নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেওবন্দি আন্দোলন-পরবর্তী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক রূপান্তর: বাঙ্গালী জাতিসত্তার পরিবর্তনশীল ধারা ও বলিউড-টলিউড-ঢালিউডের কৃত্রিম অশ্লীল সাংস্কৃতিক প্রভাব

২৬ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ১০:৪০


আধ্যাত্মিক গান
ভূমিকা: সাংস্কৃতিক শূন্যতার পরিণাম
মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অমোঘ সত্য হলো—কোনো সমাজই আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি শূন্য থাকে না। যখন একটি জাতির শেকড়গত, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়, তখন সেই শূন্যতা অবধারিতভাবে পূরণ করে নেয় কৃত্রিম, বহিরাগত ও প্রায়শই ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক প্রভাব। বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে ১৮৬৬ সালে দেওবন্দি আন্দোলনের সূচনার পর ঠিক এই প্রক্রিয়াটিই পরিলক্ষিত হয়েছে।
দেওবন্দি ওলামা-মাশায়েখগণ সূফী-কেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংস্কৃতির বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন, যা কার্যত বাঙ্গালী জাতি, জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সাংস্কৃতিক শূন্যতার স্থান দখল করে নিয়েছে বলিউড, টলিউড ও ঢালিউডের বিনোদনকেন্দ্রিক, গ্ল্যামারপ্রধান সংস্কৃতি, যা ইতোমধ্যে কেন্দ্রাতিক শক্তিতে দেশের তরুণ সমাজের নীতি-নৈতিকতা ও মননশীলতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
________________________________________
প্রথম অধ্যায়: প্রাক-দেওবন্দি যুগের সমৃদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি (১২০০-১৮৬০ খ্রি.)
সূফী-কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন
বাঙ্গালাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিল সূফী পীর-আউলিয়াদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতির মাধ্যমে। এঁরা ইসলামকে কেবল শরিয়তি আইন-কানুন হিসেবে উপস্থাপন করেননি, বরং এক জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রধান সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ:
• আধ্যাত্মিক সমাবেশ ও সামা মাহফিল: আধ্যাত্মিক সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে আল্লাহপ্রেম জাগরণ
• মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান: নবীপ্রেমের সাংস্কৃতিক প্রকাশ
• আত্মজিজ্ঞাসামূলক গান, আধ্যাত্মিক গান ও মরমী গান: হৃদয়স্পর্শী আধ্যাত্মিক সংগীত
• পুঁথি সাহিত্য: ইসলামী কাহিনী ও উপদেশের শিল্পিত রূপ
• ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জারি গান: ধর্মীয় বিষয়ের লোকজ উপস্থাপনা
স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বয়
সূফী সাধকেরা ইসলামকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির মূলধারায় একীভূত করেছিলেন। লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ মনীষীরা ইসলামী তত্ত্বকে বাংলা গানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই ধারায়:
• ধর্ম হয়ে উঠেছিল সৃজনশীল
• আধ্যাত্মিকতা হয়েছিল জীবন্ত
• নৈতিকতা হয়েছিল আনন্দময়
• সংস্কৃতি হয়েছিল ধর্মপ্রাণ
________________________________________
দ্বিতীয় অধ্যায়: দেওবন্দি আন্দোলনের পরিবর্তনমুখী প্রভাব (১৮৬৬-বর্তমান)
