![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধরে দিবানি!
চারিদিকে কুয়াশা। মেঘ দেখা যাচ্ছে না দূর আকাশে। টিএসসির মোড়ে চায়ের দোকানে বসে রয়েছি। হুট করেই ফুটপাত ধরে আনমনে হাঁটতে থাকা অমি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সেই অমি ভাই যার লেখার অন্ধ ভক্ত আমি। বন্ধু আড্ডায় যাকে গুরু বলে পরিচয় দিতে পেরে আমি গর্বিত হয়ে যাই। আগের চেয়ে কিছুটা শুকিয়ে গিয়েছেন। চোখে-মুখে চিন্তার ছায়া স্পষ্ট। অনেক দিন কোনো দেখা সাক্ষাত নেই। যে ফোন নাম্বারটা ছিলো তাও এখন বন্ধ।নিজেই এগিয়ে গিয়ে কথা বলা শুরু করলাম,
‘অমি ভাই যে এইদিকে। কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এদিকেই। এক বন্ধুর আসার কথা। কিছু টাকা ধার নেবো। মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে।’
‘বসেন ভাই। বন্ধুকে এইদিকে আসতে বলেন। কতদিন দেখি না আপনাকে।’
ঘটনা সামান্য নয়। অমি ভাইয়ের মা সিরিয়াস অসুস্থ। বোন ম্যারো ক্যান্সার। এই রোগের ভয়াবহতা বুঝার জন্য মেডিকেল সায়েন্সের স্টুডেন্ট হতে হয় না। অমি ভাইয়ের বাবা বেঁচে নেই। উনার পরিবার বলতে উনি,উনার ছোট এক বোন আর মা। অমি ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন গত বছর। এখনো কোনো চাকরি পান নি। ছোট বোন সামনের বার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। মায়ের চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করে দিয়েছেন সব। বাকি আছে কেবল ভিটে মাটি টুকু। এতোসব কথা বলতে বলতেই উনার বন্ধু এসে পরলেন। হাজার দশেক টাকা দিয়েই আবার চলে গেলো বন্ধু। উনার অফিসে নাকি তাড়া আছে। চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে দিলাম। এতোশত বৈষয়িক কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করে বসলাম কণা আপুর কথা। পাঠক তো আবার কণা আপুকে চিনেন না। কণা আপু হচ্ছে অমি ভাইয়ের সহপাঠী। এবং প্রেমিকা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই তাদের বন্ধুত্ব,এরপর প্রেম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে অমি ভাই একটা প্রেমের কবিতা লিখেছিলো আপুকে ভেবে। এই কবিতাটা আমার অসম্ভব পছন্দের। নিচে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। স্মৃতিশক্তি অনেক দূর্বল হলেও এই কবিতাটা ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।
আমি চাই না তুমি আমার তরে প্রেম করো,
শুধু চাই,
ছটফট করে কাটানো সারাটা রাত বালিশের ওপাশটায় থাকো।
আমি চাই না তুমি কলিকাতার কোনো সুরেলা গায়িকার মতো করে রবীন্দ্র গেয়ে শুনাও,
শুধু চাই,
কবীর সুমনের তোমাকে চাই গানটা একটিবার বেসুরো গলায় গাও।
এক কাপ কফি,
চিনি সামান্য,
তুমি এক চুমুক, আমি এক।
সভ্যদের বলে দেওয়া নোংরা কফির কাপে
লেপ্টে থাকবে আমাদের ভালোবাসা।
স্রেফ এটুকুই তো চাই।
আমার কাছে কবিতাটা ভালো মনে হলেও অমি ভাইয়ের নিজেরই নাকি ভালো লাগে নি। কণা আপুকেও একদিন ঠাট্টাচ্ছলে বলতে শুনেছিলাম,
‘আসছে আমার কবি! কবিতায় ছন্দ তো কিছুই নেই। হি হি হি হি।’
কণা আপুর জলতরংগ হাসিতে যাদু আছে। অমি ভাইও হাসতে শুরু করলো।
তো কণা আপুর ব্যাপারে অমি ভাইয়ের সঙ্গে কথোপকথনেই আবার ফিরে যাই। অমি ভাইকে কণা আপুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই উনার এলোমেলো দৃষ্টির বিষন্ন ভাবটা যেনো আরো প্রবল হলো। বললেন,
‘কণার বিয়ে হয়ে গেছে।’
এরপর সারাটা রাস্তা আর কোনো কথা হয় নি। হাসপাতালের কাছে এসে পরলাম। উনার মাকে দেখে বিদায় নেয়ার সময় অমি ভাই পেছন থেকে ডাক দিলো,
‘এই নীল শোন। কণার কোনো দোষ ছিলো না রে। ওর বাসা থেকে এতো চাপ দিলো আর এদিকে মার এই অবস্থা। আমার নেই চাকরি। ওর সঙ্গে দেখা হলে বলিস, মাকে একবার এসে দেখে যেতে। মা ওকে খুব পছন্দ করতো।’
এরপর অনেকদিন অমি ভাইয়ের সঙ্গে কোনো দেখা সাক্ষাত নেই। মেডিকেলের কাঠখোট্টা পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। আইটেম,কার্ড,টার্ম,প্রফ-একের পর এক পরীক্ষায় নিজেরই কোনো খবর নেই। কয়েকদিন পর অমি ভাই ফোন দিয়ে জানালো উনার মা মারা গেছেন। পড়াশোনার ব্যাস্ততায় জানাজাতেও যেতে পারি নি। পরীক্ষা শেষে ছুটির দিনে টিএসসি গিয়ে চটপটি-ফুঁচকার দোকানে কণা আপুকে দেখলাম। সঙ্গে উনার স্বামী। এগিয়ে গিয়ে কথাবার্তা বললাম। ফিরে আসার সময় আপু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন,
‘অমি কেমন আছে রে? তোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?’
