে আমি খোঁজ নিতে এলাম সমবয়সী কোন ছেলে এলো কিনা।তবে মাগরিবের আযান পড়ে যাওয়াতে অনেকের মত আমিও বিফল মনোরথে বাড়িতে ফিরে এলাম উল্লেখ যোগ্য কোন তথ্য সংগ্রহ না করেই।
আমাদের পরিবারের অলিখিত কিছু নিয়ম ছিলো,যেখানেই থাকি না কেন মাগরিবের আযানের সাথে সাথে বাড়িতে ঢুকতে হবে।না হলে আব্বার কাছে হাজার কৈফিয়ত দিতে হতো আর সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারলে শাস্তি নিশ্চিত ছিল ।যাহোক বাড়িতে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসতে বসতে মনে মনে ভাবলাম আগামীকাল খোঁজ নিবো।
রাতে যখন খাবার খেতে বসলাম আম্মু জানতে চাইলো
-বিলকিসদের বাড়িটাতে কারা এলো রে নেহাল? জানিস কিছু?
আমি তো তেমন কিছু জানি না তো কি উত্তর দেবো? মনে মনে সব রাগ গিয়ে পড়লো আব্বার উপর।মায়ের সাথে অকারণে রাগ দেখিয়ে বললাম
- আমি কি সব খবর নিয়ে বেড়াই না-কি?তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল।তোমার জন্য খবর আনতে গেলে তো বাড়ি ফিরতে দেরি হতো আর তখন আমাকেই সব বকা শুনতে হতো।
- রাগ করছিস কেন? আমার মনে হয় যারা এসেছে তারা বাঙালি ই হবে,কি বলিস? কাল একবার সাহিদার সাথে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবো,না হয়।হাজার হলেও প্রতিবেশী বলে কথা।
আমার তাড়া ছিল।আমি তেমন কিছু বললাম না আর।আসলে হুমায়ুন আহম্মেদ নামে একজন লেখকের "শঙ্খনীল কারাগার" বইটা পেয়েছিলাম গত ক'দিন আগে , সেটা নিয়ে পড়তে বসলাম।রীতা বলেছে বইটা বেশ ভালো। মাও সেদিন এক বসাতে শেষ করেছে। কাহিনী সংক্ষেপ বলতে চেয়েছিল আমি শুনতে চাইনি।পড়তে পড়তে আমি বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলাম এবং এক সময় ঘুমিয়েও পড়লাম।
পরদিন সকালে আগ্রহ থাকা স্বত্বেও নতুন বাসিন্দাদের খোঁজ খবর নিতে যাওয়া হলো না আব্বার সাথে বাজারে যেতে হলো ঘুম থেকে উঠেই।বাজার থেকে ফিরে নাস্তা সেরে যথা সময়ে আমি স্কুলে চলে গেলাম ।
বছরের প্রথম দিক বলে আমাদের স্কুলে টুকটাক নতুন স্টুডেন্ট ভর্তি চলছে সব ক্লাসেই। আমাদের ক্লাসে ইলা নামে এক মেয়ে ভর্তি হলো সেদিনই। মেয়েটিকে বেশ চটপটে আর কতৃত্বপরায়ণ মনে হলো। ক্লাসে এসেই মেয়ে মহলে বেশ সাড়া ফেলল প্রথম দিনই ।টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুদের সাথে আমি দাড়ি'চা খেলছি হঠাৎ ইলা আমাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে ডাক দিলো
- এই ছেলে এই এদিকে আয় তো। কি নাম তোর?
মেয়েটির ডাকবার ভঙ্গি আমার মোটেও ভালো লাগলো না।আমি বেশ বিরক্ত হলাম।মনে মনে ওর একটা নাম পাতালাম।সময় মতো এটা প্রচার করে দিবো সেটাও ভেবে রাখলাম।
বন্ধুরা সবাই জানে আমি ভালোর ভালো খারাপের খারাপ আর স্বভাবে বেশ রগচটাও আর তাই ইলার এরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ডাকে আমার কি প্রতিক্রিয়া সেটা দেখতে সকলে বেশ উৎসাহী হল।
রাজন খিক খিক করে বদমায়েশি হাসি হেসে বলল
- মহারানি তোকে ডাকছে রে। যা যা...
