নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ ‒ ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ ‒ ১৫ই আগস্ট ২০২৩: ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন

১৪ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:০৮

বিকল্প শিরোনাম: ব্রিটিশ উপনিবেশোত্তরকালে সংঘটিত মাইলফল রাজনৈতিক ঘটনার নিরিখেবাংলাদেশের ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন

১. ভুমিকা
আলোচ্য এই প্রবন্ধের মাধ্যমে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঘটনাটিকে ভাষা-রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে সমসাময়িক কাল পর্যন্ত ব্যপ্তিতে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করবো।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসের কতকগুলো মাইলফলক ঘটনা হলো — ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি নতুন রাষ্ট্রের সৃজন, ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ খ্রিস্টব্দে বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের পরিণতি, ২৩শে মার্চ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্ত পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তারিখে সামরিক অভ্যুত্থান ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ এবং তৎপরবর্তীকালে ১৫ বছর ব্যাপী সামরিক সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে সামরিক সরকারের পতন। উল্লেখিত এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও তৎসংশ্লিষ্ট আরও কিছু রাজনৈতিক ঘটনা সমূহ বাংলাদেশের ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ রূপান্তরের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। এ সমস্ত রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের নিরিখে বাংলাদেশে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
২. ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ বিবৃতকরণ
ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হলো কোনও ভাষার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কে সেই ভাষা ব্যবহারকারীদের চেতনা ও মূল্যবোধের সমষ্টি। এ পর্যায়ে ভাষা-রাজনীতি বিদ্যা অনুযায়ী ভাষার স্বরূপটি কী তা তুলে ধরা হবে। সাধারণ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ভাষা হলো নিছক সংজ্ঞাপনের মাধ্যম। কিন্তু আদতে ভাষা কেবলমাত্র সংজ্ঞাপনের মাধ্যম নয়। বরং এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ বিশেষ, যা প্রেক্ষাপটভেদে নানান নিয়ামক হিসাবে অবির্ভূত হয়। বিষয়টি বোধগম্য করার জন্য নিম্নে ভিন্ন দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার স্বরূপ ও প্র্রায়োগিকতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো:
ক) জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―

i) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম,
ii) সামাজিকীকরণের মাধ্যম,
iii) জাতীয়তাবাদের প্রতীক,
iv) সভ্যতার বাহন,
v) সামাজিক সম্পদ ও
vi) সাংস্কৃতিক সম্পদ।

খ) সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
i) ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার,
ii) অন্যের সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার ও
iii) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার।

ভাষার উক্ত স্বরূপ ও প্রায়োগিকতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভাষা কোনো জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো গঠনের বা বিগঠনের অপরিহার্য অনুঘটক বিশেষ।
ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ দৃশ্যমান কোনও বিষয় নয়। তবে এই আদর্শ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক ভাষা সম্পর্কে জারীকৃত অধ্যাদেশ, আইন ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এবং জনগণ কর্তৃক পরিচালিত ভাষা অধিকার আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়।

৩. বিভিন্ন রাজনৈতিক কালপর্বে ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুঘটক দ্বারা তাড়িত হয়ে এ দেশের ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। এই বিবর্তন প্রতিভাত হয়েছে রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণের ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। নিম্নে বিভিন্ন কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হলো:

৩.১. ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পূর্বকালে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। কারণ এই দিনে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দু প্রধান দু’টি অঞ্চলে বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান ও ইণ্ডিয়া নামক দু’টি ব্রিটিশ অধিরাজ্য জন্মলাভ করে। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট বিভক্ত হলেও, এর বিভক্তির পটভূমি রচিত হয় ১ম বিশ্বযুদ্ধেরও পূর্বকালে। এসব রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যেই কিছু ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম জাতি পরিচয়ের মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক ভাষানীতি হিসাবে খ্যাত English Education Acts 1835 আইনের প্রবর্তন।

ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ায় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বিভাজন ও শাসন নীতি গ্রহণ করে। তারা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুত্ববোধ ও মুসামানীত্ববোধ জাগ্রত করতে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় হিন্দু-মুসলামন— এই দুই জাতি ভিত্তিক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ ঘটে। এ সময় হিন্দুত্ববাদীগণ মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লীর স্থানীয় ভাষাছাঁদকে ভিত্তি ধরে হিন্দি ভাষা নামে নতুন ভাষার সৃষ্টি করে এবং ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এই ভাষাকে বিহার রাজ্যের দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করে। এই হিন্দি ভাষা ছিলো মূলত উর্দু ভাষার হিন্দুস্থানী রূপ। কাজেই এই দ্বিজাতি তাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিক্রমায় হিন্দি ভাষা হয়ে উঠে হিন্দুত্ববাদের প্রতীক আর ইসলাম ধর্ম হয়ে উঠে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এভাবে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসাবে উর্দু ভাষা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

অন্যদিকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ায় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেজন্য ব্রিটিশ ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী English Education Acts 1835 নামে একটি ভাষা আইন পাশ করে। এই আইন পাশের পিছনে একটি দূরভিসন্ধী ছিলো। এই দূরাভিসন্ধীটি লক্ষ্য করা যায়, এই শিক্ষানীতির স্মারক প্রণয়নকারী টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাওলে-এর ভাষ্য থেকে। তিনি তাঁর শিক্ষা স্মারকপত্রে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ প্রশাসনের স্বার্থে এ দেশে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রবর্তন করা প্রয়োজন, যেনো এর মাধ্যমে ইংরেজদের পোষ্য ও অনুগত একটি আর্থ-সামজিক শ্রেণী সৃষ্টি করা যায় যারা “রক্ত ও বর্ণে থাকবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, চিন্তাধারা, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ (Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals and in intellect)” এবং তাদের ইংরেজি মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান স্থানীয় ভাষায় সাধারণ্যে পরিবহণ করতে পারে। ইংরেজদের লালিত ঐ দূরাভিসন্ধীর প্রতিফলন বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে আজও বিদ্যমান রয়েছে। এই আইন পাশের মাধ্যমে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ফার্সি ভাষা বাতিল হয়। আর ইংরেজি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চালু হয় ও স্থানীয় ভাষা স্থানীয় দাপ্তরিক কার্যাদি সম্পাদনের কাজে ব্যবহার শুরু হয়।

দাপ্তরিক কার্যক্রম ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষা চালু হলে, নবজাগরণের পণ্ডিতগণ পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠে এবং তাঁরা তাঁদের আহৃত জ্ঞান দেশ ভাষা বাংলায় সাধারণ্যে প্রচারে ব্যপৃত হয়। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এ সময় বাঙ্গলার নবজাগরণের পণ্ডিদের দ্বারা বাংলা ভাষা তার আধুনিক অবয়বগত সৌষ্ঠব লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হলে, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিষয় সমূহ বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধায়নের প্রয়াস শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১৯৩০ এর দশক থেকে বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার চালু করা হয়। এভাবে বাংলা ভাষা বাঙ্গালী জাতির আত্মপরিচয়ের মাধ্যম হয়ে উঠে এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠে।

৩.২. ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট পূর্ববাংলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিরাজ্য পাকিস্তানের অংশ হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসাবে স্বাধীনতা লাভের সময় তিনটি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। এগুলো— ক) বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষা, খ) মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক উর্দু ভাষা এবং গ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির প্রতীক ইংরেজি ভাষা। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যুদয়কালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলো ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব সমগ্র ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক ইসলাম ধর্ম ও উর্দু ভাষার মাধ্যমে সমস্ত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তান রাষ্ট্র সমাজে আত্তীকরণে প্রয়াসী ছিলো। কিন্তু উর্দু ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির এই আত্তীকরণ প্রয়াসের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটে। এই বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এবং পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উর্দু ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আদর্শে হাওয়া যোগায়। কিন্তু বাঙ্গালী সমাজে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ হিসাবে প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায় ইংরজি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ।
৩.৩. ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের প্রণোদনায় পরবর্তীকালে যথাক্রমে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং এর পরম্পরায় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। অত:পর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলা ভাষার অনুকূলে নিম্নরূপ ঘোষণা প্রদান করেন,
‘...আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে। বাংলাভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা চালু করবেন, তারপরে বাংলাভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা চালু করে দিব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে’।

কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামীলগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করলে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ডাক দেয়। অত:পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের পুনর্গঠন বাধাগ্রস্হ হয়। এই অবস্থার মধ্যেই ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি দাপ্তরিক কাজে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু দেশে তখনও ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের বিস্তৃতি চলছিলো। সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ সরকারি অফিস-আদালতের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। প্রজ্ঞাপন জারীকালে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন যে,
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লগ্নে অধিষ্ঠিত সরকার শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী ছিলো। এই প্রয়াসের অংশ হিসাবে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাব্যবস্থায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে এবং ইংরেজি ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে সকল বিদেশি ভাষার সমান শিক্ষার সুযোগ রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয়।

৩.৪. ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট প্রত্যুষে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যা করে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর মুক্তিযু্দ্ধে পরাজিত নেতৃত্ব ও নীতিভ্রষ্ট বামপন্থী নেতৃত্বের সহায়তায় সামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং কখনও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ও কখনও গণতন্ত্রের আভরণে এই সামরিক সরকার ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। সামরিক শাসন কালপর্বের ১৫ বছর সামরিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রতি যত্নবান ছিলো। এর প্রমাণ হিসাবে দেখা যায় যে, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ তারিখে সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ কর্তৃক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তারিখে জারীকৃত দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপনের পক্ষে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ জারী করণের বিষয়। এই আইনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে (৩৷ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা) পূর্ণরূপে কার্যকর করবার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইন। আইনটি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২নং আইন। এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ নিম্নরূপ:

ধারা ৩(১)
এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

ধারা ৩(২)
৩(১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।

ধারা ৩(৩)
যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ধারা ৪
সরকার সরকারী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন৷

এই আইন প্রণয়নের পর থেকে জাতীয় সংসদের সকল আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে এবং যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশের আপামর সকল জনগণকে তাদের নিজেদের ভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়নের পথে ঔপনিবেশিক ভাষিক বাধা দূরীভূতকরণে আইনটির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’করা হলেও সুপ্রীম কোর্টে আইনটি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।

৩.৫. জানুয়ারি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
সামরিক সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পর গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এর পর থেকে দেশে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারকে বাদ দিলে, এ কালপর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে ৩ মেয়াদে ও ২ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এ সময়ের মধ্যে দেশে পূঁজিবাদের বিকাশ ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উপজাত হিসাবে নতুন ধারার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। নতুন বিকশিত এই রাজনৈতিক শক্তি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, ফলশ্রুতিতে এই শ্রেণির মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ পরিপন্থী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের উন্মেষ ঘটে।

এই নতুন রাজনৈতিক শক্তি শিক্ষানীতিতে পুন:পুন: পরিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাকে সর্বাত্মক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। এই নব্য রাজনৈতিক শক্তি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে চালু করে এবং পরবর্তীতে যথাক্রমে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতির মাধ্যমে English medium School, English version School এবং English medium বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। শিক্ষানীতিতে পুন:পুন: পরিবর্তনের ফলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলো সূচীত হয় তা নিম্নরূপ:
ক) ইংরেজি-বাংলা দ্বি-ভাষিক সাক্ষরতা বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
খ) প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্বাক্ষরতা ইংরেজি কোর্সের প্রবর্তন
গ) ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড ও জিইডি ইত্যাদি বিদেশি কারিক্যুলামে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
ঘ) শিক্ষার সকল স্তরে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন

এই কালপর্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষার পক্ষে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি কেবলমাত্র একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনও ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। বাংলা ভাষার পক্ষে যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করে তা হলো— উচ্চ আদালত কর্তৃক বাংলাভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেনো দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর-প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ।

