নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশে ইসলামী ও নাস্তিক চিন্তাধারার মরণপণ দ্বন্দ্ব: একটি বিশ্লেষণ

০৪ ঠা জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৫:২৫


ভূমিকা
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে গত দেড় দশক ধরে যে সংঘাতটি সবচেয়ে তীব্র ও বিতর্কিত রূপ নিয়েছে, তা হলো ইসলামী চিন্তাবিদ ও নাস্তিক যুক্তিবাদীদের মধ্যকার আদর্শগত দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, সামাজিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে একটি সুগভীর দার্শনিক বিতর্ক। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের পাল্টা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয় এবং তার প্রভাব আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অনুভূত হচ্ছে।
দার্শনিক দ্বন্দ্বের মূল ভিত্তি
জ্ঞানতত্ত্বের সংঘাত
বাংলাদেশের ইসলামী চিন্তাবিদগণ জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রথমে কুরআন ও সুন্নাহকে স্থান দেন, অতঃপর যুক্তি ও অভিজ্ঞতাকে। তাদের দৃষ্টিতে, ওহী (দৈব প্রত্যাদেশ) হলো সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত জ্ঞানের উৎস, যা মানবীয় যুক্তির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে। শাহ আহমদ শফী, মামুনুল হক, আহমাদুল্লাহর মতো ব্যক্তিত্বরা এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করেন।
অপরদিকে, নাস্তিক যুক্তিবাদীরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও যুক্তিবোধকে জ্ঞানের একমাত্র বিশ্বস্ত উৎস মনে করেন। অভিজিৎ রায়, আসিফ মহিউদ্দীন, অনন্ত বিজয় দাশের মতো চিন্তাবিদরা মনে করেন যে, অতিপ্রাকৃত বা দৈব কোনো শক্তির অস্তিত্ব নেই এবং সকল প্রাকৃতিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভব।
সত্যের ধারণায় বিভাজন
ইসলামী দর্শনে পরম সত্য আল্লাহর কাছে নিহিত এবং মানুষ কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে সেই সত্যের সন্ধান পায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশনা প্রযোজ্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতা একটি ভ্রান্ত ধারণা।
যুক্তিবাদী নাস্তিকদের মতে, সত্য হলো আপেক্ষিক ও বিকশিত - বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধানের মাধ্যমে এটি প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হয়। তাদের দৃষ্টিতে, কোনো "চূড়ান্ত সত্য" নেই এবং সব ধরনের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অধিকার মানুষের রয়েছে।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাত্রা
রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের প্রশ্ন
ইসলামী চিন্তাবিদগণ বাংলাদেশকে একটি "ইসলামী রাষ্ট্র" হিসেবে দেখতে চান, যেখানে সংবিধানের ভিত্তি হবে কুরআন ও সুন্নাহ। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিতে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। তারা মনে করেন:
সংবিধানে "আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস" পুনঃস্থাপন
কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল
ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সর্বজনীনকরণ
নাস্তিক যুক্তিবাদীরা বাংলাদেশকে একটি "ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র" হিসেবে দেখতে চান, যেখানে রাষ্ট্র সকল ধর্মের প্রতি সমান দূরত্ব বজায় রাখবে। তাদের দাবি:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক সংবিধান
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রতিষ্ঠা
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার
ক্ষমতার কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই দ্বন্দ্বকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ মূলত ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাঝে মাঝে ইসলামী শক্তির সাথে সমঝোতা করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট স্পষ্টভাবে ইসলামী রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এই রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে যেমন রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থানকারী ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা, অন্যদিকে রয়েছেন ইসলামী আদর্শের পক্ষে সওয়াল করা আলেম-উলামা ও তাদের সমর্থকরা।
সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ
শিক্ষাব্যবস্থার দ্বৈততা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে তিনটি ধারা: সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা। এই বিভাজন সামাজিক দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করেছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার সমর্থকরা মনে করেন:
আধুনিক শিক্ষা মুসলিম যুবসমাজকে ধর্মবিমুখ করছে
ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণে মাদ্রাসা শিক্ষা অপরিহার্য
পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাতিয়ার
যুক্তিবাদী শিক্ষাবিদরা মনে করেন:
মাদ্রাসা শিক্ষা যুক্তিবোধ ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার বিকাশে বাধা
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূরীকরণে আধুনিক শিক্ষা প্রয়োজন
শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে
নারী অধিকার ও পারিবারিক কাঠামো
এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে নারীর ভূমিকা নিয়ে রয়েছে মৌলিক মতপার্থক্য।
ইসলামী চিন্তাবিদগণ মনে করেন:
ইসলাম নারীকে যথেষ্ট অধিকার দিয়েছে
পর্দা ও পারিবারিক মূল্যবোধ নারীর সম্মান রক্ষা করে
পশ্চিমা নারীবাদ মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতিকর
নাস্তিক যুক্তিবাদীরা মনে করেন:
ধর্মীয় বিধিনিষেধ নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন
পিতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে
মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই দ্বন্দ্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ব্লগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে নাস্তিক চিন্তাবিদরা তাদের মতামত ব্যাপকভাবে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছেন। একই সাথে ইসলামী চিন্তাবিদরাও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের বক্তব্য তুলে ধরছেন।
এই পরিস্থিতিতে তথ্যের বিশ্বস্ততা, সত্যতা যাচাই ও গুজব প্রতিরোধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের মাত্রা
ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে এই দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা।
ইসলামী সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি:
বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয় ইসলামভিত্তিক
হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে মুক্ত থেকে ইসলামী সংস্কৃতি গড়তে হবে
পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করতে হবে
আরবি-ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে
ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি:
বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সকল ধর্মের মানুষের অবদানে গড়া
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন সাঁইয়ের ধারা অনুসরণ করতে হবে
বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়ায় নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত সংস্কৃতি গড়তে হবে
উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান
পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় উৎসব নিয়েও এই দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইসলামী চিন্তাবিদরা কিছু উৎসবকে "অনৈসলামিক" বলে অভিহিত করেন, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদরা এগুলোকে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন।
হিংসার মাত্রা ও মানবিক সংকট
ব্লগার হত্যাকাণ্ড
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে একাধিক ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও লেখক নিহত হয়েছেন। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি নীল প্রমুখের হত্যাকাণ্ড এই সংঘাতের ভয়াবহ রূপ তুলে ধরে।
এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং তা বাংলাদেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনি ও বিচারিক জটিলতা
বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধন একটি জটিল বিষয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা (পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা) নিয়ে বিতর্ক এই সমস্যার প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিক মাত্রা ও প্রভাব
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের এই দ্বন্দ্ব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণ ও ধর্মনিরপেক্ষ উদারনীতির মধ্যে যে সংঘাত চলছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তারই একটি স্থানীয় প্রকাশ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থা নিয়মিত এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
মধ্যমপন্থী অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা
এই দ্বন্দ্বের সমাধানে প্রয়োজন মধ্যমপন্থী ও সহনশীল একটি অবস্থান, যা উভয় পক্ষের ন্যায্য দাবি ও উদ্বেগকে বিবেচনায় নেবে। এর জন্য প্রয়োজন:
সংলাপ ও আলোচনার পরিবেশ: দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।
আইনি কাঠামোর সংস্কার: মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে সমতা বিধানকারী আইন প্রণয়ন।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: সহনশীলতা, যুক্তিবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা সর্বস্তরে প্রদান।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাধান খুঁজতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে:
বহুত্ববাদের স্বীকৃতি: সমাজে বিভিন্ন মতামত ও বিশ্বাসের অধিকার স্বীকার
সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা: সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে সংখ্যালঘুর মতামতের স্থান
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা
উপসংহার
বাংলাদেশের ইসলামী ও নাস্তিক চিন্তাধারার মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা। এর শিকড় রয়েছে দার্শনিক মতবিরোধে, কিন্তু এর প্রকাশ ঘটেছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য, সামাজিক সংহতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই সংকট অপ্রতিরোধ্য নয়। যদি দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজ একসাথে কাজ করে, তাহলে একটি সহনশীল, বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, ধৈর্য ও সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অটুট বিশ্বাস। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাধানের উপর।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.