‘উনার মা মারা গিয়েছে। অসুস্থ থাকার সময় অমি ভাই বলেছিলো তোমাকে একদিন নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তোমারই তো কোনো খোঁজ পেলাম না।’
‘ও আচ্ছা। আমি অনেক খারাপ তাই না?’
কণা আপুর চোখ ছলছল করছে। কেঁদে দিলে অসুবিধা। প্রসঙ্গ পালটিয়ে বললাম,
‘আচ্ছা। আর কিছু বলার আছে তোমার? সামি ভাইয়া কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম। তোমার সঙ্গে বেশ মানিয়েছে।’
‘চুপ বেয়াদপ। কথা ঘুরাবিনা একদম। আচ্ছা শোন, আমার কাছে অমির কিছু কবিতা আছে। এগুলোকে ওকে দিয়ে দিবি।’
বলেই উনার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে দিলো। এই কবিতা ঠাসা ডায়েরি ব্যাগে বয়ে বেড়ায় নাকি! মেয়েদের কোনো বিশ্বাস নেই। এরা সব পারে। স্বয়ং আদেমও বুঝতে পারে নি হাওয়াকে। আর আমি কোন ছাড়। আপু ফিরে যাচ্ছে। উনার স্বামী সামি ভাইয়া গাড়িতে বসে রয়েছে। আমি রিকশা খুঁজতে লাগলাম। হলে যেতে হবে। অমি ভাইয়ের কবিতা গিলবো অনেকদিন পর। প্যারাসিটমলের মতো দুইবেলা খাবো।
এ ঘটনার কয়েকমাস পর অমি ভাই হঠাৎ একদিন আমার কলেজে এসে উপস্থিত। উনার ফোন ছিনতাই হয়ে গিয়েছিলো। কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিলো না। উনি চাকরি পেয়েছেন। আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে উনার বিয়ে। বিয়ে করে বউ, ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকায় বাসা করে ফেলবেন। আমাকে বিয়েতে উনার গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। অমি ভাই বলে কথা। রাজি হয়ে গেলাম। একদিন ক্লাশ মিস হলে হোক।
সবকিছু প্রায় ঠিকঠাক মতোই হলো। প্রত্যেক বাঙ্গালি বিয়েতেই সামান্য ঝামেলা হবেই। জীবনেও দেখা না হওয়া আত্বীয়রা দেখা যাবে সামান্য কারণে হুলুস্থুল করে বিয়ে ভাঙ্গার জোগাড় করে দেন। সামান্য ব্যাপারের একটা নমুনা দেই। হয়তো বরপক্ষের কেউ একজন মাংশ চেয়েছে। আনতে দেরি হলো কিংবা ভুলে গেলো। এটা নিয়েই এলাহী কান্ড হয়ে যাবে। সে যাই হোক। কনেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। আমি এদিক-সেদিক পায়চারি করছি। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ঢাকায় ফিরে আসতে হবে। অমি ভাই ডাকলো,
‘এদিকে আয় ভাই।’
‘কিছু বলবেন? সারাদিন তো অনেক ধকল গেলো। আপনি ঘরে যান।ভাবী অপেক্ষা করছে।’
‘না। আচ্ছা। তুই যা। ওইদিকের ঘরটা তোর জন্য রাখা আছে। ঘুমিয়ে পর।’
অমি ভাই বাসরঘরের দিকে যাচ্ছে। আমি ঘরে গিয়ে ব্যাগের ভিতর থেকে ডায়েরিটা বের করলাম। হাতে নিয়ে অন্ধকার গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে গেলাম। হাতে ম্যাচলাইট। কবিতা ঠাসা ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আকাশে ফকফকা জোছনা। কবিতা পুড়া গন্ধ শুকে জোছনা খাচ্ছি। অমি ভাই হয়তো ভাবীকে এখন নতুন কোনো কবিতা শুনাচ্ছেন। হয়তোবা উনি কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছেন। আর উনার কবিতার অন্ধভক্ত আমি নিজ হাতে কবিতা পুড়ছি।