- মহারানী না ডাইনি আমি ওকে মাস্টারনী নাম দিয়েছি।বেয়াদব মেয়ে একটা।এসেই ভাব নেওয়া শুরু করেছে। মনে হচ্ছে নাক মুখ থাবড়িয়ে দেই।চাপা স্বরে বললাম।
তারপর কিছু তো বলতে হয় তাই বেশ জোরেই বললাম
- আমাকে বলছো না-কি ?
- হ্যাঁ তোমাকেই। আমি তোমাকে চিনেছি মনে হয়।এসো এসো
এগিয়ে গিয়ে নকল অবাক হবার ভান করে বললাম
- তাই? আমি এত জনপ্রিয় জানতাম না তো?তা কি দরকার আমাকে বলতো?
- তুমি সেই ছেলেটা না যে কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসার সামনে অকারণে ঘুর ঘুর করছিলে।
এমনিতে ইলার প্রতি বিরক্ত ছিলাম এবার সেটা ক্ষোভে দাড়ালো। এই মেয়ে তো সরাসরি আমার ইমেজ সংকটে ফেলে দিলো।স্বাভাবিকভাবে ওর ডাহা মিথ্যে কথায় ভীষণ রেগে গেলাম। ককর্শ স্বরে বললাম
- নতুন এসেছো নতুনের মত থাকো। বেশি ভাব নিও না।খবর হয়ে যাবে কিন্তু। কথাবার্তা ভালো করে বলো।
-ভাব নিচ্ছি আমি?
- নয়তো কি? নিজেকে কেউ কেটা প্রমানের জন্য অন্যের নামে মিথ্যা মনগড়া কথা বলে অপদস্ত করা আমি একেবারে পছন্দ করি না। সোজা কলপ্লেইন করবো।
- কেউ কেটা! অপদস্ত! কমপ্লেইন!বেশ কনফিডেন্সিয়াল। হুহ তুমি শের শাহ শুরী রোডে থাকো না?
- থাকি, তো? তোর তাতে সমস্যা কি?
- ২০/১২ ওই বাসাটা আমাদের। গতকাল এসেছি আমরা।
এবার পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এবং তৎক্ষনাৎ ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলাম।
সুযোগ পেয়ে অনিক বলল
নেহাল তুই কবে থেকে মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা ধরলি। খালাম্মা কি জানে এসব?
ইলার উপর আমার রাগ আরও বেড়ে গেলো।ব্যাপারটা ওভাবে না বললেও পারতো।অসভ্য একটা মেয়ে। ম্যানার জানে না কোন। সুযোগ পেলে রগড়ে দিতে হবে একদিন।
আমি তেজ দেখিয়ে বললাম
- ওর মত মেয়ে আমি থোড়াই কেয়ার করি।
ইলা কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেল ।
(২)
শুরুটা ঝামেলা দিয়ে হলেও আমাদের ভাব হতে খুব বেশি দেরি লাগলো না। অচিরেই আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।
মায়ের সাথেও ওদের পরিবারের লোকজনদের দারুণ জমে গেল।
ওদের বাসায় আমার যাতায়াত অবাধ হলো ক্রমে ক্রমে। ইলা মেয়েটি সত্যিই অসম্ভব মেধাবী ছিল। এদিকে আমি আবার পড়াশোনায় ভীষণ অমনোযোগী ছিলাম।অন্য দিকে পাঠ্য বহির্ভূত বই আমাকে বেশি আকর্ষণ করতো তবে ইলার সহচার্যে আশ্চর্যজনকভাবে লেখাপড়ায় ক্রমশ ভালো করতে লাগলাম। আমরা ভীষণ বন্ধু হয়ে উঠলাম। মা ও ইলাকে ভীষণ পছন্দ করতো।লোকে বলে ছেলে আর মেয়েতে কোন বন্ধুত্ব হয় না।সে সময় ঢাকা শহরের মানুষ তত আধুনিক হয়নি তখনও কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত ছিলাম।দু পরিবার থেকে এ সম্পর্ক নিয়ে কোন বাধাও আসেনি কখনও।পাড়া প্রতিবেশীরা এ ব্যাপারে কিছু বললেও পাত্তা পেত না তেমন একটা। সবচেয়ে বড় কথা আমরা জানতাম কোথায় থামতে হয়। সম্পর্ক কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়।
একটু বড় হতে আমরা শপথ করে ছিলাম এই বন্ধুত্ব কখনও প্রেমেতে গড়াবে দেব না।কোনক্রমেই না। আমরা শুধুই বন্ধু।বন্ধু আছি এবং বন্ধুই থাকবো।
আমরা ছিলাম ভীষণ বই পড়ুয়া আর তেমনই সিনেমা খোর। এর জন্য অবশ্য আমিই দায়ী বলা চলে।
তখন ইলা পড়ে শেকসপিয়ার জ্যাঁ পল সার্ত্রে এদিকে আমি পড়ি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রুশ সাহিত্য।
