নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সম্পাদিত কৌশলগত সম্পর্কের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও সামরিক শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া

০১ লা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৬



এ সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত কূটনৈতিক খবর হলো বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নতুন দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক। সপ্তাহ কয়েক ধরে চলমান নানান নাটকীয়তার পর, গত ২৬শে এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে জাপানের রাজধানী টোকিওতে বাংলাদেশ ও জাপান— ১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন এবং ১টি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এই সমঝোতা স্মারক সাক্ষর ও যৌথ বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে দেশ দু’টির বিদ্যমান সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হলো। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১ বছর আগে। সে হিসাবে দেশ দু’টি গত বছর (২০২২ খ্রিস্টাব্দ) কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করলো। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশ দু’টির মধ্য সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। সেজন্য জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে অব্যাহতভাবে ঋণ ও অনুদান প্রদান করে এসেছে। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল হলে, জাপান বাংলাদেশে শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। দেশের সড়ক যোগাযোগ, বিমান বন্দর ও সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও প্রাযৌক্তিক সহায়তা দিয়ে আসছে। বিদ্যমান এই সম্পর্ককে এতোদিন উভয় দেশ ‘সার্বিক অংশীদারিত্ব’ ভিত্তিক সম্পর্ক হিসাবে বর্ণনা করলেও, ২৬শে এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে নতুন সম্পর্ককে উভয় দেশ ‘কৌশলগত অংশদারিত্ব’ ভিত্তিক সম্পর্ক হিসাবে আখ্যা দিয়েছে।

দুই দেশের সম্পর্ককে বৈশাষ্ট্যায়িত করতে ব্যবহৃত ‘কৌশলগত’ পরিভাষাটি কূটনীতিক মহলে এবং এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্য কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। কারণ কৌশলগত পরিভাষাটি আমাদের দেশে সামরিক বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত পরিভাষা বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বস্তুত: দু’দেশের মধ্যে সাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দেশ দু’টি নতুন সামরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দশক দুই আগে এই দেশের কোনোটিরই সামরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মতো পররাষ্ট্রনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি ছিলো না। কারণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূল ভিত্তি হলো— বাংলাদেশের স্থপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত নীতি—‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। তাছাড়া বাংলাদেশ কৌশলগত অংশিদারিত্ব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মতো অর্থনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো না। অন্যদিকে জাপানের কোনও দেশের সাথে কৌশলগত অংশদারিত্ব মূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা ছিলো। এই প্রতিবন্ধকতা আরোপিত হয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক। কারণ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রণীত সংবিধান অনুসারে জাপানের যুদ্ধ করার অধিকার ছিলো না। কিন্তু চীন সাগর ও মধ্য এশিয়ায় গণচীনের আধিপত্যবাদী কার্যক্রম মোকাবেলার স্বার্থে জাপান ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তার সংবিধান সংশোধন করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জাপান যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার ফিরে পায়। অধিকার ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নিছক সংবিধানের সংশোধনী থেকে উৎসরিত হয়েছে তেমন নয়, বরং চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মিত্র তৈরিতেই যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে এই সুযোগ প্রদান করে। জাপান তার সংবিধান সংশোধনের পর, যুদ্ধ সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরপর থেকে জাপান পূর্ণ উদ্যমে তার সামরিক শক্তি গঠনে মনযোগ দেয়। জাপান এখন সামরিক বাহিনী গঠন, অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয় এবং বিভিন্ন দেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে মনযোগ দিয়েছে। দেশটি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে উচ্চপ্রাযৌক্তিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে।

বাংলাদেশ ও জাপান-এই দুই দেশ অর্থনৈতিক, প্রাযৌক্তিক ও সামরিক শক্তিতে সমপর্যায়ের নয়। কাজেই দুই দেশের সম্পর্ক হলো একপ্রকার অসম সম্পর্ক, যেখানে বাংলাদেশ অনুবর্তী আর জাপান কর্তত্ববাদী। তা সত্ত্বেও এই দেশ দু’টি নতুন এমন একটি কৌশলগত অংশিদারিত্বের সম্পর্কে জড়ালো, যখন বিশ্ব ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও চীনের চীনসাগর অভিমূখী আধিপত্যবাদী নীতি ও আরব উপদ্বীপাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থাকে ঘিরে বিশ্বে নতুন মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। চলমান এই মেরুকরণের বাস্তবতায় বাংলাদেশের কোনও এক ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ মানে হলো— অন্য মেরুর দেশসমূহের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু হওয়া। মেরুকরণের এই বাস্তবাতাকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার জাপানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলো। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করলো, অর্থ্যাৎ বিপরীতক্রমে রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বাধীন বলয়ের দেশসমূহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো।