সাংস্কৃতিক নীতিমালার পরিবর্তন
১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামী সংস্কৃতির বিষয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনা প্রবর্তিত হয়। দেওবন্দি ওলামাগণ ঘোষণা করলেন যে:
"বিদআত" হিসেবে বিবেচিত সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ:
• আধ্যাত্মিক সমাবেশ পালন = অনুৎসাহিত
• সুফী সংগীত = অনাকাঙ্ক্ষিত
• মিলাদ অনুষ্ঠান = প্রশ্নবিদ্ধ
• আত্মজিজ্ঞাসামূলক গান, আধ্যাত্মিক গান ও মরমী গান = নিরুৎসাহিত
• নারীদের সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ = সীমিত
বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিষয়ে মতামত
দেওবন্দি মতাদর্শ বাঙ্গালী মুসলিমের সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতিকে "স্থানীয় প্রভাবিত" আখ্যা দিয়ে সাংস্কৃতিক পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছে। ফলে:
• বাংলা ভাষার চর্চা হ্রাস পেয়েছে
• ফার্সি-উর্দু প্রাধান্য লাভ করেছে
• স্থানীয় ঐতিহ্য পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়েছে
• সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনায় পরিবর্তন এসেছে
ইবাদত-আমল নির্ভর ধর্মীয় চর্চার প্রাধান্য
দেওবন্দি ব্যাখ্যায় ইসলাম হয়ে উঠেছে আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি-বিরোধী ইবাদত-আমল কেন্দ্রিক:
• আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে কেবল ব্যক্তিগত ইবাদতে মনোযোগ
• সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবর্তে যান্ত্রিক আমলের উপর জোর
• সামষ্টিক আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত নফল-তাসবিহ
• সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তে শুধুমাত্র ফরজ ইবাদত
সাবলীল নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
এই ইবাদত-আমল নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বাঙ্গালী সমাজে একটি গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে:
আখলাক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা:
• সাংস্কৃতিক মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষার অভাব
• হৃদয়ে দাগ কাটার মতো আখলাক শিক্ষার পরিবর্তে কেবল নিয়ম-কানুন
• আত্মিক পরিশুদ্ধতার পরিবর্তে বাহ্যিক আমলের গুরুত্ব
• সামাজিক মেলামেশায় নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ হ্রাস
সাবলীল সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা:
• শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচারে নিরুৎসাহ
• সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে সংকোচ
• সৃজনশীল ধর্মীয় চর্চার পরিসর সংকোচন
• বাঙ্গালী ঐতিহ্যের সাথে ইসলামের সমন্বয়ে বাধা
________________________________________
তৃতীয় অধ্যায়: সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও নতুন প্রভাব (১৯৯০-বর্তমান)
প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম: শূন্যতা পূরণ
সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্র হলো—কোনো সমাজই সাংস্কৃতিক শূন্যতায় টিকে থাকতে পারে না। যখন দেওবন্দি আন্দোলন বাঙ্গালী মুসলিমের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনল, তখন সেই শূন্যতা পূরণের জন্য তরুণ সমাজ খুঁজতে লাগল বিকল্প সাংস্কৃতিক মাধ্যম।
