![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হজ্জের সফরে গিয়ে পবিত্র মক্কা মুকাররমার অলিতে গলিতে এবং এর সন্নিহিত অদূরবর্তী এলাকাসমূহ ঘুরে দেখার শখ ছিল আমার দূরন্ত পর্যায়ের। মক্কা নগরীরর বাইরের মেঠো পরিবেশ কেমন, আমার দেশের মাঠ-ঘাটের বিপরীতে সে দেশের ভূমি-প্রকৃতির কতখানি পার্থক্য, সর্বোপরি প্রিয় রাসূল (স.) যে ভূমিতে জন্ম ও শৈশবসহ দীর্ঘ ৫৩ বছর কাটিয়েছেন সেখানে ব্যাপক বিচরণের পরিকল্পনা আমি হজ্জে যাওয়ার পূর্বেই সাজিয়ে রেখেছিলাম। মনে মনে এ চিন্তার বীজও বপন করেছিলাম যে, মনের মতো উৎসাহী এবং তারুণ্যদীপ্ত এ্যানারজেটিক সঙ্গী না পেলে অন্তত একা একা যতদূর পারি ঘুরে বেড়াব।
আমরা মক্কা মোকাররমা পৌঁছানোর দুদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ আমাদের কাফেলার প্রায় ৮০ জনের কুরবানীর পশু সরেজমিন দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমি তো মহা খুশি ! প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হয়ে সবার আগে আমি গুছিয়ে হোটেলের লবিতে যেখানে নিয়মিত বড় জামাতে নামায হয় সেখানে নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের হাজীদের পশু সরবরাহকারী জনাব জসিম ভাই বাদ আছর একটি মাইক্রো যোগে আমাদের ৫ জনকে নিয়ে গেলেন বাইতুল্লাহ থেকে প্রায় ২০/২২ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিরাট আয়তনের খামারে। তিনদিকেই পাহাড়বেষ্টিত খামারটিতে দুম্বা, গরু, বকরী রয়েছে হাজারেরও বেশি। আমাদের জন্য নির্ধারিত সাইজের বকরীগুলো দেখে চুক্তিবদ্ধ রেটের সাথে তা যথেষ্ট সন্তোষজনক এ মনোভাব নিয়ে বাইতুল্লায় এসে মাগরিব নামায আদায়ের পরিকল্পনায় খামার থেকে ফিরতি যাত্রা শুরু করি। জসিম ভাই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আরেকটি মাইক্রো ঠিক করে খামারের অঙিনা থেকেই আমাদের বিদায় জানালেন এবং উনি অন্য ট্যাক্সিতে আরো দুজনকে সাথে নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে তিনি ভিন্ন দিকে চলে গেলেন।
আমরা আরব উপত্যকার উত্তপ্ত গোধূলী দেখতে দেখতে ফিরছি আর ভাবছি দিন শেষের লাল সূর্যটা এখনো কী পরিমাণ উত্তাপ ছড়াচ্ছে- অথচ আমাদের অঞ্চলে এ সময়ের সূর্য একেবারে নিস্তেজ হয়ে আসে। হেমন্তের এ সময়টাতে তো রীতিমতো কূয়াশার দেখা মিলে এবং খোলা এলাকায় তো শীতই অনুভূত হয়। সারি সারি পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের লুকোচুরি দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল কিন্তু খামার ছেড়ে প্রায় ৫ কিঃমিঃ আসার পর সহসা একটি অনাকাক্সিক্ষত বিপত্তি ঘটে গেল। পথের একটি অস্থায়ী চেকপোস্টে সৌদি পুলিশ আমাদের গতি রোধ করে এবং সাথে পাসপোর্ট বা অন্য আইডি কার্ড দেখতে চান। কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে থাকবে কী করে ? আমাদের পাসপোর্ট তো বিমান বন্দর থেকে বাসে উঠার সময় নিয়ে নিয়েছে কিন্তু মোয়াল্লেম অফিস থেকে আইডি কার্ড তখনো আমাদিগকে সরবরাহ করা হয়নি। পুলিশ ভাই বেঁকে বসলেন এবং আমাদের মাইক্রো পাশে সাইট করে থামিয়ে রাখলেন। জানতে পারলাম যে, হজ্জের কয়েকদিন পূর্বে মক্কার প্রবেশ পথসমূহে এ ধরনের কড়াকড়ি চেক পোস্ট বসে।
