নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বঙ্গবিদ্যা ও রিডিং ক্লাব আয়োজিত গ্রন্থ আলোচনা সভায় \'ভাষা -সংসর্গ বিদ্যার নিরিখে বাংলা ভাষার সৃজন, উন্নয়ন ও অবনমন পরিক্রমা\'- শীর্ষক গ্রন্থ সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্যের সারমর্ম

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৩৩



১. ভূমিকা
ভাষা-সংসর্গ বিদ্যার নিরিখে বাংলা ভাষার সৃজন, উন্নয়ন ও অবনমন পরিক্রমা— শীর্ষক গ্রন্থে ভাষা-সংসর্গ তত্ত্বের নিরিখে যথাক্রমে বাংলা ভাষার সৃজন, উন্নয়ন ও অবনমন-এর পটভূমি ও প্রক্রিয়ার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। বাস্তবে বাংলা ভাষার সৃজন ও উন্নয়ন সম্পর্কে একটি ইতিহাস প্রচলিত রয়েছে। তবে বাংলা ভাষার অবনমন সম্পর্কে কোনও ইতিহাস নেই। কাজেই এই গ্রন্থে বাংলা ভাষার সৃজন ও উন্নয়ন সম্পর্কিত ইতিহাসটির পুনর্লিখন করা হয়েছে আর বাংলা ভাষার অবনমনের ইতিহাসটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে লেখা হয়েছে।
গ্রন্থটির পরিসর ও ব্যাপ্তি অনেক। শুধুমাত্র এর সারংশ সম্পর্কেও বলতে গেলেও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। সেজন্য আমি গ্রন্থাকার হিসাবে শুধু মাত্র এই গ্রন্থ রচনার অভিজ্ঞতাসমূহ বর্ণনা করবো।
ভাষা-সংসর্গ হলো একটি সমাজ-ভাষিক প্রক্রিয়া, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে পরস্পর সংজ্ঞাপনে ব্যপৃত হলে, একটি ভাষা অন্য একটি ভাষাকে প্রভাবিত করে। ফলশ্রুতিতে ভাষা-মিশ্রণ, নতুন ভাষা সৃজন ও অনুবর্তী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজেদের ভাষা পরিত্যাগ করে প্রভাবশালী ভাষায় অপবর্তন ঘটে।
ভাষা-সৃজন, উন্নয়ন ও অবনমন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে কতকগুলো সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের অনুঘটনে, যার অন্তরালে থাকে একটি বিশেষ পটভূমি।

২. ইন্দোআর্য ভাষার সৃজন
প্রথমেই আসা যাক, বাংলা ভাষার সৃজন সম্পর্কে। বাংলা ভাষা সৃজনের একটি ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাস রচনায় যাদের অবদান বেশী, তাঁরা হলেন ODBL গ্রন্থাকার খ্যাত সুনীতি কুমার চট্টোপধ্যায়, সুকুমার সেন ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই বাংলা ভাষা ইতিহাসকারদের রচিত বাংলা ভাষার ইতিহাসগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতার কারণ হলো এই যে, তাদের বাংলা ভাষার সৃজন সম্পর্কিত ইতিহাসে বাংলা ভাষা সৃজনের পটভূমি স্পষ্ট নয়।

২.১. পটভূমি
আলোচ্য এ গ্রন্থে বাংলা ভাষা সৃজনের পটভূমি নির্মাণে নিম্নের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে:
১) একটি সামাজিক-সংস্কৃতিক বলয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে বাঙ্গলাবর্ত।
২) বাঙ্গলাবর্তের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, অর্থ্যাৎ বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশে হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা সৃজনের শর্তগুলো তৈরি হচ্ছিলো, যা উত্তর-পূর্ব মূখী হয়ে ক্রমশ বাঙ্গলার দিকে অগ্রসরমান ছিলো।
৩)ভাষা-সংসর্গ শুরুর কারণ হিসাবে বাঙ্গলাবর্তে আর্যদের অভিবাসন এবং আর্য ও অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যকার পারস্পরিক সংজ্ঞাপন শুরুর কথা বলা হয়েছে। যার ফলে নতুন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের ঢেউ উত্থিত হয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ঢেউয়ের অন্যতম হলো ভক্তিবাদী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ। ভক্তিবাদী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আন্দোলন বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে না ছিলো ধর্মীয় এবং না ছিলো সাংস্কৃতিক।