এরপর কয়েক বছর পার হয়ে গেলো। অমি ভাই নিজের মতো করে ব্যাস্ত। আমিও ডাক্তারি পাশ করে ফেলেছি। পড়াশোনার চাপ যেনো আরো বেড়েছে। মাঝেমধ্যে অমি ভাইয়ের অফিসে যাই। গল্প করি। তবে সে গল্পে সাহিত্য,কবিতা অনুপস্থিত। পড়াশোনার অত্যধিক চাপ সাহিত্যনুরাগ সবটুকু শুষে নিয়েছে ইতিমধ্যে। তেমনি একদিনের আড্ডায় অমি ভাই হঠাৎ বললেন,
‘তোর পরিচিত কোনো প্রকাশক আছে? একটা কবিতার বই বের করতাম।’
আমি অবাক হয়েছিলাম অমি ভাইয়ের কথায়।পুরোদস্তুর সংসারী বনে যাওয়া এই মানুষটা এখনো কবিতা লিখে! কয়েকটা কবিতা চেয়ে নিয়ে পড়লাম। অমি ভাইয়ের কবিতায় ছন্দ! কয়েকটা তাও আবার চতুর্দশপদী! দুজন বহু ঘুরে প্রকাশক খুঁজে বের করলাম। বইমেলাতে বই প্রকাশিত হলো। ধ্রুব এষকে দিয়ে প্রচ্ছদ করানো হয় নি। করেছে অমি ভাইয়ের বউ। অসাধারণ প্রচ্ছদ। চেয়ে দেখার মতো। আমি কেবল বোকা বনে যাচ্ছিলাম।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন এসে গেলো দেখতে দেখতে। বোকা বনে যাওয়া আমার হুট করেই শখ জাগলো অন্যকে বোকা বানানোর। সে অন্য কেউটা আর কেউ নয়, আমার গুরু অমি ভাই। কণা আপুর ফোন নাম্বার জোগাড় করে উনাকে বই প্রকাশের ব্যাপারে সব জানালাম। দুপুরের দিকেই ভাবীসহ অমি ভাই স্টলে এসে বসলো। আমি দূর থেকে দেখছি। কালো শাড়ি পরা কণা আপু এগিয়ে যাচ্ছে স্টলের দিকে। কবিতার প্রথম বইটা হয়তো উনিই কিনবেন। অমি ভাইয়ের কবিতায় ছন্দ দেখে হয়তো অবাক হবেন। আবার হয়তোবা অমি ভাই অবাক হয়ে যাবেন কালো শাড়ি পড়া কবিতা কিনতে আসা এই পাঠিকাকে দেখে। আমার এসব দৃশ্য না দেখলেও চলবে। রাস্তার ভিড়ে মিশে গেলাম। উপরে নীল মেঘ। আমাকে চ্যাম্বারে যেতে হবে। প্রত্যেক রোগীকে অমি ভাইয়ের কবিতার বই ফ্রি দিয়ে দেবো। গুরুর কবিতা পরে আর যাই হোক, মানুসিকভাবে কেউ অসুস্থ থাকতে পারবেনা।
উৎসর্গঃ জগতের সকল ব্যর্থ কবিদের।
৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৪৪
অপরাজেয় বিদ্রোহি বলেছেন: ধন্যবাদ।
প্রথম ক্রেতা ঠিক করে দেওয়ার ব্যাপারটা অনেক মজার। অমি ভাই কনা আপুকে দেখে ঠিক 'তব্দা' খেয়ে যাবে। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্যের অবতারনা হবে। আমার কল্পনায় ঠিক এভাবেই বিষয়টা এসেছে।
২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪০
আফসানা যাহিন চৌধুরী বলেছেন: হ্যাঁ... সেটাই খুব ভাল লেগেছে- পুরো লেখাটিই।
৩১ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১০:৩৬
অপরাজেয় বিদ্রোহি বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:০০
আফসানা যাহিন চৌধুরী বলেছেন: ভালো লাগল অনেক-
প্রথম ক্রেতাটি ঠিক করে দেওয়া- গুড কারেজ