বলিউড-টলিউড-ঢালিউডের প্রভাব বিস্তার ও বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকাশ
এই সাংস্কৃতিক শূন্যতার সুযোগে কেন্দ্রাতিক শক্তিতে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং গ্ল্যামার সর্বস্ব বস্তুবাদী চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছে:
বলিউডের প্রভাব ও বস্তুবাদী দর্শন:
• চাকচিক্যময় জীবনাদর্শ ও বৈষয়িক সাফল্যের গুরুত্ব
• ভোগবাদী মানসিকতার প্রচার ও আধ্যাত্মিকতার অবহেলা
• পারিবারিক মূল্যবোধে পরিবর্তন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা
• বিনোদনমূলক উপাদানের আধিক্য ও গভীর চিন্তার অভাব
টলিউডের অবদান ও আত্মদর্শন চর্চায় বাধা:
• হিন্দু সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রাধান্য ও মুসলিম আত্মপরিচয়ে বিভ্রান্তি
• ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আত্মদর্শন ও আধ্যাত্মিক উদাসীনতা
• বাঙ্গালী মুসলিম পরিচয়ে মিশ্রণ ও আত্মচিন্তায় বিক্ষেপ
ঢালিউডের বৈশিষ্ট্য ও গভীর চিন্তার অভাব:
• বলিউডের অনুসরণ ও আত্মনির্ভর দর্শনের অভাব
• মৌলিক সৃজনশীলতার সীমাবদ্ধতা ও গভীর আত্মচিন্তার দুর্বলতা
• নৈতিক নির্দেশনার অভাব ও আত্মদর্শন চর্চার প্রতিবন্ধকতা
• তরুণ প্রজন্মের পছন্দে বৈচিত্র্য কিন্তু আত্মিক শূন্যতা
আত্মদর্শন চর্চায় মূল সমস্যা
ইবাদত-আমল নির্ভর দেওবন্দি চিন্তা এবং গ্ল্যামার সর্বস্ব বিনোদন সংস্কৃতি—উভয়ই বাঙ্গালী মুসলিমের আত্মদর্শন চর্চায় বিশেষ বাধা সৃষ্টি করেছে:
আত্মদর্শনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ:
• সূফী ঐতিহ্যের মূল আত্মদর্শন চর্চা নিরুৎসাহিত
• বাহ্যিক আমল ও বিনোদনের মধ্যে আত্মিক চিন্তার সুযোগ সংকোচন
• গভীর আত্মনিরীক্ষণের পরিবর্তে পৃষ্ঠপোষ চর্চার প্রাধান্য
• মরমি সাধনা ও অন্তর্মুখী চিন্তার পরিবর্তে বাহিরমুখী কার্যক্রম
________________________________________
চতুর্থ অধ্যায়: তরুণ সমাজের উপর প্রভাব ও আত্মদর্শন চর্চার ক্ষতি
নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুপস্থিতিতে এবং ইবাদত-আমল নির্ভর শুষ্ক ধর্মচর্চার ফলে তরুণ প্রজন্ম বলিউড-টলিউড-ঢালিউডের মাধ্যমে যে মূল্যবোধ গ্রহণ করছে তা সাবলীল নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে:
আখলাক বিকাশে মূল সমস্যাসমূহ:
• হৃদয়গ্রাহী নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে বাহ্যিক নিয়ম-কানুনের আধিক্য
• সাংস্কৃতিক মাধ্যমে চরিত্র গঠনের সুযোগ সংকোচন
• আত্মিক পরিশুদ্ধতার পরিবর্তে যান্ত্রিক আমলের গুরুত্ব
• বন্ধুত্ব ও সামাজিক মেলামেশায় নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার অভাব
ব্যক্তিগত জীবনে বস্তুবাদী প্রভাব:
• আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে বৈষয়িক সাফল্যের প্রাধান্য
• প্রেম-ভালোবাসায় গভীর আত্মিক বন্ধনের পরিবর্তে পৃষ্ঠপোষ আকর্ষণ
• সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাকচিক্যময় দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মিক মূল্যবোধের অভাব
• পারিবারিক সম্পর্কে ভোগবাদী মানসিকতার প্রভাব
সামাজিক জীবনে আত্মদর্শন চর্চার অভাব:
• সম্মিলিত আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিনোদনের প্রাধান্য