আমাদের কয়েকজনের হাতে মোয়াল্লেম অফিসের ঠিকানা সম্বলিত হলুদ ফিতা বাঁধা ছিল, কিন্তু সৌদি মাইক্রো চালক পুলিশের সাথে আরবি কথোপকথনে সেগুলোর কথা বলল কিনা তা বুঝতে পারলাম না। তবে পুলিশ যে পাসপোর্ট দাবী করছিল তা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। অতঃপর পেছনে আরো কয়েকটি গাড়ি অপেক্ষা করতে থাকায় আমাদের কথা শোনা বা বিদেশের মাটিতে আমাদের নিতান্তই সরল- সোজা ও উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে মানবিক কারণে ছাড় দেয়া- সে পরিবেশ সেখান থেকে সহসা পালিয়ে গেল এবং পুলিশ আমাদের গাড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে পেছনে যেতে বাধ্য করল। আমরা অসহায়ের মতো খানিকটা ভয় ও উদ্বেগকে সঙ্গী করে অগত্যা খামারে ফেরত আসি। এরই মধ্যে জসিম ভাইয়ের মাধ্যমে এজেন্সী কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
ভেবেছিলাম আরবের রাস্তায় তো তেমন কোন জ্যাম নেই সুতরাং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের উদ্ধারে গাড়ি চলে আসবে। কিন্তু তা হলো না, সূর্যটা লাল আভা ছড়াচ্ছে পাহাড়ের কিনারে কিনারে। ঐ তো ডুবে গেল সে। আমরা মাগরিব নামায আদায় করে নিলাম খামারের কোণের ছোট্ট একটি মসজিদে। তারপর উদ্বিগ্ন অপেক্ষা। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে-খামারের পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ির হেডলাইট দেখলেই আমরা আশান্বিত হচ্ছিলাম এই বুঝি আমাদের গাড়ি চলে এসেছে।
খামারের দুইজন আরব তত্ত্বাবধায়ক আমাদের দুশ্চিন্তিত মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদের সান্তনা দিতে লাগল এবং আরবের আবহমানকালের আতিথেয়তার ঐতিহ্য ধরে নিজেদের তৈরি এক কাপ করে চা খাওয়ালো। এরই মধ্যে বেশ খানিক সময় পার হয়ে গেছে। জসিম ভাইকে আবার ফোন করলাম- কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করছেন না। এবার আমাদের টেনশনের পারদ আরো কয়েক ডিগ্রী উপরে উঠল। সবার মুখে দোয়া দরূদ চলছে- মনে মনে ভাবছি পায়ে হেঁটে রওনা দিই, গাড়ি ফেরত দিয়েছে পায়ে হাঁটা লোককে তো বাঁধা দিবে না ! কিন্তু না, তাতে বিপদ বেশি ! সবাইকে নিশ্চিত জেলে যেতে হবে। আসলে এসব ছিল বিপদসংশ্লিষ্ট অসহায় মুহূর্তের বিক্ষিপ্ত ভাবনা মাত্র। ঘুটঘুটে অন্ধকারের পাহাড়ঘেরা আনকোরা মরু এলাকায় বিপদে পড়ে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু কিভাবে মাথায় আসবে ?