আবার ফরাসি চিত্রকলা আর জার্মান চলচ্চিত্র আমাদের দুজনেরই প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে ।
রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরও আমাদের প্রিয় ছিল।মাসুদ রানাও পড়ি সুযোগ পেলে। তারাশঙ্কর শরৎচন্দ্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নিহাররঞ্জন গুপ্ত সহ আরও কত কত নাম।শিল্প সাহিত্যে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা ছিল আমাদের।
চমৎকার দিনগুলো কাটতে লাগলো খুব দ্রুত। এর মধ্যে হঠাৎই ইলা আবিরের প্রেমে পড়লো। আবির আবার আমার বন্ধু ছিল ।একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
সম্ভবত প্রকৃতির নিয়মে ইলা আবিরের সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে লাগলো।আমিও কেন জানি নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলাম। কারণ তো একটা ছিলই,কারণ আর কিছু নয় আবিরের কিছু কথাও আমাকে বেশ আহত করেছিল।
আসলে আমি চাইছিলাম ইলা আর আবিরের সম্পর্কটা নির্ভেজাল থাকুক। কি দরকার ওদের রোমাঞ্চের মধ্যে কাবাবে হাড্ডি হওয়া।
এর মধ্যে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।ইলার সাথে আমার দেখা হয় কথা হয় তবে আগের মত না।কোথায় যেন সুর কেটে গেছে ।এদিকে আমার পড়াশোনার চাপ বেড়েছে।ভালো ফলাফলের তাগিদ অনুভব করি।
ইলা এক বৃষ্টির দুপুরে আমাদের বাড়িতে এলো হঠাৎই আমি তো অবাক।মজা করে বললাম
- অসময়ে গরীবের বাড়িতে হাতির পা ।ইলা প্রত্যুত্তর করলো না। ওকে ভীষণ ক্লান্ত আর বিধস্ত দেখাচ্ছিল।
ইলাকে এই অবস্থায় দেখে আমার চিত্ত কেন জানি না চঞ্চল হয়ে উঠলো।
তবে সেদিন ইলা তেমন কিছু বলল না। শুধু বলল
- নেহাল আমি যদি কোন কারণে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে বসি অন্য সবার মত তুই কি আমাকে ঘৃণার চোখে দেখবি?
আমি কোন রকমে আবেগ সংবরণ করে বললাম
- আমার প্রতি এই তোর বিশ্বাস?
সেদিন প্রথম ইলা আমাকে জড়িয়ে ধরলো এবং ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। ভাগ্যিস বৃষ্টির দিন ছিল।তাই সেই কান্না কারো কানে গেল না। খুব শীঘ্রই ইলা অবশ্য নিজেকে সামলে নিলোএবং আর কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে চলে গেল।
সেদিন রাতে জানতে পারলাম আবির রোড এক্সিডেন্টে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। আহা কি মর্মান্তিক! এজন্য মেয়েটা কাঁদছিল ।আমি ছুটে গেলাম হাসপাতালে কিন্তু আবির আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ততক্ষণে পরপারে চলে গেছে। মর্মান্তিক মৃত্যু। মেনে নেওয়া কষ্টকর।
ইলা ক্রমশ আরও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লো। আমি ওকে সঙ্গ দিতে লাগলাম।হাসি গানে গল্প কথায় ওর জীবন ভরিয়ে তুলতে সচেষ্ট হলাম। আমি জানি মানুষের জীবনের এই সময়টা ভয়ংকর হয়।যখন তখন যা কিছু করে ফেলতে পারে ইলা। এই মানসিক ট্রমা ওকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। এটা আমার দায়িত্বও বটে।
কয়েকদিনেই ইলা স্বাভাবিক হলো এবং আমার প্রতি খুব বেশি রকম নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।
একদিন হঠাৎ সে বলে বসলো
- বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কি করি বলতো?আবিরকে আমি ভুলি কি করে?