• ধর্মীয় উৎসবে গভীর আত্মচিন্তার পরিবর্তে আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব হ্রাস
• আত্মনিরীক্ষণ ও মরমি চিন্তার পরিবর্তে বাহিরমুখী কার্যক্রমের আধিক্য
• জাতীয় পরিচয়ে আত্মদর্শনমূলক উপাদানের অভাব
আত্মদর্শন চর্চার মূল ক্ষতিসমূহ
গ্ল্যামার সর্বস্ব বস্তুবাদী চিন্তাধারার ফলে তরুণেরা যে আত্মদর্শন চর্চার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে:
আধ্যাত্মিক চেতনায় ক্ষতি:
• অন্তর্মুখী চিন্তার পরিবর্তে বাহিরমুখী আকর্ষণের প্রাধান্য
• আত্মশুদ্ধি ও আত্মউন্নতির পরিবর্তে বাহ্যিক সাফল্যের গুরুত্ব
• গভীর জীবনদর্শনের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক আনন্দের সন্ধান
• সূফী-সাধকদের আত্মদর্শন ঐতিহ্যের সাথে বিচ্ছিন্নতা
মানসিক ও আত্মিক সমস্যা:
• আত্মিক অপূর্ণতা ও গভীর জীবনের অর্থ অনুসন্ধানে ব্যর্থতা
• জীবনের নতুন উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে দিশাহীনতা
• নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও আত্মদর্শনের অভাবে সিদ্ধান্তহীনতা
• সাংস্কৃতিক পরিচয়ে বৈচিত্র্য কিন্তু গভীর আত্মিক শেকড়ের অভাব
________________________________________
পঞ্চম অধ্যায়: বাঙ্গালী জাতিসত্তার পরিবর্তনশীল চ্যালেঞ্জ
জাতীয়তাবাদের ভিত্তি: সাংস্কৃতিক পরিচয়
একটি জাতির পরিচয় গড়ে ওঠে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে। বাঙ্গালী মুসলিমের ক্ষেত্রে এই পরিচয়ের মূল উপাদান ছিল:
• ইসলামী আধ্যাত্মিকতা + বাঙ্গালী সংস্কৃতির সমন্বয়
• সূফী দর্শন + লোকজ শিল্পকলার মিশ্রণ
• ধর্মীয় উৎসব + আঞ্চলিক ঐতিহ্যের একীকরণ
পরিচয়ের বর্তমান চ্যালেঞ্জ
দেওবন্দি আন্দোলনের ফলে বাঙ্গালী মুসলিম আজ সাংস্কৃতিক নতুন পথ অনুসন্ধানে নিয়োজিত:
বিবেচনার ক্ষেত্রসমূহ:
• ধর্মীয় পরিচয় বনাম জাতিগত পরিচয়
• আরবি-উর্দু প্রভাব বনাম বাংলা ঐতিহ্য
• ঐতিহ্য সংরক্ষণ বনাম আধুনিকায়ন
• বিশ্বায়ন বনাম স্থানীয়করণ
________________________________________
ষষ্ঠ অধ্যায়: সমাধানের দিকনির্দেশনা ও আত্মদর্শন চর্চার পুনরুজ্জীবন
গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপসমূহ
১. ধর্মীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ও সাবলীল আখলাক বিকাশ:
• আধ্যাত্মিক সমাবেশ, মিলাদ, আত্মজিজ্ঞাসামূলক গান, আধ্যাত্মিক গান ও মরমী গানের প্রাতিষ্ঠানিক উৎসাহ প্রদান ও হৃদয়গ্রাহী নৈতিক শিক্ষা
• সূফী সংগীত ও সাহিত্যের প্রচার বৃদ্ধি এবং আত্মদর্শন চর্চার সুযোগ সৃষ্টি
• ধর্মীয় উৎসবে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি সংযোজন ও আত্মিক উন্নতির পরিবেশ
• বাঙ্গালী ঐতিহ্যের সাথে ইসলামের সমন্বয়ে সাবলীল নীতি-নৈতিকতার চর্চা
২. শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়ন ও আত্মদর্শন অন্তর্ভুক্তি:
• পাঠ্যসূচিতে বাংলার সূফী ঐতিহ্য ও আত্মদর্শন চর্চার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তি
• মাদ্রাসায় "ইসলামিক আর্ট অ্যান্ড কালচার" বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও মরমি শিক্ষা
• ধর্মীয় শিক্ষায় সাংস্কৃতিক উপাদান সংযোজন ও গভীর আত্মচিন্তার সুযোগ
• বাহ্যিক আমলের পাশাপাশি অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা প্রদান
৩. মিডিয়া নীতিমালার উন্নয়ন ও বস্তুবাদী চিন্তার বিকল্প:
• বলিউড-টলিউড-ঢালিউডে নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রয়োগ ও আত্মদর্শনমূলক বিষয়বস্তু
• ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের টেলিভিশন প্রচার বৃদ্ধি ও গভীর জীবনদর্শনের তুলে ধরা
• সূফী জীবনীমূলক চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজ নির্মাণ যা আত্মদর্শন চর্চায় উৎসাহ দেয়
• গ্ল্যামার সর্বস্ব বিনোদনের বিকল্প হিসেবে আধ্যাত্মিক বিনোদনের প্রচার
৪. সামাজিক আন্দোলন ও আত্মদর্শন চর্চার পরিবেশ গড়ে তোলা:
• তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনা বৃদ্ধি ও আত্মনিরীক্ষণের সুযোগ
• সুফী-সাধকদের জীবনী ও শিক্ষা প্রচার এবং তাদের আত্মদর্শন পদ্ধতির অনুসরণ
• আন্তঃধর্মীয় সাংস্কৃতিক সংলাপ উৎসাহিতকরণ ও গভীর আধ্যাত্মিক আলোচনা
• মরমি সাধনা ও অন্তর্মুখী চিন্তার জন্য নিয়মিত আলোচনা সভা ও আত্মদর্শন ক্লাব
কালানুক্রমিক তুলনামূলক চিত্র: আত্মদর্শন চর্চার বিবর্তন
কালপর্ব ধর্মীয়-সাংস্কৃতির প্রকৃতি আত্মদর্শন চর্চা নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশ
১২০০–১৮৬০ সূফী-লোকজ সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি আধ্যাত্মিক সমাবেশ, মরমি গান, কবিগান, আধ্যাত্মিক সাহিত্য সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী
১৮৬৬–১৯৪৭ দেওবন্দের ইবাদত-আমল কেন্দ্রিক রূপান্তর সুফীধারার আত্মদর্শন নিরুৎসাহিত, যান্ত্রিক আমলের প্রাধান্য বাহ্যিক নিয়ম-কানুন প্রধান
১৯৪৭–১৯৭১ পাকিস্তানি উর্দু-কেন্দ্রিক নীতি বাঙ্গালী আত্মদর্শন ঐতিহ্যের অবমূল্যায়ন সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা
১৯৭১–১৯৯০ ধর্মীয় সংস্কৃতির সংকোচন আত্মদর্শন চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক অভাব নৈতিক দিকনির্দেশনায় শূন্যতা
১৯৯০–বর্তমান বলিউড-টলিউড-ঢালিউড প্রভাব ও বস্তুবাদী চিন্তাধারা আত্মদর্শনের পরিবর্তে বাহিরমুখী বিনোদন গ্ল্যামার সর্বস্ব, আত্মিক শূন্যতা
বিশেষ ব্যবস্থা: বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকল্প হিসেবে আত্মদর্শন
আত্মদর্শন চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা:
• স্কুল-কলেজে আত্মদর্শন ও মেডিটেশন ক্লাস চালু
• মসজিদভিত্তিক আত্মিক উন্নতির কোর্স ও আলোচনা সভা
• যুব সমাজের জন্য সূফী দর্শন ও জীবনযাত্রার প্রশিক্ষণ
• পারিবারিক পর্যায়ে আত্মদর্শন চর্চার উৎসাহ প্রদান
________________________________________
উপসংহার: বাঙ্গালী জাতির সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও আত্মদর্শনে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান
বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ আজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে দেওবন্দি আন্দোলনের ইবাদত-আমল নির্ভর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে বলিউড-টলিউড-ঢালিউডের গ্ল্যামার সর্বস্ব বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিস্তার—এই দুই প্রভাবের মধ্যে বাঙ্গালী জাতিসত্তা আজ সাবলীল নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
সমস্যার মূল কেন্দ্র: আত্মদর্শন চর্চার বিলুপ্তি