বাইতুল্লাহসংলগ্ন যমযম ওয়াচ টাওয়ার ততক্ষণে আলোর ঝলকানি দিতে শুরু করেছে, আমরা খামার থেকে তা দেখছি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, হে আল্লাহ ! আমাদেরকে তুমি ওখানে পৌঁছে দাও। যাই হোক দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক সময় খামারে পৌঁছালো মুয়াল্লিম অফিসের একটি মাইক্রো- সাথে দুজন তরুণ বয়সের আরব কর্মী। তাদের একজনের নাম আব্বাস, অপর জনের নাম ঠিক এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না। তাদের কথা শুনে বুঝলাম যে, তারা পুরো বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা পায়নি। এখন জানতে পেরে তারা কিছুটা থমকে গেল। বলল, পুলিশ যেহেতু একবার বাঁধা দিয়েছে তারা সহজে ছেড়ে দিবে বলে মনে হয়না। সৌদি আরবের পুলিশের নৈতিকতার মান প্রশংসনীয় হলেও ক্ষেত্রভেদে তাদের কারো কারো বাড়াবাড়ি অনেক হাজীকে কষ্টের মুখোমুখি দাঁড় করাতে দেখেছি। মুয়াল্লিম অফিসের কর্মী দুজন কিছুটা রাগত স্বরে আমাদের উদ্দেশ্য করে আরবিতে কিছু বলল- যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মৃদু ভর্ৎসনা। এ পর্যায়ে কর্মী আব্বাস তার অফিসের সাথে মোবাইলে কথা বলল এবং কথা শেষে আমাদের প্রতি তাদের অসন্তোষের মাত্রা আরেকটু গতি পেয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে অনুমান করতে পেরেছিলাম। বিপরীতে সাহস নিয়ে আমিই তাদের দায়ী করে বললাম, ২দিন পার হয়ে গেল আপনারা যদি আমাদের আইডি কার্ড (আকামা) সরবরাহ করতেন তাহলে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো যেত। অন্যরা তো ১দিন পরেই পেয়ে গেছে ! তারা তখন কিছুটা নরম হলো মনে হয়।
অতঃপর আমরা খামার থেকে বিদায় গ্রহণ করি। মুয়াল্লিম অফিসের স্টিকার সম্বলিত মাইক্রো আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। চিন্তিত দুই তরুণ কর্মী পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেতে শুধুই উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টাা চালাচ্ছে। আমাদের ৫ জনের মধ্যে তিনজনের হাতে মুয়াল্লিম অফিস থেকে সরবরাহ করা হলুদ ফিতা (এতে শুধু মুয়াল্লিম অফিসের ঠিকানা প্রিন্ট করা যাতে কোন হাজী হারিয়ে গেলে তাকে অন্য কেউ মুয়াল্লিম অফিসে পৌঁছে দিতে পারে) ছিল তার মধ্যে একজনের গলায় বাংলাদেশের হজ্জ অফিস কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডও ছিল। বাকী দুইজনের কাছে কিছুই ছিল না। হঠাৎ এক বাঙ্গালী বুদ্ধি আমার মাথায় এলো- যার গলায় কার্ড ও হাতে ফিতা ছিল তাকে বললাম ফিতা অন্যজনকে সাময়িকভাবে ধার দিতে। তাই করা হলো। বুদ্ধিটা ছেলে দুটো বেশ পছন্দ করল এবং একটু মুচকি হাসিও দিল। এই প্রথম তাদের মুখে একটু হাসি আবিষ্কার করলাম। এখন আমাদের ৪জনের কিছু দেখানোর মতো আছে- একজনের কিছুই নেই তাকে বলা হলো পেছনের সারিতে বসতে।
চেকপোস্টের প্রায় আধ কিঃমিঃ দূর থেকে গাড়ির সারি জট বেঁধেছে। তার মানে চেকিং খুব কড়াকড়ি চলছে। এক পা দু‘ পা করে আমাদের গাড়ি এগুচ্ছে সামনের দিকে। সৌদি আরবের মাটিতে এসে ঢাকার চির চেনা যানজটের চিত্র মনের মধ্যে কিছুটা ধূসর হতে চলেছিল কিন্তু আজ আবার গাড়ির লম্বা লাইন দেখে সহসা ঢাকার কথা মনে পড়ছে। তারপর আবার চেকিং এর মতো উৎকণ্ঠিত মুহূর্ত !