এ পর্যায়ে কৌশলগত অংশদারিত্বের স্বরূপটি চিত্রায়নের জন্য এই দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ঘোষণাকে বিশ্লেষণ করা যাক। নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও জাপান-এই দুই দেশের মধ্যেকার স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটি ৮ দফা বিশিষ্ট এবং যৌথ ঘোষাণাটি ৩০ দফা বিশিষ্ট। কৌশলগত অংশীদারিত্ব সম্পর্কিত জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিটি ৩০ দফা বিশিষ্ট, যা তিন পর্বে বিভক্ত: ১) প্রথম পর্ব: আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে পারস্পরিক সহযোগিতা: ১-১২ দফা, ২) দ্বিতীয় পর্ব: পারস্পরিক সুবিধা এবং আঞ্চলিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা: ১৩-২৫ দফা, ৩) সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক বিনিময়: ২৬-৩০ দফা। যৌথ বিবৃতির দলিলটিকে সামগ্রিকভাবে কৌশলগত অংশীদারিত্বের দলিল হিসাবে বর্ণনা করা হলেও, এই দলিলের প্রথম পর্বের ১০টি দফায় মূলত বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে যথাক্রমে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশিদারিত্বের বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এই কৌশলগত অংশিদারিত্বের দফাগুলোর কয়েকটিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আর কয়েকটি জাপানের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বিধৃত রয়েছে। এই কৌশলগত অংশিদারিত্বের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিম্নে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো।

জাপানের চীন-রাশিয়া বিরোধী যে পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতি রয়েছে তাকে সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত জাপানের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অঙ্গীকার আদায় করেছে। জাপান মূলত একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইজি বিপ্লবের পর জাপান একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে অবির্ভূত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ছিলো সমগ্র এশিয়াকে করায়ত্ত করা। সে সময় থেকে চীন ও রাশিয়া জাপানের সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসাবে অবির্ভূত হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে মেরুকরণের বাস্তবতায় জাপান চীন ও রাশিয়া বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এর কারণ নিহিত রয়েছে গণচীনের চীন সাগর অভিমূখী সম্প্রসারণবাদী তৎপরতায়। কারণ চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি সফল হলে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ চীন সাগরে অবাধ চলাচলের অধিকার হারাবে। জাপানের বিপুল সমুদ্রসীমা চীনের করায়ত্ত হয়ে পড়বে। চীন সাগর অভিমূখী চীনের এই সম্প্রসারণবাদী তৎপরতাকে ঠেকাতে জাপান তার মিত্রদেশ যুক্ষরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে গঠিত কোয়াড (Quadrilateral Security Dialogue)-এর আওতায় যুদ্ধকৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির অনুবর্তী বিধায় জাপান ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে। যৌথ বিবৃতিতে জাপান তার চীন-রাশিয়া বিরোধী অবস্থানকে স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেছে যে, ইউরোপ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা একইসূত্রে গাথা এবং চলমান বিশ্বব্যবস্থাকে স্থিত রাখতে এই দুই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে, জাপানসহ পশ্চিমাশক্তি রাশিয়া ও চীনকে যথাক্রমে ইউরোপ ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে। বাংলাদেশ উক্ত যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে জাপানের উক্ত চীন-রাশিয়া বিরোধী অবস্থানকে সমর্থন জানালো।

এই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আরও দু’টি বিষয়ের অনুকূলে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সেগুলো হলো উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক মারনাস্ত্র ও স্থাপনা তৈরির বিপক্ষে জাপানের কৌশলগত অবস্থানকে সমর্থন জানানো এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে জাপানকে এর সদস্য লাভে সমর্থন জানানো। বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে এতোসব সমর্থনের ফলে কার্যত জাপানের বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন জানালো।

জাপানের বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিকে সমর্থনের বিপরীতে, বাংলাদেশ জাপানের নিকট থেকে রোহিঙ্গা নীতিকে সমর্থন ও আসিয়ান ঘোষিত ৫ দফা ঐকমত্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মায়ানমারকে তাগিদ জানানো সহ ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ও সম্মতি আদায় করেছে। এছাড়া, বাংলাদেশ জাপানের নিকট থেকে পরোক্ষভাবে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য (বা প্রচ্ছন্ন) ভারত, চীন ও মায়ানমার কর্তৃক প্রযোজিত সম্প্রসারণবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে নৈতিক সমর্থন আদায় করলো। কারণ এই বঙ্গোপসাগর হলো বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত একটি সমুদ্রাঞ্চল। আর জাপান সমুদ্রসীমায় স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক (Free and Open Indo-Pacific) নীতি পোষণ করে, তার আওতায় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাপানের নৈতিক সমর্থন লাভ করলো।