বাঙ্গালাবর্তের ইসলাম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চা বিরোধী ইবাদত-আমল নির্ভর দেওবন্দী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় দেশের মানুষের সাবলীল নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। এই আন্দোলন বাঙ্গালার সাবলীল সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে, যার প্রতিক্রিয়ায় দেশে গ্ল্যামার সর্বস্ব বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে এবং আত্মদর্শন চর্চা ব্যাহত হয়েছে।
মূল সমস্যাসমূহ:
• সূফী ঐতিহ্যের আত্মদর্শন পদ্ধতি নিরুৎসাহিত হওয়া
• হৃদয়গ্রাহী নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে যান্ত্রিক আমলের প্রাধান্য
• সাংস্কৃতিক মাধ্যমে আখলাক বিকাশের সুযোগ সংকোচন
• বস্তুবাদী বিনোদন সংস্কৃতির দ্বারা আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণ
বিকল্প পথের সন্ধান: সমন্বয়ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি
মনে রাখতে হবে—কোনো সমাজই আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি শূন্য থাকে না। যদি আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আত্মদর্শন চর্চাকে পুনর্বিবেচনা না করি, তাহলে এই শূন্যতা পূরণ করবে বিকল্প বিনোদন সংস্কৃতি ও বস্তুবাদী জীবনদর্শন, যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের আত্মদর্শন, নৈতিকতা ও আত্মপরিচয়কে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে পরিচালিত করবে।
প্রয়োজনীয় সমন্বয়:
• ইবাদত-আমলের সাথে সাংস্কৃতিক আত্মদর্শন চর্চার সমন্বয়
• বাহ্যিক ধর্মপালনের সাথে অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ
• আধুনিক শিক্ষার সাথে ঐতিহ্যবাহী আত্মদর্শন পদ্ধতির একীকরণ
• বিশ্বমানের বিনোদনের সাথে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সংযোজন
আহ্বান: আত্মদর্শনে প্রত্যাবর্তন
অতএব, আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক উৎসাহ প্রদান, আত্মদর্শন চর্চার পুনর্জাগরণ ও সাবলীল আখলাক বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি আজ শুধু একটি সাংস্কৃতিক প্রয়োজন নয়, বরং বাঙ্গালী জাতিসত্তা, মননশীলতা ও আধ্যাত্মিকতার বিকাশের একটি অপরিহার্য পথ। এ ছাড়া বাঙ্গালী মুসলিমের জাতীয় পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আত্মদর্শন চর্চা ও আধ্যাত্মিক গভীরতা রক্ষা করার বিকল্প পন্থা অন্বেষণ করতে হবে।
আজকের প্রয়োজন:
• বস্তুবাদী চিন্তাধারার বিকল্প হিসেবে আত্মদর্শনমূলক শিক্ষা
• গ্ল্যামার সর্বস্ব বিনোদনের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক আনন্দের সন্ধান
• যান্ত্রিক আমলের পাশাপাশি হৃদয়গ্রাহী আখলাক চর্চা
• ব্যক্তিগত ইবাদতের সাথে সামষ্টিক সাংস্কৃতিক আত্মদর্শনের সমন্বয়
সময় এসেছে নতুন দিগন্তের সন্ধানের। সময় এসেছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মদর্শন ঐতিহ্যকে পুনর্মূল্যায়ন করার। সময় এসেছে বাঙ্গালী মুসলিমের সাবলীল সংস্কৃতি ও আত্মিক গভীরতাকে পুনরুদ্ধার করার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের এই আত্মদর্শনমুখী প্রচেষ্টার জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে।
________________________________________
"আত্মদর্শন হারিয়ে যে জাতি এগোয়, সে জাতি আসলে পথ হারিয়ে ভ্রমণ করে মাত্র। সাবলীল সংস্কৃতি ও আত্মিক গভীরতাই জাতির প্রকৃত শক্তি।"

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.