নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিনজো আবে হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সম্ভাব্য ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিণতি

১০ ই জুলাই, ২০২২ রাত ১২:০৬


জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত ৮ই জুলাই ২০২২ খ্রিস্টাব্দে জাপানের প্রাচীন রাজধানী শহর নারায় তাঁর রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনাকালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান হলো। তিনি তাঁর জীবৎকালে উদার গণতান্ত্রিক দল নামক এক রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক দলে তাঁর এই প্রভাব তিনি পুরুষানুক্রমে অর্জন করেছিলেন। কারণ বিগত অর্ধ শতক ধরে তিনিসহ তিন পুরুষ পালাক্রমে গণতান্ত্রিক দলের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাঁর মাতামহ নবুসুকে কিশি উনিশশো ষাটের দশকে ১৯৫৭-১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর পিতা শিনতারো আবে ১৯৮২-১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাপান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত ছিলেন। গত দুই দশকে তিনি তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তবে শিনজো আবে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন।

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেও, তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং রাজনৈতিক দলেও ছিলো তাঁর ব্যাপক প্রভাব। যে কারণে তিনি তাঁর দেশের স্বার্থে বেশকিছু যুগান্তকারী সামরিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জাপানের সামরিক নীতির অংশ হিসাবে রক্ষণাত্মক সামরিক নীতি থেকে সরে এসে আক্রমণাত্মক সামরিক নীতি গ্রহণ করেন। সেজন্য তিনি জাপানের জাতীয় সংসদ ডায়েটে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আহুত অধিবেশনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদের পুনর্ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে জাপানের সশস্ত্র বাহিনী সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিপুল পরিমাণে আধুনিক সামরিক সাজসরঞ্জাম যুক্ত করে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসাবে তিনি আবেনমিক্স (যার অর্থ আবে গৃহীত অর্থনীতি) নামে এক নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, এর আগে ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে জাপানের অর্থনীতি ব্যাপক মন্দা চলছিলো। তাঁর অর্থনৈতিক উদ্যোগের ফলে দৃশ্যমান পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম হলো বিপুল সংখ্যক বিদেশি প্রশিক্ষণার্থী শ্রমিক ও কর্মজীবি আমদানী এবং তাদের শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে জাপানের পণ্য ও সেবার বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং জাপানের সমাজে আত্তীকৃত এই সমস্ত শ্রমিকদের সহায়তায় তাদের উৎস দেশে জাপানের বিনিয়োগে শিল্প স্থাপন করে বিশ্বব্যাপী জাপানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও আমাদানী-রপ্তানীর শৃঙ্খল বিস্তৃত করা। শিনজো আবের উক্ত দুই উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে জাপান এখন সামরিক পরাশক্তিতে রূপান্তর এবং বিশ্বজুড়ে জাপানের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃতি দৃশ্যমান হয়েছে।

কিন্তু যে শিনজো আবে-এর দূরদর্শী নীতি জাপানকে অগ্রযাত্রার পথ দেখিয়েছে, সেই শিনজো আবেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন । তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের ফলে জাপানের রাজনৈতিক আকাশের একটি তারকার পতন ঘটলো। তাঁর এই হত্যাকাণ্ড ছিলো খুবই অপ্রত্যাশিত। কারণ গত কয়েক দশক জুড়ে জাপানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আবহ বিরাজিত রয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা দৃষ্ট হলেও, তার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিহিংসার বহি:প্রকাশ তেমন একটা দেখা যায় না। তাছাড়া জাপানে গত কয়েক দশক ধরে আগ্নেয়াস্ত্র ধারণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। এসব কারণে জাপানে রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য কোনও বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-এর সুরক্ষায় বাড়তি কোনও নিরপত্তা ব্যবস্থা ছিলো না। নিরপত্তা ব্যবস্থার এই শিথিলতার সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে আততীয় তেতসুইয়া ইয়ামাগামি হত্যাকাণ্ডের মতো অপকর্মটি অতি সহজে সম্পাদন করতে পারলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-এর মৃত্যুতে জাপান জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে জাপানের জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলে মনে হলেও, জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ ফুঁসছে।

জাপানের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অতীতে জাপানে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তার কারণ জাপানিদের রক্তে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরায়ণতা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বে সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটলে, জাপানে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কমে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে বেশ কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তার অন্যতম হলো ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইনুকা ৎসুয়োশির হত্যাকাণ্ড। ১৫ই মে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইনুকা ৎসুয়োশি নিহত হন। অন্য হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় ১২ই অক্টোবর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে। ঐ হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্ধনশীল সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা ইনেজিরো আসানুমা নিহত হন। এই উভয় হত্যাকাণ্ডের পরে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই দুই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে জাপানের রাজনীতির গতিধারায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত প্রধানমন্ত্রী ইনুকা ৎসুয়োশির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাপানে ডানপন্থী এবং অতিশয় সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান ঘটে এবং রাজনৈতিক দলে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাজতন্ত্রপন্থী নেতা ইনেজিরো আসানুমার মৃত্যুতে রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং জাপানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।

কিন্তু ৮ই জুলাই সংঘটিত শিনজো আবে-এর হত্যাকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে নতুন রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। জাপানের রাজনৈতিক আকাশে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে কালো মেঘ। এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে একটি প্রশ্ন এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা হলো—এ হত্যাকাণ্ড কী ব্যক্তি আক্রোশের কারণে ঘটেছে, না-কি রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীবাদের প্রতিহিংসার ফসল হিসাবে ঘটেছে? কারণ একজন শিনজো আবে মানে শুধু একজন ব্যক্তি শিনজো আবে নন। তিনি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও বটে। যে কারণে উক্ত প্রশ্নটিকে সামনে রেখে জাপানের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে ব্যাপক কল্পনা-জল্পনা ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড জাপানের সরকারি সংস্থাগুলোকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তারা বিষয়টির সূত্র অনুসন্ধানে তৎপর রয়েছে এবং নানান বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেছে।

বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার উক্ত তৎপরতা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এই হত্যাকাণ্ডটিকে ঘিরে এসব সংগঠন ও সংস্থার জল্পনা-কল্পনা ও বিচার-বিশ্লেষণ জন্ম দিবে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্বের। আর এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ডালপালা গজিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ হিসাবে বহি:প্রকাশ ঘটবে। অতপর তা নানান তৎপরতার মাধ্যমে দৃশ্যমান হতে শুরু করবে, যার জের হয়তো কয়েক বছর থেকে কয়েক দশক পর্যন্ত চলতে পারে। এক সময় হয়তো আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। সে সময় হয়তো জাপানের রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে অঙ্কিত হবে। কাজেই এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতি পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.