বাংলাদেশ জাপানের নিকট থেকে অর্থনৈতিক ও প্রাযৌক্তিক উন্নয়নেও ব্যাপক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে। জাপান মনে করে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ শৃঙ্খল উন্নত করা হলে, আঞ্চলিক অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটবে, যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে অবদান রাখবে। বাংলাদেশকে ঘিরে জাপানের এই কৌশলগত অবস্থান ১০ বছর পূর্বে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিগ-বি (The Bay of Bengal Industrial Growth Belt) নীতির প্রতিফলন বিশেষ। উল্লেখ্য যে, দশ বছর পূর্বে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গণচীন সরকারের গৃহীত 'এক অঞ্চল, এক পথ (Belt and Road Initiative)' নীতির বিপরীতে বিগ-বি (The Bay of Bengal Industrial Growth Belt=Big-B) নীতি গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। এই বিগ-বি নীতির আওতায় জাপান বাংলাদেশে শিল্প মান শৃঙ্খল (industrial value chain) ও স্থিতিস্থপাক সরবরাহ শৃঙ্খল (resilience of supply chain) সৃজনে সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এই দ্বিবিধ শঙ্খল সৃজনে প্রয়োজনীয় শিল্প অবকাঠামো ও যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরীতে জাপান সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এই সহযোগিতার আওতায় জাপান চট্টগ্রামের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে (যা চীন থেকে সংগৃহীত ডুবোজাহাজের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে)। একই সাথে জাপান মাতারবাড়ীকে ঘিরে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (MIDI)বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এছাড়া জাপান শিল্প উৎপাদন শৃঙ্খল উন্নয়নে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ‘বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (BSEZ)’ স্থাপন এবং জাপানের বিনিয়োগে শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সহায়ক ‘জাপান-বাংলাদেশ পাবলিক-প্রাইভেট যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ (PPED)’ নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। শৃঙ্গল সৃজনে সহায়ক উক্ত সংস্থান নির্মাণ কাজের বাইরেও, জাপান ঢাকা শহরে ‘ঢাকা ব্যাপকভি্ত্তিক দ্রুত অতিক্রমণ (Dhaka Mass Rapid Transit)’-এর আওতায় মেট্রোরেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিমান বন্দর বর্ধিত করণ প্রকল্প এবং পদ্মা ও যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে আর্থিক ও প্রাযৌক্তিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

যৌথ বিবৃতিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ভারত ও চীনের জন্য স্পর্শকাতর একটি বিষয় রয়েছে। এই যৌথ ঘোষণায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরে জাপান সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনী (Japan Maritime Self-Defense Force=JMSDF)-এর যুদ্ধ জাহাজের পৌন:পুনিক আগমন এবং দুই দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সফর বিনিময়ের কথা উল্লেখ করে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নের আস্থা ব্যক্ত করেছেন। সেজন্য দুই দেশের পরস্পরের রাজধানী শহরে সামরিক শাখা স্থাপনের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ টোকিওতে প্রতিরক্ষা শাখা এবং জাপান ঢাকায় ন্যাশানাল সিকিউরিটি শাখা (কোক্কা আনজেন হোশো উইং)স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবিত পারস্পরিক এই দুই সামরিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সংলাপ বৃদ্ধি পূর্বক সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। এই সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক স্থাপনা উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে সমরাস্ত্রের ভাণ্ডার বৃদ্ধি ও যুদ্ধকৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি সমঝোতা স্মারকের ৪নং দফাটিতে আরও পরিস্ফূট হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে— এই সমঝোতার আওতায় প্রতিরক্ষা সংলাপ, সফর বিনিময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কোর্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যক্রম এবং সহযোগিতা জোরদার করা হবে।

