নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্রিটিশ উপনিবেশত্তোর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মালয় ভাষা

১৪ ই মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্রিটিশ উপনিবেশত্তোর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মালয় ভাষাগত ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবসে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভাষার মর্যাদা, প্রায়োগিকতা ও গঠন নিয়ে ব্যপক আলোচনা হয়েছে। সে হিসেবে এই দিবস উপলক্ষে মালয় ভাষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীতা রয়েছে। কারণ মালয় ভাষা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। এটি মালয় জাতির জাতিসত্বা ও জাতীয়তার প্রতীক। তাছাড়া এটি মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা। অধিকন্তু এটি একই সাথে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই ও সিঙ্গাপুরের দাপ্তরিক ভাষা। এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা।

খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দতে বোর্ণিও দ্বীপে এই ভাষার আদি বুলির অস্তিত্ব ছিলো বলে কথিত রয়েছে। এর আদি বুলিটি আদি অবস্থান বোর্ণিও দ্বীপে হলেও, এর বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধন হয়েছে মালয় উপদ্বীপে। এই আদি ভাষাটি অনেকগুলো ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ামকের প্রক্রিয়াধীনে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই আদি বুলিটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হয়ে উঠেছে চতুর্দশ শতাব্দীতে মালয় উপদ্বীপের মালাক্কা সালতানাতের এর রাজনৈতিক পটভূমিতে। এই ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হয়ে উঠার পিছনে যে ভৌগলিক নিয়ামকটি প্রধান শর্ত হিসাবে কাজ করেছে, সেটি হলো মালাক্কা প্রণালীর ভৌগলিক অবস্থান। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রকে চীন, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও আরব অঞ্চলের মধ্যে নৌপথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে মালাক্কা প্রণালীর অবস্থান ছিলো কেন্দ্রীয়। এই কেন্দ্রীয় অবস্থানে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের বণিকদের মধ্যে পরস্পর বাণিজ্যিক বিনিময়ের সহায়ক ভাষা হিসাবে মালয় ভাষা ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সমস্ত অঞ্চলে এই ভাষা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে সময় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী বণিক শ্রেণি প্রাচ্যে ব্যবসা বিস্তৃত করতে থাকলে, লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসাবে এই ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। মালয় ভাষা বিস্তৃতির এই যে প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়, সেটি না থেমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হয়ে উঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোরকালে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়তে বাধ্য হলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অনেকগুলো প্রজাতন্ত্র গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রজাতন্ত্র গঠনে প্রয়োজন হয় ভাষার। কারণ ভাষা হলো প্রশাসন, শিক্ষা ও গণমাধ্যম পরিচালনার বাহন। কাজেই একটি এজমালি ভাষা ছাড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় আনা সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্র গঠনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা নাকি স্থানীয় ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হবে, সেই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ, তখন এই লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাটি আলোচনায় আসে। ইন্দোনেশিয়া ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করলে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব মালয় ভাষাকে প্রজাতন্ত্র গঠনে মালয় ভাষাকে জাতীয় ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে গ্রহণ করে। কিন্তু নাম দেয় ইন্দোনেশীয় ভাষা। এভাবে মালয় ভাষা প্রথমবারের একটি জাতির সংহতি রক্ষার নিয়ামক হিসাবে অবির্ভূত হয়।

উপনিবেশত্তোর ইন্দোনেশিয়ায় মালয় ভাষার ইন্দোনেশীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত লাভ মালয়েশিয়ায় এই ভাষার জাতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণযোগ্যতার পথ তৈরি করে। অত:পর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মালয়েশিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা হলে, স্বাধীন মালয়েশিয়া প্রজাতন্ত্র মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে মালয় ভাষাকে প্রবর্তন করা হয়। এভাবে মালয় ভাষা তার নিজ দেশে মর্যাদার ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে এই দেশে ব্যপক হারে চীনা ও দক্ষিণ ভারতীয় তামিল, মালয়ালাম ও কানাড়াদের বসতির সুযোগ দিলে, মালয়েশিয়ার ভাষিক জনমিতিতে অপ্রীতিকর পরিবর্তন ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের কল্যাণে স্বাধীন মালয়েশিয়া একটি বিষম ভাষা-পরিস্থিতি লাভ করে। এই ভাষা-পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পর মালয়েশিয়ার সরকারকে শিক্ষা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমের ভাষা হিসাবে চীনা ও তামিল ভাষাকে গ্রহণ করতে হয়। এই অবস্থায় মালয়েশিয়ায় একটি বহুভাষী পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা ভাষিক ভূদৃশ্য সদা দৃশ্যমান রয়েছে।

এভাবে মালয় জাতির হাজার বছরের অর্জন মালয় ভাষা থাকা সত্বেও, ঔপনিবেশিক অবশেষ হিসাবে প্রাপ্ত ভিনদেশীয় কয়েকটি ভাষার অবস্থিতির কারণে, একটি সমসত্ব মালয় জাতি গঠনে সমস্যা হচ্ছে। ভিন দেশীয় ভাষা জাতীয় সংহতির বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছে। তা সত্বেও মালয়েশিয়ায় জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, শিক্ষার ভাষা ও গণমাধ্যমের ভাষা হিসাবে মালয় ভাষার স্বীকৃতি মালয় জাতিকে সংসহত জাতি হিসাবে টিকে থাকার অনু্প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

গত দুই দশকে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশটিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদান রাখতে মনযোগী হয়েছে। একই দেশটি মালয় জাতির গৌরব ও ঐতিহ্যকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে। এই তৎপরতার অংশ হিসাবে দেশটি বিশ্বজুড়ে মালয় ভাষার প্রচার ও প্রসারে তৎপর রয়েছে। মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে ভাষা হলো সাংস্কৃতিক কূটনীতির অন্যতম উপাদান। উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশসমূহ, যেমন-যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানী, জাপান, চীন ও কোরিয়া যথাক্রমে ব্রিটিশ কাউন্সিল, এলিয়্যান্স ফ্রাসেস, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, জাপান ফাউণ্ডেশন, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট ও কোরীয়া ফাউণ্ডেশন নামক ইত্যাদি ভাষা ও সংস্কৃতি সম্প্রচার সহায়ক প্রতিষ্ঠানের গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে এসব দেশের ভাষা শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার নেতৃত্বের মধ্যে মালয় ভাষা সম্পর্কে অনুরূপ উপলব্ধি জন্মেছে। যে কারণে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিদেশে মালয় ভাষা প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। এ রকম উদ্যোগের অংশ হিসাবে মালয়েশিয়া সরকারের এ দু’টি মন্ত্রণালয় পেরাক প্রদেশস্থ সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায়কে এ কাজে পৃষ্টপোষকতা দান করছে। সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায় এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যে মালয় ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু করেছে। মালয়েশিয়া সরকারের পৃষ্টপোষকতায় সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায়ের বিদেশি ভাষা হিসাবে মালয় ভাষা শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াস কালক্রমে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এই মালয় ভাষা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার সাথে সাথে জনগণের পর্যায়ে ও লৌকিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। এভাবে বিদেশি ভাষা হিসাবে মালয় ভাষার প্রসার চালিয়ে গেলে সাংস্কৃতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়-ইন্দোনেশীয় ভাষার যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে, তাতে এই মালয় ভাষা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ মালয় ভাষাকে বিশ্বায়নের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।




মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.