চেকপোস্টের অদূরে থাকতেই আমরা লক্ষ্য করলাম, এখন দুই লেনে চেকিং চলছে। গাড়ির চাপ বেশি হওয়ায় সম্ভবত সে কারণে চেকারের সংখ্যা বেড়েছে। প্রাইভেট কার, মাইক্রো, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক কোন গাড়িই চেকিং এর হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। সিরিয়ালে আমাদের গাড়ি ২/৩ গাড়ির পেছনে থাকতে লক্ষ্য করি বিকেলে আমাদের ফিরিয়ে দেয়া ডাগর চোখের সেই ক্ষীণদেহী তেজী পুলিশটি অন্য লেনের গাড়ি চেক করছে। আমাদের সারিতে ভিন্ন একজন পুলিশ- যাকে আপাত দৃষ্টিতে বেশ ভদ্র বলেই মনে হচ্ছে, চেহারায়ও আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু এসব ভাবনা দিয়ে কী হবে ? আভিজাত্যের নিদর্শনে আমাদের কী যায় আসে ? অবশেষে এলো আমাদের গাড়ী। সাথে সাথে কিশোর কর্মী আব্বাস নিচে নেমে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, এরা সবাই হাজী। গাড়ির গ্লাস খুলে আমরাও পুলিশকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে খানিকটা আরবি কায়দায় সালাম দিলাম। খেয়াল করলাম পুলিশ আমাদের মাথার দিকে এক দফা তাকিয়ে নিল- সবার মাথা তো ন্যাড়া। গতকালই উমরাহ সম্পন্ন করে মাথা মু-ন করেছি, সাথে টুপি তো আছেই। যা দেখার দেখুক।
পুলিশ মহোদয় পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। সবাই সসম্মানে হাতের কব্জি প্রদর্শন করলাম যেখানে হলুদ ফিতা বাঁধা আছে। যার গলায় কার্ড তিনি তা মেলে ধরলেন। বললাম যে, আমাদের পাসপোর্ট তো সৌদি সরকারের কাছে- পরিবর্তে এটাই দেয়া হয়েছে। আমি এর ফাঁকে অপর পুলিশের দিকে নজর দিয়ে দেখে নেয়ার চেষ্টা করছি- তিনি আমাদের দিকে খেয়াল করছেন কিনা। পাছে বিকেলের কথা মনে করে চিনতে পেরে যদি পরিস্থিতি জটিল করে ফেলে ! কিন্তু আমাদের দিকে নজর দেয়ার তার ফুরসুৎ নেই।
আমাদের চেকার পুলিশ একটু মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “কুল্লু হাজ্জী ?” আমি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, “ না‘আম ইয়া আখি”। আলহামদুলিল্লাহ পুলিশ মহোদয় হাত নেড়ে আমাদের ছাড়পত্র দিলেন। আব্বাস তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে মাইক্রোতে উঠে কী যে এক সাফল্যের হাসি দিলেন তা বুঝানো সত্যিই কঠিন! সামনের সীট থেকে হাত বাড়িয়ে সবার সাথে করমর্দন করলেন।
গাড়ী দ্রুতবেগে আমাদের নিয়ে মক্কাভিমুখে ছুটতে লাগল। আমাদের চোখে-মুখের উৎকণ্ঠা মিলিয়ে গেছে মহান রাব্বুল আলামিনের লাখো শুকরিয়ায়। মক্কার বাইরের রাতের চিত্র দেখতে দেখতে আমরা মুয়াল্লিম অফিসে এসে পৌঁছি। সেখানে আমাদের জন্য কিছু বকা ঝকা আপেক্ষা করছিল। অফিসের ম্যানেজার একজন বাঙ্গালী- সুতরাং বাংলাতেই বলতে শুরু করলেন। কেন আমরা শহর থেকে এত দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম তারও কৈফিয়ত চাচ্ছিলেন তিনি। আমাদেরও সম্মিলিত অবস্থান ছিল এই কথার ওপর যে, আমাদর পরিচয় পত্র দিলে এই ভোগান্তি হয়ত হতো না। আমাদের এজেন্সী মুনাজ্জেমও তখন ঐ অফিসে ছিলেন। অফিসে ততক্ষণে এশার নামায শেষ হয়ে গেছে। আমরা দ্বিতীয় জামাতে নামায আদায় করে ধীরে-সুস্থে হোটেলে ফিরে আসি।
©somewhere in net ltd.