নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙ্গলাবর্তে বাংলা ভাষার মর্যাদাগত অবনমনের ধারা

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:০৪

বাঙ্গলাবর্তে সর্বত্রই চলছে বাংলা ভাষার মর্যাদাহানি
বাঙ্গলাবর্তের দেশ ও রাজ্যসমূহের ভাষা-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা এক কঠিন সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় নিপতিত রয়েছে। বাঙ্গলাবর্তের দেশ ও অঞ্চলসমূহে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে বুঝতে হলে সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইত্যাদি নিয়ামকের নিরিখে বিবেচনা করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে এসব নিয়ামকের মধ্যে সাংবিধানিক আইনগত নিয়ামক হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাংবিধানিক আইন কোনও ভাষার মর্যাদার প্রধান রক্ষাকবচ। সাংবিধানিক আইন দ্বারা কোনও ভাষার মর্যাদা স্বীকৃত না হলে, অন্যান্য নিয়ামকের সাহায্যে কোনও ভাষার মর্যাদা টিকিয়ে রাখা যায় না।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে উত্থিত রাজনৈতিক আন্দোলন-শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে বাঙ্গলাবর্তের দেশ ও রাজ্যসমূহের সংবিধান গৃহীত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান জাতীয় সংসদে ও ভারতীয় রাজ্যসমূহের সংবিধান ভারত প্রজাতন্ত্রের লোকসভায় গৃহীত হয়। অর্থ্যাৎ ভারত প্রজাতন্ত্রস্থ রাজ্যসমূহের বাংলা ভাষার মর্যাদা নিরূপণের কোনও আইনগত অধিকার নেই। বাংলাদেশ পূর্বপাকিস্তান হিসাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকার সময়, বাংলাদেশের বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারণে কোনও আইনগত অধিকার ছিলো না।

কিন্তু পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের ফলে বাংলাদেশ বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারণের আইনগত অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে এই ভাষাকে ইংরেজিসহ অন্য সব ভাষার উপর মর্যাদা দেওয়া হয়। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়। এই মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২ নং আইন)[৮ মার্চ, ১৯৮৭] আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন৷ কিন্তু এই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা হয়নি।

অন্যদিকে ভারতীয় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা বিধান সভা ও লোক সভা এই দুই স্তর বিশিষ্ট আইন সভায় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বভারতীয় লোকসভায় গৃহীত ভারত গণরাজ্যের সংবিধানে বাংলাসহ অন্যান্য রাজ্য ভাষাকে তৃতীয় পর্যায়ের ভাষা হিসাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ ভারত প্রজাতন্ত্রে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাকে বাংলা ভাষার চেয়ে অধিকতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। তবে বাঙ্গলাবর্তের সব রাজ্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমান নয়। কারণ রাজ্যসমূহের বিধান সভায় ভাষা-পরিস্থিতিভেদে বাংলা ভাষার মর্যাদা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষার প্রতিভূ রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় রয়েছে। এই দুই রাজ্যে রাজ্য ভাষা হলো বাংলা ভাষা। এই দুই রাজ্যে বাংলা ভাষার পক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাংলাপক্ষ নামক এক সংগঠন হিন্দি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার পক্ষে এক ব্যাপক সামাজিক আন্দলন গড়ে তোলে। কিন্তু আসাম ও ঝাড়খণ্ড রাজ্য বাংলা ভাষা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। রাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ত্বকেই অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে। কাছাড় অঞ্চলে বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আসামের রাজ্য সরকার বাংলা ভাষাকে রাজ্যের অতিরিক্ত ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে। কিন্তু অসমীয়াকে রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের ফলে, বাংলা ভাষা চতুর্থ স্থানের ভাষা হিসাবে মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটেছে। অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজ্য সরকার বাংলা ভাষাকে অতিরিক্ত দাপ্তরিক ভাষা নয় বরং দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারিত হয়েছে ইংরজি ও হিন্দি ভাষার পরে তৃতীয় স্থানের ভাষা হিসাবে। অন্যদিকে কেন্দ্রশাসিত আন্দামান-নিকোবর অঞ্চলে বাংলা ভাষা সবচেয়ে বেশী সংখ্যক অধিবাসী কর্তৃক কথিত হলেও, সেখানে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার কোনও স্বীকৃতি নেই। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

উপরের পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিকভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক বাস্তবাতায় বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান সম্ভব নয়, যে কারণে ভারতীয় রাজ্যসমূহে বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারিত হয়েছে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানের ভাষা হিসাবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ভারতীয় রাজ্যসমূহের সংবিধানে বাংলা ভাষার যে মর্যাদা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে টুকুও রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণে সংরক্ষিত হচ্ছে না। তার প্রধান কারণ এসব অঞ্চলের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণী ইংরেজি ভাষাকে তাঁদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছে। সেজন্য বাঙ্গলাবর্তের সব অঞ্চলেই এই শ্রেণী বাংলা ভাষার উপরে ইংরেজি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মর্যাদার ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে।

এতো সব রাজনৈতিক মতভেদের মধ্যেই, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্য বাংলা ভাষাকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর রয়েছে। তার প্রমাণ বাংলা ভাষাকে একযোগে জাতিসংঘের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। উল্লেখ্য যে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার আহবান জানানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর ও ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুন যথাক্রমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিধান সভা বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য বাংলাদেশের দাবীকে সমর্থন জানিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং এ রাজ্য দু’টি প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উপস্থাপনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের দু’টি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা কর্তৃক একযোগে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চালু করার দাবির বিষয়টি ইঙ্গিত করে যে রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্যেও বাংলা ভাষার প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী প্রধান রাজ্যগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে এই ঐতিহাসিক ঐকমত্যষটি আরো একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে যে বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় রাজ্যগুলো বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে হিন্দি ভাষার কাছে ছাড় দিতে রাজি নয়।


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.