- ভালো পাত্র হলে, না করে দেওয়া বোকামি হবে। আলটিমেটলি বিয়ে তো করতেই হবে না-কি?
- কিন্তু
- এর আবার কিন্তু কি? আবির তো আর ফিরবে না।ফিরবে?
- আবিরের কাছে আমি দায়বদ্ধ।
- ওতো মৃত। এটা তোকে মানতেই হবে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ইলা যেন বিস্ফোরক সংবাদ পরিবেশন করলো।
- আবিরের সন্তান আমার শরীরে বড় হচ্ছে। এই অবস্থায়.....
- মানে?
- ওর এক্সিডেন্টের দিন আমাদের কোট রেজিষ্ট্রেশন হবার কথা ছিল, নেহাল। আমি এ লজ্জার কথা বাড়িতে কি করে বলি? কোন মুখে বলি?
বুকটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো।কেন এমন হলো আমি জানি না। আমি কি ইলাকে ভালোবাসি?এমনতো হবার কথা ছিল না।
ইলা সেই দুপুরে তার করা শপথ ভুলে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলল
- চল আমরা বিয়ে করি নেহাল। না হলে আমার মৃত্যু ছাড়া কোন পথ খোলা থাকবে না।কিন্তু আমি বাঁচতে খুব ভালোবাসি আমি মরতে চাই না। নেহাল তুই আমাকে বাঁচা।তুই আমাদের সন্তানকে বাঁচা। বিয়ে নামক একটা সার্টিফিকেট আমার ভীষণ ভীষণ দরকার।
- তোর বাড়ির লোক?
- মেনে নেবে।আমি জানি ওরা তোকে অপছন্দ করে না।তারপরেও যা হবে দেখা যাবে। তুই শুধু মন স্থির কর।
- আমি এখনও বেকার।
- তুই আমাকে বিয়ে করবি কি-না বল?না হলে আমি অন্য পথ দেখি।
ইলার আচরণে আমি ভীষণ অবাক হলাম। আহতও হলাম।আবিরের দায় আমাকে কেন বয়ে বেড়াতে হবে?সে প্রশ্নও এলো মনে। একবার ভাবলাম বলি, তুমি সন্তানটা নষ্ট করে ফেলো।কিন্তু বিবেকে বাধা দিলো। আসলে আমি ইলাকে কোন ক্রমে আঘাত করতে চাইছিলাম না।
আমাদের বন্ধুত্বের শুরুতে আমরা শপথ করেছিলাম এ জীবনে আমাদের সম্পর্ক কখনে প্রেমে গড়াবে না বিয়ে তো দূর অস্ত। কিন্তু এখন....
আমরা শপথ নিয়েছিলাম মানবতার সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবো। কিন্তু ইলা পথিমধ্যে নিজের সিদ্বান্ত বদলালো আর তারপর এই বিপর্যয়।
আমি আমার জীবন পথশিশুদের উৎসর্গ করবো। রাত জেগে কত কত পরিকল্পনা। তার জন্য আরও কত শত কাজ বাকি আছে..আছে কত সমস্যা। অথচ এদিকে
পরদিন দুপুরে ইলা আবার এলো ব্যাকুল হয়ে বলল
- নেহাল তোকে একটা কথা বলেছিলাম। কিছু ভাবলি?
- ঠিক ভুল বুঝতে পারছি না কিছু। আমি...
- কোন সমস্যা হবে না। তুই আমার বন্ধু না। আমাকে তুই এটুকু ফেভার করবি না?
- বিয়ে জিনিসটা ছেলে খেলা নয় ইলা।
- জানি।তবু অনুরোধ বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করবি না?
তারপর
ইলা সরে এসে ফিসফিসিয়ে বলল
- আরে তুই কি মনে করছিস সত্যি সত্যি বিয়ে নাকি! মিথ্যেমিথ্যি বিয়ে। বর হিসাবে তোকে আমার একটুও পছন্দ নয়।তুই শুধু সবাইকে বলবি তোর আর আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ব্যাস।একটা শুধু সার্টিফিকেট দরকার। আবিরের স্মৃতি টুকুকে বাচাতে হবে।এটুকু আমার জন্য করবি না?
