নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিবেকের দ্বন্দ্ব ঘটে এমন আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত নয়

২৭ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ১০:৫৯

একজন নৈতিক শিল্পীর প্রতিকৃতি
১. ভূমিকা
সংস্কৃতি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আমাদের পরিচয়, মূল্যবোধ এবং জীবনদর্শনকে রূপ দেয়। কিন্তু যখন কোনো আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চা ব্যক্তির অন্তরে অপরাধবোধ কিংবা পাপবোধের জন্ম দেয়, তখন একটি গভীর প্রশ্ন উঠে আসে: এমন সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা কী এবং রাষ্ট্রের তা সমর্থন করা উচিত কিনা?
বাঙ্গালাবর্তের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, বহু আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চাকারী জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজেদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য অন্য পথে অগ্রসর হন। এটি দেখায় যে রাষ্ট্র-সমর্থিত সংস্কৃতির কিছু ধারা ব্যক্তিগত বিবেকের সঙ্গে গভীর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে।
________________________________________
২. ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা ও আত্মদর্শনের ভূমিকা
যারা ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা করেন তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চাকে অনৈতিক মনে করার প্রবণতা দেখা যায় না। বরং তারা গানের মাধ্যমে আত্মদর্শন লাভ করেন এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধন করেন। সূফী সংগীত, মরমী গান এবং আধ্যাত্মিক সাহিত্য ব্যক্তি-মানুষের অন্তর্জগতকে সমৃদ্ধ করে, নীতিনৈতিকতা জাগিয়ে তোলে এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশে সহায়তা করে।
২.১ আত্মদর্শনমূলক সংগীতের উজ্জ্বল উদাহরণ
বাউল মাতা আলেয়া বেগম এবং ফকির শিতালং শাহ বাঙ্গালাবর্তের আত্মদর্শনমূলক সংগীত ঐতিহ্যের দুই মহীরুহ।
• বাউল মাতা আলেয়া বেগম তার দীর্ঘ ৫০ বছরের সংগীত জীবনে ১ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। "তুমি দয়ার সাগর আল্লাহ পরোয়ার" এর মতো বন্দনা গান এবং কোক স্টুডিও বাঙ্গলার ‘কথা কইয়ো না’ তাকে আধ্যাত্মিক সংগীতের সমকালীন প্রতীকে পরিণত করেছে।
• ফকির শিতালং শাহ (১৮০৬–১৮৯৯) সিলেটের একজন মরমী সাধক-কবি যিনি সুফি দর্শনকে লোকসংগীতে রূপ দিয়েছেন। তার "ভবে ঠগা খাইলাম রে" গানের মতো রচনায় মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা, পরকালের প্রস্তুতি এবং আল্লাহপ্রেম প্রতিফলিত হয়েছে।
এই দুই শিল্পীর গানের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আত্মজিজ্ঞাসা এবং নৈতিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়।
________________________________________
৩. গণমাধ্যম নির্ভর তারকা সংস্কৃতির সমস্যা
রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি বলয়ে দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণির মহাতারকা আধিপত্য বিস্তার করেছে। ব্রিটিশ পূর্ব যুগ থেকে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের আগমন পর্যন্ত প্রতি দশকে শতাধিক তারকার আবির্ভাব ঘটে, যাদের জীবনযাপন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
• তারা পুঁজিবাদী ও কতিপয়তন্ত্রী শাসনের সহযোগিতায় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশীয় সংস্কৃতির ধারা বিনষ্ট করছে।
• তাদের স্বপ্ন পশ্চিমা দেশে আবাস গড়া, যা দেশের প্রতি তাদের আত্মিক সংযোগহীনতাকে প্রমাণ করে।
• যুবসমাজ তাদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে আসল আত্মদর্শনমূলক সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এমন তারকা-নির্ভর সংস্কৃতি আত্মিক পরিশুদ্ধি নয়, বরং ভোগবাদী জীবনধারার প্রসার ঘটাচ্ছে।
________________________________________
৪. আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চা ও বিবেকের সংঘাত
মানুষের জীবনে মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়। যৌবনে যা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল, বার্ধক্যে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বাঙ্গালাবর্তে বহু শিল্পী জীবনের শেষ দিকে এসে ধর্মীয় চর্চায় মনোযোগী হন এবং অতীত কাজ নিয়ে অনুশোচনায় ভোগেন।
কারণসমূহ:
• মৃত্যুচেতনার প্রভাব: পরকালের চিন্তা মানুষকে অতীত মূল্যায়নে তাড়িত করে।
• সামাজিক ও পারিবারিক চাপ: পারিপার্শ্বিকতার কারণে আত্মসমালোচনা বেড়ে যায়।
• আধ্যাত্মিক উপলব্ধি: ধর্মীয় জাগরণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়।
এটি প্রমাণ করে, এমন কিছু সংস্কৃতি চর্চা রয়েছে যা শেষ পর্যন্ত বিবেকের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালিয়ে যাওয়া প্রশ্নবিদ্ধ।
________________________________________
৫. রাষ্ট্রের ভূমিকা ও নীতিগত দায়িত্ব
একটি আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো:
1. সকল নাগরিকের আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চার অধিকার রক্ষা করা
2. ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন
3. সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখা
কিন্তু যে সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত বিবেকের দ্বন্দ্ব, অপরাধবোধ এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, রাষ্ট্রের তা পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত নয়।
রাষ্ট্রের উচিত এমন সংস্কৃতিকে সমর্থন করা যা:
• আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি ঘটায়
• সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে
• ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে
________________________________________
৬. সংস্কৃতির মূল্যায়নের মানদণ্ড
একটি আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতির মূল্যায়নে চারটি মানদণ্ড জরুরি:
1. শিল্পগুণ ও সৌন্দর্য – এটি কি নান্দনিকভাবে গ্রহণযোগ্য?
2. সামাজিক প্রভাব – এটি গঠনমূলক নাকি ধ্বংসাত্মক?
3. সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ – এটি কি ঐতিহ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে?
4. মানবিক মূল্যবোধ – এটি কি নৈতিকতা ও মানবিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
________________________________________
৭. আত্মদর্শন চর্চার পুনরুজ্জীবন: করণীয়
৭.১ আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির প্রসার
• বাউল, সুফি ও মরমী গানের প্রাতিষ্ঠানিক উৎসাহ প্রদান
• আত্মজিজ্ঞাসামূলক সাহিত্য ও সংগীতকে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা
৭.২ ঐতিহ্যগত সমন্বয়
• ইসলামী সংস্কৃতির সাথে বাঙ্গালী ঐতিহ্যের সৃজনশীল মেলবন্ধন
• ধর্মীয় উৎসব ও আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতির সমন্বিত কর্মসূচি
________________________________________
৮. উপসংহার
আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চা এবং ব্যক্তিগত বিবেকের দ্বন্দ্ব একটি গভীর সামাজিক বাস্তবতা। যে সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত অপরাধবোধের জন্ম দেয়, আত্মিক শান্তি বিনষ্ট করে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়, তার পৃষ্ঠপোষকতা রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত নয়।
রাষ্ট্রের উচিত সেই সংস্কৃতিকে সমর্থন করা যা মানুষের অন্তর্জগতকে শুদ্ধ করে, সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করে এবং নৈতিক উন্নতি ঘটায়।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, বিবেকের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এমন সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত নয় — কারণ রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হলো এমন একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যা মানুষের আত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.