২.২. প্রক্রিয়া
৫ম শতাব্দী থেকে আরব্ধ আর্যদের অভিবাসনের পূর্বে বাঙ্গলাবর্তে অস্ট্রিক (নিষাদ) ও তীব্বতীয়-বর্মী ও কিছু দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীর মানুষ জলাকীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিলো, যারা আর্যদের সাথে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে পরস্পর সংজ্ঞাপনে ব্যপৃত হলে, অনার্যগণ নতুনভাবে সৃষ্ট ইন্দোআর্য সমাজে আত্তীকৃত হতে থাকে এবং আর্য ও অনার্য— এই উভয় ভাষার মিশ্রণে নতুন ইন্দোআর্য মিশ্রভাষা সৃজনের নিরন্তর প্রক্রি্য়া শুরু হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং লৌকিক প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই ইন্দোআর্য মিশ্র ভাষা রূপমূলীয় ও বাক্যবৈন্যাসিক মানদণ্ডে ভিন্ন ভিন্ন ছিলো।
বাঙ্গলাবর্তে অনার্য নৃগোষ্ঠীসমূহ বৃহত্তর ইন্দোআর্য সমাজে ধাপে ধাপে শতশত বছর ধরে আত্তীকৃত হয়েছে, সেজন্য অঞ্চল ভেদে এবং কালপর্ব ভেদে এই ইন্দোআর্য ভাষার গঠন ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে।

৩. বাংলা ভাষার উন্নয়ন
বাংলা ভাষার উন্নয়ন হয়েছে, যখন এটিকে কোনওকিছু লিপিবদ্ধায়নের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাঙ্গলাবর্তে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অন্যান্য ইন্দোআর্য বুলিতে লিপিবদ্ধায়ন সংঘটিত হয়ে এসেছে। লিপিবদ্ধায়নের কার্যটি প্রাতিষ্ঠানিক, আধা-প্রাতিষ্ঠানিক ও লৌকিক পর্যায়ে সম্পাদিত হয়েছে। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় কর্মকাণ্ড এবং সেন শাসনামল পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধায়িত হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ইন্দোআর্য ভাষায় লিপিবদ্ধায়িত হয়েছে। কিন্তু লৌকিক ধর্মীয় সংস্কৃতি, যেমন- গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সূফী ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং আদি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু, আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠীর এজমালি সৃজন লৌকিক ইন্দোআর্য ভাষায় লিপিবদ্ধায়িত হয়েছে।
কিন্তু বাংলা ভাষার উন্নয়নের শুরুর কাল ধরা হয়েছে, যখন ইন্দোআর্য বুলি-শৃঙ্খলের থেকে একটি বুলি ভাষানীতি ও ভাষা-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় এর অবয়ব বা গঠনের উন্নয়ন ঘটে এবং সেটি বাংলা নাম ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে ইন্দোআর্য বুলি বাংলা অভিধা ধারণ করেছে, যখন বাঙ্গলা সালতানাত নামক রাষ্ট্র (১৩৩২-১৫৭৬) প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উল্লেখযোগ্য যে বাঙ্গলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঙ্গলাবর্ত যে সব সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছে, তার সবগুলোরই নাম ছিলো কোনওনা কোনও রাজবংশের নামে, যেমন- পাল শাসনামল ও সেন শাসনামল ইত্যাদি। কাজেই বাঙ্গলা সালতানাত অভিধা লাভের জন্য বাঙ্গলা সালতানাত নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ছিলো।

৪. বাংলা ভাষার অবনমন
ব্রিটিশ বেঙ্গল ও আসাম বিভক্তির ফলে, বাংলা ভাষা কয়েকটি ভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াধীনে নিপতিত হয়েছে এবং যুগপৎভাবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবলে নিপতিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষার শক্তিমত্তা কমে যাচ্ছে। বাঙ্গলাবর্তে যে সব সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় শর্ত ও প্রক্রিয়াধীনে আর্য ও অনার্য ভাষার মধ্যে ভাষা-সংসর্গ সংঘটিত হয়ে, আর্য ও অনার্য ভাষা— এই উভয় ভাষার অবনমন সূচীত হয়েছে, বর্তমানে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার ইংরেজি ভাষা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষার মধ্যে ভাষা-সংসর্গ সংঘটিত হচ্ছে। ফলাফল হিসাবে দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক দপ্তর পরিচালনায় বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেণী সংজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করছে। বাংলা ভাষায় বিষয়বস্ত লিপিবদ্ধায়নে বাংলা জ্ঞানীয় পরিভাষার পরিবর্তে ইংরেজি পরিভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। ইংরেজি-বাংলা মিশ্রণ থেকে সৃষ্ট অপসৃষ্টি বাংলিশ সৃজন অব্যাহত রয়েছে। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে, ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করাকে সম্মান জনক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

৫. সীমাবদ্ধতা
এই গ্রন্থে শব্দের বানানে ও বাক্য গঠনে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল রয়েছে। এ গুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে
শুধু মাত্র এর বিষয়বস্তুর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি।
গ্রন্থটি যদি বাংলা ভাষার ইতিহাসে নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করে অথবা প্রচলিত ইতিহাসটি পুনর্লিখনে সহায়ক হয়, তবেই কেবল আমার গ্রন্থ লেখার কাজটি সার্থকতা বহন করবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.