- যা তা কি করে হয়।
ইলা ফোস করে উঠলো
- আসলে আমারই ভুল তুই আসলে তথাকথিত আর পাঁচটা মানুষের মতই।তোকে অবশ্য আলাদা ভেবেছিলাম। সব ভুল।
- এভাবে বলিস না।অনেক হিসাব আছে এখানে। অনেক জটিলতা।বিয়ে কেন ছেলেখেলা নয়।
-বড্ড হিসবি হয়েছিস। এখানে কোন হিসাবের দরকার নেই। সব হিসাব বরাবর। আমার আসলে কয়েকটা মাস সময় চাই। এই ছলনাটুকু করতে চাইছিলাম না তবে মাকে ঠেকানো যাচ্ছে না।তাছাড়া তথাকথিত এ সমাজে আবিরের সন্তানের একটা পরিচয় দরকার?
আমার বেশ অবাক লাগলো।ইলা কত বদলে গেছে। সে স্বার্থপরের মত শুধু নিজের টুকু ভাবছে। সমাজ সংসার বলে একটা কথা আছে।
ইলা তখনও এক মনে বলে চলেছে
স্কলারশিপটা পেতে এবং গুছিয়ে নিতে আমার কিছু সময় চাই নেহাল।সারাজীবনের জন্য তোর কাঁধে সিন্দাবাদের নাবিকের মত বোঝা হতে চাই না।যাস্ট একটু হেল্প আমি এই শহর ছাড়তে চাই। সেই সময় টুকু চাইছি।
তাছাড়া তুই তো অনাথ শিশুদের জন্য অনেক কিছু করিস। আমার সন্তানের জন্য এটুকু করবি না?
এর পর আর কোন কথা চলে না।
আব্বা চলে গেছেন ততদিনে। মাকে ম্যানেজ করতে আমার সময় লাগলো না। বন্ধুর জন্য এটুকু করাই যায়। যদিও তৎকালীন সমাজে এমন সিদ্ধান্ত বেশ সাহসী ছিল।
ইলা চলে এলো আমাদের বাড়িতে। আমাদের বিয়েটা বিয়ে ছিল না মা সম্ভবত সেটা টের পেয়ে গেছিল কদিনেই তবে মা ইলাকে ভীষণ ভালোবাসতো। এক শরতের শেষ বিকালে ইলা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ চলে গেল।
ইলা বিদেশে যাবার পর সময়ের সাথে সাথে আমার সাথে কেন জানি যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। তবে ও চিঠিতে জানাতো এখানে এসে ও জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে ।ওর একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম ও নেহাল রেখেছে। নেহালকে আমার বড় আপন মনে হয়। যদিও কখনও দেখা হয়নি আমাদের।হয়নি কোন কথাও।
মা বাদে আমি অন্য কাউকে বলিনি আমার সাথে ইলার পাতানো বিয়ের কথা। মাও দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে আমার মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল।মা আসলে সারাজীবন ই ভীষণ সহজসরল ।তবে ইলাকে মা খুব ভালোবাসতো।সে হয়তো ধরেই নিয়েছিল ইলা সত্যি সত্যি একদিন আমার বউ হবে। বিদেশ থেকে ও ঠিক ফিরে আসবে।
ইলা আর ফেরেনি। ইলারা ফেরেনা। সে ব্যস্ত আছে তার পৃথিবী নিয়ে। আর এদিকে আমি দুস্থ নিঃস্ব মানুষের মাঝে ইলা আর নেহালকে খুঁজে ফিরি।
তাদের সুন্দর জীবন দেবার চেষ্টা করি তারা যেন পরিচয় সংকটে জনঅরণ্য হারিয়ে না যায়।
পরিশিষ্ট
ইলার সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল হঠাৎই। ততদিনে সে আবার বিয়ে করে সংসারি হয়েছে । আমিও পেতেছি সংসার।মৌটুসী বেশ মনে মিষ্টি একটা মেয়ে।মৌটুসী আর আমার সংসারে একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে আমাদের। আর আমার মেয়ের নাম রেখেছি ইলা। .. ….