যৌথ বিবৃতি সম্পর্কে উক্ত পর্যালোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশ ও জাপান অর্থনৈতিক, প্রাযৌক্তিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতার আড়ালে ধীরে ধীরে সামরিক মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। দশ বছর পূর্বে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত বিগ-বি (The Bay of Bengal Industrial Growth Belt=Big-B) নীতিটি যে জাপানের একটি দূরভিসন্ধীমূলক কৌশলগত নীতি ছিলো, তা আজ স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান তার সাম্রাজ্যবাদী সমরনীতি পরিত্যাগ করে। কিন্তু ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সংশোধনের পর জাপান তার পূর্ণাঙ্গ সামরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট রয়েছে। সেজন্য তার নতুন সামরিক মিত্র দরকার। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানের সাম্রাজ্য বিস্তার প্রয়াসের সময় জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসমূহে যে যুদ্ধের ক্ষত রেখে যায়, তা এসব অঞ্চলের দেশসমূহে সামরিক মিত্র হিসাবে জাপানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানের সামরিক তৎপরতার আঁচ এ দেশে লাগলেও, ক্ষতের পরিমাণ ততোটা লক্ষণীয় ছিলো না। যে কারণে বাংলাদেশের কাছে জাপানের সামরিক মিত্রতার প্রস্তবনা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই সামরিক মিত্রতা সফল হলে, চীনের উপর বাংলাদেশের যুদ্ধকৌশলগত নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। চীনের মায়ানমার হয়ে বঙ্গোপাগরমূখী যে 'এক অঞ্চল, এক পথ (Belt and Road Initiative)' নীতি রয়েছে, তার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪২

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: এই সামরিক মিত্রতা সফল হলে, চীনের উপর বাংলাদেশের যুদ্ধকৌশলগত নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। চীনের মায়ানমার হয়ে বঙ্গোপাগরমূখী যে 'এক অঞ্চল, এক পথ (Belt and Road Initiative)' নীতি রয়েছে, তার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে।

কিন্তু এর ফলে চীন ও নিশ্চয় প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তাতে চীন বাংলাদেশ সম্পর্কে কি ধরনের ইম্প্যাক্ট পরবে বলে আপনি মনে করেন?

০২ রা মে, ২০২৩ সকাল ৯:২২

রেজাউল করিম ফকির বলেছেন: উত্তরটি পূর্ণাঙ্গভাবে দিতে গেলে, আরও একটি নিবন্ধ লিখতে হবে। তবে চীনের প্রতিক্রিয়া ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পাবে, যা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার কারণ হতে পারে। কিন্তু তা মোকাবেলায় নতুন কৌশলগত মিত্র জাপান সহায়তা করবে বলে প্রতিভাত হয়।

২| ০১ লা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪২

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:




একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে বিশ্লষনাত্বক পর্যালোচনা ।
বাংলাদেশে আর্থনৈতিক ও সামরিক খাতের উন্নয়নে
এর বেশ ভাল প্রভাব পড়বে । দেশের কুটনৈতিক
কলাকৌশলে বেশ অনেকটা পরিপক্কতা এসেছে বলে
মনে হচ্ছে । এখন চীন -রাশা বলয় বিষয়টিকে কিভাবে
দেখে এবং এর প্রভাব কি হয় তা দেখার পালা ।

শুভেচ্ছা রইল

৩| ০২ রা মে, ২০২৩ দুপুর ১:০২

রাজীব নুর বলেছেন: বাংলাদেশ কতটা লাভবান হলো সেই কথা দুই লাইনে বলুন।

০৩ রা মে, ২০২৩ সকাল ৯:৩৯

রেজাউল করিম ফকির বলেছেন: বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে বলে আশা করা যায়। ফলশ্রুতিতে এসব বিষয়ে চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে।

৪| ০২ রা মে, ২০২৩ বিকাল ৩:০৭

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: লেখক বলেছেন: উত্তরটি পূর্ণাঙ্গভাবে দিতে গেলে, আরও একটি নিবন্ধ লিখতে হবে। তবে চীনের প্রতিক্রিয়া ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পাবে, যা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার কারণ হতে পারে। কিন্তু তা মোকাবেলায় নতুন কৌশলগত মিত্র জাপান সহায়তা করবে বলে প্রতিভাত হয়।

আমার কেন জানি মনে হয় চীনের প্রস্তাবিত সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ থেকে বাংলাদেশ সরে আসার পরেই ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে। যদিও বিষয় দুটিকে রিলেট করে কাউকে কোথাও কিছু লিখতে দেখি নাই। অবশ্য আমার এই সন্দেহ কতটুকু সঠিক তা জানার কোন উপায় নাই।

কিন্তু বাংলাদেশ যখন সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ থেকে সরে আসলো তখনি আমার মনে হয়েছিল এর একটা খারাপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কারণ, জাপানের অর্থায়নে যখন মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ঘোষণা আসল তার আগে চীন থেকে খুব শান্ত ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.