৪. ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শিক বিবর্তনের নেতিবাচক ফলাফল
বাঙ্গালী জাতি ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া বিভক্তির সময় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক, মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক ও ব্রিটিশ রাজের ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হিসাবে যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি— এই তিনটি ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলো। বাংলাদেশ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর আশা করা হয়েছিলো যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি সমূহ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু গত ৭৬ বছরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। এসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি উদ্ভবের পিছনে যে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে তা বিস্মৃত হয়েছে। তারা পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উর্দু ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক অবশেষ হিসাবে রেখে যাওয়া ইংরেজি ভাষিক ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ এসব রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। এর নিদর্শন দেখা যায় যখন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা লাভের পরও, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা না করে, ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়।

ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলে দেশে এখন একটি সর্বব্যাপী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা ও যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি সাক্ষরতা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা লাভের কারণে মানুষের মধ্যে ভাষিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। অধিকন্তু যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণ জনিত অনাসৃষ্টি বাংলিশ সৃষ্টি করছে। ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা ও বাংলা ভাষা— এই উভয়ই কলুষিত হচ্ছে। সমাজের একটি অংশের মানুষের বাঙ্গালী হিসাবে সামাজিকীকরণ ঘটছে না, পরিণামে তারা বাঙ্গালী সমাজে বিআত্তীকৃত রয়ে যাচ্ছে। বিআত্তীকৃত এই জনগোষ্ঠী থেকে সঞ্জাত নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য চিন্তা, মনন ও মূল্যবোধ ধারণ করছে। এই প্রজন্মটি না বাঙ্গালী না ইংরেজ হিসাবে গড়ে উঠছে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে যার সংখ্যা হতে পারে অর্ধকোটি। বস্তুত: জাতীয় বাজেট দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি শিক্ষা দ্বারা বাঙ্গালী জাতি বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া ও বাংলা ভাষা দূষণ প্রক্রিয়া— এই দ্বিবিধ প্রক্রিয়াধীনে নিপতিত হয়েছে। জ্ঞানীয় কর্মকাণ্ড ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধায়তি হচ্ছে বিধায় ইংরজি ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু বাংলা ভাষা অসমৃদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষার মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হচ্ছে।

৫. উপসংহার
বিভিন্ন কালপর্বে রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক গৃহীত ভাষিক কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট যে, দেশে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের ব্যাপক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে ইংরেজি ভাষার বিস্তৃতি ঘটেছে।
উল্লেখ্য যে, ইউনাস্কোর সহায়তায় পরিচালিত এক গবেষণায় পশ্চিম আফ্রিকার এক গবেষক Gnamba (১৯৮১: ২৩৫-২৪০) বিবৃত করেছেন যে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ মূলত সাম্রাজ্যবাদ নামক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি দেশের ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ না থাকলে, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ সে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে সাম্রাজ্যের ভাষাকে সে দেশের চিন্তা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও আদর্শ ইত্যাদির বাহক হিসাবে প্রচলনে সচেষ্ট হয়। কাজেই বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র তার ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় অনুবর্তী দেশ সমূহকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শোষণ করে থাকে।
বস্তুত: কোনও দেশের জনগোষ্ঠী ভাষাগতভাবে সংহত না হলে, সে জাতি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবলে নিপতিত হয় এবং সে দেশের ভাষা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন সূচীত হয়। ফলশ্রুতিতে সে দেশে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। কাজেই কোনও দেশকে ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তন জনিত রাজনৈতিক সমস্যা থেকে সুরক্ষা করতে জাতীয়তাবাদী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে অর্থে বাঙ্গালী জাতিকে জাতি হিসাবে সুসংহ থাকতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী
Ouedraogo, R. M. (2000). Language Planning and Language Policies in Some Selected West African Countries. Burkina Faso: UNESCO.
Chowdhury, R., Kabir, A.H. Language wars: English education policy and practice in Bangladesh. Multilingual Education. 4, 21 (2014).
এ প্রবন্ধটি ১৪ই আগস্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলোচনায় উপস্থাপিত বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে লিখিত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.