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:১৮
ইসিয়াক বলেছেন:
আপু,
ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো।
শুভেচ্ছা।
২| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:০৯
মিরোরডডল বলেছেন:
ইলাকে অনেক বেশি সুবিধাবাদী আর স্বার্থপর মনে হয়েছে।
০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:২৯
ইসিয়াক বলেছেন:
পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক সময় মানুষকে নিরুপায় করে দেয়।এক্ষেত্রে ভালো মন্দ বিবেক বোধ লোভ পায়। ইলাকে সেজন্য দোষ দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক বিধিনিষেধগুলো ও মানুষগুলোর মানসিকতাও কমবেশি দায়ী।ইলা নিজের অনাগত সন্তান ও নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে। নেহালকে সে বন্ধুই মনে করে। আসলে হয় না এমন যে সব বন্ধু বা বান্ধবীকে স্বামী বা স্ত্রী রূপে মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না।সত্যি বলতে কি ভালোবাসাবাসিতে মনের উপর জোর চলে না।
শুভকামনা রইলো প্রিয় ব্লগার।
ভালো থাকুন।
৩| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:২৪
জুল ভার্ন বলেছেন: গল্প ভালো হয়েছে।
০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:৩১
ইসিয়াক বলেছেন:
অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো প্রিয় ব্লগার।
শুভেচ্ছা সতত।
৪| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৩
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: ভালো লাগলো গল্পটা।
বউ কি বন্ধু হতে পারে না? আমাদের সমাজে একটা সাধারণ ধারণা হল নর নারীর মধ্যে বিয়ে হওয়া মানে বন্ধুত্বের অবসান। অনেক ক্লাস মেট ছেলে মেয়ে একে অন্যকে বিয়ে করে। তাহলে কি বিয়ের পরে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়? এটা তো হওয়ার কথা না। যদি হয় কেন হয়?
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২০
ইসিয়াক বলেছেন: বউ অবশ্যই বন্ধু হতে পারে। আপনি ঠিক বলেছেন আমাদের সমাজে ছেলে মেয়ের বিয়ে হওয়া মানে বন্ধুত্বের অবসান এরম একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে ব্যাপারটা ঠিক না।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যদি বন্ধুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সত্যি মুশকিল। যদিও বা টিকে থাকে তাতে ভালোবাসা থাকে না।
ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার।
শুভকামনা রইলো।
৫| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:৩৪
শেরজা তপন বলেছেন: বেশ - সত্যি ঘটনা মনে হচ্ছিল।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২২
ইসিয়াক বলেছেন:
হা হা হা..... ইহা শতভাগ মিথ্যা গল্প। আমার সম্পর্কে একটা তথ্য দেই তাহলে আমি ছোট বেলা থেকে দারুণ মিথ্যা কথা বলতে পারি। তিন সত্যি!
ভালো থাকুন।
৬| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৯:০৫
চারাগাছ বলেছেন:
বেশ ভালো লেগেছে।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২৩
ইসিয়াক বলেছেন:
ধন্যবাদ চারাগাছ।
পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো।
ভালো থাকুন সব সময়।
৭| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১২:১৪
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: ভালো ছেলেদের শুধু ব্যবহার করা হয়। তাদেরও যে মন আছে, ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে এসব বুঝতে চায় না অনেকেই। ভীষণ খারাপ লাগে।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২৪
ইসিয়াক বলেছেন:
পৃথিবীটা খুব স্বার্থপর জায়গা। কি আর করা।
শুভকামনা রইলো।
৮| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:০৩
সোহানী বলেছেন: আরে এটা আসল নাকি নকল ঘটনা....। একেবারে আসলের মতোই তো লাগছে।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২৬
ইসিয়াক বলেছেন:
হা হা হা.... না প্রিয় ব্লগার। ইহা শতভাগ মিথ্যা গল্প। অলস মস্তিষ্কের কল্পনা।
শুভেচ্ছা সতত।
©somewhere in net ltd.
১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:০৫
মিরোরডডল বলেছেন:
- কেউ কেটা! অপদস্ত! কমপ্লেইন!বেশ কনফিডেন্সিয়াল।
কনফিডেন্সিয়াল এই শব্দটা কি এখানে ঠিক আছে?
মনে হয় কনফিডেন্ট লিখতে গিয়ে টাইপো হয়েছে?